ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: দুর্যোধনাদি ভ্রাতারা অসমর্থ হলেও ভীমসেনের গদাচালনা এবং অর্জুনের শরসন্ধানে পরাস্ত ও বন্দি হলেন রাজা দ্রুপদ। পরাজিত দ্রুপদকে সামনে পেয়ে অপমানের দীর্ঘ যন্ত্রণা উপশম হল দ্রোণের। তিনি দ্রুপদকে তাঁর কৃতকর্ম স্মরণ করিয়ে দিলেন। তার পর পুত্র অশ্বত্থামার জন্য অর্ধেক পাঞ্চাল গ্রহণ করে বাকি অর্ধাংশ ফিরিয়ে দিলেন দ্রুপদকেই। অন্য দিকে একলব্যের অন্তর্ধান এবং তার সম্ভাব্য মৃত্যুর সংবাদ শুনে রীতিমতো হতোদ্যম হয়ে পড়লেন মগধরাজ জরাসন্ধ।
কুরুরাজ্যের পাঁচ রাজকুমার, পাণ্ডুতনয় যুধিষ্ঠিরাদি ও তাঁদের মাতা কুন্তী হস্তিনা থেকে এক দীর্ঘ প্রবাসে যাবেন স্থির হয়েছে। পশুপতি উৎসব উপলক্ষে রাজ-উদ্যোগে প্রয়াগ-নিকটবর্তী বারণাবত নগরে পাঠানো হচ্ছে তাঁদের।
বিদর্ভ-রাজকুমার রুক্মী কৃষ্ণের কাছে পরাস্ত ও অপমানিত হয়ে আর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেননি। তিনি ভোজকট নামক স্থানে নিজস্ব রাজধানী স্থাপন করে এক সমৃদ্ধ নগর নির্মাণ করছেন।
নানা রাজ্যের নানা সমাচার। একের পর এক ব্যক্ত হচ্ছে, কিন্তু আজ জরাসন্ধ কোনও সংবাদকেই বিশদে জানতে চাইছেন না। অতি বিমনা দেখাচ্ছে তাঁকে।
শুধু, বিদর্ভ আর রুক্মীর প্রসঙ্গটি আসতে, সহসা যেন ঈষৎ নড়ে উঠলেন রাজা। চক্ষু এক বার কম্পিত হল, শিথিল মুঠি এক বার বুঝি কঠিন হল মুহূর্তের জন্য। শ্বাস দ্রুত হল এক লহমায়। তার পরেই আবার পূর্ববৎ!
গত অপরাহ্ণের স্মৃতি এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে মগধেশকে।
এখনও কানে বাজছে অরণ্যের বৃক্ষশাখায় প্রতিধ্বনিত রোদনধ্বনিগুলি। পুত্রহারা ললনার বিলাপ। শোকাকুল পিতার রুদ্ধ ক্রন্দন। বৃদ্ধ পিতামহের হাহাকার।
“কেন আপনি অমন ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে আমার বাছাকে লড়তে পাঠালেন, মহারাজ?”
প্রত্যক্ষ, একেবারে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তাঁকেই দায়ী করছিল নিষাদ-রমণী। বিশাখা যার নাম। অশ্রু আর বহ্নি একত্রে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার নয়নে। চিৎকার করে সে বলছিল, “জঙ্গলে ছিল আমার ছেলেটি, দিব্য ছিল। আপনার পরামর্শে সে গেল আর্য গুরুর কাছে বিদ্যা নিতে। ফল কী হল? আঙুলটি কেটে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিলপিশাচ গুরু!”
জরাসন্ধ, প্রবল প্রতাপী মগধেশ, সেই অরণ্যের মধ্যে, চারিপাশে সমবেত মৌন কিন্তু ক্ষুব্ধ নিষাদবৃন্দের মাঝখানে— মৌনী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জানতেন, কেবল একলব্যের পরিবারেই নয়, ক্ষোভ রয়েছে আরও অনেকের মধ্যেই। একলব্যের সেই সব অনুগামী ব্যাধ-যোদ্ধারা— যারা রৈবতক-সন্নিহিত পথ-সংঘর্ষে দেবকীনন্দনের শরাঘাতে নিহত হয়েছিল, তাদের স্বজনরাও ক্রোধাশ্রুলিপ্ত হয়ে রয়েছে। যদিও, কথা বলছে বিশাখা একাই।
সম্রাট জরাসন্ধ— যাঁর নামে আর্যাবর্ত প্রকম্পিত, সেই তিনি এক অবলা অনার্য-রমণীর সম্মুখে নিশ্চল নতমুখ, যেন বিচারকের সমক্ষে আনীত বদ্ধ অভিযুক্ত! এ কী অভাবিত অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
ব্যাধপত্নীর কঠোর বাক্য শুনে পার্শ্ববর্তী এক রাজ-অনুচর কর্কশস্বরে ভর্ৎসনা করে উঠেছিল, “আরে, মূর্খ অনার্যা, স্বয়ং মগধেশ্বর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তোদের সান্ত্বনা দিতে এসেছেন, তোদের চতুর্দশ পুরুষের...”
জরাসন্ধ কিছু না বলে, এমনকি গ্রীবা পর্যন্ত না ঘুরিয়ে, আচম্বিতে বাম করপৃষ্ঠ দিয়ে সজোরে একটি চপেটাঘাত করেছিলেন লোকটিকে। একেবারে তার উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের উপর, সপাটে! মুহূর্তে মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায় সেই চাটুকারের, বাক্য মধ্যপথে স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজ-সঙ্গী পারিষদ-প্রহরী-অমাত্যদের মধ্যে আর কেউ কোনও শব্দ করেনি অতঃপর।
“বলো, নিষাদ মাতা!” হাতের রক্ত শান্ত ভাবে উত্তরীয়ে মুছে নিয়ে, বিশাখার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে শুষ্ককণ্ঠে বলেছিলেন রাজা, “আজ আমি তোমার কাছে অপরাধী, সে আমি জানি। তাই দুঃসংবাদ পেয়ে স্বয়ং এসেছি এই অরণ্যে। তোমার তিক্তবাক্য আমার সম্পূর্ণত প্রাপ্য! কিন্তু জেনো, আমিও শোকার্ত। তার পরম সুচিন্তক ছিলাম আমি। বড় স্নেহ করতাম তাকে। তাই তো কর্তিত অঙ্গুষ্ঠটি যাতে পুনরায়...”
“কেন, কেন, প্রভু? কী দরকার ছিল? মাঝের দু’টি আঙুল দিয়ে তির ছুড়েই আমার একলব্য হরিণ কিংবা বরা’ শিকার করে আনতে পারত বেশ, ব্যাধের পুত্তুর ব্যাধ হত— আপনি তাঁকে কেন অত তোড়জোড় করে যোদ্ধা বানাতে চাইলেন বলুন! কী লাভ হল তার নতুন বুড়ো আঙুল নিয়ে?”
হিরণ্যধনু, চির-অনুগত নিষাদরাজ— সম্ভবত নিজের গভীর শোকের মধ্যেও মগধেশ্বরের মর্যাদা বিস্মৃত হয়নি। সে আকুলা পত্নীকে সংযত রাখার চেষ্টা করছিল। আবেগ-প্রাবল্যে বিশাখা অপমান করে না বসে প্রভুকে! নিজের প্লাবিত চক্ষু দু’টি মুছে সে আর্দ্রকণ্ঠে বলছিল, “চুপ কর, বিশাখা! মহারাজ যা করেছেন সবই তো আমাদের পুত্রের উন্নতির জন্যে, মঙ্গলের জন্যে! ভাগ্য বিরূপ...”
“উন্নতির জন্যে! মঙ্গলের জন্যে!” বাধা পেয়ে বিশাখা এ বার অধিকতর উচ্চস্বরে বলে উঠেছিল, “কোথায় সেই বিদর্ভের রাজকন্যে, কোথায় দ্বারকার কান্হা! তাদের সঙ্গে আমাদের কোন কালের কী, তাদের বিয়ে রুখতে আমার বাছার কী দায় ছিল? সে কি আগে যুদ্ধু করেছে কখনও? অস্ত্র শিখেছে বলেই রাজার দাস হয়ে তাঁর যুদ্ধু লড়তে যেতে হবে? কে কার কনে হরণ করে পালাচ্ছে— বড় বড় রাজারা রুধতে পারলে না, সেনাপতিরা মুখ পোড়াল যুদ্ধে— আমার কচি ছেলেটাকে ইনি সেই দূর পশ্চিমদেশের পাহাড়ে পাঠালেন সেই তার মতো ভয়ানক শত্তুরের পথ আটকাতে! এই উন্নতি, এই মঙ্গল!”
প্রতাপশালী প্রবীণ জরাসন্ধ এর কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
৩৬
“মার্জনা করবেন রাজন। কিন্তু আপনি কেন বারংবার একই অনুরোধ করছেন?”
প্রভাতটি মনোরম। যমুনাতীরে ব্রহ্মর্ষি উপযাজের তপোবন বিহগকলতানমুখরিত হয়ে উঠেছে। নির্মেঘ আকাশে শরতের বালার্ক সদ্য তার কনকমরীচিমালা বিস্তারে রত। নিদ্রোত্থিত নদীর বুক থেকে অতি মধুর শীতল অনিল বিলাসী লীলাভঙ্গিমায় তীরস্থ বৃক্ষশাখাগুলিকে স্পর্শ করে যাচ্ছে, মৃদু পত্রমর্মর শোনা যায় ওই। আশ্রমের পুষ্পবিতানে মকরন্দ-অভিলাষী ভ্রমরের সলজ্জ গতায়াত শুরু হয়েছে এইমাত্র।
কিন্তু ঋষির মুখ তত প্রসন্ন নয়। পদ্মাসনে যেমন ঋজু তাঁর বসার ভঙ্গিমাটি, তেমনই গম্ভীর অনমনীয় তাঁর কণ্ঠ।
“আমি তো একাধিক বার আপনাকে বলেছি, হে পাঞ্চাল-নরেশ! এই কর্মে আমি নিজেকে নিয়োজিত করব না!”
দ্রুপদ অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, “জানি, হে ব্রহ্মর্ষে! বারংবার একই প্রত্যাখ্যান-বাক্য বলতে বলতে আপনি বিরক্ত। কিন্তু আমিও তো শপথবদ্ধ। এই কর্মকেই আমার জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি জানি, সাধনায় বহু ধৈর্য ধারণ করতে হয়। আপনার বারংবার প্রত্যাখ্যানেও আমি নিবৃত্ত হইনি, হবও না। বড় বড় সাধক-তপস্বীরা কী পরিমাণ ধৈর্য নিয়ে, কী বিপুল কৃচ্ছ্রের মাধ্যমে ঈপ্সিত ফললাভের প্রযত্ন করেন— তা তো কারও অজ্ঞাত নয়। আশা রাখব, আপনি এক দিন ঠিকই প্রসন্ন হবেন, আমার নম্র প্রার্থনায় সাড়া দেবেন। আমি নিরুপায়, কারণ আমার এই অভিপ্রায় সিদ্ধ করার মতো উপযুক্ত ব্যক্তি তো আর কেউ নেই!”
ঋষি উপযাজ মাথা নাড়লেন। গম্ভীরস্বরে বললেন, “সাড়া আমি কখনওই দেব না, হে পাঞ্চালরাজ। এ আপনি ঠিকই শুনেছেন যে, পুত্রেষ্টি যজ্ঞ খুবই দুরূহ কৃত্য, প্রাচীনকালের এক রহস্যময় যজন-ক্রিয়া। এ যুগে খুব কম ঋষি-তপস্বীরই আয়ত্ত আছে সে বিদ্যা।”
“মহাত্মন্, তাই তো আপনার দ্বারস্থ আমি! বিকল্প-পন্থ-হীন, অসহায়— ব্যাকুল এক পুত্রার্থী!”
“কিন্তু রাজন্, এ পুত্রাকাঙ্ক্ষা তো আর পাঁচটি সাধারণ পিতার অনুরূপ নয়! আপনি তো নির্দোষ-নিরীহ একটি পুত্রযজ্ঞ চান না। আপনি চাইছেন— একই সঙ্গে একটি কুলের ধ্বংস এবং এক জন ব্যক্তির বধ! সেই অভিসন্ধিতেই আপনার এই সন্তান-যাচ্ঞা!”
“হ্যাঁ! আমার প্রতিশোধ চাই উভয়ত। কুরুরাজ্য ও দ্রোণ, এই দুয়েরই বিনাশ!” দ্রুপদের চক্ষুতে স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল।
ঋষি শান্তস্বরে বললেন, “প্রতিশোধ সাধনের জন্য যজ্ঞ, ক্ষতিসাধনের জন্য পুত্র-উৎপাদন— এ আমি নীতিবিরুদ্ধ মনে করি। পবিত্র অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার সময় এই মনোভীষ্ট ব্যক্ত করতে পারব না যে, এমন পুত্র চাই যার আবির্ভাবই হবে একটি বিশেষ ব্যক্তিকে সংহার করার জন্য!... না,এতে আমার তপোবল ও পুণ্যফল দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে! অখ্যাতিও। আপনি তো জানেন, ঋষিগণ অখ্যাতি-ভীরু; কারণ, অপযশ তাঁদের জীবিকার পক্ষে হানিকারক!”
“ক্ষতিপূরণ করতে আমি প্রস্তুত, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ উপযাজ! আপনার অবশিষ্ট জীবনের জীবিকার জন্য যথেষ্টরও অধিক সম্পদ আমি আপনার চরণে দিতে সম্মত! স্বর্ণ ভূমি গোধন আদি যা কিছু আপনি চাইবেন, যত পরিমাণে চাইবেন...”
উপযাজ শ্মশ্রু-গুম্ফের ফাঁকে হাসলেন। বললেন, “এখনই তো দেখি, এই মাসাধিক কাল ধরে প্রতি দিন প্রত্যুষে আপনার অনুচরেরা স্বর্ণপাত্রে দুগ্ধ ঘৃত মধু ফলমূলাদি এবং মুদ্রার থলি রেখে যায় আশ্রমদ্বারে। আমি কিন্তু সে সব স্পর্শ করি না। আমার শিষ্যরা ওগুলি দীনদরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে আসে...”
“জানি, প্রভু। আমি আপনাকে উৎকোচ দেওয়ার জন্য ওগুলি প্রেরণ করি না। নিতান্তই ভক্তির অর্ঘ্য। আমার সাধনার নৈবেদ্য মনে করবেন ঋষিবর! এটুকু করতে দিন।”
“তা বেশ, যদি তাতেই আপনার সন্তোষ— আমি বাধা দেব না। গ্রহণ তো করছি না! দরিদ্ররা উপকৃত হোক। কিন্তু আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না, পুত্রেষ্টি যজ্ঞকে বধাভিপ্রায়ের ও ধ্বংস-কামনার সঙ্গে যুক্ত করতে আমি অপারগ! বিশেষত, যেখানে সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি... ব্রাহ্মণ!”
“হ্যাঁ! সেখানেই তো যত বাধা! সে লোক ব্রাহ্মণ বলেই তো তার জন্য যজ্ঞোদ্ভূত দৈবাদিষ্ট হন্তারক প্রয়োজন, হে মান্যবর! নচেৎ অসির একটি আঘাতেই তার শির একেবারে বিচ্ছিন্ন করা চলে, ব্রাহ্মণের দেহ তো লৌহে নির্মিত নয়! কিন্তু, ওই যে,” দ্রুপদের স্বর কঠিন হল, চিবুকও। তিক্ত অসহায়তা ফুটে উঠল মুখের রেখায়, “সমাজ! সমাজ তাকে রক্ষাকবচ দিয়ে রেখেছে, হাঃ! ব্রহ্মহত্যাকারীকে সমাজ থেকে নির্বাসিত হতে হবে! নরকস্থহতে হবে!”
উপযাজ গম্ভীর স্বরে বললেন, “অবশ্যই। ব্রাহ্মণ যতই শত্রুতা করুক, সে অবধ্য! সম্মুখযুদ্ধেও তাঁকে বধ করলে মহাপাপ!
একটি ক্ষুব্ধ শ্বাস ফেললেন দ্রুপদ, “এ বড় পক্ষপাতী বিধান, ঋষিবর! নচেৎ, পাঞ্চাল-রক্তে ক্ষাত্রতেজ এখনও এত মন্দীভূত হয়নি যে, মনুষ্যশরীরধারী একটি শত্রুর নিধনের জন্য যজ্ঞায়োজন করতে হবে! যদি সে ব্রাহ্মণ না হত...”
উপযাজ মৃদু হাসলেন, “কিন্তু... যদি নির্দিষ্ট ব্রাহ্মণের বধার্থই যজ্ঞ হয়, তবে সেই যজ্ঞজাত ব্যক্তি স্বচ্ছন্দে ব্রহ্মহত্যা করতে পারেন, তাই না? তাতে পাপ বা শাস্তি নেই...”
“নেই, কারণ সে দৈবাদিষ্ট! বিধান তো তেমনই। ওই বিশেষ দৈবকর্মের জন্যই তার জন্ম! সুতরাং...”
“সমাজ-বিধানের মধ্যে রন্ধ্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন! আপনি প্রখর বুদ্ধিমান, রাজন!” উপযাজ এ বার আসন ত্যাগ করে উঠে পড়লেন। তাঁর প্রাতঃকালীন ধ্যান-আহ্নিকের সময় হয়েছে। কুশের আসনটি গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “তবে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। এ বার আপনি স্থির করুন, অন্যত্র সন্ধান করবেন কি না!”
দ্রুপদও উঠলেন। আশ্রম ত্যাগের আগে শান্তকণ্ঠে বললেন, “রাজ-জ্যোতিষী গণনা করে বলেছেন, আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবেই। এবং তা হবে এই যমুনাতীরের তপোবন থেকেই! আজ পর্যন্ত তাঁর কথা কখনও ভুল প্রমাণিত হয়নি। আমি নিয়মিত আপনার পদসেবা করে যাব। দেখি আপনার হৃদয় বিগলিত হয় কি না!”
উত্তর না দিয়ে উপযাজ মৃদু হাসলেন শুধু।
৩৭
হ্যাঁ। সত্য কথা বলেছিল বটে শোকার্তা নিষাদ-জায়া, বিশাখা। অকাট্য সত্য! কী বিবেচনায় অনভিজ্ঞ একলব্যকে পাঠানো হল কীর্তিমান যোদ্ধা তথা যাদবশ্রেষ্ঠ বাসুদেবের পথ রোধ করতে?
এ মহা-ধুরন্ধর জরাসন্ধেরই বিচারের ভ্রম। অতিবুদ্ধিমানেরও সিদ্ধান্ত-বিভ্রাট হয়। তিনি যাদব দেবকীনন্দনের ক্ষাত্রসামর্থ্যকে ক্ষুদ্র ভেবেছিলেন, তাঁকে রণত্যাগী ভীরু বিবেচনা করেছিলেন। বাস্তবিকই জানা ছিল না— শুধু পিচ্ছিল মৎস্যের মতো অরাতিকে ফাঁকি দিতেই নয়, বিক্রান্তশার্দূলের মতো সম্মুখ-সংঘর্ষে শত্রুশাসনেও সে ব্যক্তি সমান পারঙ্গম!
স্ত্রীর কর্কশ ভর্ৎসনায় অপ্রস্তুত হিরণ্যধনু এগিয়ে এসে যুক্তকরে রাজাকে বলেছিল, “প্রভু, শোকে-দুঃখে স্ত্রীলোক উন্মাদ হয়ে আছে, অপরাধ নেবেন না... কিন্তু প্রভু... বড় জ্বালা, এইখানে... পুরুষমানুষের পক্ষেই অসহ্য, বুঝলেন... ওঃ হো...” বলতে বলতে ক্রন্দনরোধের আপ্রাণ প্রয়াসে মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল তার।
অসহ্য লাগছিল জরাসন্ধেরও। সাম্রাজ্যবিস্তারে চির-অক্লান্ত জরাসন্ধ, শত্রুনিপাতে নির্মম জরাসন্ধ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রবলপ্রতাপ জরাসন্ধ! দেশ জয় করে রাজাদের বলি দেবেন বলে বন্দি করে রেখেছেন যে জরাসন্ধ! আজ তাঁর হৃদয় জুড়ে অনুশোচনা আর বেদনার জলোচ্ছ্বাস। আশ্চর্য?... নাঃ! জরাসন্ধ বৃদ্ধ হচ্ছেন। নচেৎ এমন প্রকট হৃদয়দৌর্বল্য...
কিছুতেই এই গ্লানি থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে পারছেন না মগধনরেশ! যুদ্ধে তো সৈন্যক্ষয় কতই হয়। কিন্তু এই তরুণ, কেন কে জানে, তাঁকে অধিকার করে ফেলেছিল খুব! একটি নিষ্পাপ ভাগ্যবিড়ম্বিত নবীন প্রাণ, একটি অমূল্য সম্ভাবনা— কেবল তাঁরই ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে অকালে নির্বাপিত হল! তিনি তার মঙ্গলার্থী হয়েছিলেন তো নিজ স্বার্থেই, নয় কি? এত যে মহত্ত্ব দেখিয়ে চিকিৎসা করানো, এত যত্ন এত অভিভাবকত্ব পৃষ্ঠপোষকতা— সব তো নিজ অভিসন্ধি চরিতার্থ করার মানসেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy