ছবি: কুনাল বর্মণ।
বছরটা ১৮৬৪। অগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। চার্লস রবার্ট ডারউইন এবং তাঁর স্ত্রী এমা ডারউইন তখন লন্ডনে। এসে উঠেছেন ৪ নম্বর চেস্টার প্লেস রোডে। ডারউইনের শ্যালিকা সারা এলিজ়াবেথ ওয়েনউড-এর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। কেন্ট কাউন্টিতে ডাউন গ্রামে পৈতৃক বাড়ি থেকে ডারউইন-দম্পতির লন্ডন শহরে আসার কারণ গৃহস্বামীর ব্যাধি। অনেক দিন ধরে ডারউইন অসুস্থ। যখন-তখন বমি হচ্ছে তাঁর। বন্ধু জন ডালটন হুকার-কে লেখা এক চিঠিতে ডারউইন জানিয়েছেন, হাওয়া বদল দরকার তাঁর। তাই সেই হাওয়া বদলের জন্যই এসেছেন তিনি।
শ্যালিকার বাড়িতে ডারউইনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন এক জন। স্কটল্যান্ডের নৃতাত্ত্বিক হিউ ফ্যালকনার। তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি ফসিল। অধুনালুপ্ত এক মানুষের খুলি, যা পাওয়া গিয়েছিল জিব্রাল্টারে। পাওয়ার পর তেমন হইচই হয়নি। না হলেও, ফ্যালকনার এবং আর এক জন নৃতাত্ত্বিক জর্জ বাস্ক ঠিক করেছেন, বাথ শহরে ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’-এর আগামী অধিবেশনে ওই খুলি দেখাবেন। খুলি নিয়ে একটা পেপারও পড়বেন ওঁরা ওই অধিবেশনে। তার আগে বন্ধু ডারউইনকে সেই খুলিটি দেখাতে নিয়ে এসেছেন ফ্যালকনার।
ডারউইন দেখলেন ফসিলটি। বা ভাল করে দেখলেনও না। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে ছেড়ে দিলেন। মাত্র পাঁচ মাস পরে ফ্যালকনার মারা গেলেন। তাঁর লেখাপত্রে কোনও উল্লেখ নেই ডারউইনের সঙ্গে সাক্ষাতের। ডারউইনের লেখাপত্রেই কি আছে? নাঃ, তাও নেই, শুধু হুকারকে লেখা এক চিঠিতে একটি মাত্র লাইন ছাড়া। লাইনটি হল “চার্লস লিয়েল এবং হিউ ফ্যালকনার দেখা করতে এসেছিলেন আমার সঙ্গে। ফ্যালকনার আমাকে একটা চমৎকার জিব্রাল্টার খুলি দেখালেন।” ব্যস, ওইটুকুই। সারা জীবনে যে ওই এক বারই মাত্র মানুষের খুলি স্বচক্ষে দেখলেন ডারউইন, সেই দেখায় কী মনে হল তাঁর, সে সবের কিছুই উল্লেখ নেই চিঠিতে। নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু মনে হয়নি ডারউইনের। তা হলে তো তার উল্লেখ থাকত।
হায়! চার্লস ডারউইনেরও ভুল হয়। যে বিজ্ঞানী সারা জীবন নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে বেড়ালেন, তাঁর তত্ত্ব দাঁড় করালেন সেই সব নমুনার উপর, তিনিই তাৎপর্য বুঝ পারলেন না শ্রেষ্ঠ নমুনাটির? এই হল বিজ্ঞান! অন্ধকারে পথ চলা। তাই প্রখ্যাত লেখক আর্থার কেসলার বিজ্ঞানীকে বলেছেন স্লিপওয়াকার। ঘুমের মধ্যে চলা পথিক। মানুষ যেমন ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে পথ চলে, গবেষণাও তাই। অন্ধকারে হাতড়ানো। খেপা খুঁজেফেরে পরশপাথর— কখন যে পাওয়া যায়, কেউ জানে না। অকস্মাৎ পেলেও, অচিরেই হারিয়ে যায়।
তা না হলে, ডারউইন বুঝতে পারতেন জিব্রাল্টার খুলির তাৎপর্য। আর, তা হলে জীবনের শ্রেষ্ঠ বইটি তিনি লিখতে পারতেন ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দেই। তার পরে আরও সাত বছর অপেক্ষা করতে হত না। বইটি চার্লস ডারউইন প্রকাশ করেন ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। এ বছর সেই বইয়ের ১৫০ বর্ষপূর্তি। আর সে উপলক্ষেই বইটি আলোচিত হচ্ছে নানা বিদগ্ধ মহলে।
বইটির নাম— ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘অন দি ওরিজিন অব স্পিশিস বাই মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজ়ার্ভেশন অব ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ’ তাঁর লেখা বিখ্যাততম বই হতে পারে, তবে শ্রেষ্ঠ বই নয়। শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বইটি।
এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীর রূপান্তর যদি হয় ডারউইনের মূল কথা, তা ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’-এ ব্যক্ত হলেও, সেই বিবর্তনবাদ থেকে যে মানুষও মুক্ত নয়, মানুষও যে এক বিবর্তিত পশু, তা স্পষ্ট করে ডারউইন বললেন ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। বারো বছর আগে অন্য পশুর কথা শোনাতে গিয়ে তিনি শুধু মানুষের কথা বাদ রেখেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘মানুষের উৎস এবং ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।’ মানে, পরে আলোচিত হবে। সেই আলোচনা জরুরি। পশুপাখি তো আর বই পড়বে না। পড়বে মানুষ। সে জানতে চায়, সে কোথা থেকে এল? বিবর্তনবাদের অন্য আবিষ্কর্তা আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস-এর সঙ্গে পত্রালাপ ছিল ডারউইনের। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ওঁকে যে চিঠি লেখেন ডারউইন, তাতে তিনি মানুষের উৎপত্তিকে বলেছিলেন ‘দি হায়েস্ট মোস্ট ইন্টারেস্টিং প্রবলেম ফর দ্য ন্যাচরালিস্টস’।
সেই সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক সমস্যার সমাধান ডারউইন করলেন ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’ বইটি লিখে। দেখালেন, যে ভাবে পশু থেকে পশু রূপ পরিগ্রহ করে, তেমনই মানুষও এক পরিবর্তিত পশু। সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ হল ‘শ্রেষ্ঠ দশটি তাৎপর্যপূর্ণ বইয়ের অন্যতম’। সত্যি, বিজ্ঞানে তো বটেই, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব কিংবা দর্শনশাস্ত্রেও বইটির অভিঘাত কম নয়। আর বিতর্ক? তা আজও ইউরোপ-আমেরিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখানে ‘নাট্য আনন’ গোষ্ঠী প্রযোজিত ‘অ-মানুষ’ নাটকে (যা জেরোম লরেন্স এবং রবার্ট এডুইন লি-রচিত ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’-এর ভাষান্তর) আমেরিকায় প্রায় একশো বছর আগেকার এক মামলার উপাখ্যান বিধৃত। ৬২ বছর বয়েসে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার এমন নজির বিজ্ঞানে বিরল। এর পর মাত্র একটি বই-ই লিখেছিলেন ডারউইন। ‘দ্য এক্সপ্রেশন অব দ্য ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস’। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ওই বইয়ের উপজীব্যও মানুষের উৎপত্তি।
ওই জরুরি প্রশ্নটা ডারউইনের মনে ঘুরপাক খেয়েছে বহু কাল। তা হলে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’-এ তা বাদ কেন? ভয়? চালাকি? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের মানুষ ডারউইন এবং তাঁর সময়কে বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডারউইন কিন্তু কোনও অর্থেই পেশাদার বিজ্ঞানী ছিলেন না। বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তারি করুক। সে উদ্দেশ্যে ওঁরা তাঁকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ভাল লাগেনি ছেলের।
কেরিয়ার কী হবে ছেলের? চার্চের পাদ্রি হোক। সে উদ্দেশ্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হল। পাদ্রি ডারউইনকেই পেতাম আমরা, যদি না একটা ঘটনা ঘটত। ১৮৩১ থেকে ১৮৩৬— পাঁচ বছর ধরে সমুদ্রযাত্রা। নানা দেশে ঘোরা, অসংখ্য পশুপাখি দেখা, অনেক আদিম জনজাতির সংস্পর্শে আসা। আর একটা ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখা। কী? দাসপ্রথা। শ্বেতাঙ্গরা নাকি কালা আদমিদের বংশপরম্পরায় ক্রীতদাস রাখতে পারে, কারণ ওরা তো আলাদা জাত। ঈশ্বর ওদের আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন। কালা আদমিরা তো দাস হওয়ার যোগ্য। মনে রাখতে হবে, ইংল্যান্ডে তখন মহিলাদের ভোটাধিকার নেই। দাসপ্রথা নিয়ে আমেরিকায় ধুন্ধুমার, এমনকি গৃহযুদ্ধও। এ দিকে ডারউইনের পরিবার দাসপ্রথা বিলোপের, মহিলাদের ভোটাধিকারের পক্ষে। সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে দেশে দেশে দাসপ্রথা দেখে ডারউইনের মনে ইচ্ছে জাগে। পশুপাখি আর সব মানুষই যে এক, তা প্রমাণের। কী করে তা হবে? এক উৎস (পশু) থেকে সব মানুষ এসেছে, তা দেখাতে পারলে।
কিন্তু ইংরেজ সমাজে ধর্মের প্রভাব প্রবল। ধর্ম আবার দাসপ্রথা সমর্থন করে। সমর্থন করেন ডারউইনের বন্ধু লিয়েলও। তিনি ডারউইনকে পড়ালেন আমেরিকান পাদ্রি রেভারেন্ড জন বাকম্যানের প্রচার পুস্তিকা। পাদ্রি বলেছেন, সাদা ও কালো আদমির ঐক্য চাই। বলেছেন, ও দুটো আলাদা জাত। লিয়েল বিশ্বাস করেন, শ্বেতাঙ্গরা বুদ্ধিবৃত্তিতে কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে এগিয়ে, সুতরাং, ওরা আলাদা জাত। ডারউইন বন্ধু লিয়েলকে চটাতে চাইলেন না। সিনিয়র বিজ্ঞানী বলে কথা!
‘ওরিজিন অব স্পিশিস’-এ ডারউইন যতই লিখুন যে, মানুষের ব্যাপারে পরে আলোকপাত করা হবে, ওই বই প্রকাশের সময় থেকেই জনমানসে প্রশ্ন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডারউইন কি বলতে চান যে, প্রকৃতির স্রষ্টা আদৌ ঈশ্বর নন? তিনি কি সমাজকে ঠেলে দিচ্ছেন নাস্তিকতার দিকে? আদম আর ইভের আখ্যান কি মিথ্যে? প্রাকৃতিক নির্বাচন যে বাস্তবে ঘটছে, তার প্রমাণ কোথায়? প্রাকৃতিক নির্বাচন তো একটা যান্ত্রিক পদ্ধতি, সম্ভাব্যতায় ভরা, তা কী করে মানুষের সৌন্দর্যবোধ, নৈতিকতা বা ভাষার মতো চমৎকার গুণাগুণের জন্ম দেয়? নিজের মতো করে ডারউইন সব প্রশ্নের উত্তর দেন ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ। নামটিও লক্ষণীয়। ‘ওরিজিন অব ম্যান’ নয়, ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’। উৎপত্তি নয়, উৎস।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বইটি ছিল দু’খণ্ডের। ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয়, ‘সেক্সুয়াল সিলেকশন’। অর্থাৎ ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’-এর পাশাপাশি আর একটা নীতিও আমদানি করলেন ডারউইন ওই বইতে। যৌনতার নিয়ম। যৌনসঙ্গী নির্বাচনের নিয়ম। বিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য উপাদান। ডারউইন মন্তব্য করেছিলেন, ময়ূরকে দেখলে আমি বিরক্ত হই। ময়ূরের সমস্যা হল তার পেখম। পেখম তার দেহে এক বাহুল্য। তা তৈরি করতে এনার্জি খরচ। বাঘ ময়ূরকে তাড়া করলে, তার জোরে দৌড়নোয় অসুবিধে। জীবনধারণে আর আত্মরক্ষায় বাধা সৃষ্টিকারী পেখম ময়ূরের দেহে থাকার কথা নয়। বিবর্তনের নিয়মে তো ও
জিনিস ময়ূরের দেহে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু ময়ূরের দেহে পেখম টিকে আছে ময়ূরী তা পছন্দ করে বলে। ময়ূরের বংশবৃদ্ধিতে কাজে লাগে, তাই ময়ূরের পেখম টিকে আছে। ডারউইনের মতে, সেক্সুয়াল সিলেকশনই মানুষের মধ্যে জাত (সাদা এবং কালা আদমি) সৃষ্টি করার মূলে দায়ী। কারণ
এক এক জায়গার সৌন্দর্যচেতনা এক এক রকম।
ডারউইন-বর্ণিত এই সেক্সুয়াল সিলেকশন তত্ত্বের এক কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। হ্যাঁ, বিবর্তন তত্ত্বের অন্যতম আবিষ্কর্তা। তিনি স্ত্রী-প্রজাতির মধ্যে এই সৌন্দর্যচেতনার তত্ত্বটিকে আক্রমণ করেন। সৌন্দর্যবোধ প্রাণী উন্নত না হলে আসে না। মানুষের মধ্যে রমণীদের যে বোধ থাকলেও থাকতে পারে, তা স্ত্রী-পশুর কী করে থাকবে? ওয়ালেস এবং কিছু বিবর্তনবাদী ভাবলেন, সেক্সুয়াল সিলেকশন নামে আলাদা তত্ত্ব খাড়া করার দরকার নেই, ন্যাচারাল সিলেকশনই সবটা ব্যাখ্যা করতে পারে।
আর প্রথম খণ্ড? ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ খণ্ডে ডারউইন আলোচনা করলেন মানুষ ও পশুর তুলনা, কোথায় কোথায় মিল আছে তাদের মধ্যে। চেতনা, যুক্তি, নৈতিকতা, স্মৃতি, কল্পনা এমনকি ভাষা। ডারউইনের মতে, মানুষের মানসিক ক্ষমতা বলে যা যা চিহ্নিত, তা সব পশু থেকে এসেছে ধাপে ধাপে, এসেছে প্রাকৃতিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। উপসংহারে ডারউইন লেখেন, ‘আমার মনে হয়, মহান গুণাগুণ নিয়ে, নীচতম যে ব্যক্তি, তার প্রতি সহানুভূতি নিয়ে, অন্য মানুষ শুধু নয়, দীনতম প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা নিয়েও, সৌরমণ্ডলের গ্রহ-উপগ্রহের চলন সম্পর্কে ঈশ্বরসম জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও— এমন সব ক্ষমতার অধিকারী হয়েও— মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নীচ জাতের প্রাণী থেকে উঠে আসার লক্ষণ রয়ে গেছে।’
‘ওরিজিন অব স্পিশিস’ প্রকাশিত হলে যে বিতর্ক হবে, তা (মানুষ তা হলে কী দোষ করল?) আগেই অনুমান করেছিলেন ডারউইন। ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ সব সমালোচনার জবাব দিলেন তিনি। সে জন্য ওই বইকে পণ্ডিতেরা বলেন, ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’-এর ‘দি আদার মিসিং হাফ’। এই বইতে ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হল ‘ইভলিউশন’ বা বিবর্তন শব্দটি। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বাক্যাংশটিও ব্যবহার করলেন ডারউইন। শব্দগুচ্ছের উদ্ভাবক ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসার। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘প্রিন্সিপলস অব বায়োলজি’ বইয়ে তিনি প্রথম লেখেন ওই বাক্যাংশ। প্রাকৃতিক নির্বাচন বোঝাতে। স্পেনসার অকপটে স্বীকার করেন ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’ পড়ে তাঁর মাথায় ওই শব্দগুলো আসে। ছাপা হওয়া মাত্র তা ভাল লাগে বিবর্তনের আবিষ্কর্তা আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস-এর। তিনি ডারউইনকে বার বার অনুরোধ করেন লেখাপত্রে অমন জুতসই একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে। ডারউইন কবে প্রথম তাঁর লেখায় ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ কথাটা ব্যবহার করেন, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। সে বিতর্ক নিরসন করেছেন দু’খণ্ডে (‘ডারউইন: ভয়েজিং’ এবং ‘ডারউইন: দ্য পাওয়ার অব প্লেস’) রচিত তাঁর জীবনীর লেখক জ্যানেট ব্রাউন। কাগজপত্র ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছেন, ডারউইন প্রথম ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ কথাটা ব্যবহার করেন ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ‘দ্য ভেরিয়েশন অব অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’ বইতে। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’-এর পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হলে ওই বইতেও তিনি ঢুকিয়ে দেন ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ কথাটা।
‘ডিসেন্ট অব ম্যান’-এর প্রকাশক জন মারে। সেই ভদ্রলোক, যিনি ১২ বছর আগে ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’ ছেপেছিলেন। ডারউইন যে বরাবর নতুন বক্তব্য পেশ করেন, মারে তা জানতেন। সূক্ষ্ম ব্যবসায়িক বুদ্ধিবলে তিনি জানতেন, এই বইটিও বিতর্ক তুলবে, বিক্রি হবে। ডারউইন পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দেই। তা মারে দেখতে দেন তাঁর বন্ধু রেভারেন্ড হুইটওয়েল এলউইনকে। এলউইন মারের প্রকাশনা সংস্থা থেকে ছাপানো ‘কোয়ার্টারলি রিভিউ’ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক। এলউইন ডারউইনের লেখা পাণ্ডুলিপি পড়ে বললেন, ‘আজেবাজে কথায় ভর্তি’। মন্তব্য অগ্রাহ্য করে বইটা ছাপলেন জন মারে।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭১। ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ প্রকাশিত হল। হট কেক। প্রথম প্রিন্ট ২৫০০ কপি। মুদ্রণপ্রমাদ সহযোগে। পরের মাসে আবার প্রিন্ট ২৫০০ কপি। এ বার ভুলচুক শুধরে। দাম ১ পাউন্ড ৪ শিলিং। আমেরিকায় বইটা ছাপাল ভি অ্যাপলটন অ্যান্ড কোম্পানি। ফ্রান্স এবং জার্মানির যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের পরিস্থিতি উত্তাল। তা সত্ত্বেও ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ অনূদিত হল ডাচ, ফরাসি, জার্মান, রুশ, সুইডিশ, পোলিশ ভাষায়। সঙ্গে ডারউইনের অর্থলাভ, যা তিনি ‘ওরিজিন অব স্পিশিস’ লিখেও পাননি। মারে চেক পাঠালেন ডারউইনকে। ১,৪৭০ পাউন্ডের। তা হলে কী হবে, ‘দ্য হর্নেট’ পত্রিকায় কার্টুন বেরোল। ডারউইনকে ওরাং ওটাং সাজিয়ে। নীচে লেখা হল ‘সম্মানীয় ওরাং ওটাং’।
ফিরে আসি সেই প্রসঙ্গে, যে প্রসঙ্গ দিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল চতুর্থ অধ্যায়। ওই অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেন ভ্রূণগত, দেহগঠন এবং আচরণে পশুদের সমপর্যায়ে হয়েও মানুষ কোথায় কোথায় আলাদা। মানুষের বিশেষত্ব ডারউইনের মতে তার চারটে লক্ষণে— অস্ত্র ব্যবহার, দাঁতের পাটি ছোট হয়ে আসা, দু’পায়ে চলাফেরা এবং মস্তিষ্কবৃদ্ধি। লেখেন, ‘অস্ত্র ধরার জন্য হাত মুক্ত হয়ে যাওয়া হামাগুড়ি দেওয়ার বদলে সোজা হয়ে চলার কারণ ও ফলাফল দুটোই।... মানুষ একমাত্র জীব, যে দ্বিপদ। আমার মনে হয়, আমরা কিছুটা বুঝতে পারি কী ভাবে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, যেটা তার সঙ্গে নিকটবর্তী আত্মীয়ের মূল ফারাক। এ পৃথিবীতে মানুষ প্রভুত্ব করতে পারত না হাতের ব্যবহার ছাড়া। মানুষের পূর্বপুরুষের দাঁত আকারে বড় ছিল। কিন্তু সে যখন থেকে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য পাথর, মুগুর বা অন্য অস্ত্র ধরতে শিখল, তখন থেকে তার দাঁতের ব্যবহার কমল।... যখন থেকে তার মানসিক কাজকর্ম বাড়ল, মস্তিষ্কের আয়তনও বাড়ল।’
‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ প্রকাশের পর ১৫০ বছর কেটে গেছে। এই ২০২১ সালেও নৃতাত্ত্বিকরা চিন্তিত সেই সব প্রশ্নে, যা একদা পীড়িত করেছিল ডারউইনকে। হঠাৎ কেন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াল? তার অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়াটা কি দু’পায়ে হেঁটে বেড়ানোর আগে ঘটেছিল, না পরে? অথবা একই সময়ে?
তা হোক, তবু আধুনিক নৃতাত্ত্বিকরা বিস্মিত হন ডারউইনের ভ্রমে। ভুল তা হলে চার্লস ডারউইনেরও হয়। এ কথা ঠিক যে, ওঁর সময়ে ফসিল বেশি খুজে পাওয়া যায়নি, সারা জীবনে এক বারই মাত্র খুলি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ডারউইন, তা তো আগেই বলেছি। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’-এর অধিবেশনে একটা খুলির অংশবিশেষ প্রদর্শিত হয়েছিল। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম কিং ওই খুলি দেখিয়েছিলেন। ওটা পাওয়া গিয়েছিল জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকায় ফেল্ডহোফার গুহায়।
কিং ওই গুহাবাসীদের নাম দিয়েছিলেন ‘হোমো নিয়ানডারথালেনসিস’। ইউরোপবাসী, যারা আজ বিলুপ্ত। এখন ওদের ‘নিয়ানডারথাল’ বলা হয়। ফ্যালকনার যে খুলিটি দেখিয়েছিলেন ডারউইনকে, তাও এক নিয়ানডারথাল রমণীর। একটা খুলি পেলে ডারউইন বিভ্রান্ত হতে পারতেন। কিন্তু, দুটো খুলি তো একটা প্যাটার্ন ইঙ্গিত করে। খুলির মধ্যে ছোট দাঁতের পাটি এবং মস্তিষ্কের বড় আকার দেখে ডারউইনের চেনা উচিত ছিল ওই খুলি মানুষের পূর্বপুরুষের। তা হলে আর সাত-সাতটি বছর অপেক্ষা করতে হত না ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ লেখার জন্য। অনেক আগেই তা লেখা হত।
খেপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy