ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: পঞ্চপুত্রসহ নিষাদ-রমণীকে জতুগৃহে দগ্ধ করা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না অর্জুনের বিবেক। যুধিষ্ঠির বাস্তবসম্মত নানা যুক্তিতে তাঁকে প্রবোধ দেন। অর্জুনের সংশয় তবু যায় না, সকলে কি একেবারেই ওই পাঁচটি মৃতদেহকে পঞ্চপাণ্ডবের বলে মেনে নেবে? দেহগঠন ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখবে না! যুধিষ্ঠির সে সম্বন্ধেও অর্জুনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্য ও আসন্ন অনিশ্চয়তায় মনে মনে কষ্ট পান কুন্তী। তবু পাঁচ ছেলের কাছে সে মনোভাব প্রকাশ করেন না। পথ চলেন অন্ধকারে।
সমৃদ্ধির চূড়ায় ছিল যারা কয়েক দণ্ড আগেও— এখন তাদের সামনে অপেক্ষমাণ সহায়হীন অজ্ঞাতবাস, নিত্য গোপনীয়তা, চরম দৈন্য, অনিশ্চিত ভিক্ষুক-জীবন। কে জানে, কত দিনের এই নির্বাসন! এই অন্ধকার থেকে কবে আবার আলোকে প্রত্যাবর্তন...
ভীমের অবিন্যস্ত কেশগুলিতে স্নেহপরশ বুলিয়ে দিতে দিতে রাজ্ঞী ও রাজমাতা পৃথা বললেন, “উদ্বেগ করিস না, বাছারা! এক দিন অরণ্য থেকে প্রাসাদে এসেছিলি তোরা আমার হাত ধরে। আবার তোদের হাত ধরে প্রাসাদে পৌঁছে দেব। ভাবিস না। মা আছে সঙ্গে, চিন্তা কী?”
৪৮
শেষরজনীর মলিন চন্দ্রমা অরণ্যশীর্ষে লগ্ন হয়ে আছে, আর কয়েক দণ্ড পরেই ঘনকৃষ্ণ বৃক্ষচ্ছায়াগুলির পিছনে অদৃশ্য হয়ে যাবে। নিশিজাগর নক্ষত্রগুলিও এখন পাণ্ডুর। অনিমিখ ক্লান্তনেত্রে অপেক্ষায় রয়েছে, পূর্বগগনের কালিমা কখন ঈষৎ অস্পষ্ট হয়! উদীয়মান স্বর্ণজ্যোতিরেখাটিকে অভিবাদন করে তবেই তারা তমোময় নভোমঞ্চ ত্যাগ করে আলোক-যবনিকার অন্তরালে যাবে, তার পর সারা দিন তাদের বিশ্রাম।
ক্ষুদ্র মৃন্ময় শয়নগৃহটিও অন্ধকার। শিয়রে প্রদীপটি নিভে গিয়েছে কখন। শুধু মুক্ত দ্বার আর বাতায়ন দিয়ে প্রবিষ্ট ক্ষীয়মাণ জ্যোৎস্নার আভা।
কাষ্ঠাসনের দীন শয্যায় এক শ্যামকান্তি রূপবান যুবা, অর্ধমুদ্রিতনয়ন। বহু দিন পর, আজ নিদ্রার মধ্যে বারবার অস্থির হয়েছে সে। ছিন্ন স্বপ্নে নানা বিচিত্র ছবি ভেসে ওঠে ক্রমাগত।
...দুই পাশে পর্বত, মধ্যে এক সঙ্কীর্ণ উপলময় পরিসর। সেই নির্জন গিরিবর্ত্মে ভূতলশায়ী সে। এক কৃষ্ণবর্ণ প্রচণ্ড পুরুষ তার বক্ষের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে! তাঁর দুই বলশালী হাতে উত্তোলিত এক বিশাল প্রস্তরখণ্ড! তাঁর নেত্র ক্রোধে রক্তিম, এখনই তিনি পাথরটিকে আছড়ে ফেলবেন তার মাথায়...
নিদ্রিত যুবকের দুই করতল স্বতই যুক্ত হয়ে যায়। অস্ফুট কাতরোক্তি নির্গত হয় তার মুখ থেকে।
“প্রভু, শুনেছি আপনিই নররূপী ভগবান! মরতে ভয় পাই না, আপনার হাতে নিহত হচ্ছি এ তো পরম পুণ্য! কিন্তু আমার এ-জন্মের প্রতিজ্ঞাটুকু পূর্ণ হল না... নিধনের আগে অন্তত আশীর্বাদ করুন যাতে পরজন্মে...”
স্বপ্নচিত্র পরিবর্তিত হয়ে যায় আবার।
“কী করছেন, প্রভু! আমাকে আলিঙ্গন করবেন না... আমি নীচ জাতি...”
তেজোময় পুরুষটির মুখে রহস্যময় কিন্তু সুস্থির হাসি, “পরজন্ম? চাও? সত্যই চাও?”
“চাই! এই অভিশপ্ত ব্যর্থ জীবন— এ আর দরকার নেই। যত বার মাথা তুলতে চাই তত বার পায়ের নীচে মাটি সরে যায়...”
“কঠিন ভিত্তির উপর সুস্থিত করো নিজের অস্তিত্ব। আগে প্রকৃত আত্মপরিচয় জানো, তোমার সত্যকার গোত্রসন্ধান! তুমি নিষাদবংশজ নও...”
“নিষাদ নই! তবে?”
“ক্ষত্রিয়! তুমি ক্ষত্রিয়! নিজের অবয়ব দেখোনি, দর্পণে বা নদীজলে? অন্তরে উপলব্ধি করোনি সেই ক্ষাত্রতেজ যা কখনও অনার্যশোণিতে প্রকট হতে পারে না! জাগো হে, নিজেকে চেনো! তোমার শিরায় সেই শোণিত, যে-শোণিত...”
শয্যায় ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ ফিরছে তরুণ। তার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম। যেন বহু যুগ কল্প মন্বন্তর অতিক্রম করে ভেসে আসছে চলচ্ছবিগুলি— প্রস্ফুটিত হচ্ছে তার মুদ্রিত চক্ষুর গভীর কৃষ্ণপটে— পরক্ষণেই বিলীন হচ্ছে।
“নবজন্ম?” ঘুমের ঘোরেই সে ফিসফিস করে ওঠে।
“হ্যাঁ! তাই তো চেয়েছিলে তুমি! বলেছিলে, মৃত্যুর পূর্বে তোমার অন্তিম প্রার্থনা! পরজন্মে যেন...”
“চেয়েছিলাম, প্রভু! কিন্তু সেই আঁধার-ঘনানো গোধূলিতে আমার প্রার্থনা-করা মৃত্যুটি তো দিলেন না আপনি। পাথরটি তো দূরে ফেলে দিলেন। আমাকে এত দিন এমন যত্নে আড়ালে বাঁচিয়ে রাখলেন... ডানার আড়ালে পাখির শাবকের মতো... কেন প্রভু? মৃত্যু না হলে নবজন্ম কেমন করে হবে?”
আবার সেই হাসি। সেই আশ্চর্য স্বর! কী যে সম্মোহক! “মৃত্যু কি শুধুই শরীরের হয়, ভ্রাতঃ?”
“ভ্রাতঃ! আপনি আমাকে ভাই-সম্বোধন...”
“শোনো। তুমি মৃত্যু চেয়েছিলে, এখন থেকে নিজেকে মৃত জ্ঞান কোরো। নিষাদ মৃত। সম্পূর্ণ বিস্মৃত হও অতীতের অস্তিত্বকে। তুমি পরজন্ম প্রার্থনা করেছিলে। এই মুহূর্ত থেকে তোমার সম্পূর্ণ নূতন এক জন্মের প্রস্তুতি শুরু হল। নূতন পরিবার হবে তোমার, নূতন নাম। নূতন প্রতিবেশ, নূতন রূপ, নূতন পরিচয়! সেই তোমার পরজন্ম, সেখানেই তোমার প্রতিজ্ঞা চরিতার্থ হবে! এক বিপুল রাষ্ট্রপরিকল্পনার অংশ হও তুমি...”
নিদ্রিত যুবার ভ্রূ বঙ্কিম হয়ে উঠছে। নিজের অজ্ঞাতসারেই তার করাঙ্গুলিমুদ্রায় বিস্ময়ের আভাস ফুটে ওঠে।
“সেও কি সম্ভব, প্রভু? আমি নিষাদের কুটিরে পালিত... সেই জীবনধারা আমার হাড়ের মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে! জগতের চোখে আমি মৃত লোক এক জন, আপনার কৃপায় এই কয়েক মাস গিরিগুহায় আত্মগোপন করে প্রাণ ধরে আছি। কিন্তু, সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় নতুন ব্যক্তি হব কী করে? সে তো অসম্ভব কাজ!”
“ইতিহাসের ডাক এসেছে, ভ্রাতঃ। ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অভ্যুত্থান— এই অশুভকে নিবারণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে গভীর, বিস্তারী মহা-পরিকল্পনা! সেই নাট্যে তোমার নব ভূমিকা আমি নির্ধারণ করে দিচ্ছি। নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে। পূর্ব-ইতিবৃত্ত বর্জন করো।”
“পূর্ব-ইতিহাস মোছা যায়, প্রভু?”
“সহজ নয়। কিন্তু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্ভব। শোনো। জগৎ জেনেছিল তোমার অঙ্গুষ্ঠ কর্তিত। এখন জগৎ জানে, তুমি মৃত। এই তো চমৎকার অবসর। ...নব অঙ্গুষ্ঠ পেয়েছ আগেই, এবার নব পরিচয়! কেউ তোমাকে চিনবে না আর। যে-ব্যক্তি মৃত বলে প্রচারিত, তার সুবিধা অনেক, তার অস্তিত্ব-সম্ভাবনা কেউ গণনার মধ্যে আনে না। জম্বুদ্বীপের ক্ষত্রিয়-সংসারে এমনিতেই তুমি অপরিচিত ছিলে; তোমার নামটুকু জানত যারা, তারাও তোমাকে চাক্ষুষ করেনি তেমন। তদুপরি দীর্ঘ অজ্ঞাতবাসের পর তুমি ঘোষিত ভাবে মৃত। এখন পৃথক এক অস্তিত্ব নিয়ে জগতের কাছে প্রত্যাবর্তন— তোমার চেয়ে আর কারই বা এমন সুবর্ণসুবিধা?”
“প্রত্যাবর্তন? আলাদা লোক হয়ে? অন্য নাম-পরিচয়ে বাকি জীবন...!”
“হ্যাঁ! অতীতের অভিজ্ঞান-হীন, সম্পূর্ণ নূতন এক আবির্ভাব! তুমি তোমার আরব্ধ শপথ পূর্ণ করতে পারবে এমন পন্থা উন্মোচিত হয়ে যাবে তোমার সম্মুখে! অগ্নিতে ভস্মীভূত হোক মৃত নিষাদের পূর্বসত্তা, সেই অগ্নি থেকেই হবে তোমার পুনরুত্থান...”
স্বপ্নের মধ্যে মাথা নাড়ে তরুণ। অস্থির হয়। অক্ষিতারাগুলি কাঁপে উত্তেজনায়।
কম্বুকণ্ঠে বলে চলেছেন শ্যামাঙ্গ মহাভুজ পুরুষ, “শোনো হে। পলকপাতের মধ্যেই তো এ হওয়ার নয়। সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। লোকচক্ষুর অগোচরে তোমার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করব আমি স্বয়ং! শিক্ষা, দীক্ষা, আভিজাত্যের পাঠ। বাচনভঙ্গি, পদক্ষেপ, শরীরী ভাষা, আচরণ। শিখে নাও সব, শোষণ করে নাও। দীর্ঘ অভ্যাসে সমস্ত কিছু বিবর্তিত করা সম্ভব জেনো। শারীরিক গঠন পরিবর্তিত হবে ব্যায়ামাদিতে, কৃশ অবয়ব হবে পেশল। বিশেষজ্ঞ ভিষগবৃন্দের পরিচর্যায় বাহ্যিক রূপও পরিমার্জিত হবে। গাত্রবর্ণ, কেশবিন্যাস, ভ্রূ-সংস্থান— মুখাবয়ব পর্যন্ত এমন পরিবর্তন করে দেওয়া হবে, কারও সাধ্য নেই তোমার পূর্বসত্তাকে চিনবে! শুধু এই নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তোমার একাগ্র অধ্যবসায় প্রয়োজন। নতুন এক রাজপুত্র হবে তুমি, অভিজাতবংশীয় বীর! তুমি সম্মত?”
“না প্রভু, এ-কর্ম খুব অবাস্তব! এই বয়সে নতুন লোক সাজতে যাওয়া... রাজপুত্তুর! আমি ধরা পড়ে যাব নিশ্চিত...”
“তবে অনারব্ধই থাক তোমার প্রতিজ্ঞা!” তীব্র হয় বিপরীতের স্বর, “দ্রোণহন্তা হওয়া তোমার আর হল না... তুমি অসহায় অক্ষম অবস্থায় অরণ্যে পর্বতে ঘুরে ঘুরে বৃদ্ধ হয়ে মরো... অসার্থক ব্যাধজীবনই তোমার অন্তিম সীমা হয়ে রয়ে যাক! ইচ্ছার তীব্রতা নেই তোমার...”
“না, না! ...আমি সম্মত, প্রভু! সম্মত!” আর্তনাদের ভঙ্গিতে কম্পিত হচ্ছে নিদ্রিত যুবার স্বপ্নতাড়িত ওষ্ঠ, “ঠিক! ঠিক বলেছেন আপনি। আমার তো বেঁচে থাকার আর অন্য উদ্দেশ্যই নেই হে যদুনাথ! মরেই গিয়েছি ধরে নিই! প্রতিজ্ঞাপূরণের উপায় না হলে, এই ব্যর্থ জীবন টেনে নিয়ে বেড়াবই বা কী জন্য? বেশ... আমি আপনার কথামতোই সব কিছু অভ্যাস করব। আপনি ঘষেমেজে বদলে দিন আমায়... নতুন জন্ম দিন। রাজার ঘরেই শুরু হোক আমার নতুন জীবন, নতুন ভূমিকার জন্য আমি প্রস্তুত... আগুনে পুরনোকে ছাই করে, আবার আগুন থেকেই উঠে আসব নতুন আমি...”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy