আবার “অ্যাই গেল!” উল্টো দিক থেকে আসছিল বছর বাইশ-তেইশের একটি মেয়ে। লাল টপ। কালো প্যান্ট। মুখশ্রী অসহ্য রকমের সুন্দর। কান ছাড়িয়ে গালে এসে-পড়া দলছুট চার-পাঁচটা উড়ো চুল— দৃশ্যটা তার মতো যুবকের পক্ষে অসহনীয়।
কাজেই ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। মেয়েটি সুতনুকা হলেও হাইটে একটু শর্ট। তার চেয়ে বড় কথা, শৌর্যর এখনও বিয়ে পর্যন্ত হয়নি। ঘাড় নামিয়ে দেখতে গিয়েই মাথাটা চটাং করে ঘুরে গেল তার। আইটি ফার্মে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারে ঘাড় গুঁজে কাজ করে ভরা যৌবনেই এই কর্পোরেট রোগটা বাধিয়ে বসে আছে। সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস।
তাতে তার অবশ্য একটা সুবিধে হয়েছে। বাবা-মা বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। শরীর খারাপ বলে আপাতত তারা থমকে গেছে। শৌর্যও হাঁপ ছেড়েছে। এক্ষুনি বিয়ে করলে টাল সামলাতে পারবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধাও আছে তার। চিকিৎসা যত দিন চলে তারই ভাল।
কিন্তু ভাল বললেই তো হয় না। ভালর মধ্যে বিপত্তিও আছে। সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস ঘাড়ে বাসা বাঁধলে যা হয়, কখন যে মাথা ঘুরে যাবে তার ঠিক নেই। মাথা বলে কথা, সব কেমন জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। স্থান-কাল-পাত্রী থেকে শুরু করে আক্কেলজ্ঞানও টলে যায়।
বেছে বেছে সেটাই হয়েছে। মাথা টলতেই শরীর পার্সোনাল রিফ্লেক্সে তার কমান্ডের তোয়াক্কা না করে “অ্যাই গেল!” বলে কখন যে সে মেয়েটির একটা হাত চেপে ধরেছে, খেয়ালই নেই তার।
“এটা কী হল?” মেয়েটি সজোরে হাত ছাড়িয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল।
নেহাত সিরিয়াস না হলে স্পন্ডিলোসিস এমনিতে ভারী ভদ্র রোগ। অন্য রোগে মাথা ঘুরলে সব সময় তল-কূল মেলে না। কিন্তু এতে চটাং করে ঘুরলেও ঝড়াং করে স্টেডি করে দেয়। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আক্কেল ফিরতেই নার্ভাস ভাবে হাসল শৌর্য, “এক্সট্রিমলি স্যরি ম্যাডাম! মাথাটা ঘুরে গেছিল।”
কিন্তু তার মতো টাটকা যুবকের রোগের ঠেলা এমন সুন্দরীকে বইতে দিলে শুকনো ‘স্যরি’তে কি কাজ হয়! মেয়েটি দ্বিগুণ বিক্রমে ঝাঁঝাল, “মাথা ঘুরে গিয়েছিল, অ্যাঁ? অসভ্য! ইতর!”
অসভ্য, ইতর? সব কিছুর বিবর্তন হয়, আর পুরুষদের প্রতি মেয়েদের গালাগালিই বাদ? এ সব তো মাসিমারা কমবয়সে দুষ্টু মেসোমশাইদের বলতেন!
“কুল ম্যাডাম, কুল!” নার্ভাসনেস কিছুটা কাটল শৌর্যর, “আমার ভার্টিগো আছে। ট্রিটমেন্ট চলছে। অ্যালোপ্যাথিতে তেমন কাজ হচ্ছে না। আকুপাংচার করাচ্ছি। হঠাৎ-হঠাৎ মাথা ঘুরে যায়।”
“মেয়েদের দেখলেই বুঝি ঘোরে? একদম মিথ্যে বলবেন না!”
দেখতে এত ভাল, কিন্তু মুখের ভাষার এ কী ছিরি? দেখাই যাচ্ছে আইটি হাব থেকে বেরিয়েছে। সারা দিন তার মতোই কম্পিউটারে কাজ করে বাড়ি ফিরছে। শৌর্য যাচ্ছে নাইট শিফ্ট সামলাতে। হতাশ হয়ে না বলে পারল না, “না হয় হাতটাই ধরেছি, রাগ করছেন কেন? টেক ইট ইজ়ি।”
“কী বলতে চান আপনি? খুব সাবধান। দেখবেন? চিৎকার করব?”
আরও হতাশ হল শৌর্য। এখনও লোক ডাকতে হয়? নিজেদের সমস্যা নিজেরা সামলাতে পারে না? তার সঙ্গে কাজ করে যে সব মেয়েরা, তারা এ সব ছোটখাটো ব্যাপার পাত্তাই দেয় না। ইভটিজ়িং তুড়ি মেরে উড়িয়ে উল্টে আদম-টিজ়িংয়ে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। এমন এমন কথা বলে, মাথা-কান গরম হয়ে যায়।
“এক্সাইটেড হবেন না ম্যাডাম। সারা দিন খেটেছেন...” শৌর্য বলল, “বাড়ি যান প্লিজ়!”
“চোওপ!” মেয়েটির রাগ পড়ার নাম নেই, “মাথা ঘোরা না ছাই, আপনি খেয়ে আছেন।”
“খেয়ে আছি?” শৌর্য ভ্যাবাচ্যাকা খেল, “খেয়েই তো বেরিয়েছি। মিড নাইটে কফি আর হালকা স্ন্যাক্স নেব।”
“চালাকি হচ্ছে! বুঝেও না বোঝার ভান করছেন! বদমাইশি ছুটিয়ে দেব।”
বদমাইশির কি পা আছে? ছোটানো যায়! যা তা! এ কি নেট-চ্যাট করে না? কত রকম পোস্ট আসছে। দিন-রাত নতুন নতুন রিল চলছে। ভাষার কত রকম কায়দাকানুন বেরিয়ে গেছে। কোন জমানায় পড়ে আছে?
“ওকে! ওকে!” শৌর্য বলল, “আমার অন্যায় হয়েছে।”
“হ্যাঁ খবরদার! আর করবেন না!”
খবরদার! এ তো মেয়েদের ডায়ালগই নয়! স্টেশনের কুলিরা বাদে আর কেউ আজকাল বলে কি না সন্দেহ! রেগেমেগে শৌর্য পকেট থেকে স্যানিটাইজ়ার বার করে বাড়াল, “হাতটা পাতুন, দু’ফোঁটা দিয়ে ঘষে নিন। হাত নির্মল হয়ে যাবে।”
“অনেক হয়েছে!” মেয়েটি হাত গুটিয়ে নিল, “যান! যান!”
স্যানিটাইজ়ারকেও বিশ্বাস করছে না! এতটাই বিতৃষ্ণা জাগল শৌর্যর, ভেবেছিল কয়েক সেকেন্ড মেয়েটিকে প্রাণ ভরে দেখে তার পর যাবে, মনে মনে ‘দুচ্ছাই’ বলে আর দাঁড়াল না। হনহন করে হাঁটতে শুরু করল।
অফিসে এসে দেখল, কাজ পুরোদমে শুরু হয়নি। ডে শিফ্টের মেয়েরা কেউ কেউ এখনও আছে। যাওয়ার আগে নাইট শিফ্টের ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা জুড়েছে। শতরূপাদি হেসে গড়িয়ে পড়ছে। শৌর্যকে দেখে “শুনে যা! আজ যা হয়েছে না!” বলে হাতছানি দিল।
শৌর্য মাথার চক্কর সামলে সিট টেনে বসতে শতরূপাদি যা বলল, ভাবাই যায় না। সকালে আসার সময় প্রচণ্ড ভিড় বাসে উঠেছিল। জানলার ধারে বসে ছিল। পাশে একটা মেয়ে। তার প্রেমিক জায়গা না পেয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বলে মেয়েটি তাকে বসিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে ছিল।
কিছু ক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ বাস বিশ্রী ভাবে ব্রেক কষায় শতরূপাদি সিট থেকে জাম্প করে উঠে ধপাস করে বসে পড়ে ছেলেটির ডান পায়ের উপর। ছেলেটি সিটটা ধরে ছিল। মেয়েটাও হ্যান্ডেল ধরে ছিল বলে সামলে নেয়। কিন্তু তার পর শতরূপাদির দিকে চেয়ে রাগে ফেটে পড়ে, “ঠিক করে ধরে বসতে পারেন না? ওর কোলে উঠে পড়েছেন?”
নিজেকে সামলে ঠিক করে বসে শতরূপাদি বলে, “ভেরি স্যরি!”
“স্যরি? কী ভেবেছেন, অ্যাঁ?” মেয়েটির থামার নাম নেই, “সভ্যতা-ভব্যতা নেই আপনার?”
মাথা গরম হচ্ছিল শতরূপাদির। তা-ও নিজেকে শান্ত রেখে বলেছিল, “এ ভাবে বলছেন কেন? রানিং বাসে এমন তো হয়েই থাকে।”
“হয়ে থাকে? কই আমরা তো কারও কোলে উঠে পড়ছি না!,” মেয়েটি রাগে ফুঁসছে, “আপনার মতলব খুব খারাপ!”
আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেনি শতরূপাদি। গম্ভীর গলায় বলেছিল, “মোবাইল নম্বরটা দিন তো!”
“কেন?” মেয়েটি অবাক।
শতরূপাদি গলা আরও গম্ভীর করে বলেছিল, “আমার বাড়ির ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি। চলে যাবেন। গিয়ে আমার বরের কোলে যত ক্ষণ ইচ্ছে বসবেন, হ্যাঁ? কেউ বারণ করবে না।”
শুনে গোটা বাসের লোক হাসিতে ফেটে পড়েছিল। মেয়েটিও অপ্রস্তুতের একশেষ। যত ক্ষণ বাসে ছিল, আর মুখই খোলেনি।
বলে শতরূপাদি হাসতে শুরু করল। শৌর্যও হাসছে। মনে পড়ছে মেয়েটার কথা। কোথায় পড়ে আছে!
কোথায় পড়ে আছে জানতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না শৌর্যকে।
মাস দুই পরের কথা। তত দিনে মেয়েটির উপর ক্ষোভে-দুঃখে নিয়ম করে সিটিং দিয়ে সার্ভাইকাল স্পন্ডিলোসিস সারিয়ে ফেলেছে শৌর্য। একেবারে ফিট। কিন্তু পাছে আবার বাড়ির লোক বিয়ের জন্য পিছনে পড়ে, মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরে যাওয়ার অ্যাক্টিং চালিয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই হঠাৎ এক দিন সন্ধ্যায় বাসে মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শৌর্যর। মেয়েটা বোধ হয় শিফ্ট বদলে নাইটে গেছে। বিশাল ব্যাকপ্যাক কোলে নিয়ে বসে আছে জানলার পাশে। আজ তার পরনে সালোয়ার-কামিজ। হাওয়ায় মুখে এসে-পড়া চুল সামলাতে ব্যস্ত। খেয়ালই ছিল না তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শৌর্য। রাগত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।
দৃষ্টির তরঙ্গ হয়। তার ঘায়ে হঠাৎ মুখ তুলে মেয়েটি চিনে ফেলল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ বেজার। কটমট করে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল জানলায়।
এখনও সে দিনের হ্যাংওভার কাটেনি! মুখ থমথমে হয়ে গেল শৌর্যর। ঠিক করে নিল, যা অসহিষ্ণু মেয়ে, সে দিনের ঘটনা নিয়ে যদি কিছু বলে বা সিন ক্রিয়েট করে, আজ ছাড়াছাড়ি নেই। তার বিয়েই হয়নি। মেয়েটারও হয়নি হয়তো। তাতে কী? শতরূপাদির দাওয়াই অ্যাপ্লাই করে মুখের উপর শুনিয়ে দেবে, ‘এত কথা কিসের ম্যাডাম? ঠিকানা দিচ্ছি, হাজ়ব্যান্ডকে পাঠিয়ে দেবেন। গিয়ে যত ক্ষণ পারে আমার বৌয়ের হাত ধরে বসে থাকবে। কিচ্ছু বলব না।’
ভাবতে ভাবতে যে ঘটনা ঘটে গেল, শৌর্যর কল্পনার দু’শো গজের মধ্যে ছিল না। ব্রেক কষল বাস। শতরূপাদি যেমন ফেস করেছিল, তার কাছ দিয়েই যায়।
পাশে মাথার উপরের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল নতুন বিয়ে-করা একটি মেয়ে। হ্যান্ডেল থেকে হাত পিছলে গেল। এমন অসহায় অবস্থায় শরীরের যা ধর্ম, বিকল্প হ্যান্ডেলের খোঁজে খপাত করে ধরে ফেলল শৌর্যর হাত নয়, একেবারে কাঁধ!
স্পন্ডিলোসিস সেরে গেছে। শরীরে বিদ্যুৎ খেলছে শৌর্যর। তার হাত থেকে হ্যান্ডেল সরেনি। তবে মেয়েটির দিকে শরীরটা ত্রিভঙ্গ হয়ে এগিয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড সে ভাবে থেকে ড্রাইভার ব্রেক ছাড়তেই ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে গেল। মেয়েটাও তার কাঁধ ছেড়ে পুরনো অবলম্বন হ্যান্ডেল চেপে ধরল। কাঁচুমাচু মুখে বলল, “বাসটা এমন করে ব্রেক কষল! আই অ্যাম সো স্যরি! কিছু মনে করবেন না প্লিজ়!”
শৌর্য “না! না! ঠিক আছে,” বলে মেয়েটির দিকে তাকাতেই আবার “অ্যাই গেল!” না, স্পন্ডিলোসিসে নয়, মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে মাথাই ঘুরে গেল তার। এর কাছে কোথায় লাগে জানলার দেমাকি মেয়েটা! এতটাই ফর্সা গালদুটো, যেন বেদানার রং ধরেছে। হাইটও পারফেক্ট। নাক-মুখের ফিনিশিং লাজবাব। মনে করবে না মানে? এমন মেয়েকেই তো মনে করতে হয়। বিয়ে হয়ে গেছে তো কী হয়েছে!
সে চেয়ে আছে দেখে মেয়েটা লাজুক অপ্রতিভ হেসে বলল, “আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। এমন করে বাসটা চালাচ্ছে না?”
ভাগ্যিস চালাচ্ছে! আনন্দে-বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল শৌর্যর। তাকে ধরেই এমন সুন্দরী নারীকেও অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে হয়! তবে কেন বিয়ের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে! নাহ্, আর দেরি নয়! আর অ্যাক্টিং নয়! রোগ যখন সেরে গিয়েছে, কালই বাবাকে মেয়ে দেখতে বলবে! হাম ভি কিসিসে কম নেহি!
“যা বলেছেন! বাজে ড্রাইভার...’’
উৎসাহে ডগমগ হয়ে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করে র্যাশ ড্রাইভিং নিয়ে মুখ খুলতে যাবে শৌর্য, হঠাৎ চোখ গেল জানলার মেয়েটির দিকে। তাকিয়েই থ। মেয়েটা কটমটে চাউনি হেনেছে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, তার দিকে নয়। পাশের সুন্দরী বৌটির দিকে। শক্তিশালী দৃষ্টিতরঙ্গ। শৌর্যর দিক থেকে ঝটিতি বৌটির ঘাড়ও ঘুরে গেল। চোখ চলে গেল জানলায়। সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল সে। কষ্ট করে যেটুকু হেসেছিল, তা-ও মুখে ফিরিয়ে আর কারও দিকে তাকানো নেই, দাঁড়ানো নেই, “এখানেই নামব আমি...” বলে ঘুরে গেল গেটের দিকে। আবার কখন বাস ব্রেক কষে ঠিক আছে? নিজের স্টপেজ না অন্য স্টপেজ কে জানে, ধড়ফড়িয়ে নেমে গেল বাস থেকে।
খুব দমে গেল শৌর্য। রেগেমেগে জানলার দিকে চেয়ে আবার “অ্যাই গেল!” তবে রোগে নয়, বিস্ময়ে। মুখের ভাব বদলে গিয়েছে জানলার মেয়েটির। সেকেলে টাইপের খরখরে মেয়ে যে সেকেন্ডের মধ্যে মুখের ভাব এত দূর বদলে ফেলতে পারে, কে জানত! তার দিকে চেয়ে আছে। ঠোঁটে প্রশ্রয়-মাখা দুষ্টুমির মনোরম হাসি।
যাক! স্পন্ডিলোসিস ফিরে এলেও চিন্তা নেই! শৌর্যও হেসে ফেলল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)