স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে গম্ভীর, শান্ত গলায় যে কথা শোনালেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি রাশভারী, সবাই জানি। উন্নাসিক অপবাদও ছিল। কিন্তু কথা বলতে শুরু করলেই ম্লান হয়ে যেত সে সব। মোহিত হয়ে যেত বাঙালি তার কণ্ঠস্বরে। অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেনই না। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর মতো তিনিও আর-এক বসু, যিনি কদাচিৎ হাসতেন। কিন্তু অজয়দা আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে দাদা হয়ে উঠেছিলেন। অভিমান শব্দটা অজয়দার অভিধানে ছিল না। অজয় বসু একটি বাক্যে হাজার শব্দের সারাংশ সেরে ফেলতেন। যেমন যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে দিন স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়েই বলে বসলেন, “আমাকে আর কমেন্ট্রি করতে ডেকো না।” আকাশ থেকে পড়লাম আমরা। অজয়দা এ কী বলছেন? বাংলা ধারাভাষ্যের জনক অজয় বসুর ধারাভাষ্যে আপত্তি? টিভিতে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেছে। ফুটবল নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে একটি বাংলা সিরিয়ালের আশা জেগেছিল অজয়দাকে কেন্দ্র করে। তাঁর ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি বেশি বাক্য ব্যয় করা সহজ নয়। তবু বললাম, “তা হলে কী হবে অজয়দা! ওরা অনেক আশা নিয়ে...” কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, “তুমি করে দাও। আমার দ্বারা এ সব হবে না।” বললাম, “অত্যন্ত কঠিন কাজের দায়িত্ব আমায় দিয়ে গেলেন অজয়দা।” অজয় বসু তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বললেন, “ভালই তো। তোমাদের সাধনা কত। নতুন প্রজন্মই পারবে নতুন পথ খুঁজে বার করতে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার চাহিদার তফাত হয়ে গেছে।”
প্রথম পর্বের পর সত্যিই অজয় বসু আর এলেন না। আমাকে একাই পরবর্তী পর্বগুলোতে কমেন্ট্রি করতে হল। উনি নিয়মিত শুনতেন। জানতে চাইলে সব সময় উৎসাহ দিতেন। উনিই শিখিয়েছিলেন, মানুষ যে ভাষা শুনতে অভ্যস্ত, যে ভাষা বোঝে, সে ভাষাতেই ধারাবিবরণী দিতে হয়।
আকাশবাণীতে অজয়দার সান্নিধ্যে এসেছি ১৯৭৫-এ। সে সময় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের ক্রীড়াবিভাগ ধারাভাষ্যকারদের মান বাড়াতে প্রায়ই সেমিনারের আয়োজন করে অজয়দাকে আমন্ত্রণ জানাত। তাঁর কাছেই শিখেছি বাংলা ধারাভাষ্যের ইতিহাস, পদ্ধতিগত পরিবর্তন, বর্তমান প্রজন্মের ভাল মন্দ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যে বাংলার প্রথম ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার সেটা আমরা জেনেছি অজয়দার কাছ থেকেই। তিরিশের দশকে একটি খেলার ধারাবিবরণী দিয়ে এসে স্বনামধন্য সেই কথক নাকি বলেছিলেন, “জীবনে লুডো পর্যন্ত খেলিনি। ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে হাস্যাস্পদ হয়ে ফিরে এলাম।”
চল্লিশের দশকে এক জন খেলোয়াড়কে দিয়ে চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাঁর ধারাভাষ্যে ইংরেজি শব্দের আধিক্য থাকায়। ১৯৫৭ সালে অজয় বসু এবং পুষ্পেন সরকারের জুটি একটি ক্রিকেট ম্যাচের কমেন্ট্রি করে সাফল্যের পথ দেখান। সেটাই বাংলা ধারাভাষ্যের প্রথম প্রচলন বলে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৫৯-এ ইডেনে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচে অজয় বসুর সহযোগী হিসাবে আনা হয় প্রখ্যাত ক্রিকেটার কমল ভট্টাচার্যকে। অজয় বসুর ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠস্বর, কমল ভট্টাচার্যর নাটকীয়তা, পুষ্পেন সরকারের তথ্যতালাশ— এই ত্রয়ী বাংলা ধারাভাষ্যের জগতে বহু দিন বিচরণ করেছে। এঁরা রেডিয়োর সামনে খেলাটাকে জীবন্ত করে তুলতেন। মানুষ কান দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেত মাঠটাকে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ থাকলে বাজারে রেডিয়ো সেটের হাহাকার পড়ে যেত সেই সময় এঁদেরই জন্য। ধারাভাষ্যের জগতে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া এই ধারাভাষ্যকাররা নিজেদের এমন পর্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, মানুষ তাঁদের আসল পরিচয় ভুলেই গিয়েছিল। ধারাভাষ্যকার অজয় বসুর কাছে ম্লান হয়ে গেছে প্রখ্যাত ক্রীড়াসাংবাদিক ও সম্পাদক অজয় বসু। বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম বোলার হিসাবে শতাধিক উইকেট পাওয়া কমল ভট্টাচার্যকে কে আর ক্রিকেটার হিসাবে মনে রেখেছে? সেমিনারে বা সাক্ষাৎকারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অজয়দা বলতেন প্রশংসায় আপ্লুত না হতে, সমালোচনা বা নিন্দেয় হতাশ না হতে— “আমরা পারফর্মার। আমাদের শুধু পারফরম্যান্সের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।”
অজয় বসুর প্রতিটি শব্দ চয়নে ছিল তার গভীর চিন্তার ছাপ। অজয়দাকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধারাভাষ্যের নানা দিক খুলছে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে... কিন্তু মানুষ এই পরিবর্তনটাকে গ্রহণ করতে অনীহা দেখাচ্ছেন। অজয় বসু না থাকলে রেডিয়ো বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ যেন মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র না থাকার যন্ত্রণা। অজয়দা মানতে চাইলেন না৷ বললেন, “অনন্তকাল ধরে পর্দায় সুচিত্রা-উত্তমকে খুঁজলে তো চলবে না। নতুনদের গ্রহণ করতে হবে। তাদের সমস্যাটা জানতে হবে। আমাদের কাজ ছিল শ্রোতাদের তাঁদের কান দিয়ে মাঠের ছবিটাকে দেখানো। এখন টিভির দৌলতে তাঁরা চোখ দিয়েই সেটা দেখতে পাচ্ছে। আরও বেশিই দেখতে পাচ্ছেন। মাঠের মধ্যে রেডিয়োর মাইক্রোফোন নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ক্যামেরা ঢুকে যাচ্ছে। রেডিয়ো, দূরদর্শনের মতো সরকারি সংস্থার অনেক বিধিনিষেধ আছে। মাঠের মধ্যে গোলযোগ, রেফারির ভুল সিদ্ধান্ত-সহ অনেক কিছুই ধারাভাষ্যকাররা বর্ণনা করতে পারেন না, যা প্রাইভেট টিভি চ্যানেল অনায়াসে জনসমক্ষে তুলে ধরছে।” জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে অজয় বসুকে। মসৃণ ছিল না সে পথ। সমালোচনায় বার বার বিদ্ধ হয়েছেন। নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। বলেছেন, “সবে তখন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ক্লাব বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য আমার ডাক পড়ল। আমাদের যা যা করতে হয় আগেভাগে তাই করলাম। তথ্য, কর্মসূচি হাতে পেয়ে সংগঠকদের কাছে জানতে চাইলাম এখানে স্বদেশি সঙ্গীত লেখা আছে। জাতীয় সঙ্গীত হবে তো! তারা বুঝিয়ে বললেন, এটা ক্লাব স্তরের টুর্নামেন্ট। তাই স্বদেশি সঙ্গীত। আন্তর্দেশীয় হলে জাতীয় সঙ্গীত হত। জেনেবুঝে আমি তো সময় মতো বলে বসলাম, এ বার স্বদেশি সঙ্গীত হবে। দেখলাম তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি মাননীয় ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদ-সহ সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়েছেন। বুঝলাম গোলমাল করে ফেলেছি। জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে। শব্দ তো ব্রহ্ম। তার বিনাশ নেই। পরের দিন এক ইংরেজি দৈনিক লিখল, জাতীয় সঙ্গীতকে স্বদেশি সঙ্গীত বলে, এমন অর্বাচীনকে কেন ধারাভাষ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? কাকে বোঝাব যে, এই বেচারি পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়েছিল! বোঝার দায় অন্যেরা নেবেই বা কেন? মাথা নিচু করে সবটা হজম করতে হয়েছিল। অনেকে হয়তো মজা পেয়েছিলেন কিন্তু আমি পাইনি।” খেলোয়াড়দের কোচিং সেন্টার আছে। ধারাভাষ্যের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। ধারাবাহিকতার অভাবে ধারাভাষ্যকারদের মানের উন্নতিও সম্ভব নয়। অজয়দা বলতেন, “কথা দিয়ে ছবি আঁকতে গেলে প্রচুর হোমওয়ার্ক দরকার। রং-পেনসিল দিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকার চেয়েও কঠিন। প্রত্যেকের কথা বলার ধরন আলাদা। এক-এক জনের মুখে এক-এক শব্দ মানায়। শব্দ চয়ন ধারাভাষ্যকারকেই করতে হবে।” উদাহরণ দিয়ে বললেন, “এক বার খেলোয়াড় তালিকায় নাম দেখলাম, টি এস মুখোপাধ্যায়। মনে হল টি এস এর সঙ্গে মুখোপাধ্যায় মানাচ্ছে না। মুখার্জি-টা বেশ লাগছে। তা-ই বললাম। লেগে গেল।”
একটা সময় প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের দিয়ে ধারাভাষ্য দেওয়ার আগ্রহ দেখা গেল আকাশবাণীর। দু’এক জন ছাড়া প্রায় সকলেই ব্যর্থ। তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন অজয়দা, “খেলোয়াড়রা খেলাটাকে কিংবা খেলোয়াড়দের মানসিকতাটা ভাল বোঝেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খেলাটার যথাযথ পর্যালোচনা না করে তারা নিজের অভিজ্ঞতা জাহির করে ফেলছেন অতিমাত্রায়। পরিবেশ, প্রতিপক্ষ, পরিবর্তিত সিস্টেম সব কিছু নিজের সময়ের সঙ্গে গুলিয়ে তার মূল্যায়ন করছেন। অনেকে আবার মাঠের খেলোয়াড়টির সম্পর্কে কটূক্তি করতেও ছাড়ছেন না। আমি বড় খেলোয়াড় হতে পারি, কিন্তু বক্তব্যে শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে কেন? আবার অনেক খেলোয়াড় পক্ষপাতদুষ্ট। ধারাভাষ্য দিতে গেলে নিজের পছন্দের দল থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে শ্রোতা বিরক্ত হবেনই।”
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমবয়সি অজয় বসু মোহনবাগান সমর্থক হলেও তা লুকিয়ে সারা জীবন ধারাভাষ্য দিয়ে গেছেন। যা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি কমল ভট্টাচার্যও। ১৯৬৫ সালে মোহনবাগান-রাজস্থান লিগ ম্যাচে কমল ভট্টাচার্য রেডিয়োতে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে বলে বসলেন, “সর্বনাশ! মোহনবাগান গোল খেয়েছে।” ধারাভাষ্য জগতে পিটারসন সুরিটার মতো বড় মাপের ধারাভাষ্যকারও পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। মোহনবাগান-প্রীতি তাঁর ধারাভাষ্যে প্রায়ই প্রকাশ পেত। চুনী গোস্বামীকে ‘এভারগ্রিন’ উপাধিটা বার বার রেডিয়ো থেকে প্রচার করতেন আবেগ থেকেই। খুব কম ধারাভাষ্যকারই অজয় বসুর মতো ধারাভাষ্যে সংযম দেখাতে পেরেছেন।
শুধু রেডিয়োই নয়, দূরদর্শনেও খেলার বাংলা ধারাবিবরণীর প্রথম ধারাভাষ্যকার অজয় বসু। তবে রেডিয়োতেই ধারাভাষ্য দিতে যে তিনি বেশি পছন্দ করেন, বার বার সে কথা বলেছেন। ক্রিকেট না ফুটবল, কোন ধারাভাষ্যে নিজেকে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন? প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বললেন, “দুটো খেলার গতি দু’রকম। ফুটবল যদি ছোটগল্প হয়, তো ক্রিকেট উপন্যাস। ক্রিকেটে ভাষার বিন্যাস গুছিয়ে ভেবেচিন্তে করা যায়, আর ফুটবলে বাক্যের জন্ম দিতে হয় দ্রুত। তবে তফাতটা কোথায় জানো? লেখকের পেন, কাগজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। বার বার বদলে নিতে পারে। আর ধারাভাষ্যকাররা নির্ভরশীল নানা জন, নানা যন্ত্রের ওপর।” প্রসঙ্গ টেনে অজয়দা বললেন, “ক্রিকেটে অনেক খুঁটিনাটি নিয়ম-কানুনের মধ্যে টসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার। টসের ওপর নির্ভর করে কে আগে ব্যাট নেবে, পিচের অবস্থা কেমন, সব জানা যায়। ইডেনে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ম্যাচ। আমি তো টসের কথা উল্লেখ করলাম। প্রথমেই যন্ত্র গেল বিগড়ে। আমার কথা শ্রোতাদের কানে গেল না। আমি জানতেও পারলাম না ব্যাপারটা। যন্ত্রের ত্রুটি আমার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিল। পরের দিন সংবাদপত্রে যথারীতি আমায় গালাগাল। লিখল, যিনি টসের গুরুত্ব বোঝেন না, তাকে নিল কেন? সারা দিন ধরে টসের জয়-পরাজয়ের খবর তো আর প্রচার করা যায় না। আমিও করিনি। নিজের দোষ না থাকা সত্ত্বেও সবার গালাগাল, সমালোচনা আমায় সহ্য করতে হল। তবে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন আছে। মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হওয়া যায়। পরবর্তী পর্যায়ে অনেক সতর্ক করে দিয়েছে আমাকে ওই সব ঘটনা।”
অজয় বসু শুধু ভাষার কিংবা খেলার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণেই নক্ষত্র হয়ে যাননি। ধারাভাষ্যের টেকনিকের জনকও তিনি। টেকনিকটা কী? ধরুন মাঠে কোনও ফুটবলার কর্নার, থ্রো বা পেনাল্টি নিতে যাচ্ছেন। বৃষ্টি বা অন্য কোনও কারণে ভাল দেখা যাচ্ছে না। কে কিকটা নিতে যাচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে না। ধারাভাষ্যকারকে তো আর মাইকের সামনে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। সেই সময়টুকুর মধ্যে অজয়দা চলে যেতেন মাঠের পরিবেশ, খেলার বর্তমান অবস্থান, আবহাওয়া বা তথ্যের পরিসংখ্যানে। অপেক্ষা করতেন সহযোগী ধারাভাষ্যকারের সহযোগিতার জন্য। কিন্তু যেখানে এই সুযোগটুকু নেই? বল মাঠে ঘোরাফেরা করছে, সেই অবস্থায় তো গ্যালারির বর্ণনায় যাওয়া যাচ্ছে না, তখন? অজয়দা টেনে দিতেন তাঁর বাক্যটা। “ওই-দূ-র-র অঞ্চলে ব-ল-ল-টা চলে গে-ছে...” এই ভাবে। ওই একটা দীর্ঘায়িত বাক্যের মধ্যে বল তত ক্ষণে তিন জনের পা ঘুরে গেছে।
“আসলে খেলা বিষয়টাই তো মজা। বিল লরির নেতৃত্বে ইডেনে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টেস্ট। আমায় ধারাভাষ্য দিতে হবে। তৈরি হচ্ছি ইডেনের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ ফোন এল বাড়িতে। ইডেনের গেটে ঝামেলা হয়েছে। কয়েক জন নাকি মারা গেছে। ধারাভাষ্যকারদের তখন বিধানসভার উল্টো দিকের গেট দিয়ে ইডেনের ভেতরে ঢুকতে হত। গন্ডগোলটা সেই গেটের কাছেই হয়েছে। আমাকে তো যেতেই হবে। আমি আকাশবাণীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। দুরুদুরু বুকে গিয়ে পৌঁছলাম। দেখি সব শুনশান। গেটের কাছে জল ঢালা শুধু। পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা আকাশ থেকে পড়ল। আমিও নিশ্চিন্তে কমেন্ট্রি বক্সে পৌছে ধারাবিবরণী দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরের দিন কাগজ দেখেই অবাক হওয়ার পালা। গন্ডগোলের খবরটা ঠিকই ছিল। ছ’জন মারাও যায় সেখানে। শতাধিক সমর্থক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। যে জলের কথা বললাম, সেটা পুলিশই রক্ত ধুয়ে দিয়েছিল। শীর্ষস্থানীয় এক দৈনিক আমাকে তীব্র আক্রমণ করে লিখল ছয়-ছয় জন মানুষ যে ম্যাচে মারা গেল, সেই ম্যাচের ধারাভাষ্যকার গদগদ ভাবে হাসি-হাসি মুখে দিব্যি ধারাবিবরণী চালিয়ে গেলেন! কোনও আবেগ বা আবেদনের লেশমাত্র নেই তার বক্তব্যে? বোঝো! খেলা চলল। হাজার হাজার মানুষ উপভোগ করল। সংগঠক, প্রশাসন কেউ দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করল না, আর যত দোষ ধারাভাষ্যকারের। যে ঘটনা জানতামই না, তার শিকার হয়ে গেলাম। ধারাভাষ্যটা আমার কাছে মজার পরিবর্তে সাজা হয়ে গেল।”
৩ অক্টোবর ১৯২০ অজয় বসুর জন্ম। তাঁর জন্মশতবর্ষে এ বছর কিছুটা মাতামাতি হয়েছে। স্মৃতিচারণা হয়েছে সংবাদপত্রে, রেডিয়ো-টিভিতে। মূলত ধারাভাষ্যকাররাই তাঁদের পথিকৃৎকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন। গ্যালিফ স্ট্রিটের সিটি কমার্স কো-অপারেটিভ হাউজ়িং সোসাইটি তাঁর ছবিতে মালাও পরিয়েছে। কিন্তু তাঁর শিল্পী সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখবে কে? ২০০৪ সালে ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত অজয় বসু শেষ জীবনে খুব কষ্ট পেয়েছেন। গত বছর প্রয়াত তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি বসু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কেউ ওঁকে মনে রাখল না। সত্যিই তাই। যে রেডিয়োয় বাংলায় ধারাভাষ্য দিয়ে তার উত্থান, তার যবনিকা পড়ে গেছে বহু দিন আগেই। এ লজ্জা আমাদের সকলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy