মণিকাঞ্চন: বর্ষার চিরন্তন সমন্বয় ইলিশভাজা আর খিচুড়ি। Sourced by the ABP
‘না, স্বর্গ কোথাও-নেই, কিন্তু এখানে আছে মাহ ভাদর গঙ্গা,
জালে মসৃণ পেপারব্যাকের মতো রুপো-চিকচিকে ইলিশ…’
কলকাতার গঙ্গায় শেষ বর্ষার ইলিশ ঝাঁককে মসৃণ পেপারব্যাকের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বিদগ্ধ কবি অধ্যাপক। আবার অন্য এক সুরসিক, কবি, গদ্যশিল্পী, অধ্যাপিকার কূট প্রশ্ন, এমন কোনও কবি কি আছেন, জোড়া ইলিশের বদলে জোড়া কবিতার বই পেলে যিনি সুখী হবেন? জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং নবনীতা দেবসেন, দু’জনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর এক যাদব-কুলপতি বুদ্ধদেব বসুর ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ উপাধিটির চেয়ে চিকচিকে মসৃণ পেপারব্যাকের উপমাটিই স্মার্ট নাগরিক কেতাদুরস্ত। কালচারাল ক্যাপিটালের শ্লাঘাও তাতে জড়িয়ে। কলকাতার ঘাট এক দিন কার্যত ইলিশ শূন্য হবে, তা কে-ই বা ভেবেছিল। ইলিশ আর কালচারের খরা দুটোই দুঃখবাদী বাঙালির বুকে বল্লমের ফলার মতো বেঁধে।
জোড়া ইলিশের কথায় ‘বাঙালদের বাড়িয়ে বলার অভ্যাস’ নিয়ে বেঙ্গালুরু-নিবাসী জনৈক কৃতী বরিশাইল্যা বাঙাল আমায় সাবধান করেছিলেন। বরিশাল টাউনে দক্ষিণ পটুয়াখালি থেকে নৌকায় উজিয়ে ইলিশ আসত! যতই সস্তা হোক, জোড়া ইলিশ ঝুলিয়ে বীরদর্পে গৃহপ্রবেশ তখনও সোজা ছিল না! তবে পশ্চিমবঙ্গের আদরের ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সূতিকাগার কুমোরটুলি পার্কে ভাগ্যকুলের রায় মানে পঙ্কজ রায়দের বাড়ির আত্মীয়মহলে আমি এমন গুরুতর অভিযোগের প্রতিবাদও শুনেছি। এলগিন রোডে বসত, ভাগ্যকুলের রায়কুলের বেণীমাধব রায় বুঝিয়েছিলেন, "আমাদের আত্মীয়কুটুম্ব, পাড়াপড়শি, আশ্রিতের ফুল ফ্যামিলির সরস্বতী পুজোয় ট্যালটেলে তেল, হলুদের ঝোলের সঙ্গে একটা গরগরে কিছুও চাই। তিন-চার জোড়া ইলিশও লেগে যেত!”
মনে পড়ল, এই ঘটির দেশেও আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বছরের প্রথম ইলিশকে তেল-সিঁদুর লেপে কনেবৌটির মতো রান্নাঘরে নোড়ার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত। এর কয়েক টুকরোও পাড়ার সব মন্দির, কুলগুরুর কাছে না পাঠিয়ে কত্তাগিন্নি বর্ষার ইলিশ দাঁতে কাটবেন না! হাটখোলার দত্তবাড়িতে তিন দশক আগে পর্যন্ত এ ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। জামাইবাড়িতেও আষাঢ়ে ‘ইলিশ তত্ত্ব’ যেত। সে ইলিশ, সেই সাইজ়, সুরভি বা সোয়াদ আজ লোকগাথার উপাদান! বন্ধুজন বছর চল্লিশ আগে সিলেট না বরিশালে সান্ধ্য বাজারে যে দৈত্যাকার আড়াই কেজির ইলিশের কিসসা বলেন, তার স্বাদও পৃথিবী থেকেই উধাও। তাই কী যেন বলে… অন্তর্ধান পটে হেরি তব রূপ চিরন্তন।
বছর কুড়ি পিছনে রথযাত্রারও ঢের আগে পার্ক স্ট্রিটে পেটমোটা ইলিশের সহাস্য ছবি ঝুলিয়ে নামজাদা রেস্তরাঁর হোর্ডিং পড়ত। বর্ষা মানেই স্মোকড বা গ্রিলড ইলিশের বোধন। ১৯৯০-৯১ নাগাদ কলেজ স্ট্রিটের পাইস হোটেলের মেনুতে ভরপুর কেজি দুয়েকের ইলিশ। তার তেলালো পেটির সাইজ় আজকের গাদা-পেটি মিলিয়ে কাটা পিসকেও ছাপিয়ে যাবে। তবে দক্ষিণা বড়জোর টাকা দশেক। ভরা শ্রাবণে এ লেখা পাতায় ওঠার সময়েও বাজারে কাঁচা ইলিশের জোগান অনিয়মিত। জুটলেও সে-কালের পাশে লিলিপুট। বেঙ্গল ক্লাবের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজার সুনীতকুমার মণ্ডল থেকে লেক মার্কেটের পোড়খাওয়া অজিত মাইতি ভরা সিজনেও বিশ্বস্ত হিমঘরের ফসলেই বেশি ভরসা রাখেন। বর্ষাকালীন ইলিশ পুজোর আদিখ্যেতা তাই এ যুগে অবান্তর।
বাল্যপ্রেমের মতো বাঙালির বর্ষাতেও অভিশাপ। গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে নোয়াখালি গিয়ে গঙ্গার প্রান্তদেশের ঐশ্বর্যময় জলোচ্ছ্বাস দেখে হতভম্ব হয়েছিলেন উত্তর ভারতের কোনও কোনও কংগ্রেস নেতা। তাঁদের মনে হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশের গঙ্গাতীরের থেকে কত না আলাদা এই বঙ্গভূমি! বাংলা ভাগের পরিণামও কি তখনই অনিবার্য হয়ে ওঠে? দেশভাগের প্রকৃত কারণ কাটাছেঁড়ার পরিসর এ লেখায় নেই। তবে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার বর্ষার মহাসমারোহ থেকে ইলিশের গতিপথ দু’টি দিকে বেঁকে যাওয়ার বেদনা উথলে ওঠা বেয়াদবি হবে না। ও পার বাংলার কিংবদন্তিপ্রতিম বর্ষা এ পারে কোথায়! গোয়া, বম্বের বৃষ্টি-রোম্যান্সেও এ বাংলা বঞ্চিত। বাজারফেরত মেঘলা দেখে পুঁইশাক দিয়ে ইলিশ মুড়োর কাঁটা চুষবেন ভেবে হৃদয় পুলকিত, আর চান করেই দেখলেন খটখটে রোদ! ‘রিমঝিম গিরে সাওন’-এর সুরে ভিনটেজ বম্বের সমুদ্র-সরণিতে অমিতাভ-মৌসুমি হয়ে পদচারণায় হিল্লোল তোলার স্বপ্নও কি আর সফল করতে পারে কলকাতা! এখানে বাসস্ট্যান্ডের আবছায়ায় প্রেমিক-প্রেমিকার ঠ্যাং টেনে ধরে জলকাদা মাখা দেদার!
প্রাক-ফ্রিজ় যুগের দামাল বর্ষায় বাজার করা শিকেয় তুলে, দিনের পর দিন নিরুপায় হয়ে সজনেডাঁটা চিবোনোরও স্মৃতি আছে এই শহরের। কল্যাণী দত্তের লেখায় পড়া মেয়েমহলের ছড়ায় সেই সজনেডাঁটাকে ‘আ মরি সজনে খাড়া’ বলে শুধিয়ে পরম আদরে ‘অসময়ের ঘরুনি, মাথায় ছাতা ধরুনি’ খেতাব দেওয়া হয়েছে! তেমন বর্ষা হলে অ্যাপ-চালিত ডেলিভারি পার্টনারেরাও বাজার ঘাড়ে আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারবেন না! বিচক্ষণ গৃহস্থ এটা বোঝেন! পুববঙ্গের গাঁয়ে বর্ষার জন্যই ঘরে ঘরে শোল মাছের শুঁটকি, চালে মিষ্টি কুমড়ো সঞ্চিত থাকত। চাটগাঁর গৃহিণী সু-রাঁধুনে রোকসানা ভাবির মতো কেউ কেউ চিংড়ি মাছের মুড়া ভাজার বয়ামটাও মজুত রাখেন। ‘গুড়া’ করে পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, ধনে, ‘সরিষার ত্যালে মাইখ্যা’ মুগডালের সঙ্গে খেতে মজাদার! আবার কলকাতার চিনা গিন্নিরা সেই শীতের শেষ থেকেই হ্যামচয় বা সর্ষেশাক নুন মাখিয়ে ভিনিগারে মজিয়ে রেখেছেন। বর্ষায় বিস্তর কাজে লাগে।
এ শহরের জনৈক বরণীয় কেক-প্যাটি বিশারদ ডেবরা সালদানহার কথাও বলতে হয়। উত্তর গোয়ার সালিগাওয়ে ওঁদের ‘দেশ’! ভরা বর্ষার কলকাতায় বসেও ডেবরাদের ভাঁড়ার থেকে বেরোবে গোয়ার ভিনিগার-স্নাত পারা মাছের মোরব্বা, কয়েক মাস পর্ক ফ্যাটে জারিত সুরক্ষিত সসেজ, চিংড়ি-শুঁটকি থেকে শুকনো ঢেঁড়শ, কাঁচা আপেলের টক-টক পিকল।
গোয়ায় গ্রীষ্মের ‘চার্চ ফিস্ট’ উপলক্ষে চাষিদের বাজার বসে। তখনই প্রবল বর্ষার রসদ সংগ্রহ শুরু। শুকনো মাছ, নানা কিসিমের আচারাদি ডেবরারা 'দেশ' থেকেই নিয়ে আসেন। স্যাঁতসেঁতে দিনে ট্যালটেলে খিচুড়ির গোয়ান সংস্করণ ব্রাউন রাইসের পেজ়-এর সঙ্গে এ সব উপাদান জমবেই!
আজকের বাঙালির ভুবনটাও বিস্তারে জাঁকালো। বর্ষায় স্রেফ তেলেভাজা, খিচুড়িতেই মন ভরে না। আমার মতো অনেক বঙ্গসন্তানই আর ‘বার্মার ঙাঁপ্পিতে বাপরে কী গন্ধ’ বা ‘মাদ্রাজি ঝাল খেয়ে জ্বলে যায় কণ্ঠ’ বলে কাতর হন না। তাই কখনও মনে হয় বৃষ্টিদিনে খিচুড়ির বদলে বর্মামুলুকের ‘ওয়ান পট মিল’ নারকোলের দুধ, গমের নুডলসের বাটি ‘ওউনো খাউসোয়ে’ পেলে দুপুরটা মহিমান্বিত হত। রকমারি মাছ, মাংস, শুঁটকি যোগে বিশেষ মশলায় সুরভিত এই থকথকে বস্তুটি হাপুস হুপুস করে সাবড়াতে মুখিয়ে থাকি। অঞ্জন দত্তের স্ত্রী ছন্দার ছোটবেলা সাবেক বর্মার শৈলশহর টাউনজিতে কেটে ছিল। বর্মার বিখ্যাত শুঁটকি ঙাঁপ্পি (নাপ্পি) এবং রকমারি মশলা আনিয়ে এ মরসুমে বেনেপুকুরের বাড়িতে তিনি আকছার বন্ধুজনকে ভোজ খাওয়ান!
খিচুড়ির সঙ্গতে পাতলা বেগনির বদলে কখনও বা কুর্গ উপত্যকার টকটক পর্ক পিকল, বা 'এন্টালি সসেজে'র জন্যও প্রাণটা আনচান করে। সসেজের এই তেলঝালের সঙ্গে একমাত্র ইলিশের নিজস্ব তেলে ভাত মেখে খাওয়ার তুলনা চলতে পারে। চর্বি ও মাংসকুচির চমৎকার মিশেলে অপূর্ব মশলা ছড়ানো এই সসেজও নিজস্ব তেল বিচ্ছুরণেই আপন আলোয় উদ্ভাসিত।
খিচুড়ির কথায় বাঙালির আইকনিক রান্নাপটীয়সী প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর উপদেশটাই শিরোধার্য, “ভুনি খিচুড়ি বিশেষত ডিমের আমলেট, কান্ট্রিকাপ্তেন, ক্রাম দিয়া মাছ ভাজা, শুঁটকি, মেটে ভাজা প্রভৃতি শুকনা শাকনা দিয়া খাইতে ভাল!” এক কালে বাংলা ছবিতে পার্শ্বচরিত্রদের অভিনয়ের দাপটে যেমন নায়ক-নায়িকাকেও ফিকে লাগত, খিচুড়ির সঙ্গীসাথীরা তেমনই মাঝেমধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের ‘খিচুড়ি’ কেজুরি বা কেডিগ্রির ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটে থাকে। খিদিরপুরের সাবেক রেল কলোনির মেয়ে, অধুনা পিকনিক গার্ডেনবাসী ডেনিস অ্যান্টনি খিচুড়ি-গত-প্রাণা। সঙ্গতে মাংসের কিমা ভরা ‘আলু চপ’, মাংসের পুর ঠাসা পাটিসাপ্টার মতো বিফ প্যান্ত্রাস থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের প্রবাদপ্রতিম ঝালফ্রেজ়ি-ও তাঁর আস্তিনের টেক্কা। ডুমো ডুমো কাটা আলুর সঙ্গে টুকরো টুকরো মাংসের গা-মাখা কাই, চেটেপুটে খেতে হয়। কাইয়ে কুচো পেঁয়াজ, আদা, লঙ্কাকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বলেন ‘কাটা মসালা’! বাদলা রাতে দুপুরের উদ্বৃত্ত ঝালফ্রেজ়ি আবার তাঁরা সুসিদ্ধ ম্যাকারনির সঙ্গে টমেটো কেচাপ মিশিয়ে মেরে দেবেন! এখানে বলে রাখি, ইলিশের সঙ্গে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ ইত্যাদির সহাবস্থান দীর্ঘ দিন পর্যন্ত হিঁদু বাঙালি ঘোর অধর্ম বলে ধরলেও, ইলিশের ঝালফ্রেজ়ি-ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা বাঙালি খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরল নয়। বন্ধুজন শেফ প্রদীপ রোজ়ারিওর মা ভেরোনিকা ওরফে আহ্লাদীদেবীর হাতের এ রান্নাটিও একদা চেখে আমোদিত হয়েছিলুম!
দিনগুলি কুড়োতে হারানোর ভারটিও বর্ষায় কম নয়। লালবাজারের কাছে মৌরলা ভাজা খ্যাত ‘মন্টিকার্লো কাফে’য় হুইস্কির সঙ্গী গরগরে চিলি মাটন মিলবে না! উৎকলীয় শেফ আব্বাস রিটায়ার করেছেন। কলেজ স্ট্রিটের কালিকায় মাছের চপ, কাটলেট, ডেভিলরা থাকলেও পেঁয়াজি, বেগুনি, আলুর চপ, ফুলুরি বিদায় নিয়েছে। কোথাও আবার বদল পাড়ার চরিত্রেই! লক্ষ্মীনারায়ণের নিরিমিষ তেলেভাজায় কামড় দিয়ে সেকেলেরা এক বারটি অন্তত উল্টোফুটে রংমহল কাঁপানো জহর রায়ের কথা ভাববেনই! ডবল শোয়ের ফাঁকে লক্ষ্মীনারায়ণের তেলেভাজা ছিল তাঁর নিত্য ভোজ্য। জহর রায়ের ছড়া “চপ খাব আস্ত/ তৈরি করব স্বাস্থ্য/ বেগুনি খাব গোটা/ আমরা হব মোটা…” এ পাড়ায় এখনও মুখে মুখে ফেরে। তবে রংমহল, বিশ্বরূপার তল্লাট জুড়ে এখন সুউচ্চ বহুতলের আস্ফালন।
আষাঢ় গড়িয়েও কলকাতার এ বারের গ্রীষ্মের তেজটা কমছিল না। তার স্তিমিত হওয়ার আভাস মালুম হল, পাড়ার কচুরি-শিঙাড়ার দোকানকে দেখেই। তিথিডোরের স্বাতীর নবীন চোখে এ কলকাতার বর্ষার সমারোহের প্রতিটা পরত ঘাসের ঘন হওয়া, গাছপালার বেড়ে ওঠা, মাটির সুখ, শিকড়ের খুশি সব ধরা পড়ত। আর আমাদের লোলুপ মধ্যজীবন রক্ষাকালী ভান্ডারে স্লিম বাঙালি শিঙাড়ার কড়া কত বার ফসল নামাচ্ছে নজর রাখে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কথিত সেঁকা ডালপুরি শহর থেকে প্রায় উবে গেছে, তবু সপ্তাহান্তে দেরিতে বাজার সেরেও লেক মার্কেটের কাছে সাউয়ের খুপরি দোকানে থমকে দাঁড়াই! রাধাবল্লভী ও কচুরির মাঝামাঝি ভুজ্যিবস্তুটি আলুর ঝোলে টক-মিষ্টি আচার ছুঁইয়ে চাখতে বাজারের না-ধোয়া ইলিশ-হাতেই তৎপর হয়ে উঠি!
অর্ধ শতক আগে ফার্পো-কোয়ালিটি শাসিত কলকাতার অফিসপাড়ায় ‘এমন কিছু লম্বা ফরমায়েশ নয়’ বলে একটি পরম কাঙ্ক্ষিত লাঞ্চের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তাতে ছিল কাঁচা পেঁপের সঙ্গী সেই স্বর্গীয় খাদ্য, প্রোটিনপূর্ণ ইলিশের ডিমের ডালনা— এ কলকাতার অভিজাততম ক্লাব, পাঁচতারাও যা আজ সহজে মেনুতে রাখতে পারবে না! কলকাতার সেই ইলিশ-প্রাচুর্য আজকের মাঝ-চল্লিশদেরও স্মৃতিতে ধূসর! বর্ষাদিনে তাই মনে মনে হেঁটে যাই কস্তুরী হোটেলে বাবলু সাহার কাচের ঘরটিতে। স্বর্গগত বাবলুবাবু তখনই অসুস্থ! মিতাহারী। কিন্তু পরম স্নেহে পাতে বেড়ে দিয়েছিলেন ইলিশের ডিম, লুকার পাতুরি। পদটি আদতে ডিম ও ইলিশের তেলের পুঁটুলি ‘লুকা’র গরগরে কষা! লুকা কষতে গিয়ে ফাটলেই রান্না পণ্ড! দু’-চার জনের জন্য এই রান্না ঠিকঠাক বানাতেই চারটে লুকা লাগবে, অর্থাৎ উচ্চাঙ্গের গোটা চারেক ইলিশ। বর্ষায় নদীর অফুরান মাছের তেল, ডিমের সদ্ব্যবহার করেও খেয়ে কুলোনো যেত না বলেই এমন সৃষ্টির নামডাক ছড়িয়েছিল।
বেঙ্গল ক্লাবের প্রখ্যাত স্মোকড হিলসাতেও প্রায় অর্ধেক মাছ ফেলা যায়। ইদানীং এই আর্ট যাঁর হাতে নিয়মিত খুলছে, বনগাঁ লাইনে বাগদার সিন্দ্রানীর ভূমিপুত্র জয়ন্ত রোজারিও একনিষ্ঠ শিল্পী। ‘এসমোক ইলিশ’ আর ভাপা ইলিশ ছাড়া জীবনে কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্লাবের গন্যিমান্যিদের পাতে পরিবেশনের উপযোগী পুরু ফিলে কাটতে এবং কাঁটা ছাড়াতে মাছের অনেকটা বাদ পড়লেও সেই বাতিল ইলিশের টুকরোটাকরা কাঁটাসুদ্ধ ফুটিয়ে একটা সস তৈরি করেন জয়ন্ত। ইলিশ-স্বাদ অটুট রাখতে যা স্মোকড মৎস্যখণ্ডে মাখানো দস্তুর। জার্মান না ডেনিশ স্মোকিং চেম্বারে খাস ইউরোপজাত মহার্ঘ ওক কাঠের গুঁড়োয় ইলিশ ধূমায়িত হয়। এই আকালেও ইলিশের এই উৎকর্ষটির সৃষ্টিতে বেঙ্গল ক্লাব পিছপা নয়।
এটা ঠিকই, প্রেমের লাথিঝাঁটার মতো ইলিশ-কাঁটায় বিদ্ধ না-হলে কেউ কেউ জীবন বৃথা মনে করেন। ট্যাংরার ডাকসাইটে রেস্তরাঁ-কর্ত্রী, চিনাকন্যা মোনিকা লিউ ঝটপট চপস্টিকে মাছ খুঁটে কাঁটা চুষে পরিষ্কার করে ইলিশ খান। শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ চক্কোত্তিরা দেড় দশক আগেই বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন, সর্ষেবাটা ছাড়াও কাঁটাবিহীন ইলিশ কত বিচিত্র স্বাদে চাখা যায়! বড়ি ভাজার গুঁড়ো ছড়ানো মুচমচে ইলিশ বেক কিংবা শুল্পো পাতা, লেবুর রসের ইলিশের মতো কিছু পদ মনে গেঁথে আছে। কাঁটা না-থাকলেও মুড়োকাঁটার স্টক গায়ে মাখিয়ে ইলিশের ইলিশত্ব অটুট রাখার সাধনা উৎকর্ষবিন্দু ছুঁয়েছিল। স্মোকড ইলিশের মতো এ সব কাঁটামুক্ত পদও বিশ্বকে বাঙালির বর্ষা-সংস্কৃতির উপহার।
ইলিশ-কাঁটা কব্জা করার একটি রাস্তা রপ্ত করেছেন আমাদের রান্নাপটু বন্ধু পৃথা দত্ত। তাঁর মায়ের কাছে শেখা বর্মী কায়দার ইলিশ-শৈলী। বর্মায় আস্ত ইলিশ চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে ভিনিগার, টমেটো, সাদা পেঁয়াজ যোগে রান্না হয়। অত ক্ষণের কসরতে সব কাঁটা গলে শেষ! কাঁটা-ভীরু দুর্বলচিত্তরাও অনায়াসে ছুরি, কাঁটা চালিয়ে নিঃশেষ করবেন। কিছু নিজস্ব তুকতাক প্রয়োগে পৃথা মায়ের রান্নায় সামান্য বদল আনলেও অভিঘাতটা তেমনই জম্পেশ। কাঁটা গলে ইলিশে মিশে আরও খোলে স্বাদটা। এ হতেই পারে আমগেরস্তরও বাড়ি বসে বোনলেস ইলিশ সাধ মেটানোর পাসপোর্ট। এমন টুকরো স্বাদগন্ধের বহতা ধারাতেই সাতরঙা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় জমে ওঠে বাদল অধিবেশন। বহু যুগের পুরনো বর্ষার চিঠি ঝামরে পড়ে শুকনো প্রাণহীন প্রাত্যহিকতায়। স্মৃতির সুগন্ধে কাকভিজে হয়ে হেঁটে যাই বর্ষার ময়দানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy