ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: হস্তিনাপুরের রাজপুরুষদের বারণ সত্ত্বেও ধৃষ্টদ্যুম্নকে শিক্ষা দিতে পিছপা হবেন না বলে জানালেন আচার্য দ্রোণ। নিজস্ব আশ্রমে দ্রৌপদ ধৃষ্টদ্যুম্নকে রেখেই এ কাজ সম্পন্ন করবেন বলে মনস্থ করেন তিনি। পরবর্তী কালে সেই অনুযায়ীই কাজ শুরু করেন। কিন্তু দৈববাণীর কথা অহর্নিশ মনে পড়ায় নিজেকে সুস্থির রাখতে পারেন না দ্রোণপত্নী কৃপী। ধৃষ্টদ্যুম্ন শিক্ষাকালে যখনই গুরুর সঙ্গে যুদ্ধকসরতে অবতীর্ণ হয়, ছদ্মআক্রমণ করে গুরুকে, দ্রোণের অমঙ্গল আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে তাঁর।
যখনই সে দ্রোণের কণ্ঠের দিকে তার খড়্গ চালনা করছে, জানু দিয়ে আঘাত করে ধূলায় ফেলে দিচ্ছে, বক্ষের উপর চেপে বসে শস্ত্র উত্তোলন করছে— কৃপী সেই ভঙ্গিমাগুলিকে কিছুতেই নিছক অনুশীলন-পদ্ধতি ভাবতে পারছেন না কেন?
আজ শুধু নয়। গত চার পক্ষকাল ধরে এই দুর্বিষহ মানসিক অবস্থা চলেছে কৃপীর। আজ শেষ বার। আজ শিক্ষা সমাপ্ত, কাল প্রভাতে পাঞ্চাল-রাজপুরীতে ফিরে যাবে তরুণ শিক্ষার্থী। কাল থেকে অন্তত চক্ষুদু’টির এই নিত্যযন্ত্রণার অন্ত।
পাঞ্চাল-কুমারকে স্বগৃহে রেখে শিক্ষাদান কি নিতান্তই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল? দ্রোণ কি বড় অধিক আতিশয্য দেখাচ্ছেন না? অন্তত কৃপীর দৃষ্টির অন্তরালে কোথাও যদি এই কর্মটি সম্পন্ন হত, নিত্য এমন মানসিক সঙ্কটে জর্জরিত হতে হত না সরল ব্রাহ্মণীকে! যেন প্রতিনিয়ত নিজের বৈধব্যমুহূর্ত দেখতে বাধ্য হচ্ছেন...
কিছুতেই নিজের অন্তরকে বোঝাতে পারছেন না কৃপী— যে, এ সব দৃশ্য সত্য নয়, অভিনয় মাত্র, মহড়া মাত্র, স্বাভাবিক অনুশীলন মাত্র! কেবলই মনে হয়— এ বস্তুত অচির ভবিষ্যতের কোনও এক বাস্তব দৃশ্যেরই পূর্বাভাস, অনিবার্য এক আগামীর পূর্বপ্রস্তুতি চলছে ওই উদ্যানে!
কাল শুধু মহড়াটুকুর অবসান। চোখের আপাত স্বস্তি। কিন্তু নিয়তি? তার তো খণ্ডন নেই।
৪৬
অশ্বত্থামাও তীব্র বিরোধিতা করেছিল পিতার সিদ্ধান্তের। এত স্পর্ধা নির্লজ্জ দ্রুপদের, ঢক্কানিনাদ করে নিধনযজ্ঞ করিয়ে, আবার সেই যজ্ঞলব্ধ ঘাতক-পুত্রকেই সাড়ম্বরে বিদ্যার্থী সাজিয়ে আনে! ক্রূর পরিহাসেরও সীমা থাকে! প্রবল ক্রুদ্ধ হয়েছিল সে পাঞ্চালের প্রস্তাবে— বলেছিল ওই যুবাকে সে এই গৃহে পদার্পণমাত্র হত্যা করবে। ঘাতককে সযত্নে শিক্ষা দেবেন পিতা, এ তার সহ্য হয়নি! পিতৃহন্তাকে নিধন করায় পাপ নেই, এই বলে গর্জন করছিল সে।
দ্রোণ খুব শান্ত ভঙ্গিতে তাকে বলেন, “অবশ্যই। কিন্তু আগে তাকে পিতৃহন্তা হতে দাও হে! তত দিন পর্যন্ত সে তোমার অবধ্য। উপরন্তু, শিক্ষাক্ষেত্রে সে সতীর্থ হতে চলেছে তোমার। এই নিরপরাধকে হনন করলে— তুমি বিপ্রসন্তান, নরকস্থ হবে যে!”
অশ্বত্থামা স্বভাবত উগ্র ও একরোখা। সে বলেছিল, “নরকও স্বীকার, আমি পিতার প্রতি কর্তব্য করব!”
দ্রোণ কঠোর হয়েছিলেন এ বার, “অবাধ্যতা কোরো না। সে ক্ষেত্রে পিতৃ-নিষেধ অমান্যকারী পাতক জ্ঞানে আমার ঔর্ধ্বদৈহিক ক্রিয়াকর্মের অধিকার থেকেও তোমাকে বঞ্চিত করে যাব আমি। আমার সিদ্ধান্তের পথ থেকে নিষ্ক্রান্ত হও! আগে পাঞ্চালকুমার তার দৈবাদিষ্ট কর্ম সমাধা করুক, তার পর তুমি কর্তব্যাকর্তব্য স্থির কোরো!”
অশ্বত্থামা বিস্ময়াহত চোখে তাকিয়ে ছিল কয়েক মুহূর্ত। তার পর বলেছিল, “আত্মহত্যা করতে চাইছেন আপনি, পিতা! এও পাপ...”
“না, এ প্রায়শ্চিত্ত!” দ্রোণের কণ্ঠ নিরুত্তাপ, “নিয়তি যাকে যে কর্মে নির্দিষ্ট করেছে, সেই দৈবকর্মে নির্মোহ ভাবে সহায়তা করাই মানবের কর্তব্য!”
“আমার পক্ষে এমন নির্মোহ হওয়া অসম্ভব! আপনি নিজ অন্ত্যেষ্টির সমিধ-আহরণে প্রবৃত্ত হচ্ছেন— এ আমি চোখের সামনে দেখতে পারব না। তত মহাপুরুষ আমি নই, পিতা!”
দ্রোণ বলেছিলেন, “তবে তুমি এক কাজ করো দেখি, পুত্র অশ্বত্থামা! মাস দুই তুমি উত্তর-পাঞ্চালের প্রাসাদে গিয়ে অতিবাহন করো, শাসনকার্যের তত্ত্বাবধানে মন দাও! এই ক্ষুদ্র গৃহে শিক্ষার্থীসমাগম হলে স্থানসংকুলানেরও সমস্যা হবে, তাই না বৎস? চারি পক্ষকাল শিক্ষা চলবে, তত দিন তুমি এখানে অনুপস্থিত থাকলেই উভয়ত মঙ্গল।”
“সেই ভাল!” সক্ষোভে শ্বাস ফেলেছিল দ্রোণপুত্র, “পাপিষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন অনুশীলন-ছলেও আপনার উপর অস্ত্রহস্তে উদ্যত হচ্ছে— এ দৃশ্য দেখলে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারব না!”
অশ্বত্থামা ভাগ্যবান। সে দূরে চলে যেতে পারল। কিন্তু কৃপী? গত দুই মাস কাল তিনি এই প্রত্যক্ষ দর্শনপীড়া সহ্য করে আসছেন।
স্বামীর প্রিয় শাক-ব্যঞ্জনটি আজ সম্পূর্ণ দগ্ধ হল। কৃপী যখন সচেতন হলেন, তখন আর কিছু উদ্ধারযোগ্য নেই। আবার নতুন করে পাকের প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্রোণজায়া বস্ত্রাঞ্চলে চক্ষু মুছলেন।
স্নানান্তে অন্নগ্রহণ করতে বসেছে গুরুশিষ্য। কৃপী নিত্যকার মতোই পরিবেশন করছেন। আজই শেষ বার একত্রভোজন গুরুশিষ্যের।
দুই মাস ধরে ধৃষ্টদ্যুম্ন নামক তরুণটিকে সশঙ্কচিত্তে পর্যবেক্ষণ করছেন কৃপ-সহোদরা। যুবা বেশ বিনয়ী কিন্তু আড়ষ্ট নয়। হাস্যপরিহাস করে গুরুর সঙ্গে। গুরুও তার সঙ্গে মিত্রবৎ আচরণ করেন। বড় আশ্চর্য এই সম্পর্ক! দৈবাদিষ্ট গুরু-হন্তা এই যুবা। এক জন হনন করবে কোনও এক দিন, অন্য জন নিহত হবে। নিয়তির নাকি এমনই লিখন, ঘোষিত হয়েছে আকাশবাণীতে! সারা দেশ তা জানে। জানে এই দুই ব্যক্তিও। জেনেও কী ভাবে এরা এমন স্বাভাবিক আদানপ্রদানে রত?
কৃপী বিস্মিত হন। এই দুই মাস তিনি কিছুতেই সহজ হতে পারেননি এই যুবার সঙ্গে। কণ্টকের মতো বিঁধে থেকেছে সেই অমোঘ কথাটি, মুহূর্তের জন্যও যার বিস্মরণ অসম্ভব! অথচ দ্রোণ সম্পূর্ণ নির্বিকার। চিরকাল অন্য ছাত্রদের যেমন শিক্ষা দিয়ে এসেছেন, তেমনই ব্যবহার। একই রকম প্রশংসা, ভর্ৎসনা, নির্দেশ, উৎসাহ, সংশোধন, স্নেহ, কঠোরতা। পাঞ্চালকুমারও সাধনায় অতি একাগ্র ও অধ্যবসায়ী। গুরুবাক্য সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তিরস্কারে ক্ষুব্ধ হয় না, প্রশংসায় বিগলিত হয় না। বিদ্যাশিক্ষা আরও কতখানি উন্নত করা সম্ভব, সেই তার একমাত্র লক্ষ্য। সে অতি উচ্চমানের শিক্ষার্থী।
...মহর্ষি দ্বৈপায়ন বেদব্যাস দ্রোণগৃহে এসেছিলেন গতকাল। তিনি সর্বত্রগামী ও সর্বদ্রষ্টা। চতুর্দিকে যা ঘটমান, সমস্ত তিনি পর্যবেক্ষণ করেন অক্লান্ত উদ্যমে। দ্রোণের মুখে কৃপী শুনেছেন, মহাকাব্য রচনার জন্য ব্যাস এই কুরুবংশ ও সমসাময়িক ইতিহাস-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তত্ত্ব দর্শন শ্রুতি গ্রথিত করে রাখতে চান।
ব্যাসদেবকে বড় শ্রদ্ধা করেন কৃপী। ঈশ্বরতুল্য মনে হয় এই মহাত্মাকে। পাদ্যার্ঘ্য দিয়ে প্রণাম করেছিলেন দ্রোণপত্নী, নানা কথার পরে কিঞ্চিৎ সাহস করে একান্তে কাতরস্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এমন অদ্ভুত ব্যাপার ভূ-ভারতে ঘটেছে কখনও? এমন অভাবনীয় নিয়তি-পরিহাসের সংযোগ? শিষ্যকে যে-খড়্গ চালনের শিক্ষা দিচ্ছেন গুরু, সেই খড়্গই কর্তন করবে তাঁর শির!
“আকাশবাণী কি বাস্তবিকই অখণ্ডনীয়, মহর্ষি?”
শুভ্র শ্মশ্রু বিলম্বিত করে স্মিত হেসেছিলেন জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ দ্বৈপায়ন। প্রত্যক্ষ উত্তর দেননি। শুধু বলেছিলেন, “কালের ইঙ্গিত বিচিত্র, হে কল্যাণী! মানুষের কাজ সেই ইঙ্গিতকে প্রশ্ন করা নয়। তাকে শান্তচিত্তে গ্রহণ করা, মান্যতা দেওয়া। আমার জয়-মহাগ্রন্থে আমি সেই বক্তব্যই পুনঃপুনঃ ঘোষিত করব। তবে, হ্যাঁ, দিনে দিনে বড় প্রহেলিকাময় হয়ে উঠছে এই ভারতেতিহাসের মহাজগৎটি... যার অন্য নাম মহাভারত...”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy