ছবি: রৌদ্র মিত্র।
গম্ভীর গলায় পরিতোষবাবু বললেন, “তুই কিন্তু আবার বেশি দাম বলছিস মুকলে! তোর বাপ থাকলে সব সময় কম নেয় আমার থেকে, তা জানিস?”
আনাজপাতির পাঁজা সাজিয়ে ধূপ দিয়ে সবে দোকানটা খুলে বসেছে মুকুল, তখনই পরিতোষবাবু এসে হাজির। ভর সন্ধেয় এ সব দামাদামির খদ্দের মানেই অলক্ষণ। মুকুলের মুখটা খানিক বেজার হয়ে গেল, “আরে কাকা, এখন বকফুল বলে মেলাই ভার। কুত্থাও এট্টা এই ফুলির গাস তুমি দেখতি পাও এখুন আর? বলো? দশ টাকা করি না নিলি বেপারিরেই বা কী দিই, আর আমারই বা কী থাকে, বলো তুমি?”
পরিতোষবাবুর মেজাজ চড়ে গেল মুকুলের কথায়, “ও সব চালাকি রাখ তো! আমার কাছে পাঁচ টাকা বেশি নিবি কী করে, সেটাই তোর ধান্দা। আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস?”
“কী যে তুমি বলো কাকা! সেই কুন ছোট্টবেলাথে তুমারে দেখছি আমি। আমি কি তুমার কাছে বেশি নিতি পারি? বাবা তুমারে নমস্কার দেয় সব সময়। তবে কী জানো, এখন দাম অনেক সব জিনিসির, তাই আর কী।”
ও দিকে সন্ধে নেমে গিয়েছে ঝুপ করে। এই কার্ত্তিক-অঘ্রান মাসের সন্ধেগুলো এমনই। কখন যে আলো কমে গিয়ে রাত শুরু হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। হাওয়ায় একটা শুকনো টান-টান ভাব। পুজোপার্বণ শেষে, রোজের রুটিনগুলোও শুরু হয়ে যায় এই সময়। বাস থেকে নেমে আবার অটোর লাইনে দাঁড়াও এখন। আর ইদানীং অটোর লাইনে এত ভিড় হয় যে, ওখানেই প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট কেটে যায় রোজ।
আরতি রোজই এই নিয়ে কথা শোনায় একপ্রস্ত। ইচ্ছে করেই নাকি রোজ দেরি করে বাড়ি ফেরেন পরিতোষবাবু, যাতে বাড়ির কোনও কাজ না করতে হয়। তার মধ্যে এই দরাদরি করতে গিয়ে আরও দেরি হচ্ছে আজ। কোথায় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সিজ়নের প্রথম বকফুলের বড়া নিয়ে আরতির সঙ্গে একটু ঘন হয়ে বসবেন, তা নয় এখন আনাজের দাম বাড়ার ফিরিস্তি! পরিতোষবাবু বিরক্ত হয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন এ বারে, “আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে! এই নে রাখ কুড়ি টাকা। দু’আঁটিই দে তুই। বেছে দিবি ভাল দেখে। পোকা-টোকা না থাকে যেন আবার।”
মুকুল হ্যা-হ্যা করে হাসে। বলে, “বকফুলি আবার পুকা হয় নাকি! তবু আমি দেখেই জিনিস দিই তুমারে। তা বকফুলির বড়ার সাথে এই লঙ্কা নিবা নাকি কাকু দু’টো? এগুলো নতুন আমদানি। যেমন ঝাঁজ তেমনি গন্ধ। কাকিরে বলবা, ব্যাসনে দিয়ে লঙ্কার চপ করে দিতি। খেয়ে বোলো, তার পর পয়সা দিয়ো।”
পরিতোষবাবু খুশিই হলেন। ছেলেটার বুদ্ধি আছে বটে। ঠিক দু’টো লঙ্কাও বেচে নিল কেমন! এমন বুদ্ধিমান ছেলেছোকরাই তো সমাজে চাই। নইলে দেশ এগোবে কেমন করে! খুশিমনে তিনি মুকুলের পয়সা মিটিয়ে অটোর লাইনে এসে দাঁড়ালেন। কপাল ভাল, নাকি শনিবার বলে তাই, আজ অটোর লাইনে মাত্র সাত জনের পিছনেই পরিতোষবাবু। আর দুটো অটো এলেই হয়ে যাবে।
কনকনে শীত শুরুর আগে হেমন্তের এই সময়টায় হাওয়ায় যেন একটা আঠালো ভাব থাকে। মাখো-মাখো একটা বিকেল সন্ধে তৈরি হয় শহরতলিতে। ঘরফেরতা টুকটাক কিছু শখের বাজার করে বাড়ি যেতে বেশ ভাল লাগে পরিতোষবাবুর। আর আজ তো বকফুল পাওয়া গেছে! আরতি আবার এ সব দারুণ বানায়। গরম চায়ের সঙ্গে বকফুলের বড়া এই ওয়েদারে, আহা! আজই ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্ল্যানটা সেট করে ফেলতে হবে। শান্তিনিকেতনের কথা ভাবলেই মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে যায়। আরতিকে একটু রাজি করিয়ে ফেলতে পারলেই ব্যস। তা এই একষট্টি বছর বয়সে এসে বেশি দূরে কোথাও যাওয়ার মতো শরীরের জুত তো আর নেই। তবে কত্তা-গিন্নি দু’জনে মিলে প্রতি শীতে এক বার করে কাছেপিঠে কোথাও একটা বেরিয়ে পড়েন ঠিক।
এই গত শীতেই তো দু’জনে গিয়েছিলেন টাকি বেড়াতে। পূর্ণিমায় ইছামতীর রূপ যে কী অসাধারণ, যে দেখেছে সে-ই শুধু জানে। আরতি তো বাচ্চা মেয়েদের মতো বায়না করে ভটভটি চড়ে ঘুরল সারাটা দিন। সে নাকি নৌকোয় থাকবে। ব্যস, রাত্তিরে ধুম জ্বর আর তার সঙ্গে হাঁটুর ব্যথা। সারা দিনের রোদ, তার সঙ্গে নদীর জোলো হাওয়া, সহ্য হবে কেন? পরের দু’দিনের সব প্ল্যান বাতিল করে কলকাতা ফিরতে হয়েছিল সকাল-সকাল। সেই থেকে পরিতোষবাবু ঠিক করেছেন, ও সব নদী-সমুদ্রে শীতকালে আরতিকে নিয়ে যাবেন না। এ বারের শীতে শান্তিনিকেতনের প্ল্যানটা করতেই হবে।
বড় রাস্তার মোড়ে অটো থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন পরিতোষবাবু। তেনার আবার আজ মুড কেমন থাকে কে জানে! বাড়ি ঢুকে টবের গাছপালায় জল দেওয়ার কাজটা আগেভাগে সেরে ফেলতে হবে আজ। সংসারের সব খুচরো কাজগুলো পরিতোষবাবুকেই করতে হয়। আরতির বিশ্বাস, কাজের লোকেরা জল দিলে গাছেরা নাকি দুঃখ পায়, ঠিকমতো বাড়ে না। পরিতোষবাবু এ সব বিশ্বাস করেন না যদিও। আরতির মন রাখতেই ও সব উৎপাত সহ্য করেন। মনে মনে নিজের কপালের দোষ দেন।
গাছপালাগুলোরও কী ভাগ্য তাই ভাবেন। ওর খানিকটা যত্নও যদি পরিতোষবাবু নিজে পেতেন! তা তো নয়, সারা ক্ষণ খালি শুনে এলেন তিনি নাকি কিছুই পারেন না, আদ্যোপান্ত অপদার্থ একটি মানুষ। ভাগ্যিস আরতি ছিল, তাই নাকি এ জীবনে তরে গেলেন। কী দেখেই যে সেই কলেজ ফেস্টে ফার্স্ট ইয়ারের আরতির প্রেমে পড়েছিলেন! সেই থেকে আজ অবধি চলছে। এ সব আর কে-ই বা বুঝছে আর কে-ই বা শুনছে! যা-ই হোক, আজ যদি ম্যাডাম একটু সদয় থাকেন, তবে বারান্দায় চায়ের সঙ্গে গরম বকফুলের বড়া আর গল্পগাছায় জম্পেশ কাটবে সন্ধেটা।
নিজেদের আবাসনের এই গলির মোড়ের আলোটা ফের দপদপ করছে কিছু দিন হল। আরতি বহু বার কথা শুনিয়েছে এই নিয়ে, “কী এক এঁদো গলিতে যে ফ্ল্যাট নিয়েছ! রাস্তার একটা আলো অবধি ঠিক মতো জ্বলে না। মানুষ থাকে এখানে!”
পরিতোষবাবু একটুও অবাক না হয়ে নিজের নির্বুদ্ধিতা মেনে নেন, “তা যা বলেছ। ভাবলাম যে শেষ বয়সটা দু’জনে একটু নিরিবিলি থাকব, আর সুভাষটাও এত করে ধরল তখন। টুপাইরা তো আর দেশে ফিরবে না। সেই ভেবেই আর কী…”
“আ-হা রে! কী আমার নিরিবিলি! তা বলে এ রকম সুরকি-ফেলা রাস্তা বাড়ির সামনে! কলকাতার আশপাশে কোথাও এ রকম আছে? তোমাকে বোকা বানিয়েছে তোমার খাতিরের প্রোমোটার বন্ধু। বুঝেছ?”
“তা কেন! ও তো আর ঠকায়নি আমাকে। ঠিক সময়ে বাড়িটা রেডি করে দিল কেমন, বলো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তবে আর কী! বন্ধু বললেন আর উনিও ধেইধেই করে নেচে উঠলেন। তোমার নিজের ঘটে কি আছে কিছু আদৌ? নাকি সারা জীবন এ সব বুজরুকি দিয়েই কলেজে পড়িয়ে গেলে, শুনি?”
পরিতোষবাবু যদিও জানেন আরতি নিজেই বেশি আগ্রহী ছিল এ ব্যাপারে, এই পাড়ার নিরিবিলি শান্ত পরিবেশের জন্য, তবু এ সব সময় তিনি নিজের বোকামোয় সিলমোহর চাপিয়ে চুপচাপ কেটে পড়েন। বেশি ঘাঁটান না আরতিকে। বেশি কিছু বললেই আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবে আর ছেলের কাছে নালিশ জানিয়ে সংসার মাথায় তুলবে। তার চেয়ে বরং চুপচাপ থাকাই মঙ্গল।
গত শীতে এক দিন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন পরিতোষবাবু। রাস্তার ঢালটা ঠিকমতো খেয়াল করতে পারেননি। ব্যস, পড়ে গিয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালির হাড়ে এমন লাগল, টানা এক মাস পা তুলে বসে থাকা বাড়িতে। আর সেই সঙ্গে আরতির মেজাজ! আইস প্যাকের সেঁক দিতে দিতে রোজ আরতির একই প্রশ্ন, “এত লোক চলে রাস্তায়, কেউ তো তোমার মতো এ রকম শুকনো ডাঙায় আছাড় খায় না! তুমি পড়লে কী করে?”
পরিতোষবাবু মিনমিনে গলায় বোঝানোর চেষ্টা করেন, “আরে ওই জায়গাটা কেমন উঁচু-নিচু আছে, দেখেছ তুমি? আলোটাও ঠিকমতো জ্বলছিল না রাস্তার। ঠিক বুঝে ওঠার আগেই তো পা-টা মচকে গেল।”
“থাক থাক। আর এত খতেন দিয়ে কাজ নেই। বুঝে ওঠেননি! বলি কোন বিষয়টা জীবনে ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারলে শুনি! এখন ভোগো বসে, আর কী!”
পরিতোষবাবু আরতির গালে একটা আলতো টোকা মেরে বললেন, “কেন? ঠিক বুঝেই তো তোমাকে বিয়েটা করে ফেলেছিলাম।”
আজ এক বার বকফুলের বড়া খেতে খেতে সে কথা মনে করিয়ে দেবেন নাকি আরতিকে? এ সব ভাবতে ভাবতে আবাসনের গেট পেরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত কখন চলে এসেছেন, খেয়ালই করেননি। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঢুকলেন পরিতোষবাবু।
সারা বাড়ি অন্ধকার। একটাও আলো জ্বালানো হয়নি কোথাও। ও ধারে ড্রয়িং-এর স্লাইডিংটা হাট করে খোলা। সেখান থেকেই বাইরের আলো আরতির টবের গাছপালাদের গা বাঁচিয়ে একটু একটু ঘরে এসে ঢুকছে। সন্ধের পর জানালাটা বন্ধ রাখার কথা বার বার বলেও লাভ হয়নি আরতিকে। এই সময়ে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে শহরে। জানালা এ রকম হাট করে খুলে রাখার কোনও মানে হয়? কিন্তু কে কার কথা শোনে!
বকফুল আর লঙ্কার থলে হাতেই ক্লান্ত শরীরে আন্দাজ করে আলোর সুইচ দিলেন পরিতোষবাবু। ড্রয়িং-এর দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে আরতির মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। গত কাল ছবিতে দেওয়া রজনীগন্ধার মালাটা এখনও হালকা গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরে। ছবির নীচে টেবিলে ধূপের ছাই জমে রয়েছে। পরিতোষবাবু আরতির মুখ খুঁটিয়ে দেখলেন ভাল করে। আরতির চোখের কোলটা যেন বেশিই ফোলা মনে হচ্ছে! আরও একটু কাছে গিয়ে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করলেন। বিশেষ কিছু বোঝা গেল না।
কিছু ক্ষণ পর সবিতা এসে রাতের রান্নার কাজে লেগে গেল রোজকার মতো। তত ক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে গাছে জল দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে পরিতোষবাবুর। সবিতা এসে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, চা খাবেন তো? গরম গরম দু’টো বকফুল আর লঙ্কার বড়াও ভেজে দিই?”
পরিতোষবাবু হেসে ফেললেন, বললেন, “ওগুলো তোদের জন্যই এনেছি রে। বাড়ি নিয়ে যা সব। সবাই মিলে খাস।”
বকফুলের বড়া আরতির খুব পছন্দের ছিল। আরতির পছন্দের অনেক কিছুই আর খেতে পারেন না পরিতোষবাবু।
সবিতা কাজ সেরে চলে গেলে পরিতোষবাবু ঘরের আলোগুলো সব নিবিয়ে দিলেন। শুকনো রজনীগন্ধার মালাটা খুলে ফেলে দিলেন আরতির ছবি থেকে। ছবির নীচ থেকে ধূপের ছাই সরিয়ে সুগন্ধী মোমবাতিটা জ্বাললেন। বাইরে থেকে চুঁইয়ে আসা আলো মোমবাতির নরম আলোয় মিশে, হালকা হলদেরঙা একটা নিভৃতি তৈরি করেছে ঘরের ভিতর।
বাড়ির বাইরে, আরতির এই ছবিটা যত ক্ষণ চোখের আড়ালে থাকে, নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারেন পরিতোষবাবু। তার আগে ও পরে শুধু নীরবতাই তাঁর সঙ্গী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy