Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩৩
Bengali Series

হাওয়ার আড়ালে

একটা মিসড কল। ইন্টারন্যাশনাল নম্বর। তবে কি মেহুলি? ইস! হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কাল রাতে ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছিল।

Woman.

ছবি: পিয়ালী বালা।

অজিতেশ নাগ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:১৮
Share: Save:

বাইরে এসে নিমেষে মনটা ধিক্কারে ভরে গেল কস্তুরীর। ছি ছি! এটা কী করল সে? এই কি তার এত দিনের জমিয়ে রাখা শিক্ষাদীক্ষার ফল? গুরুজনদের সঙ্গে এ রকম ব্যবহার কি তার বাবা-মা শিখিয়েছেন তাকে? বাবা শুনলে কী প্রচণ্ড বকাবকি করবে। সবচেয়ে বড় কথা, একই ঘটনা নিজের বাড়িতে ঘটলে কস্তুরী কি নিজের মাকেও একই ভাবে বলতে পারত? ছি ছি! বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে। সে এত জোরে চেঁচিয়েছে, নিশ্চয়ই বাথরুমে বসে শ্যামলেন্দু সবটা শুনতে পেয়েছেন। কী ভাবছেন এত ক্ষণে তাকে নিয়ে! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল কস্তুরীর। সে ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করেই চমকে উঠল।

একটা মিসড কল। ইন্টারন্যাশনাল নম্বর। তবে কি মেহুলি? ইস! হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কাল রাতে ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছিল। ভোরে উঠে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করেছে কিন্তু মোবাইলটাকে নর্মাল মোডে আনার কথা আর খেয়াল নেই।

ফোনটাকে ঠিক করে গেটের দিকে এগোতেই থামতে হল। একটা কালো রঙের বাইক এসে থেমেছে বাড়ির বাইরে। একটি ছেলে আর পিছনের সিটে একটি মেয়ে, দেখে মনে হয় বিবাহিত, নেমে দাঁড়াল। তার পর ছেলেটি হেলমেট খুলে সরাসরি কস্তুরীকে প্রশ্ন করল, “আন্টি, কেমন আছেন?”

এই সেরেছে! এরা কারা? ছেলেটি ভিতরে এসে হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করেই বলল, “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ময়ঙ্ক। ময়ঙ্ক মদনানি।”

ও হরি! সেই ছেলেটা। এক সময় মেহুলির সঙ্গে খুব মিশত। কস্তুরী বলল, “ও মা! এত দিন কোথায় ছিলে? পিছনে ওটি কে? ওয়াইফ?”

“জি আন্টি। আমি দেশে ছিলাম। মিরাট। আন্টি, মেহুলি আছে?”

“না। ও তো নেই বাবা।”

“ও আমি আবার ভাবলাম মেহুলি তো বরাবরই লেট রাইজ়ার। তার উপরে আজ স্টেট হলিডে। ও কি ফিরবে এখন? আসলে ওয়াইফের সঙ্গে আলাপটা করানো হয়নি এত দিন। খুব মারবে।”

“আসলে ও আউট অব ইন্ডিয়া। মানে ফর ফারদার স্টাডি।”

“ও মাই গড! মেহুলি ওভারসিজ় গেছে?”

বেশ শব্দ করে কস্তুরীর মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল ফের সেই বাইরের নম্বর। কোনও মতে “তোমরা মাসচারেক পরে মেহুলির দেখা পাবে। এক্সকিউজ় মি!” বলেই ফোনটা রিসিভ করল কস্তুরী।

ফোনের ও পারে মেহুলির গলা বাঁধভাঙা জলের মতো আছড়ে পড়ল, “মাম্মিই-ই-ই! কেমন আছ? স্যরি স্যরি। আসলে এখানে এসে লোকাল সিম কালেক্ট করতে জান বেরিয়ে গিয়েছিল।”

“বোঝো! আমি এ দিকে চিন্তায় চিন্তায়... তুই কেমন আছিস? মিস্টার মুখার্জি?”

“সব ভাল। বাবিও ভাল আছে। আমরা এখন আছি ডাবলিনে। পরশু এসেছি। জান মা, কত্ত কত্ত দেখবার জিনিস এখানে। কাল আমরা বাস ট্যুর করেছি। আইরিশ ইমিগ্রেশন মিউজ়িয়াম, ডাবলিন ক্যাসল, ক্রাইস্ট চার্চ, চিড়িয়াখানা। এখানে বাইকে করেও শহর ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা আছে।”

“সব কিছু এখনই বলবি? ফিরে এসে গল্প করার মতো কিছু স্টক রাখ।”

“আছে আছে, প্রচুর আছে।”

“খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছিস তো মা? কী খাচ্ছিস কে জানে।”

“আরে হ্যাঁ। কী অথেন্টিক সব রেস্তরাঁ এখানে আছে, বিশ্বাস করতে পারবে না তুমি! এখানে খাওয়ার জায়গার অভাব নেই মা। পায়ে পায়ে রেস্তরাঁ আর পাব। কালই তো ডিনার করলাম... কোথায় যেন বাবি?”

মিস্টার মুখার্জির আওয়াজ পাওয়া গেল, “সাউথ অ্যানে স্ট্রিটে কাফে বিস্ট্রো।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাফে বিস্ট্রো। মাশরুম স্যুপ আর ব্রাউন ব্রেড। সঙ্গে...”

“অ্যাঁ! শেষমেশ রুটি খেতে ডাবলিন!”

“হিহিহি। সঙ্গে রোস্টেড চিকেন সুপ্রিম উইথ বেকড পোলেন্টা।”

“সে আবার কী?”

“সব গল্প ফিরে গিয়ে বলব। এখানে সবই ভাল, তবে ঠান্ডাটা বেশি। পাঁচ ডিগ্রির কাছাকাছি।”

“এই সেরেছে! গরম জামাকাপড় কিছু নিয়ে গিয়েছিলি তো সঙ্গে?”

“সব নিয়েছি। আগে থেকে আমি আর বাবি বসে বসে কত্ত প্ল্যান করেছিলাম। তুমি তো কিছুই জানতে না। এয়ার টিকিট, হোটেল বুকিং, সাইটসিয়িং, সব, সব। রাস্তায় কোনও সমস্যা হয়নি। শুধু সাড়ে চোদ্দো ঘণ্টার প্লেন জার্নিটা রিয়ালি বোরিং। আর বাবি আমাকে একটা ফারের জ্যাকেট গিফট করেছে। ভেরি কম্ফর্টেবল।”

“সব বুঝলাম। কিন্তু কবে ফিরছিস?”

এই কথার উত্তরে মেহুলি কী বুঝল কে জানে, সে বলল, “এখানে দারুণ দারুণ ভ্যালি আছে। হিল এরিয়া আছে। যদিও কয়েকটা জায়গা মাত্র দেখে উঠতে পেরেছি। তবে অনেক দেখার জিনিস আছে। জানো মা, এখানকার লোকেরা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গায়, বাজনা বাজায়, হাসে, নাচে নিজেদের মতো করে। কী মজা যে লাগছিল! আর এই সবের মধ্যে যদি পিসি-পিসেমশাইয়ের দেখা পাই। তবে বাবি বলেছে, ব্যাপারটা সহজ হবে না। দেখি... কিন্তু তুমি এত ভোর রাতে জেগে আছ কেন? প্রথম বার যখন ফোন ধরলে না, আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমোচ্ছ। এ মা, ভুলেই গিয়েছিলাম। আয়ারল্যান্ড তো সাড়ে চার ঘণ্টা পিছিয়ে।”

“হুম।”

“কাজে বেরোবে না? সাবধানে যেয়ো। আমি পরে ফোন করব আবার। দাদু-ঠাম্মা কেমন আছে?”

“সবাই ভাল। তুই সাবধানে থাকিস মা। বেশি নাচানাচি করে ঠান্ডা লাগাস না। এমনিতে বিদেশ, তাও আমি নেই...”

কথা শেষ করার আগেই হালকা ‘কুট’ শব্দে বুঝল ফোন কেটে গেছে।

কস্তুরী অবাক না হয়ে পারল না। মেয়ে এই কয়েক সপ্তাহে কতটা বদলে গেছে! আগে কী রুড ছিল! কত রাত দুশ্চিন্তায় কেটেছে কস্তুরীর। বিশেষ করে ওই লেডিজ় কন্ডোমের কেসটার পর থেকে। দাদুর প্রতি তেমন কিছু ফিলিংস না থাকলেও, আকিঞ্চনের মাকে তো ও দু’চোখে দেখতে পারত না। সেই মেয়ে কি না ফোন করে দাদু-ঠাম্মার খোঁজ নিচ্ছে! এটা কি সেই ভদ্রলোকের কেরামতি না কি? হতে পারে। মানুষ যখন একটা ছাতার আশ্রয় হারায় তখন অন্য ছাতার খোঁজ করে। যাতে আয়েশ করে বসা না যাক, কড়া রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিশ্চিন্তে দাঁড়াতে পারে। আকিঞ্চনের কাছ থেকে কতটা ঝটকা খেয়েছে ওইটুকু একটা মেয়ে, ওকে দেখলে আর কেউ না পারুক, কস্তুরী ঠিক বুঝতে পারত। হয়তো আকিঞ্চন জেলে যাওয়ার পর থেকেই ও বিকল্প ছাতা খুঁজছিল। হয়তো মায়ের প্রতি সেই ভরসাটা তখনও বেড়ে ওঠেনি। অথবা মেহুলি শেষমেশ বুঝতে পেরেছে তার মা-ই ঠিক। কিন্তু তা বলে স্বর্ণেন্দু! কে ভেবেছিল? আচ্ছা, মিস্টার মুখার্জি কি মেহুলিকে বলে দিয়েছেন সব কিছু? নিশ্চয়ই বলবেন না। উল্টে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন এই অদ্ভুত সম্পর্কের রসায়ন।

আপাতত একটা চিন্তা গেল। এ বার তিতি। কী যে হল মেয়েটার!

একটা অ্যাপ-ক্যাব নিয়ে কস্তুরী যখন পাটুলির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ঘড়িতে সকাল ন’টা। ডোরবেল বাজাতেই এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। কস্তুরী আন্দাজে বুঝল ইনিই মিশুকের বাবা। হাত তুলে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক যে খুশি হলেন, এমনটা মনে হল না। নির্বিকার মুখে ‘আসুন’ বলে দরজা খুলে দিলেন।

এমন সময় ভিতরের ঘর থেকে আরতিদেবীর আবির্ভাব ঘটল। আজ কিন্তু অন্য দিনের মতো উচ্ছ্বসিত দেখাল না ভদ্রমহিলাকে। কেমন একটা ম্রিয়মাণ গলায় বললেন, “আসুন ভাই।”

আজ সকাল থেকেই বড্ড মেঘলা-মেঘলা ভাব। শীতকালে আকাশ মেঘলা থাকলে বড্ড মনকেমন করে কস্তুরীর। ঘরের ভিতরটাতেও কেমন মন খারাপ করে দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মিশুক কোথায়? আরতিদেবী ভিতরের ঘরে গেছেন তাকে বসিয়ে। কস্তুরী ভাবল নিশ্চয়ই মিশুককে খবর দিতে গেছেন। মিশুক কি এখনও ঘুমোচ্ছে? কস্তুরী এসেছে শুনলে নিশ্চয়ই এত ক্ষণে দৌড়ে চলে আসবে।

আচমকা জানলার পর্দা উড়িয়ে এক রাশ হাওয়া ঢুকল ঘরে। গায়ের স্টোলটা আরও ভাল করে জড়িয়ে নিল কস্তুরী। টাইম পাস করতে সামনের টেবিলে উল্টে রাখা একটা বই তুলে নিল। শঙ্খ ঘোষ! কস্তুরী সামান্য অবাক হল। এই বাড়িতে কবিতা কে পড়ে?

পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখল কস্তুরী। সামনে ফিনফিনে রাতপোশাক পরা মিহিরা। ঘুমচোখে উঠে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। কস্তুরী বলল, “এ মা! গায়ে কিছু দাওনি কেন? শীত করছে না?”

একগাল হেসে মিহিরা বলল, “করছে। তবে ভাল লাগছে। আমাদের বরানগরের মামাবাড়িতে এই সময়ে প্রতি বার যাই। এ বার এখনও বাবা নিয়ে যায়নি। মামাবাড়িতে একটা বাগান আছে জানো? প্রচুর আম, কাঁঠাল আর গন্ধরাজ লেবুর গাছ। সামনেই পুকুর। তার পাড়ে ঘাস। সকালবেলায় সেই ঘাসের উপরে প্রচুর শিশির পড়ে থাকে। এখানে তো শিশির দেখাই যায় না। সক্কাল সক্কাল ঘাসের উপরে দাঁড়াতে আমার যে কী ভাল লাগে! আমি পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর হিহি করে কাঁপি। দিদুন দেখতে পেলেই বড্ড বকুনি দেয়। কিন্তু আমি শুনি না।”

“তোমাদের মামাবাড়ি বরানগরে? ওখানে কে কে আছেন?”

“সব্বাই। মামা, মামি, দিদা, এক মাসির বিয়ে হয়নি, সে। এক মেসো ঘরজামাই থাকে, সে। দাদান মারা গেছে। আর এক পাল কুচোকাঁচা। তাদের সঙ্গে হুটোপুটি... ওফ! দিন দশেক হু-হু করে কেটে যায়।”

“তোমার প্রকৃতি ভাল লাগে?”

মিহিরা থপ করে কস্তুরীর পাশে বসে পরে বলল, “সুপ্পার। আগে যেখানে ভাড়া থাকতাম, মানে যাদবপুরে, ইস, কী ফালতু লাগত। চার দিকে খালি ক্যাঁচর-ম্যাঁচর আর বড় বড় বাড়ি। একটু যে ছাদে উঠে আকাশ দেখব তার উপায় ছিল না।”

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy