পদার্থবিদ রাজা রমন্না।
সে দিন ডান পা-টা বাইকের উপর তুলে বেশ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমিও সুযোগটা নিলাম। সোজা গিয়ে জানতে চাইলাম, উনি এর পর কোথায় যাবেন।
“আপনি কে?”
পরিচয় দিলাম।
স্থান, রবীন্দ্র সদন। উপলক্ষ, কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট বার্ষিক সমাবর্তন। প্রতি বছর আমার ঘাড়েই এই অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব চাপত।
সে বারে এসেছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এবং তদানীন্তন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. রাজা রমন্না। ওঁর সম্পর্কে নানা লেখা পড়েছি। বিশেষ করে পোখরান পর্ব। মনে হল, এ-হেন ব্যক্তিত্বের যদি একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়!
সঙ্গী ফোটোগ্রাফারকে ডেকে বেরিয়ে পড়লাম। সল্টলেকের শেষ প্রান্তে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই বিরাট বাধা। বড় বড় করে লেখা ‘প্রোহিবিটেড প্লেস’। কারণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ঝুঁকি।
পাকানো গোঁফওয়ালা দারোয়ান আমার পথ আটকালেন। সীমিত হিন্দি জ্ঞান নিয়ে বললাম, “ম্যায় এক পত্রকার হুঁ।” তিনি এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন। বচসা শুরু হল।
ঠিক সেই সময়েই হুটারের আওয়াজ শোনা গেল। উনি গেটটি খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যা থাকে কপালে, ভেবে আমরাও কনভয়ের পিছনে ছুটতে আরম্ভ করলাম। ওই প্রথম এবং ওই শেষ আমার সেই গবেষণাকেন্দ্রে প্রবেশ। ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে প্রথমে নেমেছেন সেন্টারের ডিরেক্টর, তিনি আমার পূর্বপরিচিত, এবং ড. রমন্না। ডিরেক্টর আমাকে প্রশ্ন করলেন, “হোয়াট ব্রিংস ইউ হিয়ার, মি. বোস?”
হাঁপাতে হাঁপাতে ক্ষমা চেয়ে আমি ড. রমন্নার থেকে দু’মিনিট সময় চাইলাম। আমি দেখেছি, সংবাদ কিংবা সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে ভিক্ষার্থীসুলভ অ্যাপ্রোচ কাজ দেয় খুব।
এবং সে দিনও কাজ দিল। ওঁরা ধাপে ধাপে উঠছেন আর আমিও তাল মেলাচ্ছি। একতলা থেকে দোতলার পথে ল্যান্ডিংটিতে দাঁড়িয়ে বললেন, “হোয়াই ডিড ইউ পিপল নট অ্যাটেন্ড মাই লেকচার অ্যাট দ্য রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার ইয়েস্টারডে? আই এক্সপেক্টেড ইয়োর লার্জ অ্যাটেন্ডান্স!”
সবিনয়ে জানালাম, সেখানে আমরা আমন্ত্রিতই ছিলাম না। শুনে সঙ্গী ড. দিবাকরের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডিড ইউ রেকর্ড মাই স্পিচ?”
“অফকোর্স উই ডিড স্যর।”
“গিভ দ্য বয় আ চান্স টু লিসন টু ইট। হি ক্যান রাইট ফ্রম ইট।”
এ তো মেঘ না চাইতেই জল। আমিই শুনব, কাজেই আমার ‘এক্সক্লুসিভ’ অনিবার্য। গেলাম পাশের বাড়ির উপরতলার ঘরে। বক্তৃতা শোনার পর কী মনে হতে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা উনি কি আজই প্রথম এলেন?”
“না না, কালও এসেছিলেন। আর বলবেন না। আমাদের খুব বকেছেন।”
সমস্ত ঘটনা শুনে নিলাম। নোট নিলাম না। কারণ উনি সতর্ক হয়ে পড়তে পারেন।
তার অল্প কয়েক দিন আগেই জার্মানি থেকে ফিরেছি। বার্লিনে দেখে এসেছি মোমবাতি মিছিল। পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সেই প্রশ্নটা ড. রমন্নাকে করতে চেয়েছিলাম। ভারতে এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
পৃথিবীতে অষ্টম আশ্চর্য বলেও কিছু আছে। আমার কাগজে পর দিন প্রথম পাতায়ই দু’টি খবর বেরোল। দুটোই আমার নাম-সহ।
যত দূর মনে আছে, প্রথমটির শিরোনাম ছিল, ‘ইন্ডিয়া টু প্রোডিউস টেন থাউজ়্যান্ড মেগাওয়াটস অব নিউক্লিয়ার পাওয়ার বাই টু থাউজ়্যান্ড এডি।’ দ্বিতীয়টির হেডলাইন: ‘রমন্না স্নাবস বার্ক (BARC) সায়েন্টিস্টস ফর ফেলিয়োর টু ইউটিলাইজ় ফান্ডস’।
তখন তারাপুর পারমাণবিক চুল্লি তৈরি। কলাপক্কমও হওয়ার পথে। সারা পৃথিবীতেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ সম্পর্কে একটা দ্বিধা ছিল। বিশেষ করে বর্জ্য নিষ্কাশন পদ্ধতি নিয়ে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ড. রমন্নার এই বক্তৃতাটি একেবারে পলিসি স্টেটমেন্ট।
দ্বিতীয় সংবাদটির তাৎপর্য ছিল অন্য কারণে। ভেক (VECC)-এ ওঁদের সে বার যত কোটি টাকা বাজেট ছিল, তার অর্ধেকের বেশি ওঁরা খরচ করে উঠতে পারেননি। এ দিকে মার্চ মাস শেষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে বাকি টাকা খরচ হবে কি না সন্দেহ। সে জন্যই ড. রমন্নার বকুনি।
রাজা রমন্নার জন্ম ১৯২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি। সেই হিসেবে এবছরই তাঁর শতবর্ষের সূচনা। ছোট থেকেই ইউরোপীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তাঁর আগ্রহ। মহীশূরের তদানীন্তন করদ রাজ্য টুমকুরে বিচারপতি বি রমন্না এবং মা রুক্মিণী আম্মা, রাজার এই আগ্রহের কথা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। বিশপ কটন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে লাগল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অধ্যয়ন।
কে জানত, এক দিন উনিই হয়ে উঠবেন ভারতীয় পারমাণবিক গবেষণাক্ষেত্রের অন্যতম প্রবক্তা এবং স্থপতি, যিনি একই সঙ্গে দীক্ষিত হবেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবার আদর্শে?
স্কুলশিক্ষার শেষে ভর্তি হলেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে, পদার্থবিদ্যা নিয়ে। একই সঙ্গে পড়লেন ভারতীয় মার্গসঙ্গীত ও দর্শনশাস্ত্র।
তার পর বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে পদার্থবিদ্যায় এম এসসি এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে উচ্চতর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এ বার কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে সাগর পাড়ি। ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংস কলেজে। এক সঙ্গে চলল পদার্থবিদ্যায় গবেষণা, এবং লন্ডনে রয়্যাল স্কুল অব মিউজিকে পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত অধ্যয়ন। দু’জায়গা থেকেই ডিগ্রি লাভ হল।
লন্ডনে থাকার সময়েই পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ডিজ়াইনের কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। দেশে ফিরে যোগ দিলেন ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। তাঁর স্বপ্ন ছিল নবীন ভারতের পারমাণবিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এই গল্পের ক্লাইম্যাক্স সারা দুনিয়া জানে ‘দ্য লাফিং বুদ্ধ’ নামে।
ইতিমধ্যে ড. ভাবার দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল ড. রমন্নার কাঁধে।
এসে গেল ১৯৭৪ সালের মে মাসের সেই দিন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতিও নেওয়া ছিল। ভূগর্ভস্থ সেই বিস্ফোরণ ঘটল। পরের দিন শ্রীমতী গান্ধীর পাশাপাশি রাজা রমন্না ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান হোমি শেঠনার ছবি দেখা গেল পোখরানে, যেখানে ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণটি ঘটেছিল। রমন্না দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আমরাও পারি পারমাণবিক শক্তিধর জাতি হতে।
সে বার ভারতে অসামান্য পারমাণবিক সাফল্যের পর ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন রাজা রমন্নাকে তাঁর দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সব আলোচনা হওয়ার পর ওঁকে নিয়ে এলেন ইরাকি পারমাণবিক কর্মস্থল তোয়াইথাতে। সরাসরি প্রস্তাব দিলেন— ‘তুমি আমার এখানে থেকে আমার দেশকে পারমাণবিক স্বয়ম্ভর করে তোলো। অর্থের কোনও অভাব হবে না।’
হোটেলে ফিরে সে রাতে আর ঘুম এল না। সারা রাত বিছানায় ছটফট করলেন। এবং তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন। ‘ব্যাক টু ইন্ডিয়া বাই দ্য ফার্স্ট ফ্লাইট’। নীতির প্রশ্নে কোনও আপস তিনি করেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy