ছবি: পিয়ালী বালা।
কস্তুরী মিহিরাকে জিজ্ঞেস করে, “কেন? ছাদে কী সমস্যা?”
“আরে চার পাশেই তো ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা বাড়ি, খালি ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট। পাটুলিতে চলে এসে বাঁচলাম। এখানে অনেকটা সবুজ। তবে কত দিন থাকবে কে জানে? আমাদের বাড়িতে ঢুকতে সামনের বিশাল জমিটা দেখলে?”
“হুঁ। ভাঙাভাঙি হচ্ছে দেখলাম।”
“সেটাই তো গো! কী সুন্দর একটা মাঠ ছিল। মার্চের বিকেলে বসলেও শরীর জুড়িয়ে যেত। সহ্য হল না। ওখানে এখন নাকি হাইরাইজ় হবে! দুত্তোর!”
“তুমি বেশ কথা বলো। এই বইটা তোমার?”
মাথা ঝুঁকিয়ে নিল মিহিরা, “হ্যাঁ। উনি আমার কবিতার দেবতা।”
কস্তুরী বিস্মিত হল, “তুমি কবিতা পড়ো! লেখোও নাকি!”
মিহিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে ধমকের সুরে আরতি দেবী বললেন, “এখনও বসে আছিস? যা, মুখ ধুয়ে আয়।”
ধমক খেয়ে ছুট্টে পালিয়ে গেল মিহিরা। দু’কাপ চা নামিয়ে আরতি দেবী বললেন, “দুটো মেয়ে দু’রকমের। একটা গোছানো, আর একটা অগোছালো। এই জন্য আমার কাছে যে কত বকুনি খায়। এই ছোটটিকে দেখছেন, পড়াশোনায় এক ফোঁটা মন নেই, মেয়েকে গপ্পো করতে দিন, ব্যস ঘণ্টার পরে ঘণ্টা কাবার।”
“সবাই কি আর এক রকম হয় ভাই?”
“তা ঠিক। মিহি কী রকম জানেন? এই হয়তো পড়তে বসেছে। বাইরে বৃষ্টি নামল, অমনি দৌড়ে বাইরে গিয়ে বেশ খানিক ভিজে নিল। তার পরেই ফ্যাঁচফোঁচ। দু’দিন শুয়ে রইল বিছানায়। বড়টা কিন্তু খুব ম্যাচিয়োর। এটা যে কবে দাঁড়াতে শিখবে,
কে জানে।”
মনটা থেকে থেকেই উসখুস করে উঠছে কস্তুরীর। যার সঙ্গে দেখা করতে আসা, সে কোথায়? কস্তুরীর মুখটা বোধহয় পড়তে পারলেন আরতি দেবী। নিজের চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বললেন, “আর বলবেন না দিদি। এত দিন জানতাম ছোটটিরই মাথা খারাপ। বড়টারও যে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে, কে জানত?”
“কী হয়েছে?”
“শুনবেন? পরশু ট্রাম ডিপো থেকে ভিজতে ভিজতে এসেছে পাটুলি। তাও সারা রাস্তা হেঁটে। ভাবতে পারছেন, সেই ট্রাম ডিপো থেকে পাটুলি! কম রাস্তা!”
“সে কী! কেন?”
“কী হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল না। অবশ্য বলার মতো অবস্থাও ছিল না। কপালে হাত দিয়ে দেখি ধুম জ্বর।”
“ও মা! তার পর?”
“তার পরে বিছানায়, আর কী? কাল রাত অবধি ভুগল। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিল এমন অবস্থা। ডাক্তার পাশেই থাকেন এই যা রক্ষে। আজ সকালে দেখলাম জ্বরটা আর নেই।”
“আমাকে জানাতে পারতেন।”
“এটা অবশ্য ভুল হয়েছে। আসলে হয়েছে কী, আপনার নম্বরটা তো আমার কাছে নেই। মিহিরাকে বললাম, দিদির ফোনে নাম্বার আছে, একটা খবর তো দে ওঁকে। কিম্তু মুশকিল হল, ফোন ছিল ব্যাগে আর ব্যাগটা না কি অন্য কাউকে ধরতে দিয়েছিল, আনতে ভুলে গেছে। কাকে দিয়েছে যে জিজ্ঞেস করব, দেখি মেয়ে জ্বরে বেহুঁশ। সেই ব্যাগ কে এক জন এসে আজ সকালে দিয়ে গেল। সেই ফোন থেকে আপনার নম্বর নিয়ে জাস্ট ভাবছিলাম মিহিকে বলব আপনাকে একটা ফোন করতে, আপনি চলে এলেন। কিছু মনে করবেন না দিদি। তার পরে আজ সকাল থেকে তো আর এক কাণ্ড...”
কস্তুরী আর থাকতে পারল না, “মিশুক কি এখনও ঘুমোচ্ছে? একটু দেখা করতাম, কেমন আছে মেয়েটা। পরশু রাত থেকে কোনও খবর নেই, আমি চিন্তায় চিন্তায়...”
“সে কথাই তো বলছি। সবে মেয়েটা আজ সকালে উঠে চায়ে মুখ দিয়েছে কি দেয়নি, একটা ফোন এল আর অমনি সে বেরিয়ে গেল। কত বললাম, যাচ্ছিস যখন, কিছু খেয়ে যা।”
“বেরিয়ে গেছে! কোথায়?”
“কী জানি ভাই! আজকালকার মেয়ে। সব কথা কি মা-বাবাকে বলে? আমাদের যুগে...”
আরতি দেবীকে থামিয়ে দিয়ে কস্তুরী বলল, “ও মা! তাই না কি? মিশুক বাড়িতে নেই? কী আশ্চর্য! আজ সকালেও গুড মর্নিং জানালাম, তারও কোনও রিপ্লাই নেই।”
উত্তরে আরতি দেবী কী সব বকবক করতে লাগলেন, কস্তুরীর কানে কিছু ঢুকছিল না। একটা ব্যাপার সে জানে যে, শুট নয়। শুট থাকলে তাকে নিশ্চয়ই জানাত, অথবা ফোন করত। কী এমন হল যে হুট করে বেরিয়ে যেতে হল? কারও কোন বিপদ? সে ফোনটা হাতে তুলে নিল। এমন সময় ঘরে ফের মিহিরা। সে একটা ছোট্ট হাই তুলে বলল, “দিদির পরিচিত কে এক জন হসপিটালাইজ়ড হয়েছে, কে জানি না, যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে ফিরতে লেট হবে।”
আরতি দেবী চোখ কপালে তুললেন, “দেখো কাণ্ড! তবে কি মেজদা...”
কস্তুরী ফোন কানে দিয়ে শুনছিল, তিতির ফোনে রিং হয়ে যাচ্ছে। এক বার, দু’ বার, তিন বার... কোনও রিপ্লাই নেই। এ বার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। এমন কাণ্ড তো কোনও দিন করে না তিতি! সে যথেষ্ট রেস্পনসিবল মেয়ে। কোথাও গেলে তার বিবিকে একটা মেসেজ করবেই। আচমকা মাথায় এল, আচ্ছা, কোনও মুভির জন্য ডাক পায়নি তো? হয়তো খুব বড় কোনও পরিচালক। যেমন শুনে এসেছে সে তিতির কাছে! এদের হাতে সময় খুব কম থাকে, যখন ডাকে তখনই ছুটে যেতে হয়। কিন্তু নিজেই নিজের যুক্তি ভেঙে দিল কস্তুরী। নাঃ। তা হলে অ্যাপ-ক্যাবে যেতে যেতে একটা ফোন বা মেসেজ তো করতেই পারত।
তিতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল কস্তুরী। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কোথায় খুঁজবে এখন মেয়েটাকে? ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই ফোনটা এল। তিতি!
মুহূর্তে রিসিভ করতেই তিতির গলা কানে এল, “তুমি কোথায় বিবি?”
“আমি তোদের বাড়ি এসেছিলাম রে।”
“কাঁটাপুকুর চেনো?”
“কাঁটাপুকুর! সেটা কোথায় রে? আর তুই কোথায়? আমি ভাবলাম...”
“একটা ক্যাব বুক করে চলে এসো। লোকেশনে লেখো কাঁটাপুকুর অথবা রিমাউন্ট রোড। মোমিনপুরের পরের স্টপেজ। এখানে পৌঁছে আমাকে ফোন করো।”
উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কস্তুরী, ফোনটা কেটে গেল। মহা মুশকিল তো! সে প্রথমে গুগলে কাঁটাপুকুর লিখে সার্চ দিতেই যে লিঙ্কটা এল, হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে লাফিয়ে উঠে ফের নেমে এল। কাঁটাপুকুর মর্গ! হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আকিঞ্চনের মুখে শুনেছিল দু’-এক বার। নয়তো ঘোষালের মুখে। শুনেছিল ওখানে ডেডবডি কাঁটাছেড়া হয়। যাকে পোস্ট মর্টেম বলে। কার বডি! কে মারা গেল?
জলদি একটা অ্যাপ-ক্যাব বুক করে নিল সে। স্ক্রিনে দেখল, গাড়ি এখন হাইল্যান্ড পার্কের সামনে। তার মানে আসতে এখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। কী মনে করে একটা দোকান থেকে দু’ প্যাকেট বিস্কুট আর একটা জলের বোতল কিনে ব্যাগে ভরে নিল কস্তুরী। বিস্কুট এমনিতে খেতে চায় না তিতি, তবে এই ব্র্যান্ডটা দেখেছে পছন্দ করে। যদিও ওর খাওয়া মানে একটা, বড়জোর দেড়টা।
গাড়ি যখন থামল, কস্তুরী দেখল একটা লম্বাটে আদলের বাড়ির সামনে তার ক্যাব দাঁড়িয়েছে। সেই বাড়ির গায়ে ‘কাঁটাপুকুর পুলিশ মর্গ’ নামটা দেখে আর এক বার বুক কেঁপে উঠল। গাড়ি থেকে নেমে ফোন করতে যেতেই দেখল মিশুক বেরিয়ে আসছে। এ কী চেহারা হয়েছে মেয়ের! মাথার চুল উস্কোখুস্কো। যেন বিছানা ছেড়ে সোজা চলে এসেছে, মুখে জল-টল দেওয়ারও টাইম পায়নি। চোখ
প্রচণ্ড লাল।
মিশুক চোখ তুলে কস্তুরীকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। তার পর জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল কিছু ক্ষণ। কস্তুরী আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস বলল, “কার কী হয়েছে রে?”
বোধহয় এইটুকু জিজ্ঞেস করার অপেক্ষায় ছিল। হাউহাউ করে কেঁদে উঠল মিশুক। ওকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। কস্তুরীর বুকের ভিতরে মুখ গুঁজে কেঁপে কেঁপে উঠছিল মিশুক। ওকে জাপ্টে ধরে রাখতে রাখতে আপনা থেকেই নিজের চোখ দুটো জলে ভরে আসছিল। কিন্তু এখন নিজে ভেঙে পড়লে এই মেয়েকে সামলানো যাবে না। তাই কোনও মতে মিশুকের কানের কাছে মুখ এনে কস্তুরী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মা? কার কী হয়েছে আমায় এক বার বল।”
প্রায় মিনিট দুয়েক পরে কান্নার বেগ সামান্য কমলে জড়ানো গলায় মিশুক বলল, “বিবি, সব্য আর নেই।”
“মানে!” মুহূর্তে ফের হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল গলার কাছে। কী বলছে মেয়েটা!
কস্তুরী এ বার মর্গ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল হিয়ান্তিকা আর তার সঙ্গে তিন জন ছেলেকে। হিয়ান্তিকারও চোখ লাল। সে কস্তুরীর সামনে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “ম্যাসিভ কার অ্যাকসিডেন্ট। স্পট ডেড।”
“কখন! কী করে হল এ রকম?” গলা প্রায় বুজে আসছিল কস্তুরীর।
হিয়ান্তিকা বলল, “কাল রাতে। চায়না টাউনের সামনে ঘটনাটা।”
“ওখানে কী করছিল ছেলেটা?”
“আমরা এর বেশি কেউ কিছু জানি না আন্টি। মিশু বলল, কাল রাতেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছে বারোটা নাগাদ। তখন বলেছিল যে ও ঘুমোতে যাচ্ছে। তার পর চায়না টাউন কখন পৌঁছল, কখনই বা ঘটনাটা ঘটল...। ভোর সাড়ে চারটার সময় আমরা জানতে পারি। পুলিশ ফোন করে খবরটা দিয়েছিল সব্যদার বাড়িতে। সব্যদার বাড়ি তো আমার বাড়ির একটা বাড়ি পরেই। ঘুমিয়ে ছিলাম। কান্নাকাটির আওয়াজ কানে আসতেই ঘুমটা ভেঙে যায়। গিয়ে শুনি এই কাণ্ড। আমি সঙ্গে সঙ্গে মিশুকে ফোন করি। মিহিরা ফোনটা ধরেছিল। মিশুর শরীর খারাপ শুনে আমি বলি, সকাল হলে ফোন করব। ব্যস এইটুকু।”
“সব্যর বাড়ির লোকজন কোথায়?”
“ভিতরে। পুলিশ এসেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলছে। ইস, প্রদ্যুতকাকুর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। একমাত্র ছেলে।”
কস্তুরীর বুকের কাছাকাছি ফের কাঁপুনি শুরু হল। মিশুককে একটা পক্ষিশাবকের মতো বুকের কাছে আগলে কাছাকাছি একটা গাছের গুঁড়ির নিচে বেদিতে বসিয়ে দিল কস্তুরী। তার পরে নিজেকে আর সামলাতে পারল না সে। মিশুককে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে উঠল কস্তুরী। বার বার সব্যর মুখটা মনে পড়তে লাগল। কী উচ্ছ্বল, প্রাণচঞ্চল ছিল ছেলেটা! দেখা হলেই ‘বিবি’ বলে সম্বোধন করত, আর তত বারই তিতির ধমক খেয়ে ফের ‘আন্টি’তে ফিরে আসত। আজকালকার ছেলেদের তেমন মনে লাগে না কস্তুরীর। সব কেমন উচ্ছৃঙ্খল টাইপের। খালি গুলতানি মারে আর বিড়ি ফোঁকে। সেই অনুপাতে সব্যসাচী বাগচীকে বেশ মনে ধরেছিল কস্তুরীর। তার উপরে সুদর্শন। একমাত্র ছেলে। নিজেদের বাড়ি। আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সব সময়ই বলত, “আরও, আরও অনেক উপরে উঠতে হবে আন্টি।”
সব্যকে দেখে অনেক বার কস্তুরীর মনে হয়েছে, হ্যাঁ, যদি মেহুলির জন্য পাত্র খুঁজতে হয়, ঠিক এই রকম। এর মধ্যে এক দিন ভাবছিল কস্তুরী, এক দিন দু’টিকে বাড়িতে এনে নিজে হাতে রেঁধে খাওয়ালে হয়। তিতিকে প্রস্তাবটা দিতেই বলেছিল, “তোমার বাড়ির সিচুয়েশনটা তো তুমি ভাল জানো বিবি। আমাদের কোনও ব্যাপার নয়। সব্যকে ডেকে নিয়ে তুমি একটা অকওয়ার্ড সিচুয়েশনে পড়ে যাবে কি না সেটা আগে ভেবে নাও। তার চেয়ে বরং এক দিন বাইরে খাওয়া-দাওয়া করি।”
কস্তুরী বলেছিল, “সে তো হতেই পারে, কিন্তু ছেলেটাকে, স্পেশালি তোকে তো কোনও দিন আমার হাতের রান্না খাওয়াতেই পারলাম না।”
সব শেষ। আজকাল এত অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে! লরিগুলো রাতে যে ভাবে চালায় সে আর বলার মতো নয়। কিন্তু হিয়ান্তিকাকে ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করে নিজেই চমকে গেল কস্তুরী। হিয়ান্তিকা বলল, “সব্যদাই রাস্তার ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে গাড়িসুদ্ধ উল্টে যায়। পুলিশ আন্দাজ করছে রেকলেস ড্রাইভিং। তবে...”
মিশুকের কান বাঁচিয়ে কস্তুরীর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে হিয়ান্তিকা বলল, “হি
ওয়াজ় ড্রাঙ্ক।”
কস্তুরী স্তম্ভিত। সে অনুভব করল মিশুক মুখ তুলেছে, “বিবি, তুমি এক বার দেখবে না সব্যকে?”
“কী দেখব আর? তা ছাড়া এখন বোধহয় পোস্টমর্টেম চলছে। তাই না?”
সঙ্গের ছেলেগুলোর এক জন বলল, “হ্যাঁ আন্টি। তবে অনেক ক্ষণ শুরু হয়েছে। শেষ হয়ে এল বলে। তার পরে বডি ছেড়ে দেবে।”
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো লাফিয়ে উঠল মিশুক, “শাট আ-আ-আপ!”
বুঝল কস্তুরী। এটা ঠিক। তার নিজের দাদু যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন কে যেন এই শব্দটা উচ্চারণ করায় খুব খারাপ লেগেছিল কস্তুরীর। একটা মানুষ, এত দিন ধরে কারও বাবা, কারও স্বামী, কারও দাদু, কারও বন্ধু— হৃদ্যন্ত্র থেমে যেতেই মুহূর্তে ‘বডি’? কী বিচ্ছিরি লাগে শুনতে।
কস্তুরী ফের মিশুককে বুকের কাছে টেনে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, “তোমরা ভিতরে যাও প্লিজ়। দেখো ওদের কাজ কত দূর।”
ছেলেগুলো চলে যেতেই ব্যাগ খুলল কস্তুরী, “দুটো বিস্কুট খেয়ে জল খা দেখি। মুখ তো আর মুখ নেই, আমসি হয়ে গেছে।”
কস্তুরী জানত মিশুক খেতে চাইবে না, তাই আজ ইচ্ছে না থাকলেও মৃদু ধমক দিতে হল। এ বার ওর বাড়িতে একটা ফোন করতে হবে। হয়তো বাবা-মা-বোন ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।
কাঁটাপুকুর থেকে সবচেয়ে কাছে চেতলায় কেওড়াতলা, তবু সব্যর বাড়ির লোক সব্যকে নিয়ে গেল নিমতলায়। পরে শুনেছিল ওখানেই নাকি সব্যদের পরিবারের সব লোকের দাহকাজ হয়। তাও আবার কাঠের চুল্লিতে। কাঠের চুল্লি জিনিসটাই অত্যন্ত খুব খারাপ লাগে কস্তুরীর। চোখের সামনে তিলতিল করে প্রিয় মানুষকে পুড়তে দেখার দৃশ্য যন্ত্রণা কমায় না, বাড়ায়।
কস্তুরী ঠিক করল সব্যর দেহটা একটু একটু করে পুড়বে, এটা দেখা তার পক্ষেও সম্ভব নয়, তিতিকেও দেখতে দেবে না। এক বার সে দেখল চিতায় শোয়ানো সব্যর চেহারাটা। সারা মুখটাতেই প্রায় ব্যান্ডেজ।
সে মিশুকের হাত ধরে টানল। এত ক্ষণ চিতাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল, হাতে টান পড়ায় অবোধ শিশুর মতো তাকাল মিশুক।
কস্তুরী বলল, “উঠে আয়।”
“কোথায়?”
“আমি বলছি তিতি, এটাই কি বড় কথা নয়?”
বাধ্য মেয়ের মতো উঠে এল মিশুক। কস্তুরী জিজ্ঞেস করল, “টয়লেট যাবি?”
মাথা উপর-নীচ করল মিশুক। কাছাকাছি একটা টয়লেট খুঁজে বের করে ঘুরিয়ে এনে গঙ্গার ধার ঘেঁষে বসল দু’জনে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy