Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২৫
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

ঋজু হয়ে বসলেন বিদুর। এক বার কক্ষের রুদ্ধ দ্বারটির দিকে, তার পর চক্রাকারে সকলের মুখে দৃষ্টিপাত করে নিলেন।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৪
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বিদুর অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, যুধিষ্ঠিরকে অবসর বিনোদনের উপলক্ষে বারণাবতে বৎসরাধিক কালের জন্য পাঠানোর আয়োজন করা হচ্ছে। দুর্যোধন এবং ধূর্ত রাজ-অমাত্য কণিকের কিছু পরোক্ষ ইন্ধনেই এমন সিদ্ধান্ত। অন্য দিকে জম্বুক ব্রহ্মর্ষি উপযাজকে জানান, পুত্রেষ্টি যজ্ঞ চলবে বৎসরাধিক কাল এবং তা থেকে উত্থিত হবে পূর্ণবয়স্ক পুত্র এবং কন্যাসন্তান। তারা দু’জনেই হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পুরো ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্য করাতে হবে দৈববাণী এবং ঋষিবাক্যের উপর নির্ভর করে।

উপযাজ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন, “এই কন্যাটিও কি অত্যাবশ্যক?”

“সম্পূর্ণত। সে হবে ভাবীকালের যুগবিপ্লবের এক প্রধান অক্ষ।”

উপযাজ সংশয়পূর্ণ স্বরে বললেন, “কিন্তু এতশত গূঢ় আয়োজন কি মুখের কথা? বহু সময় ও শ্রম লাগবে যে!”

“লাগুক। প্রস্তুত হতে থাকুক কুমার-কুমারী! তত দিন স্থগিত থাকবে যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। এক একটি মহাযজ্ঞ তো, দেখা যায় বৎসর-বৎসর ধরে চলে। এটিও দীর্ঘকালব্যাপী হবে, ক্ষতি কী? বরং, তাতেই প্রমাণিত হবে, এ এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী যজ্ঞ! ভূ-ভারতে কেউ দেখেনি! প্রচারও হবে তেমনই। শেষে বাস্তবিকই দেখা যাবে, এটি অভূতপূর্ব! একই সঙ্গে দুই তরুণ-তরুণী উদ্ভূত হবে যজ্ঞের ধূম থেকে, কাম্পিল্যের জনতা স্বচক্ষে দেখবে...”

“এক জন দ্রোণহন্তা, অন্য জন কুরুকুলনাশিনী!”

“হ্যাঁ! প্রত্যক্ষ দৈববাণী হবে এই মর্মেই! দৈবলব্ধ পুত্রকন্যা, দ্রৌপদ-দ্রৌপদী! জনতা দৈব-ভীরু ও বিশ্বাসপ্রবণ, এ তো জানেনই। মহাযজ্ঞ, ঋষিদের বচন, রাজ-প্রচার ও দৈববাণী— এই চতুঃসংযোগের ফল হবেই। আর, ভবিষ্যতে ওই কন্যার স্বয়ংবর ঘটানো হবে এমন কৌশলে— যাতে কুরুকুমার পাণ্ডুপুত্র অর্জুনই তাঁকে জয় করতে পারেন, অন্য কেউ নয়!”

“আচ্ছা, একটি কৌতূহল থেকেই যাচ্ছে,” ঋষি জিজ্ঞাসু চোখে তাকান, “এই কুরুকুমারের সঙ্গে পাঞ্চাল-কন্যাকে যুক্ত করে দেওয়ার কী এমন অমোঘ প্রয়োজন? বিশেষত, কুরুর সঙ্গেই তো বিরোধ পাঞ্চালের! শুনেছি, এই অর্জুনই দ্রুপদকে পরাস্ত ও বন্দি করেছিলেন! তিনি তো পরম শত্রু! তিনিই আবার দ্রুপদ-নন্দিনীকে... বাসুদেবের অক্ষক্রীড়ার এই দানটি ঠিক বুঝতে পারছি না। কুরুকুলকে ধ্বংস করতে চাইছেন দ্রুপদ, আবার কুরুকুলের কুমারকেই দ্রুপদের জামাতা করা... এ বেশ প্রহেলিকা নয়?”

“বিপ্রর্ষে, আপনি হয়তো জানেন না, মৃত রাজা পাণ্ডুর তনয়রা সম্প্রতি কুরু-রাজনীতিতে খুবই অবহেলিত। নানা প্রতিকূল আবর্তের শিকার। তাঁরা সর্বগুণান্বিত, কিন্তু হস্তিনায় তাঁরা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন না কিছুতেই। তাঁদের শত্রুশিবিরই সেখানে অধিক প্রভাবশালী, সৈন্য অমাত্য ধন ও কর্তৃত্ব রয়েছে দুর্যোধনের অধীন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদেরই এখন প্রকৃত ‘কৌরব’ বোঝায়।”

“অর্থাৎ পাণ্ডুপুত্ররা ‘পাণ্ডব’? পৃথক? দ্রুপদ-অরাতি কৌরবদের মধ্যে তাঁরা গণ্য নন আর?”

“হ্যাঁ, ওই নামেই তাঁরা পরিচিত হচ্ছেন ক্রমশ। পৃথক হয়ে যাচ্ছেন কুরু থেকে! জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির যুবরাজ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও প্রাসাদ-রাজনীতির মূলস্রোত থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। তাঁরা এখন বস্তুত কৌরবদের প্রতিশক্তিরই স্থান নিয়েছেন, কিন্তু নিঃসহায়, সংখ্যালঘু, ব্রাত্য-প্রায়! কেশব উপলব্ধি করেছেন, তাঁর স্বসাত্মজ এই সৎপথগামী রাজকুমারদের প্রয়োজন একটি পরাক্রমী শক্তির সঙ্গে মিত্রতা; এমন কোনও শক্তি... যে কুরুর বিরোধী।”

“শত্রুর শত্রু মিত্র! বুঝলাম। তাই, কৃষ্ণ চান— তাঁর ভ্রাতা পার্থ দ্রুপদের জামাতা হোন! অর্থাৎ পাণ্ডুর পুত্ররা স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। দ্রুপদের আত্মীয় তথা মিত্র, পাণ্ডবপক্ষ!”

“নির্ভুল!”

তর্জনী সঞ্চালন করে যেন একটি কাল্পনিক জ্যামিতি-চিত্র মিলিয়ে দেন উপযাজ, “আর, পাঞ্চালের প্রকৃত শত্রু তবে রয়েই যাবে সেই হস্তিনার কৌরবরা! ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষটি! তাদেরই বিনাশার্থে ওই কন্যা...”

“মোক্ষম!” জম্বুক বলে, “এই তো, আপনি সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপটটি উপলব্ধি করে ফেলেছেন! ধার্মিক কৌন্তেয়র সঙ্গে শক্তিশালী পাঞ্চালদের আত্মীয়তা স্থাপন— এই হল প্রভুর গূঢ় কূটনৈতিক জালের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ! বাসুদেব যে ধর্মরাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন, তা এই নীতিপরায়ণ কিন্তু অজেয় পাণ্ডবদের ঘিরেই গড়ে উঠবে। এই হল প্রকল্পের গূঢ় কথা। ভারত-রাজনীতিতে পাণ্ডবদের দ্রুত ও নিরঙ্কুশ উত্থান প্রয়োজন!”

ঋষি উপযাজ বহু ক্ষণ কথা বলেন না। চিবুকটি বাম মুষ্টির উপর রেখে, নীরবে বসে থাকেন। জম্বুকও নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে।

৪১

ঋজু হয়ে বসলেন বিদুর। এক বার কক্ষের রুদ্ধ দ্বারটির দিকে, তার পর চক্রাকারে সকলের মুখে দৃষ্টিপাত করে নিলেন। শেষে বললেন, “অতি গুরুতর কথা। প্রত্যেকে শুনবে, হৃদয়ঙ্গম করবে— এবং পরবর্তী কালে নিজেদের আচরণে এক বিন্দুও বহিঃপ্রকাশ করবে না। সম্মুখে সঙ্কট!

“কণিকের সঙ্গে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের প্রাথমিক আলোচনার নির্যাস আমি বিশ্বস্ত সূত্রে উদ্ধার করেছি। রাজা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, যুধিষ্ঠির যুবরাজ হওয়ার পর থেকে পাণ্ডবদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন তিনি, বিশেষত তাঁদের বীরত্বকে তিনি ভয় পান— এমতাবস্থায় তাদের প্রতি কী কর্তব্য। কণিক বলেন, ‘উপযুক্ত কাল না আসা পর্যন্ত অমিত্রকে স্কন্ধে বহন করুন, সুযোগ পেলেই প্রস্তরে আছাড় মেরে তাকে চূর্ণ করুন। মুখে মধু কিন্তু অন্তরে ক্ষুর, এই নীতি নিয়ে চলতে হবে। ধীবর যেমন বিনা অপরাধেই মৎস্যদের হত্যা করে, তাতেই তার ধনলাভ— তেমনই সমৃদ্ধিলাভের জন্য নিরপরাধের সর্বনাশও কখনও কখনও প্রয়োজন হয়ে পড়ে!’”

এত দূর শুনে মধ্যম পাণ্ডব প্রায় গর্জন করে উঠলেন, “নীচ, পাপী কণিক! ভণ্ড নরাধম আজ প্রাতেও আমাকে মিষ্টসম্ভাষণ করছিল...”

বিদুর ওষ্ঠে তর্জনীস্থাপন করে তাঁকে চুপ করালেন। তার পর আবার বলতে লাগলেন, “কণিকের সঙ্গে দুর্যোধনেরও একটি পৃথক ও গোপন পরামর্শ হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল দুঃশাসন এবং সৌবল শকুনিও। কী ভাবে পাণ্ডবদের চিরতরে অপসারিত করা সম্ভব, এই ছিল আলোচনার বিষয়। সেখানেই স্থির হয়, হস্তিনায় অবস্থানকালে পাণ্ডুপুত্রদের ক্ষতিসাধন করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। প্রজাবর্গ সন্দেহ করতে পারে। বিশেষত, এখানে পাণ্ডবদের প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী আছেন কয়েক জন। ভীষ্ম আছেন বিদুর আছেন— তাঁদের চররা যদি গোপন চক্রান্ত পূর্বাহ্ণে টের পায়! সুতরাং, আগে ছল করে তাঁদের হস্তিনা থেকে সুদূরে কোনও প্রত্যন্ত স্থানে নিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘকাল দূরেই রাখতে হবে, যাতে হস্তিনার প্রজাদের মন থেকে তাঁদের স্মৃতি ও প্রাসঙ্গিকতা কিঞ্চিৎ ক্ষীণ হয়! তার পর, সেই প্রবাসেই, নির্বান্ধব ও অসহায় অবস্থায় তাঁদের আঘাত করা সহজতর হবে। এই পরিকল্পনাতেই উঠে আসে বারণাবতের নাম। এবং সেই প্রস্তাবটি যাতে রাজা ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং উত্থাপন করেন, সে সম্বন্ধে তাঁকে সম্মত করা হয়। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে কিন্তু দুর্যোধন তার হনন-পরিকল্পনার কথাটি সম্পূর্ণ ব্যক্ত করেনি। হয়তো চূড়ান্ত জিঘাংসাটিতে রাজা অনুমোদন দিতেন না। তাই কপট দুর্যোধন তাঁকে শুধু বলেছে, পাণ্ডবদের কৌশলে নির্বাসিত করা হোক! রাজাকে সে বুঝিয়েছে, এক বার হস্তিনার বাইরে পাঠাতে পারলে সে আর তাদের সহজে প্রত্যাবর্তন করতে দেবে না, ফলে সিংহাসন নিরাপদ থাকবে। তাতেও ভীরু ধৃতরাষ্ট্র দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। যদি প্রজা বা রাজপুরুষদের মধ্যে কিছু অসন্তোষ... দুর্যোধন তাঁকে আশ্বস্ত করে, রাজকোষ তার করায়ত্ত, ফলে প্রজা ও অমাত্যদের বশীভূত করা তার পক্ষে সহজ। অশ্বত্থামা তার মিত্র, রাজ-অর্থের ঋণবদ্ধ দ্রোণ ও কৃপও তার পক্ষেই থাকবেন। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম কদাপি হস্তিনার রাজার বিরুদ্ধে যাবেন না। আর বিদুর কুরু-অর্থে পালিত হয়েও পাণ্ডব-পক্ষপাতী— কিন্তু একাকী আর কী করবে সে!...এই ভাবে রাজাকে আশ্বস্ত করার পর রাজা সম্মত হন।

“এর অধিক বিশদ বিবরণ এখনও পাইনি, তবে সংগৃহীত হবে অবিলম্বেই। চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রটি ঠিক কী, সেইটুকু তথ্য এখনও আমাদের অজ্ঞাত। সে বিষয়ে আমি গূঢ় সন্ধান করে নেব স্বল্পকালের মধ্যেই। যাত্রার প্রাক্কালেই যুধিষ্ঠিরকে তা জানিয়ে দেব। যদি একেবারে শেষ মুহূর্তে তা হয়, তবে সর্বসমক্ষেই বলতে হবে। তখন অগত্যা আমি ম্লেচ্ছভাষায় সঙ্কেত বিবৃত করব। তোমাকে ম্লেচ্ছভাষা শিক্ষা দিয়েছিলাম, বৎস যুধিষ্ঠির— মনে রেখেছ তো?”

যুধিষ্ঠির বললেন, “রেখেছি, হে কুরুভূষণ!”

বিদুর বললেন, “ও, হ্যাঁ, আর একটি তথ্য মিলেছে। দুর্যোধনের বিশ্বস্ত আধিকারিক পুরোচন আজ প্রভাতে সূর্যোদয়ের পূর্বেই দ্রুতগামী রথে ধাবিত হয়েছে বারণাবতের দিকে। গতকাল গভীর রাতে তাকে দুর্যোধনের কক্ষের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল। সম্ভবত সেখানেই চূড়ান্ত পরিকল্পনাটির রূপরেখা সম্পূর্ণ হয়েছে।”

“পুরোচন! লোকটি অসৎ। পয়োমুখ বিষকুম্ভ, দেখলেই বোঝা যায়,” যুধিষ্ঠির স্বগতোক্তি করলেন, “তার সঙ্গে রাত্রিকালীন গোপন আলোচনার অভ্রান্ত অর্থই হল— অশুভ চক্রান্ত!”

“সেই চক্রান্তের অন্যতম প্রধান ইন্ধনদাতা সেখানে উপস্থিত ছিল। প্রারম্ভ থেকেই পাণ্ডববিনাশের ষড়যন্ত্রে দুর্যোধন অপেক্ষা তার উৎসাহ কম নয়! দুর্বুদ্ধির অনেকাংশ তারই অবদান!”

“কে?” অর্জুন জানতে চাইলেন।

বিদুর এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। কেন কে জানে, এক বার পৃথার দিকে ঘুরে গেল তাঁর দৃষ্টি। কয়েকটি পলক যেন অতিরিক্তই চেয়ে রইলেন রাজমাতার মুখে, তার পর ধীরে ধীরে কিন্তু কঠিন স্বরে বললেন, “রাধেয় বসুষেণ!”

কুন্তী মুহূর্তের মধ্যে একটু বিবর্ণ হলেন, নেত্র নামিয়ে নিলেন। যুধিষ্ঠির বাতায়নের দিকে তাকিয়ে, মৃদুকণ্ঠে বললেন, “প্রত্যাশিত! বেশ কিছু কাল সে দুর্যোধনের ভবনে আতিথ্য নিয়ে রয়েছে...”

অর্জুন দন্তে দন্ত পেষণ করে বললেন, “এই ব্যক্তির এত বৈর কিসের! এত কুটিল কেন?”

“নীচ কুক্কুরকে যজ্ঞের হবি খাইয়েছে পাপী দুর্যোধন, সারথির পুত্রকে রাজা করেছে,” ভীম বদন বিকৃত করলেন।

নকুল হেসে উঠে বললেন, “আচ্ছা, শুনেছিলাম ওই সূতপুত্র নাকি শ্রেষ্ঠ বীর! হেঃ, পাঞ্চালযুদ্ধে ওর ধ্বস্ত পলায়ন এখনও চোখে ভাসে...”

সহদেবও সঙ্গত করেন, “পরশুরামের কাছে তবে ও-শ্যালক কী বিদ্যা নিয়ে ফিরল? শুধুই কি অশ্ব-পরিচর্যা? সে তো ওর বাপই শেখাতে পারত!”

বিদুর লক্ষ করলেন, তাঁদের প্রতিটি কুবাক্যে এক বার করে কেঁপে উঠছেন কুন্তী, যেন কোনও অদৃশ্য কশা তাঁর হৃৎপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করছে! ক্রমশ অধোমুখ হয়ে পড়ছেন রাজমাতা।

কেমন একটা কঠিন তৃপ্তি হয় বিদুরের! ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাসি ধরে রেখেই আর এক বার অপাঙ্গে দেখে নেন পাণ্ডুপত্নীকে, তার পর শীতল কণ্ঠে বলেন, “আমি গোপনে যত দূর জেনেছি, পরশুরামের আশ্রমে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটি পাওয়ার আগেই রাধেয় বিতাড়িত হয়েছিল। মিথ্যা পরিচয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিল সে, গুরু কোনও সূত্রে সেটি ধরে ফেলেন। যেটুকু দুর্লভ উপকরণাদি সে সংগ্রহ করেছিল তাও নাকি শেষলগ্নে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। উপযুক্ত মুহূর্তে শ্রেষ্ঠবিদ্যা প্রয়োগ সে করতে পারবে না কখনও! শব্দময় শূন্যকুম্ভ, হা হা!”

ধর্মপরায়ণ, দয়াশীল, শুদ্ধচিত্ত বিদুর! সুখে-দুঃখে সতত সমদর্শী, অনুদ্বেলচিত্ত। কিন্তু রাধেয়র প্রসঙ্গে বারংবার পৃথাকে বিদ্ধ করে তিনি এমন নিষ্ঠুর আনন্দ কেন পান?

৪২

দীর্ঘ ভাবনার মুহূর্তগুলি অতিক্রান্ত হয়। তার পর ঋষি নিজের শ্মশ্রুজালে অঙ্গুলিচালনা করতে করতে জম্বুকের দিকে তাকান। বলেন, “বাসুদেবের পরিকল্পনা মহৎ। দেশে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে, তার জন্য কিছু অনুকূল শক্তিকে পরস্পর-সংযুক্ত করা দরকার এবং কিছু প্রতিকূল শক্তিকে বিযুক্ত করা দরকার— তা তিনি সম্পন্ন করবেন। এবং এই বিপুল নাট্যের তিনিই হবেন নেপথ্য-নায়ক। প্রত্যক্ষ অংশ নেবেন না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ-রজ্জু থাকবে তাঁরই অঙ্গুলিতে! তিনি রাজা হবেন না, রাজ-নির্মাতা হবেন! আমি বুঝেছি।”

জম্বুক মৃদু হেসে বলল, “আপনি প্রাজ্ঞ!”

“কিন্তু,” একটি শ্বাস ফেলে উপযাজ বলেন, “তবু্‌... হে দূত! আমি এই অভীষ্টের জন্য আমার নিজের পুণ্যফল বিসর্জন দিতে পারি না। রাজা দ্রুপদকে আমি যে কথা বলেছি, সেই কথাই আবার বলি। যে ব্যক্তির সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই, তার মৃত্যুকামনায় আমি যজ্ঞাসনে বসতে পারব না।”

“কিন্তু, হে ঋষিকুলতিলক, কেশব যে অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে...”

“সবই বুঝতে পারছি। তাঁর লক্ষ্যে-আদর্শে আমার সমর্থন আছে। কিন্তু যে বংশের সঙ্গে আমার বৈর নেই, তার বিনাশ চেয়ে মন্ত্রপাঠে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অক্ষম। আমি আবাল্য সদাচার করে এসেছি। এমনকি স্বয়ং ঐশী অবতার মহান কৃষ্ণের নির্দেশেও সেই তপের ফল আমি নষ্ট করব না। তার পিছনে অভিপ্রায় যতই উত্তম হোক!”

জম্বুকের হতাশ মুখ ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে— সে দিকে তাকিয়েই উপযাজ আবার বলেন, “হতাশার প্রয়োজন নেই। আমি স্বয়ং বিকল্প পথ বলে দিচ্ছি! দ্রুপদের মনোরথ সিদ্ধ হবে, কেশবের পরিকল্পনা রূপায়ণে কোনও বাধা হবে না। এমনকি সেখানে আমি পরোক্ষ ভূমিকাও নিতে পারব।”

“কী সেই বিকল্প?”

“আমার সহোদর ভ্রাতা, যাজ!”

“যাজ! ঋষি যাজ, আপনার ভ্রাতা... তিনিও কি এই যজ্ঞের জ্ঞান...”

“হ্যাঁ! ব্রহ্মর্ষি তিনিও। এই গূঢ় যজ্ঞের সব পদ্ধতি জানেন। একই সূত্র থেকে আমাদের উভয়ের শিক্ষা। তাঁর নিবাস অদূরেই। তিনি অনুরুদ্ধ হলে এই কর্মে অসম্মত হবেন না। উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে তিনি এই কাজ করে দেবেন।”

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy