ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: স্বয়ংবরের দিন প্রত্যুষে যখন বিদর্ভ রাজকুমারী রুক্মিণী দেবীমন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছেন, পরিকল্পনা মতো তখনই কৃষ্ণ রথে তুলে নিলেন তাঁকে। কিন্তু ফেরার পথে বার বার বিভিন্ন আবর্তে অপেক্ষমাণ জরাসন্ধের সৈন্যরা গতি রুদ্ধ করছিল তাঁদের। সবচেয়ে কঠিন বাধা হয়ে এলেন মহাবীর রুক্মী। কিন্তু সম্মুখসমরে প্রবল বীরত্ব দেখিয়ে তাঁকে ভূপাতিত করে নিধনে উদ্যত হন কৃষ্ণ। কিন্তু রুক্মিণীর সানুনয় প্রার্থনায় রুক্মীকে প্রাণভিক্ষা দেন বাসুদেব। তাতেও বিপদের শেষ হয় না।
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিটিকে শুধু সহজে পরাস্ত করা যাচ্ছিল না। মাটিতে জানু পেতে অতি সপ্রতিভ ভঙ্গিতে সে পর পর শরক্ষেপণ করে চলেছে, স্বল্পালোকেও তার লক্ষ্য অভ্রান্ত, কৃষ্ণকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল সেগুলি নিবারণ করতে। বিশেষত, রথে রুক্মিণী রয়েছেন, তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে কৃষ্ণের নিজের প্রতিরক্ষায় মাঝে মাঝেই সামান্য রন্ধ্র দেখা দিচ্ছিল। ধানুকীটি তার সদ্ব্যবহার করে তাঁকে একটি-দু’টি বাণে বিদ্ধও করল।
কৃষ্ণ ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। ম্লান আলোকেই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেন শত্রুকে। সাধারণ তিরন্দাজ নয় এ লোক। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান, শরনিক্ষেপে নিপুণ, খর-দৃষ্টি, সাহসী। সঙ্গীরা পলায়ন করলেও এ ব্যক্তি এতটাই সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তথা আত্মবিশ্বাসী যে, একাকীই পথ রোধ করে রয়েছে।
কৃষ্ণ ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন ধানুকীকে। অতি তরুণবয়স্ক; পরনে নিষাদ-বেশ। মাথায় রক্তবর্ণ বস্ত্রখণ্ডে পালক শোভিত, কটিতে পশুচর্ম। কটিবন্ধে খড়্গ। বক্ষেও চর্মাবরণী। ধনু অভিজাত নয়, সাধারণ বেত্রনির্মিত। সর্বাঙ্গে অঙ্গারচূর্ণ বিলেপিত, মুখেও— ফলে অসিত অবয়বটি খুঁটিয়ে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মগধ-সেনাদলে যে ধরনের আরণ্য জাতির লোকজন অন্তর্ভুক্ত থাকে, তেমন সাধারণ শিকারজীবী ব্যাধ তো এ নয়! ক্ষাত্রবীর্যের স্পষ্ট অভিজ্ঞান...
চকিতে যদুপতির মস্তিষ্কে একটা বিদ্যুৎ-দীপনের মতো অনুভব হল।
তাই তো, এত ক্ষণ ভেবে দেখেননি! একটি শ্বাস চাপলেন কৃষ্ণ। আরও এক বার দেখলেন অতি নিবিড় মনঃসংযোগে। চক্ষু সামান্য বিস্ফারিত, তার পর কুঞ্চিত হল। এক পল কী যেন এক গভীর ভাবনার ঘ্রাণ নিলেন। তাঁর চিন্তন-তরঙ্গ অকল্পনীয় দ্রুতগতি। ঈষৎ উত্তেজিত দেখাল তাঁকে। তার পর উচ্চকণ্ঠে বললেন, “বড় চমৎকার বিদ্যা তো হে, নিষাদ! মগধ-সৈন্যদলে অনেক দিন এমন দেখি না। নাম কী তোমার?”
“নাম জেনে কী হবে যাদব? নিজের প্রাণ বাঁচাও!” রুক্ষ উত্তর এল, “তুমি নাকি স্বয়ং ভগবান বলে শুনি! তা, ভগবানের দেহে তো তির দিব্যি বিঁধছে!”
কৃষ্ণ এক মুহূর্ত চুপ থেকে, আবার বললেন, “তোমাকে চিনি মনে হচ্ছে হে! তোমার পিতা বড় ভাল লোক, তিনি কেমন আছেন বলো দেখি? রাজা হিরণ্যধনু?”
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে থমকে গেল ধনুর্ধারী। বাসুদেব সঙ্গে-সঙ্গেই আবার বললেন, “আরে! কৃত্রিম অঙ্গুষ্ঠ জুড়েছ দেখছি... কাঠের নাকি হে? দেখো, খুলে না যায়!”
সামান্য অন্যমনস্ক হয়েছিল যুবা, সেইটুকু রন্ধ্রই যথেষ্ট! তিলার্ধ বিলম্ব না করে কৃষ্ণ নিজের ধনুঃশর তুলে নিয়ে দুটি ক্ষুরপ্র জুড়লেন চক্ষের পলকে, আর নিমেষে ছিন্ন করে দিলেন তার ধনু!
প্রতিপক্ষের এমন কৌশলী হস্তলাঘব নিষাদ প্রত্যাশা করেনি। কিছু ক্ষণ হতচকিত হয়ে থাকে সে। তার পর সোজা হয়ে দাঁড়ায়, নিমেষে কটি থেকে খড়্গ খুলে নিয়ে রথের দিকে ধাবিত হয়।
রথের রশি রুক্মিণীর হাতে দিয়ে কৃষ্ণও খড়্গ হাতে ভূমিতে নামেন। তিনি ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেছেন।
অপরাহ্নের রক্ত-আলোয় শুরু হয় সম্মুখ-সংগ্রাম। শস্ত্র-সংঘর্ষের ধাতব নিনাদে মুখরিত হয় রৈবতকের গিরি-উপত্যকা।
রুক্মিণী এ বার অন্য রকম বিস্মিত হচ্ছিলেন কৃষ্ণের যুদ্ধ-প্রকৃতি দেখে। কেমন যেন হচ্ছে এই দ্বন্দ্বটি! খড়্গসঞ্চালনে নিষাদই যেন অধিকতর দক্ষ ও আগ্রাসী! কৃষ্ণ শুধু আত্মরক্ষাটুকু করছেন। প্রতিপক্ষের বিক্রম সহ্য করতে না পেরেই বুঝি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন এক পা এক পা করে! মাঝে মাঝে দৌড়েই দূরত্ব বৃদ্ধি করছেন— সমতলভূমি থেকে সরে, অদূরের প্রস্তরময় টিলাটির দিকে চলে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। হয়তো তাঁকে পরাজয়মুখী, ভীত ও পলায়নপর ভেবেই শত্রু সগর্জনে লাফ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করছে ধরে ফেলার। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লঘুসঞ্চারে কৃষ্ণ নিজেকে লুক্কায়িত করে ফেললেন এক গিরিবর্ত্মের মধ্যে। খড়্গধারী নিষাদও তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে চলল। দু’জনেই পাহাড়ের অন্তরালে এখন। রুক্মিণী কাউকেই দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু সাক্ষাৎ হয়েছে দু’জনের, নিশ্চিত। ওই যে শোনা যাচ্ছে অসির ঝন্ঝনা!
এমন সব মহাবৈরীকে হেলায় পরাভূত করে— শেষে এক নিষাদের খড়্গাঘাতের ভয়ে বীরশ্রেষ্ঠ বাসুদেব পর্বতান্তরালে আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন? রুক্মিণী নিজের মনেই মাথা নাড়লেন। অবশ্যই এ রণছোড়ের ছল, সরল ব্যাধ তার সন্ধান জানে না।
সহসা আয়ুধ-সংঘাতধ্বনি থেমে গেল। রুক্মিণী উৎকর্ণ হয়ে চেয়ে রইলেন। কিন্তু বহু ক্ষণ আর কোনও শব্দ নেই। প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য। গোধূলির মলিন গৈরিক বসন ধীরে ধীরে আসন্ন সন্ধ্যার ভস্মরাগে আবৃত হয়ে আসছে, বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে চরাচর। কিন্তু দুই যুযুধানের কেউই পর্বতান্তরাল থেকে বেরিয়ে আসছে না!
রথে একাকিনী বিদর্ভ-দুহিতা উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন ক্রমশ। এত বিলম্ব! কোনও শব্দ নেই, শুধু সমুদ্র-সন্নিহিত গিরিপ্রদেশের সান্ধ্য শীতল বাতাস হু হু করে বইছে। এত ক্ষণ ধরে কী ঘটছে, অদৃশ্যে? প্রবল অমঙ্গলের আশঙ্কা রুক্মিণীকে ঘিরে ধরতে থাকে।
দিবালোক সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। রুক্মিণী কী করবেন? রথ থেকে নেমে অনুসন্ধান করতে যাবেন? অপরিচিত পার্বত্য অঞ্চল, অন্ধকার ঘনীভূতপ্রায়, তিনি একাকিনী নিরস্ত্রা ললনা। ওই প্রস্তরের আড়ালে কী ঘটে চলেছে— বা ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে— জানা নেই। কী করতে পারেন অসহায়া বিদর্ভ-কুমারী?
এমন সময় বিশাল এক প্রস্তরখণ্ডের পিছন থেকে কৃষ্ণ বেরিয়ে এলেন।
একা। অসি কোষবদ্ধ। পরিশ্রান্ত ও গম্ভীর দেখাচ্ছিল তাঁকে।
রুক্মিণী প্রায় ক্রন্দনোন্মুখ হয়ে ছিলেন। অতি কষ্টে নিয়ন্ত্রিত করলেন নিজেকে। বাসুদেব নীরবে রথে উঠে তাঁর বাহু স্পর্শ করলেন এক বার, তার পর বললেন, “এ বার, গন্তব্য!”
রুক্মিণী শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, “নিষাদ...?”
“নিষাদের বৃত্তান্ত আজ সমাপন করে দিতে হল!” মৃদুস্বরে এইটুকু বললেন বাসুদেব, তার পর রথ ছুটিয়ে দিলেন ত্বরিতে।
৩৩
হস্তিনা-সভার আবহ ঘোর মেঘাচ্ছন্ন। সারি সারি মুখ গম্ভীর, চিন্তিত, ক্ষুব্ধ। মাঝে মাঝে সামান্য আলোচনা হচ্ছে, তার পর নীরব হয়ে যাচ্ছেন সকলেই। স্মরণকালের মধ্যে এমন হতাশ ও লজ্জিত পরিবেশে সভা হয়নি এ রাজপুরীতে।
অথচ, ভাগ্যের পরিহাস! যে বিষয় ঘিরে আজ মধ্যাহ্নেই এমন অন্ধকার নেমে এসেছে কুরুপ্রধানদের মুখে, মাত্র গতকালই তা নিয়ে তাঁরা কেউ প্রকট কেউ বা প্রচ্ছন্ন গর্বে-উল্লাসে উদ্দীপ্ত ছিলেন! ভরতবংশের গৌরব-কীর্তির ধ্বজা উড্ডীন হতে চলেছে বহু দিন পর, দুর্বিনীত উদ্ধত পাঞ্চাল এত দিনে উচিত শিক্ষা পাবে— এই সুখ-প্রত্যাশা নিয়েই তাঁরা নিদ্রা গিয়েছিলেন রাত্রিকালে।
কে জানত, সূর্যোদয়ের পর একটি প্রহরের মধ্যেই বালু-স্থাপত্যের মতো ভূমিলগ্ন হবে সে উচ্চাশা, দগ্ধমুখ হস্তিনাকে নিয়ে পরিহাসে মাতবে কাম্পিল্য তথা পাঞ্চালবাসীরা!
সভার নীরবতা ভেঙে এখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র তিক্তস্বরে বলছেন, “আমি মনে করি, এই দক্ষিণা চাওয়া আচার্য দ্রোণের উচিত হয়নি। যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা-হীন কয়েকজন তরুণ কুমারকে সরাসরি পাঞ্চালের মতো শক্তিধর রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পাঠানো, ঘোর অবিবেচনা! তাঁর ব্যক্তিগত জয়-পরাজয়ের সঙ্গে সমগ্র কুরুকুলকে জড়িয়ে ফেলার অধিকার তাঁর ছিল না। এই সংঘর্ষে আমার সম্মতি ছিল না প্রথম থেকেই...”
নতশিরে সভায় বসে আছেন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম। পাঞ্চালের কাছে কুরুর পরাজয়, তাও স্বতঃপ্রবৃত্ত আক্রমণে গিয়ে! এ লজ্জার সর্বাধিক দায় বুঝি তাঁরই! রাজা ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিধা সত্ত্বেও, ভীষ্ম সোৎসাহে সম্মতি দিয়েছিলেন পাঞ্চাল-অভিযানের প্রস্তাবে। দ্রোণের ব্যক্তিগত গণিতের সঙ্গে যদি কুরুর নিজস্ব রসায়ন যুক্ত হয়— তাতে হস্তিনারই রাজনৈতিক লাভ বিপুল, এই উপলব্ধি ছিল প্রবীণ নায়কের।
চিরবৈরী পাঞ্চালের দর্পহরণ— এ গঙ্গাপুত্রের দীর্ঘ দিনের কামনা। শুধু কুরুর দু’টি প্রজন্ম বীরশূন্য থাকায় সামরিক শক্তি হ্রাস পেয়েছিল, তাই সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। দ্রোণের গুরুদক্ষিণার সূত্রে কুরুকুমারদের হাতে সম্ভাব্য পাঞ্চাল-বিজয়ের বিষয়টি নিয়ে ভীষ্ম তাই চরম উদ্দীপিত ছিলেন। আগ্রহাতিশয্যে তিনি এমনকি হস্তিনার সেনাবাহিনী ও ধ্বজ পর্যন্ত এই অভিযানে ব্যবহার করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত ছিলেন; দ্রোণ অবশ্য তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এই যুদ্ধযাত্রা কেবলমাত্র কুমারদের গুরুদক্ষিণা-সম্পর্কিত, রাষ্ট্রীয় সমর নয়। সেনাবাহিনীর এতে কোনও ভূমিকা থাকা সমীচীন হবে না।
পাঞ্চাল দীর্ঘ দিন ধরে সামরিক ও কূটনৈতিক ভাবে কুরুকে বিব্রত করছে, এ ছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে দ্রুপদ সম্পর্কে বিদ্বিষ্ট হয়ে থাকার আরও একটি গোপন কারণ আছে গাঙ্গায়নির।
কাশীরাজকন্যা অম্বা ভীষ্মের বধের কারণ হতে চেয়ে তপস্যা করেছিলেন, প্রাচীন সে বৃত্তান্ত। আত্মঘাতিনী হওয়ার গল্প প্রচারিত হয়, কিন্তু চরমুখে শোনা যায়, কুরু-বৈরী পাঞ্চাল তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। পরে, অম্বার মৃত্যুর পর, দ্রুপদের পুত্র হিসেবে নাকি তাঁর ‘পুনর্জন্ম হয়েছে’ এবং সেই পুত্র শিখণ্ডীই ভীষ্মনিধনের জন্য ‘দৈবপ্রেরিত’, এই মর্মে বিপুল ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চালিয়ে চলেছে কাম্পিল্যনগর। চরমুখে শান্তনুনন্দন এমনও জেনেছেন, দ্রুপদের এ সন্তানটি আদৌ পুত্রই নয়। অম্বার পুনর্জন্মের প্রচারটিকে সত্য প্রতিপন্ন করতে ধূর্ত দ্রুপদ তাঁর ‘শিখণ্ডিনী’ নামক কন্যাকে পুরুষের মতো বেশভূষা অলঙ্কার পরিয়ে, ‘শিখণ্ডী’ নামে সাজিয়ে রাখে। ‘ভীষ্মকে হত্যা করার লোক আমার ঘরে আছে’— দেশব্যাপী এই বার্তা প্রচারেরমাধ্যমে কুরুবংশকে মানসিক চাপে রাখার নীচ রাজনৈতিক কৌশল!
বাহুবলের পরিবর্তে ক্ষত্রিয়ের এমন হীন ছল ও কূটবুদ্ধি দেখলে গাঙ্গেয়র সঘৃণ ক্রোধ জন্মায়। কুটিল দ্রুপদকে কুরুকুমারেরা বেঁধে আনুক, যথাসাধ্য নিগৃহীত করুক— এ তিনি সাগ্রহেই চাইছিলেন।
কিন্তু এ কী সংবাদ নিয়ে এল ভগ্নদূত, দিবার মধ্যভাগেই?
একশত ধার্তরাষ্ট্র সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুপদের রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে, এই বার্তা ছিল গত রজনী পর্যন্ত। দুর্যোধন চেয়েছিল শত্রুজয়ের গৌরবটি নিরঙ্কুশ ভাবে তার শিরেই উঠুক, তাই সে আক্রমণের পুরোভাগে নিজের ভ্রাতাদের রেখেছিল। এমনকি মিত্র অঙ্গরাজকেও সে ডেকে নিয়েছিল অভিযানে। নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সে নিঃসংশয় ছিল। অত প্রত্যুষে, অতর্কিত আক্রমণ সম্পর্কে অনবহিত ও অসতর্ক দ্রুপদকে বন্দি করা খুব কঠিন হবে না, এই ছিল তার প্রত্যাশা। পাণ্ডবদের সে এক রকম তাচ্ছিল্য করেই পশ্চাদ্বর্তী করে রেখেছিল। আজ যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে তার মনোভাব বুঝে অর্জুন প্রস্তাব দেয়, ধার্তরাষ্ট্ররাই স্বাধীন ভাবে অভিযান আরম্ভ করুক। তারা পঞ্চভ্রাতা মিলে বরং কাম্পিল্যনগরের বাইরে কিছু দূরেই অবস্থান করবে প্রথমে, যদি কৌরবদের প্রয়োজন হয় তখন না-হয় যোগ দেওয়া যাবে! তাতে সানন্দে সম্মত হয় দুর্যোধন। পাঁচ জনের সাহায্য বাহুল্য মাত্র, তারা একশত ভ্রাতাই যথেষ্ট...
নতশির দূতকে শ্লেষ্মাজড়িত-স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন শান্তনব, “একশত বীর ভ্রাতা মিলেও এত দ্রুত পরাজিত হল কী করে?”
দূত মৃদুকণ্ঠে বলতে থাকে, “হে কুরুকুলকিরীট! প্রথম উদ্যমে কুরুরাজকুমাররা যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছিলেন। নিদ্রিত নগরীকে তাঁরা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন, দৌবারিক প্রহরী রক্ষী সকলে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, নাগরিকরা ভয়ে আর্ত চিৎকার করছিল। রথারূঢ় কুমার দুর্যোধন সদলে রাজপথ দিয়ে প্রাসাদ-অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন, সম্মুখে সমস্ত বাধা তাঁরা হেলায় অপসারিত করছিলেন। প্রথম যে ক’টি সৈন্যদল তাঁদের পথরোধ করে, তারা ফুৎকারে উড়ে যায় কৌরব-বিক্রমের সামনে!”
“তবে? এত শুভ সূচনার পর আচম্বিতে কী এমন হল...” ধৃতরাষ্ট্রের বিমর্ষ কণ্ঠের প্রশ্ন উচ্চারিত হল।
“মহারাজ, বাস্তবিকই জয়লক্ষ্মী কৌরবপক্ষের করায়ত্ত হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। কিন্তু রাজা দ্রুপদ অতি রণনিপুণ। তিনি অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে নিজের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের সংগঠিত করে ফেলেন। তারপর দুই ধারে জলাশয়-বেষ্টিত এক সঙ্কীর্ণ কৃষি-প্রান্তরের কাছে, পাশের দিক থেকে আকস্মিক প্রতিআক্রমণ করেন কুরুবাহিনীকে। তাঁর সঙ্গে কয়েকটি সুশিক্ষিত হস্তী ছিল, সেগুলির আগ্রাসী বিচরণ আমাদের কুমারদের হতচকিত করে দেয়। উপরন্তু, প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠে সাধারণ নাগরিকরাও— যে যা অস্ত্র হাতে পেল তাই নিয়েই চতুর্দিক থেকে সম্মিলিত আক্রমণ করে বসে। তারা কোনও যুদ্ধনীতি মান্য করছিল না, পথটিকে জনসমাকীর্ণ ও নৈরাজ্যসঙ্কুল করে তুলে যে ভাবে হোক অস্ত্র নিক্ষেপ করাই তাদের উদ্দেশ্য! এর ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। সম্মুখপথ রুদ্ধ, পাশের দিকেও শত্রুবেষ্টিত— এ অবস্থায় কৌরবপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়...”
এ বার মহামন্ত্রী বিদুর ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। বললেন, “সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্রাঘাতেই এত বিড়ম্বনা! কেন, কুমার দুর্যোধনের সঙ্গে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর ছিলেন— পরশুরামের শিষ্য মহাবীর বসুষেণ! তিনি কী করছিলেন? কোনও মহারণক্ষেত্র নয়, দুর্জয় দিগ্বিজয়ী প্রতিপক্ষ নয়, সাধারণ পথে-প্রান্তরে অল্প কয়েক জন সৈন্যসামন্ত আর অপ্রশিক্ষিত কয়েক শত জনতা— এদের সম্মিলিত আক্রমণেই লাঙ্গুল সঙ্কুচিত করে পালিয়ে বাঁচলেন! তাঁর চমৎকারী মহাস্ত্রগুলি কি শুধুই রঙ্গভূমিতে আস্ফালনের জন্য?”
সৌবল শকুনি এত ক্ষণ অতি বিরসবদনে নিজের কণ্ঠের একটি মুক্তাহার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। বিদুরের শ্লেষোক্তি শুনে এক বার সে দিকে তির্যক দৃষ্টিপাত করে কষায়-কণ্ঠে বলে উঠলেন, “রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি সভায় বসে বিশ্লেষণ করা যায় না, মান্য মহামাত্য! তত পরিমাণ যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা আপনার আছে কি? অঙ্গাধিপতির মতো মহাবীর যেখানে পরাস্ত হয়েছেন, নিশ্চিত সেখানে অসামান্য কিছু প্রতিকূলতা ছিল। আপনার স্নেহধন্য অর্জুন থাকলেও একই দশা হত সন্দেহ নেই!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy