Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Short Story

পালিয়েছে শর্মিষ্ঠা

বিছানার পাশের টেবিলে তাঁর চশমা আর গল্পের বই থাকে। রাতে বইয়ের পাতায় বুকমার্ক গুঁজে রেখে ঘুমোতে যান। না হলে পরের দিন পাতা খুঁজে পেতে সময় যায়।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ ০৯:৩৪
Share: Save:

শর্মিষ্ঠা পালাল। শ্বশুরবাড়ি থেকে। ভোরবেলা।

রায়ভিলায় সবার আগে ঘুম ভাঙে বাড়ির গিন্নির। শর্মিষ্ঠার শাশুড়ি কনকলতার। স্নান সেরে ঠাকুরঘরে যান। পুজো সারতে ঘণ্টাখানেক। তার পর বাড়ির অন্য কাজে হাত দেন। আজ ঠাকুরঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। বন্ধ দরজায় একটা কাপড়ের টুকরো সাঁটা। নীল সুতো দিয়ে হলুদ কাপড়ের উপর লেখা ‘চিন্তা কোরো না’।

‘চিন্তা’ শব্দটায় সুতো জড়িয়ে লেখা ধেবড়ে গেছে। একটু ভাল করে দেখলে শব্দটা বোঝা যায়। এক সপ্তাহ হল শর্মিষ্ঠা, মানে ছেলের বৌকে নিজে হাতে ‘হেম’ সেলাই দিয়ে রুমালের ধার মোড়া আর ‘বোতাম স্টিচ’, ‘বকেয়া’ সেলাই দিয়ে কাপড়ে ফুল তোলা শিখিয়েছেন। কাপড়ের টুকরোটা তাঁর কেমন চেনা-চেনা লাগছে। আরে! এটা তো তাঁর নতুন রুমাল! মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর মেয়ে তিতলি আর শর্মিষ্ঠা শপিং-এ গিয়েছিল। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এক ডজন রুমালও এনেছিল। সারা দিনে হাত মুছতে তাঁর খানকতক রুমাল লাগে। বহুদিনের অভ্যেস। সুতোয় লেখা রুমাল নিয়ে তড়িঘড়ি ছেলের ঘরের দিকে গেলেন।

সকালে বাড়ির গিন্নির শাঁখের শব্দে ঘুম ভাঙে রজতশুভ্রবাবুর, মানে শর্মিষ্ঠার শ্বশুরের। ঘুম আগেই ভেঙে যায়। শাঁখের শব্দ পেয়ে বিছানা ছাড়েন। তার আগে উঠলে সকালের চা পাবেন না। আজ শাঁখ বাজতে দেরি হচ্ছে দেখে বিছানা থেকে উঠে পড়েন।

বিছানার পাশের টেবিলে তাঁর চশমা আর গল্পের বই থাকে। রাতে বইয়ের পাতায় বুকমার্ক গুঁজে রেখে ঘুমোতে যান। না হলে পরের দিন পাতা খুঁজে পেতে সময় যায়। আজ চশমা নিতে গিয়ে দেখেন, চশমার নীচে বুকমার্ক। যাহ্‌! কাল তা হলে এত ঘুম পেয়ে গিয়েছিল, বইয়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পাতায় বুকমার্ক না রেখে টেবিলে রেখে দিয়েছেন! বুকমার্ক হাতে নিয়ে বইয়ের মধ্যে রাখতে গিয়ে দেখেন, তাতে বড় বড় করে লেখা ‘টা-টা’। পাশে একটা বড়সড় স্মাইলি ইমোজি আঁকা। এ আবার কার কাজ! বুকমার্ক হাতে নিয়ে দরজা খুলে বেরোন রজতশুভ্রবাবু।

ঘুম ভেঙে চোখ খুলে ফোন চেক করা তিতলির অভ্যেস। রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট চলে। সকালেও ঘুম ভাঙলে সবার আগে ফোন হাতে তুলে নেয়। ফোন চেক করে বিছানা ছাড়ে। আজ ফোন হাতে নিয়েই চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে তিতলির। বৌদি শর্মিষ্ঠার ফোন থেকে মেসেজ এসেছে। ভোর পাঁচটা তেইশে। একটা শব্দের মেসেজ… ‘পালাচ্ছি’। তিতলি বিছানায় বসেই চেঁচিয়ে
ওঠে, “দাদাভাই-ই-ই!”

প্রতি দিন মোবাইলের অ্যালার্মে রঞ্জনের ঘুম ভাঙে। ঘুমচোখে মোবাইল বন্ধ করে বিছানার অপর প্রান্তে হাত বাড়িয়ে দেয়। কাছে টানে ঘুমন্ত বৌকে। তার পর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। এটা প্রতি দিনের অভ্যেস। কিন্তু আজ কী হল? শর্মিষ্ঠা কোথায় গেল? শর্মিষ্ঠাকে পাশে দেখতে না পেয়ে ধড়মড় করে বিছানার উপর উঠে বসে রঞ্জন। তাদের সাত মাস পাঁচ দিনের বিবাহিত জীবনে এমনটা তো আগে কখনও ঘটেনি! মানে রঞ্জনের ঘুম ভাঙার আগে শর্মিষ্ঠার ঘুম ভাঙেনি। রঞ্জন এখন তাদের বিবাহিত জীবনের হিসাব মাসের সঙ্গে দিনেরও রাখছে। জমজমাট করে প্রথম বিবাহবার্ষিকী পালন করার পরিকল্পনা আছে তার।

রঞ্জন আর শর্মিষ্ঠার বিছানার ঠিক উল্টো দিকে ড্রেসিংটেবিল। সেখানে আয়নায় লাল রং দিয়ে বড় করে লেখা ‘চললাম’। তড়াক করে বিছানা থেকে মাটিতে লাফ দেয় রঞ্জন। কাছে গিয়ে ভাল করে দেখে। হাতের লেখা শর্মিষ্ঠার। লিপস্টিক দিয়ে লেখা।

ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। ঠিক সেই সময় এক সঙ্গে মা, বাবা আর তিতলির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সবাই তাকে ডাকছে।

হাওড়া স্টেশন থেকে ইস্টার্নের ছ’টা তিনের বর্ধমান কর্ড লোকালে উঠে বসে শর্মিষ্ঠা। ট্রেনের জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। হু-হু করে উল্টো দিক থেকে হাওয়া এসে তার শ্যাম্পু করা স্টেপকাট চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে বেঁচেছে।

সঙ্গে জামাকাপড়ের ব্যাগ নেই। শুধুমাত্র হাতব্যাগ। সেখান থেকে ফোনটা বার করে। ভাল করে দেখে ব্যাগে ফোনটা রেখে দেয়। কিঙ্কিদির সঙ্গে কথা শেষ করে শর্মিষ্ঠা ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। হালকা একটা হাসি শর্মিষ্ঠার মুখে খেলা করে যাচ্ছে। আচ্ছা, শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়েরা কি হাসে?

শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসানসোলে তার মাসতুতো দিদি কিঙ্কিকে ফোন করে শর্মিষ্ঠা। ছোট থেকে কিঙ্কিদি তার ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। আজ যে সমস্যায় সে পড়েছে, তা থেকে একমাত্র কিঙ্কিদি উদ্ধার করতে পারে। এই সমস্যা ‘যা হোক’ সমস্যা নয়। শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত গভীর সমস্যা। নইলে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে কেউ পালায়? ভোর সাড়ে পাঁচটায় ফোনে শর্মিষ্ঠার নম্বর দেখে অবাক হয় কিঙ্কি।

“কী রে, সব ঠিক আছে তো? এত সকালে ফোন করেছিস!” কিঙ্কি জানতে চায়।

“তোকে যে কী বলি কিঙ্কিদি! কিছু বুঝতে পারছি না।” শর্মিষ্ঠা বলে।

“যা হোক কিছু বল। মনে এখন যা আসছে তোর...” কিঙ্কি বলে।

“এই জন্য তুই আমার সব
চেয়ে বড় ভরসা...” হাসতে হাসতে বলে শর্মিষ্ঠা।

শর্মিষ্ঠার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিঙ্কি বলে, “তুই কি বাইরে? গাড়ির শব্দ পেলাম মনে হল।”

“বেরিয়েছি...” শর্মিষ্ঠা বলে।

“রঞ্জন আছে তোর সঙ্গে?” কিঙ্কি জানতে চায়।

“না, নেই।”

“কোথায় যাচ্ছিস তুই? এত সকালে?” কিঙ্কি জানতে চায়।

“বলব না,” বলে কল কেটে ফোন বন্ধ করে দেয় শর্মিষ্ঠা।

কিঙ্কির সঙ্গে কথা বলার পর থেকে শর্মিষ্ঠার বেশ অন্য রকম লাগছে। মনটা খুশি-খুশি। এখন তার হাসি পাচ্ছে, আনন্দ হচ্ছে, আরও কত কী মনের মধ্যে আসছে-যাচ্ছে।

এত ক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে হইহই শুরু হয়ে গেছে। রঞ্জন ফোন করা শুরু করে দিয়েছে। শর্মিষ্ঠা আন্দাজ করতে পারে, রঞ্জন প্রথমে পাগলের মতো তার ফোনে ট্রাই করে যাবে। পাবে না। এর পর বালিগঞ্জে মা-কে ফোন করবে। ঝামেলা তখন থেকে আরও এক ধাপ বাড়বে। টেনশন শর্মিষ্ঠার মা অপালার নিত্যসঙ্গী। তাঁর এই টেনশন করার অদ্ভুত-অদ্ভুত গল্প শর্মিষ্ঠা তার বাপির মুখ থেকে শুনেছে।

তখন শর্মিষ্ঠার ক্লাস ওয়ান। অপালার বন্ধুর বাবা হঠাৎ মাঝরাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি বাড়ির লোক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে দেয়। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনার দিন দুয়েক পর অপালা মধ্যরাতে কান্না জুড়ে দেন। নিখিল ঘাবড়ে যান। অনেক করে প্রশ্ন করে জানতে পারেন, সেই মুহূর্তে অপালার মনে হচ্ছে, তাঁর বাবার যদি এমন হয় তাঁকে কে দেখবে? তিনি তো থাকেন হায়দরাবাদে।

এমন আরও আছে। অপালার কোনও বন্ধু বা জানাশোনা কারও কোনও সমস্যা হলে তার দু’-এক দিনের মধ্যেই তিনি অনুভব করতে শুরু করেন, তাঁরও এমনটাই হচ্ছে। এই সব কথা শর্মিষ্ঠা শুনেছে অনেকটা বড় হয়ে। ক্লাস ইলেভেনে। বাবা আর মেয়ে হেসে কুটোপাটি।

পরের ফোনগুলো যাবে তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু প্রিয়া, রুহি, পামেলার কাছে। রুহি বেজায় ফাজিল। সে এমন কিছু বলবে রঞ্জনকে, বেচারা নির্ঘাত আরও ভাবনায় পড়ে যাবে। কী করবে শর্মিষ্ঠা? সে চায়নি এমনটা করতে। কিন্তু এ ছাড়া আর অন্য কোনও ভাবনা তার মাথাতেও আসেনি।

‘বিয়ে’ শব্দটার সঙ্গে ছোট থেকে একটা ছেলে বা মেয়ে পরিচিত। শর্মিষ্ঠাও ব্যতিক্রম নয়। নিজের বিয়ের পর থেকে সে কেমন ঘাবড়ে গেছে। ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত অনেক বিয়ে দেখেছে। বেশ কয়েক জন বন্ধুরও বিয়ে হয়ে গেছে। সেই সংক্রান্ত গল্পও শুনেছে। কিছু ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির গল্প ভালয়-মন্দয় মেশানো। কিছু ক্ষেত্রে খুব খারাপ।

কিন্তু শর্মিষ্ঠার শ্বশুরবাড়ির অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা। নিজের অস্বস্তি চেপে রাখতে না পেরে কাকে বলবে না বলবে, ভাবতে ভাবতে প্রিয়াকে এক দিন ফোন করে বসে। ছোট থেকে এক সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা প্রাণের বন্ধু।

“শোন না, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। তুই পারবি আমার সঙ্গে এক বার দেখা করতে?”

প্রিয়া এক কথায় রাজি। বলে, “পরশু আমার নিজের কিছু কাজ আছে বলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি। কাজ মিটতে তিনটে। তুই সাড়ে তিনটে নাগাদ সিঁথির মোড়ের কাফেটেরিয়ায় চলে আয়। আমার ওখানেই কাজ আছে। আর তোর বাড়ি থেকেও বেশি দূর হবে না।”

পরিকল্পনা মাফিক দেখা করেছে। কফির কাপ হাতে শর্মিষ্ঠা তার সমস্যার কথা বলতে শুরু করে। শুনেই প্রিয়ার চোখ গোল হয়ে ওঠে।

“কেমন যেন লাগছে রে শুনে। এমন আবার হয় নাকি? জানি না বাবা। আমি তো ভাবতেও পারি না।”

শর্মিষ্ঠা পড়ল আরও মুশকিলে।

“কী করি বল তো?”

“সেটা আমিও ঠিক ভেবে উঠতে পারছি না। তবে চোখ-কান খোলা রাখিস। সাবধানে থাকিস।”

শর্মিষ্ঠার সুবিধেই হল। মাসিমণিকে তার সমস্যার কথা জানাবে বলে ফোন করতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় মাসিমণির ফোন।

“কী রে, কাল বাড়ি আছিস তো? তোকে দেখতে যাব ভাবছিলাম।”

শর্মিষ্ঠা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।

“প্লিজ় প্লিজ় মাসিমণি, তুমি এসো। আমি এই তোমায় ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”

“দেখছিস তো মা, একেই বলে মনের টান। আমারও তোর জন্য মন কেমন করল, আর তোরও!” মাসিমণি বলে।

ছোট থেকে মায়ের থেকে মাসিমণি বেশি প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে তাকে। যত কথা ছিল মাসিমণির সঙ্গে। কত বার মাসিমণির প্ল্যানে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছে, ঘুরতে গেছে।

শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার পর মাসিমণিকে নিজের ঘরে এনে বসিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয় শর্মিষ্ঠা। মাসিমণি মুচকি হাসেন।

“কী রে, গোপন কোনও কথা বলবি নাকি? দরজা দিলি যে বড়?”

“মাসিমণি, আমি একটা বড় সমস্যায় পড়েছি। তুমি বলো, আমি এখন কী করব?”

শর্মিষ্ঠার সমস্যার কথা শুনে মাসিমণি আকাশ থেকে পড়েন।

“বলিস কী রে! এত কাল ধরে সংসারের জোয়াল ঠেলে চলেছি। এমনটা কখনও হয় বলে জন্মে শুনিনি। দেখ, হয়তো তোর বাবার থেকে কিছু চাইবে-টাইবে। সতর্ক থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস।”

‘কিছু চাইতে পারে’ এই ব্যাপারটা হতে পারে বলে শর্মিষ্ঠার মনে হয় না। শর্মিষ্ঠা কী করবে স্থির করে উঠতে পারে না। বাবা আগের মতো অবস্থায় থাকলে তাঁর কাছেই নিজের সমস্যার কথা বলত। শর্মিষ্ঠার বিয়ের দু’মাস পরে সেরিব্রাল হয় তাঁর। এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে আগের অবস্থায় হয়তো ফিরতে পারবেন না।

বাড়ির সামনের পার্কে হাঁটতে গিয়েছিল শর্মিষ্ঠা। ফেরার পথে আচমকা দেখা হয়ে গেল তটিনীদির সঙ্গে। স্কুলের শিক্ষিকা।

“ম্যাম, আপনি এখানে?”

“আমি এখন মেয়ের কাছে আছি। তোমার শ্বশুরবাড়ি এখানে?”

মাথা নাড়ে সে। বলব কি বলব না করেও তটিনীদিকে নিজের সমস্যার কথা বলে ফেলে। স্কুলে পড়াকালীন তটিনীদি ছাত্রীদের দিদিমণি কম, বন্ধু ছিলেন বেশি।

তটিনীদি সব শুনে বলেন, “এ তো খুব আনন্দের কথা। আশীর্বাদ করি, সবটুকু যেন ধরে রাখতে পারো।”

শর্মিষ্ঠার সঙ্কট বেড়ে গেল। নানা রকম ভাবনাচিন্তা করে শেষে বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছে।

শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়েছে। তার পর সোজা হাওড়া স্টেশন।

ট্রেনে জমিয়ে পকোড়া, মৌরি লজেন্স, মটকা কুলফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে জানলার গায়ে মাথা ঠেকিয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণে বর্ধমান পৌঁছে গেছে। এ বার আসানসোল লোকাল ধরবে সে।

শর্মিষ্ঠা জানে, কিঙ্কিদিকে না বললেও সে যে এখন আসানসোলে যাবে, সেটা কিঙ্কিদি আন্দাজ করেছে। সে নিশ্চিত, ওখানে পৌঁছনোর পর কিঙ্কিদি লঙ্কার আচার, আমতেল, পেঁয়াজ দিয়ে জমিয়ে মুড়ি মেখে খেতে দেবে তাকে। উফ্‌, ভেবেই শর্মিষ্ঠার জিভে জল এসে গেল। কত দিন খায়নি!

স্টেশন রোডে কিঙ্কিদির ফ্ল্যাট। তাকে দেখে কিঙ্কিদি জড়িয়ে ধরে।

“আসতে অসুবিধে হয়নি তো?”

শর্মিষ্ঠা এ বার ঘাবড়ে যায়। তার আসার ব্যাপারে কিঙ্কিদি এতটা নিশ্চিত থাকবে ভাবেনি। ভেবেছিল, কিঙ্কিদি কিছুটা আন্দাজ করবে মাত্র। তার জন্য চিন্তিত থাকবে। অত ভোরে সে ফোন করেছে। হয়তো অনেক জমাখরচ দিতে হবে। কিন্তু কোথায় কী? যাক গে, ভালই হল।

“মুড়িমাখা?” শর্মিষ্ঠা বলে।

“সব রেডি। আগে ফ্রেশ হয়ে আয়,” কিঙ্কি বলে।

মুড়ির বাটি শর্মিষ্ঠার হাতে ধরিয়ে কিঙ্কি বলে, “শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছিস, তাই তো?”

শর্মিষ্ঠা হেসে মাথা নাড়ে।

“আচ্ছা শর্মি, এই যে তুই শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছিস তার তো নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে।”

কিঙ্কির পাশে বসে শর্মিষ্ঠা বলে, “আছে তো।”

“তোর শাশুড়ি খুব খাটান তোকে, তাই না? ভাল করে কথা বলেন না। ঠিকমতো খেতে দেন না। তোর উপর সব সময় খবরদারি করেন। তাই তো?” কিঙ্কি বলে।

“না রে কিঙ্কিদি। ঠিক উল্টো। কোনও কাজ করতে দেন না। ভাল করে কথা কেন, যা কথা এখন সব আমার সঙ্গে। আর খাওয়া? যখন যা বলি তা-ই নিজে রান্না করে দেন। আর খবরদারি করবেন কেন? সে সব ওঁর ধাতেই নেই,” শর্মিষ্ঠা বলে।

“তার মানে বাইরের খাবার অ্যালাও করেন না।”

“রেস্তরাঁ থেকে অর্ডার উনিই করেন। সেটাও আমায় করতে হয় না। শুধু আমি কী খেতে চাই তা মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা।”

“শ্বশুরমশাই খুব জ্বালান তোকে? সারা দিন খিটখিট, গিজগিজ চলতেই থাকে। কি, তাই তো?”

“একেবারেই না। শাশুড়িমার মতো উনিও আমার খুব খেয়াল রাখেন। আমার পছন্দমতো ওয়েব সিরিজ়, মুভি ডাউনলোড করে রাখেন। ভাল বই পেলে আমায় পড়তে দেন। আমার পছন্দমতো বই লাইব্রেরি থেকেও এনে দেন। রঞ্জনকে তো থেকে থেকেই বলেন, ‘শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে বেড়াতে যা। এখনই তো তোদের ঘোরাফেরা, আনন্দ করার দিন’।”

“বুঝেছি। এই সব দেখে তোর ননদ খুব হিংসে করে তোকে। যা নয় তা-ই কথা শোনায়। অবশ্য এটা প্রায় অনেক শ্বশুরবাড়ির সমস্যা।”

“এ মা! না না। তিতলি ভীষণ ভাল মেয়ে। কলেজের বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও আমাকে অনেক সময় দেয়। কত গল্প করি আমরা। পার্লারে, শপিং-এ যাই এক সঙ্গে। আমরা একে অপরের ড্রেস পাল্টাপাল্টি করে পরি। ভাল বন্ধু আমরা।”

“রঞ্জনের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছিস? সত্যি কথা বলবি। ছোট থেকে তোর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। চাকরি নয়, ব্যবসা করবি। তা-ও যেমন তেমন ব্যবসা নয়। নিজে হাতে বনসাই তৈরি করে বিক্রি করবি। তুই সে কথা বলেছিস আর রঞ্জন বাগড়া দিচ্ছে। তাই তো?”

“না রে কিঙ্কিদি। ও তো উৎসাহ দিচ্ছে আমায় খুব। ইন ফ্যাক্ট সে সব নিয়ে নিজেও পড়াশোনা করছে আর আমাকেও পাশে বসিয়ে সে সব দেখাচ্ছে, বোঝাচ্ছে।”

“এত ভাল!” কিঙ্কি কাঁধ ঝাঁকায়।

“আমার খুব ভয় করছে কিঙ্কিদি। আমার মতো মেজাজি মেয়েকে এত আদর, ভালবাসা! মনে হয় আমি যা দেখছি ঠিক নয়। ভয় হয়, এত সুখ আমি ঠিক হারিয়ে ফেলব। আমি শ্বশুরবাড়িতে লিখে রেখে এসেছি বটে, ‘আমি পালালাম’, তবে সত্যি কি আমি পালিয়ে এলাম? আমার এই পালানো আসলে নিজের ভয়ের কাছে। বলতে পারিস আমি এই সুখটুকু ধরে রাখার জন্যই পালিয়ে এসেছি। খালি মনে হচ্ছে আমি একটা স্বপ্ন দেখছি, যে কোনও মুহূর্তে স্বপ্ন ভেঙে যাবে আর মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ব আমি।”

কিঙ্কি বলল, “শুধু এই কারণে এ রকম পাগলামি করলি!”

শর্মিষ্ঠা একটু হাসল। বলল, “তা নয়। একটা ছোট পরীক্ষাও আছে। রঞ্জন আমাকে খুঁজতে কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেটাও এক বার দেখে নিতে চাই। তবেই তো বুঝতে পারব কোনটা সত্যি, আর কোনটা আমার ভুল। বলতে পারিস, এই পরীক্ষার নাম ‘পালানো পরীক্ষা’।”

শর্মিষ্ঠার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিঙ্কির ফ্ল্যাটের সামনে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ। দু’জনেই কান পাতে। দু’মিনিট পর কিঙ্কির ডোরবেল বেজে ওঠে। দরজা খোলে কিঙ্কি।

ঘরের ভিতর থেকে শর্মিষ্ঠা শোনে রঞ্জন বলছে, “সকাল থেকে হন্যে হয়ে শর্মির খোঁজ করে চলেছি। চেনাজানা জায়গা, যেখানে যেখানে ও যেতে পারে এমন সব জায়গায়। পাইনি। খুব চিন্তা হচ্ছে। আপনি তো ওর খুব কাছের। কিছু জানেন কি আপনি?”

শর্মিষ্ঠার চোখে জল আসে। এই জল আনন্দের।

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy