তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র, ফলে বাড়ির দুর্গাপূজায় রাজা রামমোহন রায়কে নিমন্ত্রণ করার গুরুদায়িত্ব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরই ন্যস্ত হয়েছিল। দ্বারকানাথ বিলক্ষণ জানতেন যে, রামমোহন প্রতিমাপূজা ও পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধী। তাই নিজে যেতে সাহস করেননি। তবু আরাধ্য মানুষটিকে হয়তো সম্মানার্থেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। পিতার আদেশে মহর্ষি রামমোহন রায়ের সামনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, “রামমণি ঠাকুরের বাড়ীতে আপনার দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ।” রামমণি ঠাকুর ছিলেন দ্বারকানাথের পিতা। নিমন্ত্রণবার্তা শুনে স্পষ্টতই কিছুটা অপ্রস্তুত ও হতভম্ব রামমোহন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?”
রামমোহনের চেয়ে দ্বারকানাথ বয়সে প্রায় বাইশ বছরের ছোট ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের দর্পনারায়ণের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুরের মাধ্যমে তাঁদের আলাপের সূত্রপাত। রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাধারা ও আদর্শে ভীষণ ভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন দ্বারকানাথ। যদিও এই প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি ছিল পারস্পরিক। দ্বারকানাথের জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের পুত্র) বলেছিলেন, “লৌহ ও চুম্বক যেমন পরস্পরকে আকর্ষণ করিয়া থাকে, সেইরূপ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বৎসরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রৌঢ় এবং কুড়ি-বাইশ বৎসরের যুবক পরস্পরকে আকর্ষণ করিয়াছিলেন।”
দ্বারকানাথ পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী পূজার বেশ সুখ্যাতি ছিল। কিন্তু রামমোহনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর ১৮২১ সাল নাগাদ উইলিয়ম অ্যাডাম সাহেবের একেশ্বরবাদী সমিতির অধিবেশনে প্রত্যেক রবিবার দ্বারকানাথের যাতায়াত শুরু হয়। রামমোহন ও অ্যাডাম সাহেবের একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য দ্বারকানাথ মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় ধর্ম বা তত্ত্বের প্রতি আকর্ষণের চেয়েও রামমোহনের প্রভাব তাঁর উপর অনেক বেশি কাজ করেছিল বলে মনে করা হয়।
তবে রামমোহন-দ্বারকানাথের এই একেশ্বরবাদী ধারণার একটা স্বদেশি রূপ দেওয়ার ভাবনা মাথায় এসেছিল। এই ভাবনার ফলশ্রুতি হিসেবেই ১৮২৮ সালের ২০ অগস্ট চিৎপুরে কমললোচন বসুর বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এবং তখন থেকেই পারিবারিক পূজা থেকে দ্বারকানাথের সরে আসার চেষ্টার শুরু। এরই পাশাপাশি ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা, আদব-কায়দা, আহার-বিহার, ঠাটবাট— সমস্ত কিছুতে একটা টক্কর দেওয়ার প্রবণতা কাজ করেছিল। তখন থেকেই যে মানুষ এক সময় রোজ লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার পুজো করতেন, করতেন হোম-তর্পণ-জপ-যজ্ঞ, তিনিই আর ঠাকুরের কাছে ঘেঁষতেন না। তার পরিবর্তে নিত্যপুজো আরতি যাগযজ্ঞের জন্য পৃথক পৃথক আঠেরো জন পুরোহিত নিয়োগ করা হল। তবে পারিবারিক পুজোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ কমে গেলেও দ্বারকানাথ এই পূজা-অর্চনার কখনও বিরোধিতা করেননি বা তুলে দেননি। জানা যায়, দ্বারকানাথ বিদেশেও নিয়মিত গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটবেলায় পিতার মতোই নিষ্ঠাবান ছিলেন। পিতামহীর জন্য যেমন ফুলের মালা গেঁথে দিতেন, তেমনই দিদিমা অলকাসুন্দরীর (রামমণি ঠাকুরের দাদা রামলোচনের স্ত্রী। অলকাসুন্দরী ছিলেন রামমণি ঠাকুরের স্ত্রী মেনকার বড়বোন। রামলোচন-অলকাসুন্দরী পরে দ্বারকানাথকে দত্তক দেন) সঙ্গেই স্নানের পর ছাদে উঠে নিত্য সূর্যপ্রণাম করতেন। আবার বিদ্যালয় যাবার পথে ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালিকাদেবীকে প্রণাম করতেও ভুলতেন না। বাড়িতে সরস্বতী পুজোয় এমন জাঁকজমক ও সমারোহ করেছিলেন যে শহরে ফুল আর সন্দেশ অপ্রতুল হয়ে উঠেছিল। এমনকি বিশাল প্রতিমাকে বিসর্জনের সময় বাড়ির দুয়ার দিয়ে বার করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল।
ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোয় বিসর্জনের দিন পারিবারিক রীতিনীতির কিছু শিথিলতা উপভোগের সুযোগ পাওয়া যেত। বাড়ির মেয়েরা বছরের সেই এক দিনই তেতলার ছাদে উঠে প্রতিমা দেখার স্বাধীনতা পেত। ছেলেরা নতুন জামাকাপড় পরে প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে বিসর্জনে যেত। বাইরের লোকেদের তো বটেই, এমনকি খাস পুরাতন ভৃত্যরা ছাড়া বাড়ির ভিতরে অন্য কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যস্থতায় এই কড়াকড়ি একটু শিথিল হয়।
যথেষ্ট কম বয়সেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃদেব ও রামমোহনের আদর্শে সরাসরি প্রভাবিত হন। বাড়িতে ভাইদের সঙ্গে নিয়েই পৌত্তলিকতা বিরোধী দল গঠন করেন। দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করেন, “কোন প্রতিমাকে পূজা করিব না, কোন প্রতিমাকে প্রণাম করিব না, কোন পৌত্তলিক পূজায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিব না।” মাত্র বাইশ বছর বয়সে জোড়াসাঁকোতে যখন মহা সমারোহে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলছে, দেবেন্দ্রনাথ তখন তাঁর অনুগামীদের নিয়ে বাড়ির অন্য প্রান্তে পুকুরপাড়ে একটি ছোট কুঠুরি চুনকাম ও পরিষ্কার করে, প্রাতঃস্নানের পর কঠোপনিষদের শ্লোক বলছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। বীজ বপন হতে চলেছে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’-র।
এই প্রভাব থেকে দেবেন্দ্রনাথ বেরিয়ে আসতে পারেননি, সচেতন ভাবে চানওনি। তাই সিমলা পাহাড় থেকে বেড়িয়ে যে দিন বাড়ি ফিরলেন, দেখলেন সে দিন জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জন। বাড়িতে প্রবেশ না করে ব্রাহ্ম সমাজে গিয়ে বসে রইলেন। বাড়িতে সংবাদটা পৌঁছনোমাত্র সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার পরই দেবেন্দ্রনাথ বাড়িতে প্রবেশ করেন। তার পর তিনি ভাইদের অনুরোধ করলেন জগদ্ধাত্রী পুজো তুলে দিতে। তবে দুর্গাপুজো চলতে থাকল।
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ যতটা সরাসরি, তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মিক। এ ক্ষেত্রে কবির জীবনে মহর্ষির প্রভাব অনেকটাই প্রকট। তবে ব্রাহ্মধর্ম থেকে ক্রমশ উত্তীর্ণ হয়ে কবি বিশ্বপ্রেমের মন্ত্রেই দীক্ষিত হয়েছেন। শরতের পরিবেশ সব সময়েই কবিকে উন্মনা করে তুলত। সমস্ত চেতনায় অনুভব করতেন প্রকৃতির মনমাতানো খেয়ালি চরিত্রকে। শান্তিনিকেতন থেকে এ রকমই এক শরতে প্রিয় বিবিকে (ইন্দিরা দেবী, কবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কন্যা) প্রৌঢ় কবি লিখছেন, “এবার শরতে বর্ষায় বেশ প্রণয় চলচে। কাল ছিল আকাশ নির্মল, জ্যোৎস্না নিরাবিল, দিগন্ত বাষ্পবিরল; আজ সকাল থেকে প্রথমে মেঘের উঁকিঝুঁকি, তারপরে তার আনাগোনা, তার পরে এই খানিকক্ষণ হল সমস্ত আকাশ অধিকার করে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি। আমি নিজে আছি নিশ্চল, বসে বসে বাইরের আকাশে ঋতুদূতগুলির চলাফেরা দেখচি। বেশ লাগচে।”
এ রকমই এক প্রাক্পূজা পর্বে কবি সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথের দু’ধারে দেখলেন দুর্গাপ্রতিমা তৈরি হচ্ছে। শারদীয়ার প্রবল প্রস্তুতি এবং আপাত এক চাঞ্চল্যের আঁচ কবির হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল। বুঝলেন প্রতিমার আড়ালে এ-কেবল পুতুল খেলায় মেতে ওঠা নয়, বুঝলেন হৃদয়ের প্রবল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের ঢেউ আপামর মানুষকে গভীর ভাবে স্পর্শ না করলে এভাবে মেতে ওঠা যায় না। একটা জাতির এই উচ্ছ্বাসের অন্দরে কোথাও যেন আত্মিক যোগ, সঞ্চয় থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “দেশের ছেলে বুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের মতো ছেলে-মানুষ হয়ে উঠে, সবাই মিলে একটা বড়ো গোছের পুতুল-খেলায় মেতে উঠেছে। ...বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বৃথা সময় নষ্ট। কিন্তু, সমস্ত দেশের লোকের মনে যাতে ক’রে একটা ভাবের আন্দোলন একটা বৃহৎ উচ্ছ্বাস এনে দেয় সে জিনিসটি কখনোই নিষ্ফল এবং সামান্য নয়। ...সমস্ত বাংলাদেশের লোক যাকে উপলক্ষ করে আনন্দে ভক্তিতে প্লাবিত হয়ে উঠেছে, তাকে আমি মাটির পুতুল বলে যদি দেখি তবে তাতে কেবল আমারই ভাবের অভাব প্রকাশ পায়।”
রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য যে কোনও রকম আনুষ্ঠানিকতার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন যে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আত্মিক যোগ, ভক্তিযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। তার জায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে বাহ্যিক আড়ম্বর, বৈভব, উন্মাদনা।
আশ্রমের বিদ্যালয়ে মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে যোগরঞ্জনের মৃত্যু হয়। এই সংবাদ পেয়ে মনোরঞ্জনবাবু শান্তিনিকেতনে এসে কবির সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁদের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে একনিষ্ঠ আলোচনা হয়। সেখানে কবি বলেছিলেন ধর্মের সঙ্গে কোনও বিশেষ স্থান, বিশেষ সময় বা বিশেষ কথা জড়িত করে দেওয়ার যে প্রবণতা, যেটা ব্রাহ্ম সমাজের ক্ষেত্রেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সেটা এক ধরনের মেসমেরিজ়ম। অর্থাৎ আমি নিয়মিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করছি অথচ জগৎ সম্পর্কে আমার ধারণা-উপলব্ধির কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। কবি তাই বলেছিলেন, “...আমি যদি ঈশ্বরকে কোনোরকম উপলব্ধি করে থাকি বা ঈশ্বরের আভাস পেয়ে থাকি, তা হলে এই সমস্ত জগৎ থেকে, মানুষ থেকে গাছপালা পশুপাখি ধুলোমাটি— সব জিনিস থেকেই পেয়েছি।... আমরা এই জগতের অধিকাংশ জিনিসকেই জড় নাম দিয়ে আমাদের বাইরে ঠেলে রেখে দিই। আমি এই সমস্তের মধ্যে যেন প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করি।...আকাশে বাতাসে জলে সর্বত্র আমি তাঁর স্পর্শ অনুভব করি। এক-এক সময় সমস্ত জগৎ আমার কাছে কথা কয়। আমি এইজন্য বলি ঈশ্বরকে একটা বিশেষ উপায়ের ভিতর দিয়ে, একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের দ্বারা পাবার দরকার নেই।” কবির এই উত্তরণ তাঁকে বিশ্বপ্রেমে দীক্ষিত করেছিল।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “কলকাতায় আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িটা যেন একটা প্রাচীন বটগাছ...” এই বটগাছের আধারে রথীন্দ্রনাথ পূর্বোক্ত তিন পুরুষেরই সুবিশাল বিস্তার, ব্যাপ্তি ও প্রভাব অনুভব করেছিলেন। শুধু রথীন্দ্রনাথ কেন, আজও বাঙালি সমাজ সেই অপূর্ব মহিমান্বিত বটগাছের দিকে প্রত্যহ, প্রতি পদে এক হৃদয় মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
তথ্যঋণ: দ্বারকানাথ ঠাকুর - কৃষ্ণ কৃপালনী; মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; পিতৃস্মৃতি - রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ - পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়; চিঠিপত্র (৫) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল - চিত্রা দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy