ছবি: পিয়ালী বালা।
ঠিক ধরেছে কস্তুরী। নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে তো কাঠি করার লোকের অভাব নেই। হয়তো প্রোগ্রামারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি। আগে হলে বুঝত সব্যর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে। আচ্ছা, তিতি কি এখনও ট্রমা ছেড়ে বেরোতে পারেনি? হয়তো পারেনি। সবে তো হপ্তাদুয়েক হল। মেয়েটা বড্ড চাপা।
কস্তুরী বুঝতে পারে ওর বুকের ভিতরের বেশ খানিকটা জুড়ে ধস নেমেছে, অথচ বাইরে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। ও হাতব্যাগে যে সব্যর সব আংটি, বালা, মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কেউ জানে? কস্তুরীর খুব ইচ্ছে করছে মিহিরাকে বলে, দিদি টয়লেট থেকে বেরোলে কথা বলাতে। কিন্তু নিজেকে নিজে সামলাল। আগে তিতিকেই ফোন করতে হবে তাকে।
একটা ব্যাপার কিছুতেই কস্তুরী মেলাতে পারে না। মিশুক তার সব দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ তার বিবির সঙ্গে ভাগ করে নিতেই বেশি পছন্দ করে। প্রচণ্ড রাগ হলে, তাও। তা হলে?
কস্তুরী ঠিক করল, আজ দুপুর অবধি কোনও সাড়াশব্দ না পেলে সে নিজেই ফোন করবে। না ধরলে ফোন করেই যাবে। তার জন্য পরে মিশুক মুখ করলেও সহ্য করবে। ফোন না ধরলে সে সোজা চলে যাবে স্টুডিয়োতে। দেখবে মেয়েটার হলটা কী।
ড্রেস চেঞ্জ করে ঘরের বাইরে আসতেই মারাত্মক চমক। সেই মুহূর্তে কড়াক্কড় করে কান ফাটিয়ে একটা বাজ পড়ার শব্দ পেল সে। এক সেকেন্ড পরে আর একটা। আলোর ঝলকানিতে ঘর ভরে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই আর একটা। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে গেল কস্তুরী। এমন সময় এক তলায় কাচের বাসনের খানখান হওয়ার আওয়াজ পেয়ে এক দৌড়ে নীচে নেমে গেল সে।
কেতকীবালা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ চন্দন আসেনি। তাই কেতকীবালাই রান্নার আয়োজন করছিলেন। আচমকা বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে হাত থেকে কাচের প্লেট পড়ে খানখান। হয়তো শ্যামলেন্দুর জন্য প্রাতরাশ করে আনছিলেন। চার দিকে রুটি আর আলু-ছোলার তরকারি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার! কেতকীবালা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
কস্তুরী বলল, “পড়ে গেল কী করে?”
“আর বোলো না। এমনিতে শীতটা এ বারে এত বেশি পড়েছে... চাদর সামলাতে গিয়ে হাত ফস্কে গেল। তুমি কিন্তু এসো না এ দিকে।
কাচ-ফাচ ফুটে...”
“আপনিই সরে আসুন দেখি। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
কেতকীবালাকে জোর করে হাত ধরে সরিয়ে এনে কাচের টুকরোগুলো আর রুটি-তরকারি সব সাফ করে ডাস্টবিনে ফেলে দিল কস্তুরী। সত্যি, কাল থেকেই শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। মনে হয়, চলে যাওয়ার আগে শেষ কামড়! শ্যামলেন্দুও উঠে এসেছিলেন হাতড়ে হাতড়ে। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুই আজ বেরোতে পারবি, মা? যা বাজ পড়ছে।”
তা অবশ্য ঠিক। সব সেরে হাত ধুয়ে ক্যাসারোল থেকে দুটো ডিশে দুটো করে রুটি আর তরকারি সাজিয়ে ঘরে এসে দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল বাইরে। মরেছে! একে এই শীত! তার উপরে বৃষ্টি নামার আর দিন পেল না। অন্য দিন হলে হয়তো না গেলেও চলত। কিন্তু আজ ন’তারিখ, কাল রবিবার। অফিস যে না গেলেই নয়, অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্য হলেও যেতে হবে।
বৃষ্টির প্রথম দাপটটা না কমলে বেরোনোর উপায় নেই। এ দিকে বাজ পড়ারও কমতি নেই। কস্তুরী দু’কাপ চা বানিয়ে দু’জনের সামনে রেখে দিয়ে ফের দোতলায় উঠে এল। আচ্ছা গেরো তো! আগে থেকে আভাস পেলে সেন্টারে ফোন করে ড্রাইভার আনিয়ে রাখতে পারত। তবু সে ফোন করল এক বার। দু’বার রিং হয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় বারে ফোন ধরে সেন্টারের মালিক জানাল, আজ কোনও ড্রাইভার নেই। কাল নাকি কাগজে খবর বেরিয়েছিল আজ তুফান আসতে পারে। আজ সকাল থেকে অনেক ট্রেন ক্যানসেল হয়েছে। তাই বেশ কিছু ড্রাইভার আসতে পারেনি। বাকিরা অলরেডি বুকড। তবে যদি কেউ এর মধ্যে ফ্রি হয়ে যায়, অবশ্যই জানাবে। আশ্বাস পেলেও কস্তুরী বুঝল এটা কথার কথা মাত্র।
কস্তুরী বন্ধ কাঁচের শার্সির এ পারে দাঁড়িয়ে একমনে বাইরেটা দেখতে লাগল। আকাশকে আর আকাশ বলে চেনা যাচ্ছে না। চার দিকে ধোঁয়ার মতো একটা আস্তরণ সৃষ্টি হয়েছে। মুহুর্মুহু জলের ঝাপটা আছড়ে পড়ছে জানলার শার্সির ওপর। খুব ইচ্ছে করছে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়। কিন্তু মাঝে মাঝেই যে ভাবে অন্ধকার আকাশ ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে আলোর ঝলকানিতে, বেশ ভয়ও করছে। একেই বোধহয় বলে দুর্যোগ।
কস্তুরী মেহুলির ঘরে ঢুকল। মনটা হু-হু করে উঠল। চার দিকে মেয়েটার ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র। মেহুলি চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম ওর ঘরে ঢুকল। বিছানার উপরে জামাকাপড়গুলো ডাঁই করে রাখা। হয়তো কোনটা নেবে, কোনটা নেবে না, ভাবতে ভাবতেই এই হাল করে ফেলেছে। কস্তুরী ঠিক করল, কাল এক বার ঘরটাকে সুস্থ করে তুলবে।
মেহুলি বলেছিল, আর মাত্র ক’টা দিন। কত দিন? আর কত দিন? এই বৃষ্টিভেজা সকালে পুরো দোতলাটায় একা কস্তুরী। এই রকম আবহাওয়া ভারী মন খারাপ করে দেয়। কস্তুরী বারান্দার দিকের দরজা খুলেই পিছিয়ে এল। বাপ রে! বৃষ্টির কী ছাঁট! যথেষ্ট চওড়া রেন-শেড লাগিয়েছিল আকিঞ্চন। সব জানলা-দরজার উপরেই। তবুও দরজা খুলতেই হাঁটু অবধি ভিজে গেল কস্তুরীর। অন্য দিন হলে
পিছিয়ে আসত, আজ ইচ্ছে করল না। সে রেলিংয়ের পাশে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোমর অবধি ভিজে উঠল। উঠুক।
মনে পড়ল আচমকাই। বিয়ের পরে গ্যাংটক থেকে সদ্য মধুচন্দ্রিমা সেরে ফিরেছে দু’জনে। তার পর এক সপ্তাহও কাটেনি। ফের আকিঞ্চন দুটো এসি চেয়ারকারের টিকিট কেটে এনে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল কস্তুরীর। শান্তিনিকেতন। শুক্রবার গিয়ে রবিবার ফেরা। মনে আছে শনিবার সন্ধে নাগাদ হাট থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে কাকস্নান হয়ে গিয়েছিল দু’জনে। হবে না-ই বা কেন! ভরা বর্ষা মাথায় নিয়ে কেউ রাস্তায় বেরোয়? আকিঞ্চন কিছু মানেনি। ভুবনডাঙার মাঠ অবধি এসে কাকভেজা রিকশাওয়ালা আর যেতে রাজি হয়নি। তার পর ওই ভিজে ভিজেই ওরা সে দিন হেঁটেছিল ভুবনডাঙার মাঠ থেকে পোস্টাপিসের মোড় হয়ে কালোর চায়ের দোকান অবধি।
রাত আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরে জামাকাপড় বদলে ডিনার সেরে দু’জনে দু’কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। বৃষ্টি তখনও চলছিল অঝোরে। বৃষ্টির ছাঁটে ওরা ভিজে যাচ্ছিল, কফির কাপে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল মিশে পরিমাণ বাড়াচ্ছিল। সে দিকে কারও নজর ছিল না। শুধু দু’জনে দু’জনকে দেখে যাচ্ছিল। আজও মনে আছে, সেই রাতে রুমে ঢুকে গিয়ে কাপড় ছেড়ে আর অন্য জামাকাপড় পরার ফুরসত হয়নি কস্তুরীর। তার আগেই চটজলদি দরজার ছিটকিনি তুলে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিল আকিঞ্চন।
নাঃ। এই সব স্মৃতি যত না আনন্দ দেয়, কষ্ট বয়ে আনে তার ঢের বেশি। এক বার বাইরের দিকে তাকিয়ে কস্তুরী ঘরে ফিরে এল। কাপড় ছেড়ে একটা ম্যাক্সির উপরে উলের একটা হাউসকোট পরে ভাবল, একটু দাপট কমুক, তার পর আর এক বার ট্রাই নেওয়া যাবে। সে মোবাইলে ধরল রাজেশকে। রাজেশ জৈন তার জুনিয়র। জিজ্ঞাসা করল, “অফিসে গিয়েছ?”
রাজেশ ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতে পারে। সেটুকু সম্বল করে সে জানাল, অফিসে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। রাজেশের বাড়ির সামনে এক হাঁটু জল। অফিসে এক জন মাত্র এসেছে। ভার্গব। তাকে ফোন করে সে জেনে নিয়েছে কিড স্ট্রিটের অবস্থা তথৈবচ। নেহাত কস্তুরীদের অফিসটা তিন তলায়, তাই ভার্গব চুপচাপ বসে আছে। এক তলার দোকানগুলোয় জল ঢুকতে শুরু করেছে। ভার্গব নাকি এক বার দেখে এসেছে সিঁড়ির কাছাকাছি জল চলে এসেছে। জল নেমে গেলে সেও পালাবে।
কস্তুরী হাল ছাড়বে না। আজ না গেলেই নয়। বৃষ্টিটা ধরে এলে একটা ক্যাব নিয়ে নেবে। অফিসে গিয়ে জিএসটিআর-ওয়ান আর টিডিএসটা সাবমিট করে দিয়েই পালিয়ে আসবে। ফের চিন্তা হল, নেট কাজ করবে তো আজ? দুত্তেরি! মোবাইলটা রেখে সে ফের নিজের ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নাঃ, দুর্যোগ কমার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। আকিঞ্চন চলে যাওয়ার পরে সে খবরের কাগজওয়ালাকে বারণ করে দিয়েছিল কাগজ দিতে। আজ আক্ষেপ হচ্ছে। ফোরকাস্টটা জানতে পারলে আজ সক্কাল-সক্কাল অফিস পৌঁছে ভার্গবের জন্য অপেক্ষা করত তাও ভাল ছিল। ইসস!
‘চুয়া-নন্দিনী’র দুটো এপিসোড পর পর মিস হয়েছে। যত ক্ষণ না বৃষ্টি থামে, যতটুকু দেখে নেওয়া যেতে পারে। তেমন বুঝলে সেকেন্ড হাফে এক বার অফিসে ঢুঁ মারা যাবে। আচমকা মনে পড়ল, এই সেরেছে! অফিসের চাবি তো ভার্গবের কাছে! যদি বৃষ্টি থামলেই সে পালায়! ভার্গবের নাম্বারটা নেব-নেব করেও নেওয়া হয়নি। সে তড়িঘড়ি রাজেশকে ফোন করে বলে দিল যেন মিনিমাম তিনটে অবধি ভার্গব অফিসে থাকে।
সিরিয়াল খুলে বসতেই চোখ গেল সেন্টার টেবিলের নীচের তাকে। স্বর্ণেন্দু তাকে যে উপন্যাসটা দিয়ে গিয়েছিল, সেটা ওখানেই রয়েছে। গল্প-উপন্যাসের ভক্ত কস্তুরী কোনও দিনই নয়। একেবারে ছোটখাটো আকারের গল্প হলে তবু ঠিক আছে, কিন্তু একটা ঢাউস সাইজ়ের বই মুখে নিয়ে সময় কাটাতে পারবে না। কিন্তু ভদ্রলোকের শেষ কথাগুলো মনে আসছে। কী আছে এই বইটায় যার জন্য পকেটে করে নিয়ে চলে এসেছিলেন সে দিন?
কস্তুরী বইটি হাতে তুলে নিয়েছে, এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠেছে। স্ক্রিনের উপরে ‘তিতি’। পলকে রিসিভ করতেই প্রবল বৃষ্টির ধারাপাতের শব্দের সঙ্গে মিশুকের গলা ভেসে এল, “দরজা খোলো।”
“মানে!”
“আমি তোমাদের দরজার বাইরে। খোলো।”
বলে কী! এই ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে! কস্তুরী এক লাফে বারান্দায় চলে এল। সত্যি! মিশুক নীচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথায় ছাতা নেই। কী পাগল মেয়ে! পড়ি-কি-মরি করে এক তলায় এসে কেতকীবালাকে ডজ করে সদর দরজা খুলতেই বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে মিশুক হনহন করে ভিতরে এসে সোজা উপরে চলে গেল। হতভম্ব কেতকীবালা! কিন্তু ওঁকে বোঝাতে গেলে এখন সময় নষ্ট। কস্তুরীও দৌড়ে এল মিশুকের পিছন-পিছন।
মিশুক এখন ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্যত কাঁপছে। কাঁধে একটা সাইডব্যাগ। প্রচুর প্রশ্ন জমে উঠছে কস্তুরীর মনে। কিন্তু এখন সে সব জানার সময় নয়। সে এক দৌড়ে মেহুলির ঘরে ঢুকে ওর জামাকাপড়ের মধ্যে থেকে একটা টি-শার্ট আর একটা কেপরি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বলল, “শিগগিরি টয়লেটে যা।”
মিশুক কিছু বলতে যাচ্ছিল। কস্তুরী ধমকে উঠল, “আগে টয়লেট। একদম স্নান করে এগুলো পরে বাইরে আসবি। আমি গিজ়ার অন করে দিচ্ছি।”
কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বাধ্য মেয়ের মতো মিশুক টয়লেটে ঢুকে গেল। কস্তুরী দেখল মিশুক কাঁপছে! আহা রে! কত ক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে! আর যা পর পর বাজ পড়ছে। এই শীতকালের দুর্যোগে বাড়ির কুকুর-বেড়াল যেখানে বেরোয় না, সেখানে....। কিন্তু যদি অ্যাপ-ক্যাব নিয়েই আসে, এমন কাক-স্নান হল কী করে? গেট থেকে দরজা অবধি দৌড়ে এলে তো এতটা
ভেজার কথা নয়। কিন্তু এ সব জানা যাবে মিশুক বাইরে বেরোলে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy