Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

ম্লান দীপালোকে রাজ-সারথি অধিরথ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পুত্রের মুখের দিকে। ক্ষোভে-দুঃখে-হতাশায় সে মুখের রেখাগুলি ভারাক্রান্ত।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২২ ০৫:২৭
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: রাজকুমারদের সঙ্গে পিতামহ ভীষ্মের কথোপকথনে বোঝা যায়, আগন্তুক ধনুর্বিদ তাঁর অপরিচিত নন। জানা যায়, এই ব্যক্তি পাঞ্চাল দেশ থেকে এসেছেন। তিনি ভরদ্বাজ ঋষির পুত্র দ্রোণ। তাঁরই তত্ত্বাবধানে হস্তিনাপুরে স্থাপিত হয় অস্ত্রশিক্ষাকেন্দ্র। পরশুরামের থেকে প্রাপ্ত নানা গুপ্ত যুদ্ধবিদ্যা দ্রোণ শেখাতে শুরু করেন রাজকুমারদের।

জনসাধারণের কৌতূহল বাড়ে, “আসল জিনিস বলতে?”

“ওই, যেগুলি একেবারে মোক্ষম বিদ্যা! শ্রেষ্ঠ দিব্যাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, মারণাস্ত্র... আরও সব নানা গুপ্তজ্ঞান! মন্ত্রতন্ত্র আছে হে। কেবল বিপ্রসন্তানেরাই সেগুলির শিক্ষা নেয়, তারপর তারাই গুরুমুখী বিদ্যা বহন করে। ওই আশ্রমেই তারা শিক্ষাদানের বৃত্তি অনুসরণ করে থাকে। তাদেরই কেউ হবে পরবর্তী পরশুরাম।”— গোপন সব বার্তা উন্মোচিত হতে থাকে জনমণ্ডলীতে।

“অর্থাৎ কিনা, এ বিদ্যেটি এক এই হস্তিনা ছাড়া আর কোনও দেশের শিক্ষার্থী জানতেই পারবে না এই সমগ্র জম্বুদ্বীপে! ভাগ্যিস দ্রোণ-গুরু বিদ্যেটি আয়ত্ত করে নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে, তবেই না আমাদের কুমাররা পেতে চলেছে...”

“আমাদের কুমাররাই তবে কালে-কালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বীর হবে— তাদের সমকক্ষ কেউ থাকবে না, এ তো বিরাট ব্যাপার! মহান শান্তনুনন্দনের মস্তিষ্কখানি দেখেছ?”

“এ বার যোগ্য ব্যবস্থা হবে পাঞ্চাল আর মগধের! শুধু শিক্ষেটি সারা হতে দাও!”

দক্ষিণ-পূর্বের প্রবল প্রতিবেশী রাজ্য পাঞ্চালকে নিয়ে হস্তিনা-নাগরিকদের উদ্বেগ বহু কালের। পরাক্রান্ত সৈন্যদলের অধিকারী ও ধনী রাজ্য পাঞ্চালের সঙ্গে কুরুবংশের শীতল বিরোধের ইতিহাস বেশ প্রাচীন, বিশেষত গত দুই প্রজন্ম ধরে কুরু-রাজপ্রাসাদে যোগ্য পরাক্রান্ত নৃপতির অভাবে পাঞ্চালের সৃক্কনীলেহন বর্ধমান। দীর্ঘ কাল কারণে-অকারণে পাঞ্চালসেনা কুরুরাজ্যকে বিব্রত করে আসছে। পাঞ্চাল-লগ্ন কুরু-রাজ্য-প্রান্তটিকে নিয়ত বিপর্যস্ত করে রাখা যেন রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ হয়েই দাঁড়িয়েছে তাদের! সীমান্তে আজ এই গ্রাম লুণ্ঠন করে, কাল ওই অরণ্যটিকে অধিকার করে নেয়, কুরুর উদ্দেশে আগত বাণিজ্যশকট আটকে রাখে, রাজকর্মচারীদের লাঞ্ছিত করে, শ্রেষ্ঠীদের ধন অপহরণ করে চলে যায়। দূর অতীতেবড়-বড় যুদ্ধ হয়েছে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে। শুধু রাজ্যগ্রাসের অভিপ্রায়ে নয়, তুচ্ছ মান-অপমানের বিবাদেও কথায়-কথায় একে অন্যের বিরুদ্ধে সমরসজ্জা করেছে তারা। অন্যান্য রাজ্যের আহ্বানেও যখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে, কুরু-পাঞ্চাল অধিকাংশ সময়েই পরস্পরের বিপরীত শিবিরে যোগ দিয়েছে। সম্ভবত ভীষ্মের শৌর্যের কথা স্মরণে রেখেই পূর্বতন পাঞ্চালরাজ পৃষত প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হননি বেশ অনেক বৎসর। কিন্তু ঝটিকা-আক্রমণ বা গুপ্ত-দুর্বৃত্তির অভ্যাস প্রভূত পরিমাণে বর্ধিত করেন। বর্তমান রাজা দ্রুপদও অতি দাম্ভিক ও উদ্ধত। তিনি সামরিক শক্তিবৃদ্ধি তো করেছেনই, উপরন্তু নিজেও দুর্ধর্ষ মহারথী। এই জাতীয় প্রতিবেশী সর্বদা পার্শ্বরাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক।

আর, সংলগ্ন রাজ্য না হলেও, পূর্ব দিকের বিশাল ও শক্তিশালী রাজ্য মগধ ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে, আর্যাবর্তের অনেক ক্ষুদ্রতর রাজ্যই তার সাম্প্রতিক উত্থানে আশঙ্কিত। যদিও কুরুর সঙ্গে এখনও প্রত্যক্ষ সংঘাতে অবতীর্ণ হয়নি— তবু মগধের অভিসন্ধি অশুভ, এ সকলেই নিশ্চিত জানে। বর্তমান মগধাধিপতি জরাসন্ধ সর্বজনবিদিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী রণোন্মাদ। সম্রাট উপাধির জন্য তিনি লোলুপ, চতুর্দিকে বিনা প্ররোচনায় সেনা প্রেরণ করেন, পররাজ্য-গ্রাসের নেশা ধরেছে তাঁর।

তাই, কুরুপুত্রদের অজেয় হওয়ার সম্ভাবনা হস্তিনা-পৌরজনকে অভয় দেয়, উল্লসিত করে।

“তা হলে গুপ্তবিদ্যা এই শিক্ষাশ্রমেই আবদ্ধ থাকবে, অন্য কোনও রাজ্যে চলে যাওয়ার আশঙ্কা নেই,” সমবেত নিশ্চিন্তি ব্যক্ত করে জনতা। আশ্রম এখন তাদের কাছে রাজ্যের গর্ব-নিরাপত্তা-শ্রেষ্ঠত্বের এক দুর্মূল্য প্রতীক। এ সম্পদ যেন ভাগ না হয়!

তবু এক দিন কিঞ্চিৎ অন্য রকমের খবর আসে। শোনা যায়, মগধ-পাঞ্চাল থেকে না হলেও, যদুকুলের বৃষ্ণি অন্ধক প্রভৃতি গোষ্ঠী থেকে তরুণ কুমাররা এসে দ্রোণের আশ্রমে নাম লেখাতে চলেছে। পাণ্ডুপুত্র ও ধার্তরাষ্ট্রদের সঙ্গেই চলবে তাদের অস্ত্রশিক্ষা। রাজপুরীর বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এটি রাজনৈতিক তথা জ্ঞাতিগত বাধ্যবাধকতা। দুই বংশের দুই পূর্বপুরুষ, দুই ভ্রাতা— পুরু ও যদু। সেই সূত্রে যাদবরা কুরুকুলের নিকটাত্মীয়। আবার, যাদব-বীর শূরের কন্যা পৃথা, যিনি কুন্তীভোজ-রাজার পালিতা ছিলেন, তিনি পরিণয়বদ্ধ হয়েছেন কুরুবংশীয় পাণ্ডুর সঙ্গে। কুন্তীপুত্ররা তাই দুই বিশ্রুত বসুদেবপুত্র কৃষ্ণ-বলরামের আপন স্বসাত্মজ; সে দিকেও রক্তসম্পর্ক। সব মিলিয়ে, দুই রাজ্য দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক মিত্র। প্রত্যাখ্যানে অস্বস্তি ও বিপদ দুই-ই। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কুরু-রাজসভাকে অনুমতি দিতে হচ্ছে বহিরাগত শিক্ষার্থীদের।

জনতার উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। যাঃ! সে কী কথা! এত সুরক্ষা, এত নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা... তার পরেও যদি... যাদব-কুমারদের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে বার্তা। হস্তিনায় গেলে বিশেষ প্রশিক্ষণ মিলবে, এই সংবাদ। আরও বহুতর প্রান্ত থেকে উৎসাহীরা ভিড় জমাবে নিশ্চিত। যদুবংশের জন্য দ্বার খুলে দিলে অন্যদের জন্য কি আর তা নিরুদ্ধ রাখা যাবে?

ম্লান দীপালোকে রাজ-সারথি অধিরথ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পুত্রের মুখের দিকে। ক্ষোভে-দুঃখে-হতাশায় সে মুখের রেখাগুলি ভারাক্রান্ত। এই ক্ষীণ আলোকেও তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

কৈশোরের প্রান্ত অতিক্রম করেছে, এখন রীতিমতো যুবক— সূত-প্রধানের এই জ্যেষ্ঠ সন্তান, বসুষেণ। মাতা রাধার নামানুসারে তাকে সকলে রাধেয় বলেও ডাকে। ওষ্ঠের উপর রোমরেখার উদ্গম হয়েছে অনেক কাল, এখন তা নাতিস্পষ্ট কজ্জলরেখাবৎ ফুটে উঠে তরুণ মুখমণ্ডলকে এক দৃপ্ত পৌরুষশোভা দিয়েছে। ঈষৎ কুঞ্চিত ঘন কেশকলাপ। গাত্রবর্ণ অতি উজ্জ্বল সুগৌর, কর্ণবিলম্বিত সুবর্ণকুণ্ডলের সঙ্গে যেন ত্বক অভিন্ন ঠেকে! আয়ত চক্ষু, উন্নত নাসা, রক্তাভ সূক্ষ্ম ওষ্ঠাধর। দীর্ঘকায়, মহাবাহু, কৃশকটি, বৃষস্কন্ধ— এক নবীন শালতরু যেন! এক বার দৃষ্টি পড়লে কিছুতেই তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না— এমন সম্মোহক রূপ এই যুবার। নিজের চোখের সামনেই চন্দ্রকলার মতো বেড়ে উঠতে দেখেছেন সূত অধিরথ, তবু চোখের তৃষ্ণা যেন মেটে না! নবজাত শিশুর অসামান্য জ্যোতির্ময় রূপ দেখে তার নাম রাখা হয়েছিল ‘বসুষেণ’, বসু অর্থে জ্যোতি বা সম্পদ উভয়ই বোঝায়— উভয়ার্থেই সার্থক সে নাম!

কিন্তু আজ পুত্রের সেই বিভাময় আনন এত বিমর্ষ, মলিন, বিক্ষুব্ধ! আজ বার বার দৃষ্টি নমিত হয়ে আসতে চাইছে পিতার।

অধিরথ ধৃতরাষ্ট্রের অন্যতম প্রিয় সারথি, দীর্ঘ দিন অন্ধ রাজাকে সুচারু যত্নের সঙ্গে তিনি রথে বহন করছেন। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের আট সারথির মধ্যে সূত সঞ্জয় ও সূত অধিরথই রাজার সর্বাধিক আস্থাভাজন— এ জন্য অধিরথ গর্বিতও যথেষ্ট। বহু প্রযত্নে, রাজপুরীতে অর্জিত দীর্ঘ দিনের প্রভাব প্রয়োগ করে, স্বয়ং মহারাজকে অনুনয়ে দ্রব করে ও তাঁর আজ্ঞাপত্র হাতে নিয়ে— তিনি দ্রোণের আশ্রমে গিয়েছিলেন। তিনি জানেন, তাঁর তরুণ পুত্রটি প্রতিভাবান ধানুকী। স্থানীয় শিক্ষকদের কাছে সে ধনুর্বিদ্যার প্রাথমিক সব পাঠ আয়ত্ত করেছে, একান্তে নিয়মিত চর্চা করে অভ্রান্ত করেছে লক্ষ্য, তার কলাকৌশল দেখে সূতপল্লির লোকে ধন্য ধন্য করে। উন্নততর বিদ্যার জন্য সে ব্যাকুল ছিলই। তাই, যখন রাজপুরীর নিজস্ব উদ্যোগে অস্ত্র-শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হল— বসুষেণের আগ্রহাতিশয্যে অধিরথ স্বয়ং তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সেখানে।

সূত জাতিকে শিক্ষা দেন না দ্রোণ— এমন একটা বর্ণগত প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে জেনেই, সরাসরি রাজ-আজ্ঞা সংগ্রহ করা ছিল পূর্বাহ্ণে। সম্মতিপত্র সংগ্রহে সাহায্য করেছিলেন রাজার ঘনিষ্ঠ সহচর সূত সঞ্জয়ও।

কুরুভৃত্য দ্রোণ রাজার আজ্ঞা পালনে বাধ্য। তিনি বসুষেণকে শিষ্যমণ্ডলীভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শরীরী-ভাষায় একটা অনিচ্ছা ও অসন্তোষ কিঞ্চিৎ প্রকট হয়েছিল, রাজসারথির অভিজ্ঞ প্রৌঢ় চোখে তা ধরা না পড়ে যায়নি।

তবু, ব্রাহ্মণের মহত্ত্ব ও গুরুর সততার উপর আস্থা রেখেছিলেন অধিরথ। এক বার শিষ্য হয়ে গেলে আচার্য অবশ্যই সমদৃষ্টিতে দেখবেন, অপক্ষপাতই শিক্ষকের ধর্ম।

কিন্তু, আজ বসুষেণ যা বলছে...

ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন অধিরথ, “পুত্র, তুমি যা বলছ সে বিষয়ে কি তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত? কোনও সংশয় নেই তো?”

“সংশয়! না, একেবারেই না,” চাপা কিন্তু উত্তেজিত গলায় বলে বসুষেণ, “আমি বেশ কয়েক দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। এমনকি, আমার সন্দেহ সত্য না মিথ্যা তা পরীক্ষা করার জন্য সামান্য ছলের আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছি। অতঃপর নিশ্চিত হয়েছি। গুরু দ্রোণ শুধু পক্ষপাতীই নন, কপট!”

চিন্তিত দেখায় অধিরথকে। “তবু... আমার একেবারে নিরঙ্কুশ প্রত্যয় জাগছে না বৎস! এত খ্যাতনামা শিক্ষক, দেশ-দেশান্তর থেকে রাজপুত্রেরা আসছে... সকলকেই কি এই ভাবে প্রতারিতকরা সম্ভব?”

“প্রতারিত করা হচ্ছে, পিতা! বাস্তবিক! অতি সূক্ষ্ম কৌশল, তাই কেউ ধরতে পারছে না।... সত্য বলতে কী, আমি দেখলাম এই রাজার দুলালরা অধিকাংশতই বিলাসী, আরামপ্রিয় ও আমোদ-সন্ধানী— এদের বেশির ভাগেরই বুদ্ধি সুতীক্ষ্ণ বা আগ্রহ ক্ষুরধার নয়। কঠোর শিক্ষাপদ্ধতি বা জটিল তত্ত্ব অধিগত করার জন্য যে শারীরিক কষ্ট ও মানসিক শ্রম স্বীকার করার প্রয়োজন, তা নেই বহু শিক্ষার্থীর। তাই, বহু ক্ষণ ধরে শ্রমসাধ্য কলাকৌশলগুলি শেখানোর পর যখন আচার্য সকলকে উদ্যানে স্বেচ্ছামতো ক্রীড়াকৌতুকে মত্ত হওয়ার অনুমতি দিয়ে দেন, তখন সেই আদেশকে সানন্দে শিরোধার্য করে প্রায় সমস্ত ছাত্রই উল্লাসে-বিনোদনে মেতে ওঠে। আচার্য তখন সন্তর্পণে গিয়ে ওঠেন উদ্যান-প্রান্তের ধাতুশালা-গৃহে। শুধু দু’জন শিক্ষার্থী— মাত্র দু’জন— অন্যদের সঙ্গে আমোদে না মেতে, নিঃশব্দে গুরুকে অনুসরণ করে। কেউ সেটা লক্ষ করে না। দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।”

“কামারশালায়? সেখানে অস্ত্র নির্মাণ বা ভগ্ন অস্ত্রের পরিচর্যা হবে, আচার্য তার তত্ত্বাবধান করেন। স্বাভাবিক বিষয়। সেখানে এত সন্তর্পণ, এত গোপনীয়তার কী থাকতে পারে?”

বসুষেণকে ঈষৎ অন্যমনস্ক দেখায়। দশনে অধর দংশন করে সে, তার ললাট ভ্রুকুটিকুটিল। তরুণ গুম্ফে আঙুল বোলাতে বোলাতে সে বলে, “পারে। আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল— আচার্য দ্রোণ ওখানে তাঁর অর্জিত গূঢ়-বিদ্যার শিক্ষা দেন— মাত্র দু’জন বিদ্যার্থীকে। সারা দিন তিনি অন্য সকলের মধ্যে যে বিদ্যা বিতরণ করেন, তাও খুবই উচ্চাঙ্গের, সন্দেহ নেই। সমস্ত বালকেরা সন্তুষ্ট হয় বেশ। কিন্তু আমি এও নিশ্চিত, সাধারণের মধ্যে সেই প্রকাশ্য প্রশিক্ষণে তাঁর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানটি তিনি কদাপি উন্মুক্ত করেন না। সেটির জন্য তিনি নির্বাচন করেছেন মাত্র দু’জনকে। নিজপুত্র অশ্বত্থামা, আর...”

“আর?”

“অর্জুন!” বসুষেণ যেন নামটি উচ্চারণের সময় একটু শ্বাস চাপল, মনে হল অধিরথের। মৃদু দীপালোকেও তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না— যেন একটু বেশিই কঠিন হল পুত্রের চোয়ালের পেশি, যখন সে পুনরাবৃত্ত করল নামটি, “অর্জুন! তৃতীয় পাণ্ডব!”

অধিরথ বিলক্ষণ জানেন মৃত রাজা পাণ্ডুর তৃতীয় পুত্রটিকে। বনবাস থেকে যখন বিগতভর্তা রানি কুন্তী হস্তিনায় ফিরেছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচটি বালক পুত্র। ঋষিরা ঘোষণা করেছিলেন, তাদের সকলেরই জন্ম নাকি দেব-অংশে। তৃতীয় কৌন্তেয়, অর্জুন নামের বালকটি, কৃষ্ণবর্ণ। পৌরজনেরা তার আর্য-শোণিত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল কেউ কেউ। কিন্তু ব্রাহ্মণ-তপস্বী-ঋষি-মুনিদের বাক্যের প্রকাশ্য বিরোধ অসম্ভব। তাঁদের বিধান ছিল, এই বালক স্বয়ং দেবরাজ স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রের সন্তান। নাগরিকরা তা মেনে নিয়েছিল।

বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে বালক। অধিরথ রাজপুরীতে শুধু নয়, জনসাধারণের মধ্যেও তার সুখ্যাতি শুনেছেন। গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ হলেও তার অন্তর শুভ্র, তাই তার অর্জুন নাম সার্থক। সদাচারী, বিনয়ী, ধীমান— কিন্তু অতি সম্ভাবনাময় যোদ্ধা, ধনুর্বিদ্যায় এরই মধ্যে তার অদ্ভুত পারঙ্গমতার কথা মুখে মুখে ফেরে। কুরুপিতামহ ভীষ্মও তার প্রতি অপার স্নেহশীল, মন্ত্রী বিদুরও। আচার্য দ্রোণেরও প্রিয়পাত্র হবে সে অচিরেই, এতে অস্বাভাবিকত্ব নেই।

“পিতা, সম্প্রতি এই পক্ষপাত আরও একমুখী হয়েছে। এখন, অধিকাংশ দিনই, পুত্র অশ্বত্থামাকেও আর অস্ত্রকক্ষে সঙ্গে নেন না আচার্য। অর্জুন একাকীই সেই অধিকার ভোগ করে।”

“কিন্তু, পুত্র রাধেয়— শ্রেষ্ঠ জ্ঞানটির জন্য শিক্ষার্থীকে কামারশালায় নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন? ধাতুশালায় কারিগরি-বিদ্যা শেখানো সম্ভব, অস্ত্রপ্রয়োগ বা শস্ত্রসঞ্চালন তো উন্মুক্তভূমি ব্যতীত হতেই পারে না! তবে কি সত্যই কোনও মন্ত্র, জাদু, কোনও তন্ত্রসিদ্ধি-গূঢ়াচারের আয়োজন হয় রুদ্ধকক্ষে?”

বসুষেণ উঠে দাঁড়ায়। দেওয়ালে হেলান দিয়ে-রাখা ধনু ও শরপূর্ণ তূণীর তুলে নেয় কাঁধে। তার পর বলে, “আসুন, পিতা, এক বার গৃহ-পশ্চাতের উদ্যানে আসুন!”

উল্কাদণ্ডের আলোয় সমগ্র উদ্যান আলোকিত। বসুষেণ এখানে নিশাকালে শরসন্ধান-অনুশীলন করে। সে বলে, রাত্রিতে স্বল্পালোকে যে-যোদ্ধা লক্ষ স্থির রাখা অভ্যাস করে, দিবাযুদ্ধে তার একটি শরও ভ্রষ্ট হয় না।

ক্রমশ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Bengali Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy