শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা, একদা সাড়া জাগানো ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের দৃশ্য। এই নাটক দেখিয়েছিল, বাংলার ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই ।
কী কুক্ষণে যে ‘শর্ম্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রস্তাবনায় ‘অলীক কুনাট্য’ কথাটি লিখে বসেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত! বাঙালি যত কাল পরীক্ষার খাতায় ‘রেফারেন্স টু দ্য কনটেক্সট’ গতের প্রশ্নের উত্তর লিখে এসেছে, তত কাল লিটেরারি অ্যালিউশনের মর্ম বুঝেছে। ইদানীং আর সে সবের ধার ধারেন না কেউ। মধুসূদন যে বাল্মীকি ব্যাস কালিদাস ভবভূতির সাপেক্ষে আঠেরো শতকের পঞ্চাশের দশকের কলকাতার বাবুদের বারফাট্টাই থেকে উপচে পড়া ‘সকের থেটার’কে এক হাত নিয়েছিলেন, কারও মাথায় থাকে না। ছাপোষা লেখা হোক বা সম্পাদকীয় স্তম্ভ, কথায় কথায় ‘অলীক কুনাট্য’ উদ্ধার করার রেওয়াজ এখন চালু।
ব্যাপারটা এখানে মিটে গেলে তাও কথা ছিল। গোদের ওপর বিষফোড়া ‘নাটক’ কথাটার এলোপাথাড়ি প্রয়োগ। চালিয়াত চন্দরের দল ‘নাটক করচে’ আউড়ে আসছেন অনেক কাল। এই ফুট কাটার মধ্যে অধিকন্তুর একটা আলগা সম্পর্ক ছিল। হিন্দি বলয়ের পারম্পরিক নাটকের অন্যতম নৌটঙ্কি নিয়েও এমনধারা চিমটি কাটার রেওয়াজ আছে। ভাড়াটে গুন্ডা বিরু কিছুতেই বাসন্তীকে বাগে আনতে না পেরে জলের ট্যাঙ্কের ওপর উঠে বুঢ্ঢি মৌসির বজ্র আঁটুনি ফস্কে দেবার তাল কষছেন দেখে স্যাঙাত জয় একটা অপশব্দ প্রয়োগ করে বলছেন ‘নৌটঙ্কি’— এ সবই আমাদের জানা।
কিন্তু নৌটঙ্কি আর আমাদের সাধের প্রসেনিয়াম থিয়েটার তো এক নয়। কিন্তু ‘আমি নেতা কি অভিনেতা/ হেথা মালুম করিবে কে তা!’ মাননীয় খেটেখুটে বাংলা লব্জ বললেন। কুচুটে লোকে দাগিয়ে দিল— নাটক! মাননীয়া নন্দীগ্রামে আহত হলেন— নাটক! ময়দান জুড়ে থাকা লাখো জনতা ভাইজানের নামে গলা ফাটাল— নাটক! এমনকি পপুলার সিনেমার মার্কামারা পোস্টারবয় এসে তাঁর সর্প-অবতারের আবির্ভাব খোলসা করলেও— নাটক! রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে মেহনতি জনতা যে ভাবে ‘নাটক করবেন না তো!’ নিদান হাঁকেন, যৎপরোনাস্তি বিপন্ন বিস্ময়ে ভাবি— নাটক কথাটা অপশব্দ হয়ে গেল না তো!
অথচ নাটকের মতো জীবনসম্পৃক্ত সমাজসচেতন শিল্পমাধ্যম আমাদের বাংলা তল্লাটে দু’টি নেই। কোনও কালেই ছিল না। পাঁচশো বছর আগে স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জানাতে নগর-সঙ্কীর্তনের স্মৃতি আজও মিলিয়ে যায়নি নবদ্বীপের বুক থেকে। সেও তো আখেরে নাটকই। সাহেবি আমলের কলকাতায় বাবুদের কাছা খুলে দেবার নিত্য আয়োজন চলত সঙের গানে, পাঁচালির পদে। সে সবও নাটক। তাতে লাগাম পরানোর বন্দোবস্ত করে টুঁটি টিপে ধরা হলেও সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে নাটক করার রেওয়াজ পাবলিক থিয়েটার চালু হওয়ার পর বেড়েছে বই কমেনি। এখনও সারা বাংলা জুড়ে ছোট-বড় নানা রংমহলে ওই সব আলোর ফুলকি ওড়ে। দলীয় উদ্যোগে নাটক ছাড়াও সরকারি পয়সায় নাট্য উৎসবের বান ডেকেছে মার্চ মাস জুড়ে। প্রসেনিয়ামের কলকাঠি খুলে রেখে ইন্টিমেট স্পেসের বাড়বাড়ন্ত রাজ্য জুড়ে। হাজারো দলের লাখো সদস্য এই আকালেও নাটকের মধ্যে সুস্থ সচেতন বিনোদনের চর্চা করছেন। হাতে গোনা কিছু জনপ্রতিনিধি বাদ দিলে কেউ যে ও সবের ধার ধারেন না, সে অতি আক্ষেপের কথা। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে এই সংস্কৃতির সম্বন্ধ একেবারে আলগা হয়ে গেছে, এ আরও বেদনাদায়ক।
অথচ ব্যাপারটা আগে এমন ছিল না। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের পর পরই শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটক সারা বাংলায় সাড়া জাগিয়েছিল। পরিচালনায় ছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী আর সতু সেন। নামভূমিকায় নির্মলেন্দু। নাট্যনিকেতনে বছরের পর বছর ধরে চলেছে সেই প্রযোজনা। শচীন্দ্রনাথের সঙ্গে কংগ্রেসি রাজনীতির ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। মুসলিম লিগ আর হিন্দু মহাসভার প্রভাববিস্তারী দিনে একেবারে বাংলা সমন্বয়ী চেতনাকে সামনে এনে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাল্টা বয়ান তৈরি করতে পেরেছিল ‘সিরাজদ্দৌলা’। সারা বাংলা জুড়ে মঞ্চস্থ হওয়াই নয়, পাশাপাশি কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা লাগানো গ্রামোফোন রেকর্ডের দৌলতে অগণিত গৃহকোণে বেজে উঠেছিল। সেই নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম দৃশ্যে মুর্শিদাবাদ দরবারে দাঁড়িয়ে মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভের উদ্দেশে সিরাজ বলে উঠেছিলেন, ‘বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়— মিলিত হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা।’ ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির বিষিয়ে ওঠা আবহাওয়ায় মধ্যে দাঁড়িয়ে এই উচ্চারণ কী প্রবল অভিঘাত তৈরি করেছিল তা অবিদিত নয়। এই প্রযোজনায় লুৎফউন্নিসা সাজতেন সরযূবালা দেবী। নাটকের শেষ দিকে সিরাজকে লুৎফউন্নিসা বলতেন— ‘চলুন জাঁহাপনা, আপনার হাত ধরে, এই আঁধার রাতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। কেউ জানবে না যে, বাংলার নবাব তাঁর বেগমের হাত ধরে চিরদিনের মতো বাংলা ছেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন।’ এক দিন সুভাষচন্দ্র বসু এসেছেন ‘সিরাজদ্দৌলা’ দেখতে। ওই দৃশ্য চলাকালীন সরযূবালা আড়চোখে দেখে ফেলেছিলেন, সামনের সারিতে বসা সুভাষচন্দ্র রুমাল বার করে চোখ মুছলেন। নাটক শেষ হওয়ার পর শচীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন সুভাষচন্দ্র।
মুসলিম লিগ রাজনীতির সমর্থকরাও দলে দলে এসে ‘সিরাজদ্দৌলা’ দেখেছেন সে কালে। আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘কাল নিরবধি’-তে আছে, সহধর্মিণীর অনুরোধে টিকিট কেটে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ‘সিরাজদ্দৌলা’ দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর আব্বা। কংগ্রেস এগজিবিশন রোডের বাসা থেকে হাতিবাগান পাড়ায় নাট্যনিকেতন যাতায়াতের ট্যাক্সি ভাড়া নেহাত কম ছিল না। সে রজনীতে নির্মলেন্দু সিরাজ সাজতে পারেননি, সেজেছিলেন আনিসুজ্জামানদের প্রতিবেশী ছবি বিশ্বাস। এ রকম পরিস্থিতিতে চাইলে টিকিটের দাম ফেরত নিতে পারতেন দর্শকরা। কেউ কেউ নিয়েছিলেন। সবাই নেননি। কবেকার ঘটনা এটি? ১৯৪২-এর আশপাশের।
ওই সময় নাটকের বইয়ের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে একের পর এক সংস্করণ হয়েছিল ‘সিরাজদ্দৌলা’-র। তাতে বেশ কিছু আলোকচিত্রও ছিল। সে দিন গোলপার্কের ফুটপাতে পুরনো বই নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি ‘সিরাজদ্দৌলা’-র ‘পাঁচসিকা’ দামের তৃতীয় সংস্করণের এক কপি। বাঁধানো বই। মলাট নেই। তার ভেতরের পাতায় আঠা দিয়ে সাঁটা আছে লালচে রঙের এক ফালি কাগজ। সেটা ময়মনসিংহ সদরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের। তাতে প্রধান শিক্ষকের সই। তারিখ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ। ব্যাপারটা কী? ইংরিজিতে লেখা সেই সার্টিফিকেটে দশম শ্রেণির (ওল্ড) ছাত্র অনিল কুমার মুনশিকে ‘অ্যাক্টিং’-এর জন্য স্পেশাল প্রাইজ় দেওয়ার স্বীকৃতি আছে। অর্থাৎ সে বছরে সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া এক কিশোরকে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে আলাদা করে ডেকে এনেছিল স্কুল। আগের বছর হয়তো পুজোর ছুটির মুখে মঞ্চস্থ হওয়া কোনও নাটকে তাক লাগানো অভিনয়ের জন্য বাহবা জানাতে। খুঁজে দেখলে এমন সার্টিফিকেট অনেকের বাড়ি থেকে পাওয়া যাবে। কারণ সে আমলে স্কুলে স্কুলে নাটক হত। তার জন্য চটজলদি বাহবা যেমন পাওয়া যেত, যথাবিহিত পারিতোষিকও মিলত ঢের। তার মধ্যে নাটকের বইও থাকত। তরতাজা সব নাটকের বই।
পরিতাপের বিষয় এই, সেই ট্র্যাডিশন আজ সমানে চলছে না। কো-কারিকুলার আর এক্সট্রা-কারিকুলারের গেরোয় পড়ে তা প্রায় মিলিয়ে গেছে এখন। এ রাজ্যের বাংলা স্কুলে প্রথম ভাষার পাঠ্যসূচিতে নাটক নেই বললেই চলে। দ্বিতীয় ভাষায় যৎসামান্য। বছর আষ্টেক আগে নয়া ধাঁচের পাঠক্রম তৈরির সময় বর্ষীয়ান নাট্যকারদের এত্তেলা পাঠিয়ে সুপারিশ চাওয়া হয়েছিল। তাতে বড়সড় রদবদলের সম্ভাবনা ছিল। পর্বত শেষমেশ মূষিক প্রসব করে। দিল্লির খবরদারিতে চলা ইংরিজি স্কুলে এখনও শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ পড়ানো হয়। কিন্তু সে সব স্টেজ অবধি গড়ায় না। স্কুল চৌহদ্দির বাইরে আসা তো দূরঅস্ত! খোদ কলকাতা থেকে স্কুল-কলেজ ড্রামা কম্পিটিশন উঠেই গেছে বলে, এই সে দিন অবধিও পৃষ্ঠপোষকতা করে চলা ব্রিটিশ কাউন্সিল হাত গুটিয়ে নিয়েছে দেখতে পাই। পুরনো আমলের কলেজ-ইউনিভার্সিটির ড্রামা ক্লাবের নাভিশ্বাস উঠেছে কবে! দক্ষিণ কলকাতার যে গার্লস কলেজে একদা বাংলা ইংরেজি এমনকি সংস্কৃত নাটকের পালা পড়ত, সেখানে আর যবনিকা ওঠানামা করে না। উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসবে এক কালে নাটক বাঁধা ছিল। ওপেন এয়ার থিয়েটারে যাত্রাও হতে দেখেছি আশির দশকে। এখন সে সবের পালা চুকেবুকে গেছে। যে চারাগাছে জল পড়েনি সে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও উঠতে পারে, তাতে অপুষ্টি ঢাকা পড়ে না। বর্ষে বর্ষে দলে দলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাচ্ছে। নাট্যশিক্ষায় হাতেখড়ি হচ্ছে না। যেখানে সমঝদারই তৈরি হচ্ছে না, সেখানে সেলামি দেবার লোক মিলবে কী করে? কথায় কথায় ‘নাটক’-এর বাপান্ত করা হলে মুড়িমুড়কির দর তো একই হবে! ‘অলীক কুনাট্য’র দেখাশোনা করার মতো আহাম্মকই বা জুটবে কোথা থেকে?
একদা ভোটের ময়দানেও নাটকের গুরুত্ব ছিল। পরেশ ধর-পানু পালদের আমরা ভুলতে বসেছি। ১৯৫১-র প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তাঁরা পথে নেমে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে তুলোধোনা করতেন। বাম রাজনীতির ছত্রছায়ায় পথনাটকের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল কয়েক দশক জুড়ে। অবধারিত ভাবে সেখানেও এখন ভাটির টান। কাজেই এই মুহূর্তে রাজ্য জুড়ে বিধানসভা নির্বাচনের মরসুমে যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলো নাটককে হাতিয়ার করে আমজনতার কাছে পৌঁছতে চাইছেন এমন নয়। সংগঠিত উদ্যোগ না থাকলেও হাটে-মাঠে নানা রকম পথনাটকের পালা পড়ছে। ‘ফ্ল্যাশ মব’ নামে নাটকের এক নতুন আঙ্গিক চমকে দিচ্ছে পথচারীদের। তাতে বাম ছাত্র-যুবদের তৎপরতা লক্ষণীয়। সে সব দেখে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। আবার নাক সিঁটকোনোর লোকও কিছু কম হচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy