ছবি-অমিতাভ চন্দ্র
মার খাবি সবার সামনে?’’ জেঠিমা কঠিন গলায় বলল।
‘‘হ্যাঁ, মারো তো। আমার ব্যাগে স্কেল আছে। দেব?’’
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, সাবু নেমে এসেছে উপর থেকে।
জেঠিমা বলল, ‘‘সাবু তুই ওকে নিয়ে গিয়ে কাফেটেরিয়া থেকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আয়। দেখেছিস কেমন রোগা হয়ে গিয়েছে!’’
‘‘হবে না!’’ সাবু ফুট কাটল, ‘‘শরৎবাবুর ক্যারেক্টার যে। বোতল হাতে ধরিয়ে দিলে পারফেক্ট লাগবে একদম।’’
আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘‘তুই এই করতে আসিস এখানে?’’
মা আর কাকিমা বসে শুনছিল এত ক্ষণ। মা উঠে দাঁড়াল এ বার। বাকিদের বলল, ‘‘চলো আমরা এক বার দেখে আসি।’’
আমি বললাম, ‘‘আইসিসিইউ-তে আছে। এ ভাবে মেলা দেখতে যাওয়ার মতো কী আছে? চেনাশুনো আছে বলেই কি সুবিধে নিতে হবে? বাবা তো চোখ বুজে শুয়ে আছে। কী করবে সবাই গিয়ে?’
‘‘তোকে দেখতে হবে না, তুই গিয়ে খা এখন। বেশি বোদ্ধা!’’ জেঠিমা আমায় হাত দিয়ে সাবুর দিকে ঠেলে দিল, ‘‘সাবু, ওকে নিয়ে যা তো।’’
সাবুও আমার হাত ধরে টানল। বলল, ‘‘চল না। কেন ভাও খাচ্ছিস! কাকু স্টেবল এখন। চল।’’
আমি এক পা এগোতেই দেখলাম সুজয়দা-সহ অফিসের বেশ কিছু লোকজনের সঙ্গে রিজু এগিয়ে আসছে। সুজয়দারা আমায় দেখে মাথা নেড়ে বসার জায়গার দিকে চলে গেলেও রিজু এসে দাঁড়াল সামনে। তার পর আমায় বলল, ‘‘ওই বাগালে ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করছিল কাজের কত দূর। কবে আমরা কোটেশন সাবমিট করব। আগে টেকনিক্যাল বিড দিতে হবে। টেকনিক্যাল ইভ্যালুয়েশানের পরে সেটা ফ্রিজ় হলে প্রাইস বিড নেওয়া হবে।’’
আমি বললাম, ‘‘কাজ তো চলছে। অত বড় প্রোজেক্ট। আরও দশ দিন তো লাগবেই। বেশিও লাগতে পারে। লে-আউট ড্রয়িং তো দিতেই হবে। না হলে কত জায়গা লাগবে, সেটা বোঝা যাবে না তো। ড্রয়িংটা তো সুজয়দার সঙ্গে বাকিরা করছে।’’
‘‘তুই এক বার কথা বল না প্লিজ়,’’ রিজু নিজের মোবাইলটা বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি নিলাম মোবাইলটা। সত্যি! আমি যতই যন্ত্র ছাড়তে চাই না কেন, যন্ত্র আমার পিছু ছাড়তে চায় না একটুও।
সাবু বলল, ‘‘হাসপাতালেও তোদের এত কাজ! লজ্জা করে না তোর?’’
রিজু রেগে গেল, ‘‘এই সাবু! তোর চাচা চৌধুরী কোথায় রে? শুনলাম চুরি হয়েছে ওর বাড়িতে!
যা না, সেখানে যা না! আমাদের কাজে মাথা গলাচ্ছিস কেন?’’
সাবু রেগে গিয়ে আমার হাত ধরে আবার টানল, ‘‘আয় তো, আয়। পরে কথা বলিস। বাবা হাসপাতালে ভর্তি আর উনি কাজ দেখাচ্ছেন!
আর শোন রিজু, লামাদাদুর নামে ফারদার খারাপ কথা বললে কাকুর পাশের বেডে তোকে ভর্তি
হতে হবে।’’
আমি সামান্য বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলাম সাবুর। মেয়েটা কী যে করে! বললাম, ‘‘দু’মিনিট কথা বলে নিই। আমাদের ক্লায়েন্ট। প্লিজ় এ ভাবে চেঁচাস না।’’
আমার কথার মধ্যে কি কিছু বিষ ছিল! দেখলাম সাবু কেমন যেন নিভে গেল হঠাৎ।
আমার খারাপ লাগল। আমি আজকাল কী করছি! মেয়েটাকে সবার সামনে এমন করে কেন বললাম? কিন্তু কাজও তো করতে হবে। বাবা সুস্থ হয়ে উঠে যেন দেখে কাজটা আমরা পেয়েছি। এটুকু তো আমায় করতেই হবে।
আমি ফোনটা থেকে বাগালের নাম্বার ডায়াল করে কানে লাগালাম।
হাসপাতালের লাউঞ্জটা বিশাল বড়। অনেক লোক। বেশ কয়েকটা টিভি চলছে। ক্যালরব্যালর করছে লোকজন।
আমি কানে একটা আঙুল দিয়ে অন্য কানে ফোনটা লাগিয়ে একটু কোণের দিকে সরে গেলাম।
বেশ কয়েকটা রিং হওয়ার পরে বাগালে ফোন ধরলেন, ‘‘হ্যালো।’’
‘‘স্যর, লোহিত বলছিলাম।’’
‘‘আরে লোহিত। হাউ ইজ় ইয়োর ফাদার? সবুজবাবু কেমন আছেন?’’
আমি সংক্ষেপে বললাম। গলা শুনেই মনে হল লোকটা ভদ্রতা করছে। আসলে ওর দরকার কাজ কতটা এগোল তার খবর।
‘‘আই উইশ হিম স্পিডি রিকভারি,’’ বাগালে কথা পাল্টালেন এ বার, ‘‘তা ভাই কাজের কী খবর? এই অবস্থায় কি তোমরা অন টাইম টেকনিক্যাল বিড জমা দিতে পারবে? আসলে দিল্লির মিনিস্ট্রি লেভেল থেকে চাপ আসছে। তাই আমাদের একটু জলদি করতে হবে।’’
আমি বললাম, ‘‘ডোন্ট ওরি স্যর। আরও তো পনেরো দিন টাইম আছে। তার মধ্যেই করে দেব আমরা। বাবা অসুস্থ তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি। হয়ে যাবে।’’
‘‘দ্যাট’স দ্য স্পিরিট! টেক কেয়ার। গিভ মাই বেস্ট টু ইয়োর পাপা। বাই।’’
ফোনটা শেষ করে আমি রিজুর দিকে
বাড়িয়ে দিলাম। দেখলাম সাবু এখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি এ বার এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। হাত ধরে টেনে বললাম, ‘‘চল। খাব।’’
সাবু বাধ্য মেয়ের মতো আমার সঙ্গে বেরিয়ে কাফেটেরিয়ায় এল। রিজুকে আমিই আসার আগে চোখের ইশারায় আসতে বারণ করেছি। তা ছাড়া ও এক বার বাবাকেও দেখতে যাবে।
খাবার জায়গায় ভিড় থাকবে না, সেটা হতে পারে না। এখানেও তাই বেশ ভিড়। আমি ভাল করে দেখেছি হাসপাতাল, পুজোর বাজার আর বইমেলার সঙ্গে খাবারের বেশ একটা ভাল সম্পর্ক আছে।
মেনু দেখে আমি দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার করলাম। আড়চোখে দেখলাম, সাবু আমার সঙ্গে এলেও কেমন যেন মাথা নিচু করে আছে। বুঝলাম তখন ও ভাবে বলাটা ওকে কষ্ট দিয়েছে।
আমারও খারাপ লাগছে। আসলে আমি কারও মনে দুঃখ দিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি নিজে তো জানি কষ্ট পেলে কেমন লাগে! যেটা নিজে নিতে পারি না সেটা অন্য মানুষ কেমন ভাবে নেবে?
আমার সামনে একটা লোক কানে হেডফোন আটকে কারও সঙ্গে গাঁকগাঁক করে চিৎকার করে শেয়ার বাজার নিয়ে আলোচনা করতে করতে লোকজনকে গুঁতিয়ে ক্যাশের দিকে এগোবার চেষ্টা করছে। আমি ক্যাশ থেকে ব্যালেন্স নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। লোকটার যে কাণ্ডজ্ঞান নেই দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য আজকাল রাস্তাঘাটে কারই বা কাণ্ডজ্ঞান আছে! সবাই নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে। এক অদ্ভুত ‘আমাকে দেখুন ও লাইক দিন’ সিনড্রোমে সবাই আক্রান্ত! এই যে লোকটা গন্ডারের মতো একবগ্গা ভাবে প্রায় সবাইকে গুঁতিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা আসলে এই সময়টারই একটা লক্ষণ!
আমি ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখলাম আবার। আশ্চর্য! এখনও হুঁশ নেই। আশপাশের সবাই বিরক্ত হচ্ছে। লাইনের সামনে যারা আছে তারা বারণ করছে এমন করতে। কিন্তু লোকটা শুনছে না।
আমার হাত থেকে কুপনটা নিয়ে সাবু নিজেই গিয়ে খাবার নিয়ে এল।
চার দিকে ছোট ছোট টেবিল। দাঁড়িয়ে খেতে হবে। একটা টেবিল ফাঁকা হতেই আমরা গিয়ে সেটা দখল করলাম।
আমি আবার মাথা ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখলাম।
‘‘ছাড় না,’’ বলে সাবু আলতো করে আমার হাতে
হাত রাখল।
আমি বললাম, ‘‘দেখছিস এক বার? কেমন করছে মালটা?’’
সাবু বলল, ‘‘ম্যাক্স লোকজনই তো এমন। দেখিস না চার দিকে? বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, অটোয়, দোকানে, বাজারে, খেলার মাঠে, শ্মশানে, হাসপাতালে সবার খুব তাড়া! সবাইকে আগে পৌঁছতে হবে। কিন্তু তাও দেখ, দেশ কিন্তু কোথাও পৌঁছতে পারছে না! অন্যকে মানুষ বলেই মনে করে না কেউ!’’
‘‘আমি অবাক হয়ে যাই!’’ আমি সাবুর দিকে তাকালাম।
সাবু হাসল একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে।
‘‘হাসলি কেন?’’ আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে।
‘‘তোর মুখে এই কথা শুনে হাসি পেল আমার।’’
‘‘আমার মুখে... মানে?’’ সাবু কী বলতে চাইছে বুঝতে পারলাম না।
সাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার পর বলল, ‘‘তুই যাকে পছন্দ করেছিলি, সে কি আলাদা কিছু না কি?’’
‘‘এনার কথা বলছিস?’’
‘‘নয়তো কী!’’ সাবু হাতের স্যান্ডউইচটা একটা পেপার টাওয়েলের উপর রেখে বলল, ‘‘তোকে সারা কলেজ জুড়ে চরকিনাচন নাচাল। এক বার কাছে টানল, এক বার ছাড়ল। তাও দেখ তোর শিক্ষা নেই! সে দিন ওর সঙ্গে একটা ছেলেকে পর্যন্ত...’’
আচমকা আমার যে কী হল কে জানে! মাথার মধ্যে চিড়িক করে যেন স্পার্ক হল একটা। ঠিক দু’বছর আগে যে ভাবে আমাদের পাড়ার মোড়ের লাইট পোস্টে হয়েছিল।
আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, ‘‘চুপ কর! সারা ক্ষণ এনার নিন্দে করিস কেন তুই? হিংসে করিস তুই ওকে? ও কেমন সেটা তোর থেকে শুনতে হবে আমায়? লজ্জা থাকলে আর কোনও দিন এই নিয়ে কোনও কথা বলবি না। মনে থাকে যেন!’’
আমি হাতের স্যান্ডউইচটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে হাঁটা দিলাম। আমি জানি আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে আমার দিকে। কিন্তু আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। পাড়ার মোড়ে সেই স্পার্ক হওয়ার পর সারা পাড়ায় যেমন হয়েছিল, আমার মাথাতেও ঠিক সে রকমই হয়ে গেল। লোডশেডিং!
যদি আমার মাথায় লোডশেডিং না হত, তা হলে আমি দেখতে পেতাম আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা সাবুর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টি নামছে। বুঝতে পারতাম, আমিও আসলে ওই কানে হেডফোন দিয়ে সবাইকে গুঁতিয়ে এগিয়ে যাওয়া লোকটার মতোই ইতরামো করলাম।
সাবু
দীপ্যদার শরীর খারাপ। তাই নিয়ে আজ মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছিল!
সকালের ঘুমটা যদি এমন হইচইয়ের মধ্যে ভাঙে তা হলে কেমন যেন লাগে। মনে হয় গোটা দিনের তাল কেটে গিয়েছে। কাল অনেক রাতে শুয়েছিলাম আমি। না না, কোনও রাজকার্য করছিলাম না। সাধারণত যা করি না, তা-ই করছিলাম। রাত জেগে মোবাইলে সিনেমা দেখছিলাম। আসলে এখন তো গোটা একটা শহর রাতে জাগে। বাবা হাসতে হাসতে বলে সবাই ব্যাটম্যান! বলে, ‘‘আমাদের সময় সাড়ে এগারোটাতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। চোর-ডাকাত, পুলিশ ছাড়া কেউ জাগত না রাতে। আর এখন রাত তিনটেতেও লোকজন বাড়িতে এসে খাবার দিয়ে যায়! টাকা রোজগার চলছে সারা ক্ষণ। সত্যি বেঁচে থাকা এখন অনেক বেশি টাফ হয়ে গিয়েছে!’’
রাত তিনটের পরে শুয়েছিলাম। ঘুম আসতে আসতে আরও আধ ঘণ্টা। সেখানে সক্কাল সক্কাল এমন ভাল লাগে? আমি বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখেছিলাম সাড়ে সাতটা বাজে। ওঃ, আরও দু’ঘণ্টা মিনিমাম ঘুমোতে হত!
কিন্তু আমি প্রোপোজ় করি, আর মা ডিসপোজ় করে। রাগ হয় খুব। কিন্তু তার পর ভাবি, মাকে তো ভগবান হিসেবে দেখতেই শেখানো হয়, তাই মেনে নিয়েছি যে ভগবানের দায়িত্বই হল মানুষের প্ল্যান-প্রোগ্রাম পণ্ড করা!
সেই যে সকালে ঘুমটা ভেঙেছে আর আসেনি। তার পর থেকেই মাথাটা ধরে আছে। কানের উপরে, দু’পাশ দিয়ে মাথার পিছন অবধি ঘ্যানঘেনে একটা ব্যথা... ঠিক যেন ইনশিয়োরেন্সের সেল্সম্যান। কিছুতেই যাচ্ছে না।
আমি স্কুটির স্টার্ট বন্ধ করে দিলাম। সামনে বিশাল একটা মিছিল। কিসের কে জানে! আসলে চার দিকে এত মিছিল হয় সারা ক্ষণ যে, আমার মতো সাধারণ মানুষজন আর কেয়ার করে না কাদের মিছিল যাচ্ছে। কারণ আমরা বুঝে গিয়েছি যে, গত সত্তর বছর ধরে এত মিছিল করেও কোনও লাভ হয়নি। পরের সত্তর বছর ধরে মিছিল করলেও লাভ হবে না। শুধু আমাদের হয়রানিটা বজায় থাকবে।
আজ গরম বেশ। আকাশে মেঘ করে আছে। বৃষ্টি আসবে-আসবে করছে সেই সকাল থেকে। কিন্তু আসছে না।
মাথা ঘেমে গিয়েছে একদম। হেলমেটের মধ্যে দিয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে নীচে। এত অস্বস্তি হচ্ছে! আমি জানি মাথার চুল উঠছে আমার। সারা ক্ষণ হেলমেট পরে থাকলে যা হয় আর কী! মা তো রাগ করে বলে, “বিয়ের সময় টাকমাথায় সিঁদুর পরিস!”
ছবি-অমিতাভ চন্দ্র
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy