E-Paper

ক্যামেরা

পরিতোষ, সোহিনী, দীপা আর তনুময় দোলের সময় ডুয়ার্সে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললে সে এক কথায় রাজি হয়েছিল। আহা! নতুন ক্যামেরা হাতে আসতে না আসতেই ডুয়ার্সের প্রোগ্রাম!

ছবি: পিয়ালী বালা।

বিপুল দাস

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২৫
Share
Save

নতুন ক্যামেরা কিনেছে সঞ্জু। নামী ব্র্যান্ড। আহা, কত দিনের শখ একটা ভাল ক্যামেরার! আজেবাজে দোকান থেকে নয়, খোদ কোম্পানির শো-রুম থেকে কিনেছে। ছবি তোলার শখ তার বরাবরের। কলেজে পড়ার সময় বা তার পরেও মাঝে মাঝে দাদার ক্যামেরা নিয়ে এক বার বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং, আর এক বার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে সঞ্জুর মন ভরছিল না। তার পর দীর্ঘ দিন মোবাইলের ক্যামেরা দিয়েই ছবি তোলার শখ মিটিয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভাল, দামি ক্যামেরার ইচ্ছে রয়েই গেছিল। চাকরি পাওয়ার দু’বছর পর এ বার তার সে শখ মিটল। কেস খুলে ক্যামেরা বার করে কালো বডিতে লেন্সে হাত বোলালে সে টের পাচ্ছিল, তার অন্য রকম সুখ হচ্ছে। এটা শ্যামা কোনও নারীশরীর। তার শরীর শিউরে উঠছিল।

পরিতোষ, সোহিনী, দীপা আর তনুময় দোলের সময় ডুয়ার্সে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললে সে এক কথায় রাজি হয়েছিল। আহা! নতুন ক্যামেরা হাতে আসতে না আসতেই ডুয়ার্সের প্রোগ্রাম! শুধু রাজি নয়, লাটাগুড়িতে তার কাজলমামার কথা বলেছিল। তাকে বললেই ভাল রিসর্ট, সাফারি-সহ অন্যান্য ব্যবস্থা সুন্দর ভাবে হয়ে যাবে। কাজলমামারও রেস্তরাঁ আছে। কিন্তু সে নেহাতই পাইস হোটেল। তা ছাড়া, ওরা একটু দূরে জঙ্গলঘেঁষা কোনও কটেজে থাকতে চাইছিল। সঞ্জু বলেছিল, কাজলমামাকে বললেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওরা ওখানকার পুরনো বাসিন্দা। কাজলমামা ‘সিলভার ওক’ রিসর্টে ওদের জন্য দুটো ডাবল বেডেড রুম বুক করে রেখেছিল। একটায় দু’জন মেয়ে, অন্যটায় ছেলেরা তিন জন। একটা এক্সট্রা কট নিয়ে নেবে।

দিনের আলো কমে এসেছে। এখন আর প্রজাপতির পিছনে ছুটে লাভ নেই। উপরে তাকিয়ে সঞ্জু দেখল, ওরা সবাই চা আর পকোড়া সহযোগে হাঁ করে কাজলমামার গল্প শুনছে। ক্যামেরা বন্ধ করে উপরে উঠে এল সঞ্জু। একটু শুনেই বুঝল কাজলমামা তার বাবা, অর্থাৎ মণিদাদুর গল্প বলছে। এখানে মণিদাদুর ধানী জমি ছিল প্রচুর। সঙ্গে বিশাল আনাজের খেত। আর ছিল অজস্র নারকেল, সুপারির গাছ। সপ্তাহে দু’দিন মণিদাদু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটের আড়তদারের গোলায় যেত হিসাবপত্র বুঝে নিতে। তবে যা-ই হোক না কেন, সন্ধের আগেই ফিরে আসত। বুনো জানোয়ারের অভাব ছিল না। খেপা বাইসন গ্রামে ঢুকে সব তছনছ করে দিত। ছাগল, বাছুর তুলে নিয়ে যেত লেপার্ড। মানুষকেও আক্রমণ করত। সঙ্গিনীর জন্য মরণপণ লড়াই করে আহত দাঁতাল প্রচণ্ড রাগে সব লণ্ডভণ্ড করে দিত। মাঝে মাঝে দু’একটা গন্ডারও এ দিকে চলে আসত।

“তার পর, কী হল আপনার বাবার?”

সঞ্জু বুঝল, গল্প বলে কাজলমামা ওদের বশীভূত করে ফেলেছে। সত্যিই, বড় সুন্দর, বড় মোহময় তার গল্প বলার ভঙ্গি। আসর দেখে সঞ্জুর মনে হচ্ছিল, যেন গ্রামের বটতলার নীচে কোনও কথক তার গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে। যেমন বসে পূর্ণিমা ওরাওঁ, মংলু কেরকেট্টা, মঙ্গল অধিকারী, মালতী বর্মণ। তার পর, ‘বলো কথোয়াল, ওটা কি সত্যিই কুমির ছিল, নাকি পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা কাঠের গুঁড়ি...’ — সবাই জানতে চায়। কাজলমামাও তেমন আসর জমিয়ে বসেছে।

“বাবা হাট থেকে আদায়-উসুল সেরে ফিরছিলেন। সে দিন একটু দেরিই হয়েছিল। তখন তো এ পথে দৈবাৎ গাড়ি দেখা যেত। দিনমানে কাজ থাকলে লোকজন পায়ে হেঁটেই যেত। তবে একা নয়, জঙ্গলের পথটুকু দল বেঁধে যেত সবাই। তার পর বাবা তো সাইকেল চালিয়ে ফিরছেন। পথের দু’পাশে ঘন শালের জঙ্গল। অবিরাম ঘণ্টাপোকার টিং-টিং শব্দ। মনে হয় কাছাকাছি কোথাও কোনও গুম্ফায় ঘণ্টা বাজছে।”

সঞ্জু বুঝল, দাদুর সেই হাত আর কোমর ভেঙে যাওয়ার গল্প কাজলমামা বেশ রহস্যময় করে বলবে এ বার। অনেক বার শুনেছে সে, তবু বলার গুণে প্রত্যেক বারই ভাল লাগে।

“ঘন অন্ধকারে ভিতর দিয়ে বেশ জোরেই সাইকেল চালিয়ে ফিরছেন আমার বাবা মণি মিত্র। হঠাৎ তাঁর মনে হল, পথের মাঝখানে অন্ধকার যেন কিছুটা বেশি গাঢ়। অনেকটা কালো যেন জমাট হয়ে রয়েছে। একদম স্থির সেই অন্ধকার। তাঁর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। সর্বনাশ, এটাই তো সেই বিপজ্জনক এলিফ্যান্ট করিডর। দফতর থেকে নোটিস দেওয়া আছে। তখনই বাবা একটা ভুল করে বসলেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে জোরালো ফোকাস ফেললেন সেই জমাট অন্ধকারের দিকে। অমনিই প্রবল বৃংহণে সমস্ত অভয়ারণ্য কাঁপিয়ে সেই অন্ধকার তেড়ে এল বাবার দিকে। তখনই বাবার মনে পড়েছিল, এটাই সেই সঙ্গীহীন খেপা দাঁতাল। সঙ্গিনীর অধিকার নিয়ে অন্য দাঁতালের সঙ্গে লড়াইয়ে আহত হয়ে এখন পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

“তার পর বলুন মামা...”

“সাইকেল ওখানেই ফেলে বাবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে পা পিছলে গড়িয়ে পড়েছিলেন পথের পাশের গভীর নালায়। বর্ষায় সেটা খরস্রোতা। শীতে পাথরে ভর্তি শুকনো নালা শুধু। ভাগ্যিস পড়েছিলেন! ওখানে হাতি নামবে না। তাকেও দেখতে পাবে না। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর উঠতে গিয়ে দেখলেন, কোমর নাড়াতে পারছেন না। বাঁ কাঁধে অসহ্য ব্যথা। হাতির কথা আর তখন তাঁর মনে নেই। সারা রাত তিনি পড়ে ছিলেন। দিনের আলো ফুটলে লোকজন তাঁকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখেছিল, তিনি অনেকটা নীচে পড়ে আছেন।”

যদিও নোটিস ঝোলানো ছিল যে রাত আটটার পর বাইরে বেরোনো নিষেধ, তবু ওরা নেশার ঘোরে বাইরে যেতে চেয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখল, আকাশে বিশাল দোলপূর্ণিমার গোল চাঁদ। বাতাসে কোথাও আবিরের গন্ধ না থাকলেও অনেক দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু ঢোলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ওরা।

“সঞ্জু, আমাদের চার জনের একটা ক্লোজ় ছবি তুলে দে না। পূর্ণ চাঁদের মায়ায়... দারুণ হবে। তোর তো দারুণ ক্যামেরা। অ্যাপারচার, লাইট, টাইম... সব শিখে নিয়েছিস তো?

ওরা চার জন পাশেই একটা বড় পাথরের ওপর বসল। কিন্তু ওরা জোড় ভেঙে বসেছে। পরিতোষ আর দীপা জড়াজড়ি করে বসেছে। তনুময় আর সোহিনী। ওদের কথা জড়ানো, স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। একে অন্যকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে।

“এই! সঞ্জু রয়েছে। হাতটা সরাও...” দীপা ফিসফিস করে বলেছিল।

“আরে ধুস, ও আবার মানুষ নাকি। এ সবের কী বোঝে। মেয়ের বদলে ক্যামেরা নিয়ে শুয়ে থাকে। ওই ফরেস্টের দিকে যাবে? তোমাকে আরও পেতে ইচ্ছে করছে।”

সঞ্জু ছবি তুলতে পারছিল না। দেখছিল আসঙ্গলিপ্সায় কাতর চার জন মাতাল মানুষকে। মাটিতে বসে পড়ল সঞ্জু। তার মুখ জুড়ে প্রচণ্ড ব্যথার রেখা ফুটে উঠেছে, সে বলে, “আমি উঠতে পারছি না। আমি ছবি তুলতে পারছি না। আমার কোমর ভেঙে গেছে। আমার কাঁধেও অসহ্য ব্যথা। তোরা একটু ধরবি আমাকে!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Short Story Bengali Story

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।