ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: ভ্রাতা যাজকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের ঋত্বিক হিসেবে প্রস্তাব করার পাশাপাশি, যজ্ঞে প্রয়োজনীয় রমণীরও সন্ধান দেন ব্রহ্মর্ষি উপযাজ। সে যাজ এবং অনার্য উপজাতীয় এক নারীর সন্তান। কৃষ্ণাঙ্গী এবং রূপবতী। উপযুক্ত প্রশিক্ষণে সে অর্জুনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন উপযাজ। জম্বুক বৃত্তান্ত শুনে খুশি হয়। নিয়তির নির্দেশ মেনেই সম্পন্ন হয় যজ্ঞ। গুপ্তচর গিরিকর্ণ যজ্ঞাগ্নি থেকে কুমার-কুমারীর উত্থানের কথা নিবেদন করেন হস্তিনার ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর প্রমুখ প্রাজ্ঞদের কাছে।
অশ্বত্থামা কর্কশ-বিষাক্ত স্বরে বললেন, “ধৃষ্ট-দ্যুম্ন! অর্থাৎ...?”
গিরিকর্ণ বলল, “ধৃষ্ট অর্থে প্রগল্ভ, অসঙ্কুচিত, সপ্রতিভ। আর দ্যুম্ন বলতে বোঝায় সমৃদ্ধি, দ্যুতি, বীর্য। এই কুমার যুগপৎ অতি সপ্রতিভ, নির্ভীক ও বীরত্বের প্রভায় উজ্জ্বল। কাম্পিল্যবাসীদের সমবেত জয়ধ্বনির মধ্যে সেই নামই ঘোষিত হল...”
“এবং... সে আচার্য দ্রোণকে বধ করবে! এমনই আকাশবাণী শ্রুত হল!” ভীষ্ম সরোষে ও সশ্লেষে বলে উঠলেন।
“হ্যাঁ, মহাত্মন্! অনতিপরেই যখন যজ্ঞবেদী থেকে পদ্মপলাশাক্ষী সুকেশী সুদর্শনা পাঞ্চালকুমারী কৃষ্ণাও উঠলেন, একই ভাবে দৈববাণী হল— এই কন্যা কুরুবংশের ত্রাসের কারণ, এঁর কারণে কুরু-ক্ষত্রিয়রা ক্ষয়প্রাপ্ত হবেন!”
“ইনিও সোপান বেয়ে ওঠেননি, নিশ্চিত?” বিদুর যেন একই প্রসঙ্গে আবর্তিত হচ্ছেন। দৈববাণীর প্রসঙ্গে তিনি তত উৎসাহী নন।
“একেবারেই না, মাননীয়!” গিরিকর্ণও প্রত্যয়ী, “সোপানে কেউ পদার্পণ করেনি, আমি শপথ করে বলতে পারি...”
“হুম্! বাইরের সোপানে! দৃশ্যমান সোপানশ্রেণিতে! ...ঠিক! এইটুকু মাত্র তুমি শপথ করার অধিকারী বটে, গিরিকর্ণ!” বিদুরের কণ্ঠ যেন সহসা কিঞ্চিৎ তীব্র হয়। তাঁর তর্জনী নড়ে ওঠে, “তুমি তো মঞ্চের স্পর্শযোগ্য দূরত্বে যেতে পারোনি, তার নির্মাণ-রহস্য সম্পর্কে কিছু জানা নেই তোমার!”
গিরিকর্ণ একটু বিমূঢ় বোধ করে। দ্বিধান্বিত স্বরে বলে, “আজ্ঞে, না, আর্য... সে-সুযোগ তো পাইনি...”
“বেশ, বেশ!” বিদুর ঈষৎ হাস্য করলেন কি না, ঠিক বোঝা গেল না, “বলো, আর কিছু বলার আছে?
একটু চিন্তা করল গিরিকর্ণ। তার পর বলল, “আর বিশেষ কিছু নেই, প্রভু। যজ্ঞানুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর আমি আর বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করিনি। উদ্দাম উল্লাস করছিল পাঞ্চালের দর্শকেরা, ‘কুরু এ বার বিনাশ পাবে’, ‘দ্রোণের শ্রাদ্ধ সমাগত’, ‘যজ্ঞসেন দ্রুপদের জয়’ ইত্যাদি অভব্য কটুবাক্য বলছিল।”
অশ্বত্থামা দন্তঘর্ষণ করে বললেন, “তার আগে ওই ধৃষ্টের শ্রাদ্ধের আয়োজন আমি করব!”
কৃপ এক বার অপাঙ্গে দ্রোণের দিকে তাকালেন। দ্রোণ সম্পূর্ণ নীরব ও নির্বিকার। পাশে উপবিষ্ট ব্যক্তিদের কোনও প্রতিক্রিয়া— ক্রোধ উদ্বেগ ব্যঙ্গ— তাঁকে স্পর্শই করছে না।
ভীষ্ম তাঁর গূঢ়পুরুষকে বিদায় দিলেন। গিরিকর্ণ কক্ষত্যাগ করল।
৪৪
অতঃপর দ্রোণ ব্যতীত চার জন পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন। কিছু ক্ষণ নীরবতা, তার পর প্রথম কথা বললেন ভীষ্ম, বিদুরের উদ্দেশে।
“বলো হে বিদুর! এও কি পাঞ্চালের চাতুর্য?”
বিদুর খুব সুস্থিত ভঙ্গিতে বললেন, “নিঃসন্দেহে, তাত! পাঞ্চাল চিরকালই মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে আমাদের খর্ব করার চেষ্টা করে আসছে। অতীতের শিখণ্ডী-তত্ত্ব যেমন কূটনৈতিক কৌশল, এ বারেও কুরুর উপর তারা মনস্তাত্ত্বিক পীড়নের প্রয়াসে রত। দুটি সুপ্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীকে গোপনে সংগ্রহ করে, শুধু প্রচার আর কূটকৌশলের মাধ্যমে...”
কৃপ একটু বিস্মিত ভাবে বললেন, “কিন্তু... চর তো স্বচক্ষে দেখেছে, কুমার ও কুমারী উভয়েই অগ্নি থেকে আবির্ভূত হয়েছে। বাস্তবিকই কি যজ্ঞের কোনও প্রভাব হতে পারে না? কোনও মন্ত্রসিদ্ধ অলৌকিক, প্রকৃতই...”
বিদুর মৃদু হাসেন। বলেন, “আচার্যবর! যুক্তিসিদ্ধ বিচারপদ্ধতির কয়েকটি মূল সূত্র আছে। তার মধ্যে একটি হল— বাস্তবে বিশ্বাসের সুস্থিতি, অবাস্তবকে সন্দেহ। কী ভাবে? না, প্রথমে অতি যত্নে কল্পনা করে নিতে হবে, এই তথাকথিত ‘অলৌকিক’ কর্মটিকে সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত পন্থায় রূপায়িত করা সম্ভব কি না! যদি এমন অন্তত একটিও বিকল্প পথ বা ব্যাখ্যা আবিষ্কৃত হয়— যাতে ‘বিনা অলৌকিকে’, কেবল লৌকিক কৌশলেই সেই কাজটি করে দেখানো যায়— তবে অলৌকিক বলে প্রচারিত সেই মূল ঘটনাটিকে সন্দেহ করতে হবে। সিদ্ধান্তে আসতে হবে, যে, ওতে বস্তুতই অতিপ্রাকৃত কিছুই সংঘটিত হয়নি, বাস্তব কৌশলই প্রযুক্ত হয়েছে মাত্র!”
অশ্বত্থামা বলেন, “একটু প্রাঞ্জল করুন, ক্ষত্তা। ঠিক বুঝলাম না...”
“রাজপথে জাদু-ব্যবসায়ীর মায়াকৌতুক দেখেছ, বৎস? সে শূন্য থেকে পুষ্পস্তবক, পক্ষীডিম্ব, মোদক, মুদ্রা ইত্যাদি নানা বিচিত্র বস্তু করতলে উদ্ভূত করে এনে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করে। মূঢ় ও অজ্ঞ লোকে ভাবে, এটি তার অলৌকিক শক্তি বুঝি! কিন্তু বাস্তব-যুক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ভাবতে শুরু করে, শূন্য থেকে কি বস্তু আনা যায় আদৌ? তখনই সে নানাবিধ বাস্তব প্রকরণের অনুমান করে। তথাকথিত অতিপ্রাকৃতের মধ্যে সে যুক্তিসঙ্গত রন্ধ্র খুঁজতে থাকে। এবং অন্তিমে সে বুঝতে পারে, রন্ধ্র আছে। বাস্তব ব্যাখ্যা আছে। জাদুকরের বিশালাকার চিত্রবিচিত্র পরিচ্ছদ, তার আমণিবন্ধলম্বিত দুই বিপুল হস্তাবরণের মধ্যেই গুপ্ত আছে নানা উপকরণ। শূন্য থেকে নয়, বস্ত্রাভ্যন্তর থেকে আসে সেগুলি। প্রদর্শকের দীর্ঘ অভ্যাস-নৈপুণ্যের ফলে সেই কৌশলটিই দর্শকের দৃষ্টিকে প্রতারিত করে মাত্র!”
বিদুর তাঁর তর্জনীটিকে বিদ্ধ-করার মুদ্রায় নিয়ে এসে বলেন, “যে মুহূর্তে আমরা একটি বাস্তব ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলাম, সেই মুহূর্তেই ওই লীলাটি আর অলৌকিক বলে গণ্য হল না। ওটি নিপুণ চাতুর্যের পর্যায়ে নেমে এল!”
অশ্বত্থামার চক্ষু উজ্জ্বল হয়, “বুঝেছি! অর্থাৎ, আপনার সন্দেহ— দুষ্ট দ্রুপদের যজ্ঞেও এমনই কোনও চতুর কৌশলে...”
“অবশ্যই! আমাদের চর খুবই তৎপর ও বুদ্ধিমান। বাইরের সোপান দিয়ে কেউ আসতে পারে এই সন্দেহ তার ছিল। কিন্তু দ্রুপদের বুদ্ধি নিশ্চিত ভাবেই আরও ক্ষুরধার! গিরিকর্ণ কেবল বাইরের দৃশ্যই দেখেছে। কিন্তু যজ্ঞমঞ্চের অভ্যন্তরে গুপ্ত কোনও পথ, কোনও সোপান, কোনও আরোহণ-যন্ত্র লুক্কায়িত ছিল কি না, সে বিষয়ে তো তার কাছে কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। আছে কি? সে তো বেদির অভ্যন্তর পরীক্ষা করে আসেনি!”
ভীষ্মের ললাটে চিন্তারেখা মুদ্রিত হল। গম্ভীরস্বরে বললেন, “অর্থাৎ... কাষ্ঠনির্মিত উচ্চ যজ্ঞবেদির মধ্যস্থলে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড... বেদিমঞ্চের তলদেশ থেকে সরল যান্ত্রিক কৌশলেই...”
“নিশ্চিত ভাবেই! এ তো সুবর্ণসুযোগ, তাত! দর্শককুল দূরে দণ্ডায়মান, ধূম রয়েছে, মন্ত্রের কোলাহল রয়েছে, সঙ্গে উচ্চ বাদ্যরব। বৎসরাধিক কাল ধরে যজ্ঞ চলেছে, রাজ-অধিকরণ থেকে এই দীর্ঘ সময় ধরে পূর্বপ্রচারের ডঙ্কা নিনাদিত হয়েছে অবিরত, মানুষ তো শেষ লগ্নে অলৌকিক দেখার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই রয়েছে— কঠিন কাজ কি? জাদু-ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত এর চেয়ে চতুরতর প্রতারণানৈপুণ্য প্রয়োগ করে! আর আকাশবাণী, দৈববাণী— এ-সমস্ত প্রাচীন প্রচার-প্রকরণ ও কূট-কলা সম্পর্কে আর কী বলি, আপনি তো অভিজ্ঞ, হে গাঙ্গেয়।”
“কিন্তু,” কৃপাচার্য ভাবিতমুখে বলেন, “এই বাস্তব ব্যাখ্যা, যা আমরা এই রুদ্ধদ্বারে বিশ্লেষণ করছি... এ তো সাধারণ দর্শকরা জানল না! প্রচারটি তো ছড়িয়েই পড়েছে সর্বত্র...”
বিদুর মাথা দোলান, “হ্যাঁ। সমস্যা সেখানেই! সমাজরীতি অনুসারে, ঋষি-ব্রাহ্মণরা যা বলবেন, দৈববাণী যা ঘোষণা করবে— স্বীকার করতে হবে! রাষ্ট্র-শাসন-নীতির ভিত্তিই এই। সুতরাং, জনান্তিকে আমরা যা-ই নির্ণয় করি, জনতার সমক্ষে বা প্রকাশ্যে একটি শব্দও বলা যাবে না। পাঞ্চালের এ বারের প্রচারটি যথেষ্ট সুচারু, সুপরিকল্পিত এবং সফল। আমি জানতে পেরেছি, ‘কুরু-ধ্বংস ও দ্রোণ-নিপাতের আয়ুধ এখন দ্রুপদের করায়ত্ত’— এই বার্তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র আর্যাবর্তে! এর আগেও, মহান ভীষ্মের নিধন নিয়ে... আবার এই...”
“হ্যাঁ, এই নীচ ধূর্ততা... পাঞ্চালকে অনেকটাই রাজনৈতিক গরিমা দিল,” শান্তনব ক্ষুব্ধ হতাশ কণ্ঠে বললেন, “কুরুকুমারদের কাছে পরাস্ত হয়ে ও অর্ধরাজ্য হারিয়ে যতটুকু কলঙ্ক-অপমান তাদের অঙ্গে লেগেছিল, তার সিংহভাগের ক্ষালন হয়ে গেল। সমগ্র দেশ এখন জানল, পাঞ্চাল যে কোনও সময় কুরুকে বিধ্বংস করতে পারে, কুরুর মৃত্যুবাণ তার অধিগত এখন!”
কৃপ বলেন, “আচ্ছা, মহর্ষি বেদব্যাসও কি তাঁর মহাবৃত্তান্তে এই ঘটনাটির প্রকৃত বাস্তব বিবরণ রাখবেন? তিনি তো ক্রান্তদর্শী! না কি, তাঁকেও বাধ্যত এই ঋষি-বিপ্র-প্রচারিত ‘অলৌকিক’ সংঘটনটিরই মান্যতা...”
ভীষ্ম কিছু বলবেন বলে মুখ খুলতে যাবেন, এমন সময় মন্ত্রণাকক্ষের দ্বারে মৃদু করাঘাতের শব্দ। ভীষ্মের অনুমতিক্রমে চর গিরিকর্ণকে কক্ষে পুনঃপ্রবেশ করতে দেখা গেল।
ভীষ্ম-বিদুর জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। ঈষৎ সঙ্কুচিত, যুক্তপাণি হয়ে গিরিকর্ণ বলল, “মার্জনা করবেন কুরুশিরোমণি! একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার দেওয়া হয়নি...”
“কী?”
“আমি শুনে এসেছি, রাজা দ্রুপদ তাঁর যজ্ঞলব্ধ পুত্রটিকে নিয়ে অচিরেই হস্তিনায় আসবেন সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে!”
ভীষ্মের আনন কিছু বিস্ময় কিছু ক্ষোভে তাড়িত হয়ে ভ্রুকুটিকুটিল হল, “সৌজন্য-সাক্ষাৎ! কার সঙ্গে, হে?”
চরের দৃষ্টি ঘুরে যায় সর্ববামে উপবিষ্ট ব্যক্তিটির দিকে, “আজ্ঞে, প্রভু, শুনলাম— তাঁর মিত্র আচার্য দ্রোণের সঙ্গে! যজ্ঞোদ্ভূত কুমার ধৃষ্টদ্যুম্নকে ওঁর কাছে খড়্গচালনার উন্নততর শিক্ষা দেওয়াবেন বলে...”
কক্ষে বজ্রপাত হল বুঝি! সকলে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy