ছবি: পিয়ালি বালা।
কস্তুরী সিনেমা বিষয়ক একটা পাক্ষিকে পড়েছিল কাস্টিং কাউচের কথা। সে বলল, “কাস্টিং কাউচ?”
“তা ছাড়া কী। জানো বিবি, চন্দ্রাণীদি ভাল মেয়ে, কিন্তু মৈনাকদা... আরিব্বাস...”
বক্তব্যের শেষটুকু শুনে চমকে উঠেছিল কস্তুরী। মিশুকের দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝল ওর কথার লেজটুকু মৈনাকদাকে নিয়ে নয়, সামনে একটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের মেকআপ কোম্পানির বড়সড় আউটলেট। সেটা দেখেই লাফিয়েছে মেয়েটা।
“বিবি! অ্যাট লাস্ট সাউথ সিটিতে এদের শো-রুম! ভাবতেই পারছি না। এসো এসো...”
প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে ভিতরে চলে গেল মিশুক। দোকানটা দেখে কৌতূহল হল কস্তুরীর, আর হতভম্ব ভাবটাও লুকোতে পারল না। কস্তুরী ঢুকে দেখল, মিশুক দোকানের এক জনের সঙ্গে কথা বলছে। বলুক। ওদের জিনিস ওরা বুঝবে। মিশুকের সঙ্গে ঢুকতে দেখেই হয়তো কেউ আলাদা করে তাকে কিছু বলল না। সেই অবসরে কস্তুরী ভিতরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
চার দিকে নানা জিনিস সাজানো। এত রকম জিনিস লাগে অভিনেতাদের সাজতে! বাপ রে! কস্তুরীর মনে পড়ল, তার মা মানসীদেবীও আগে সাজতে খুব ভালবাসতেন। তবে আইটেম মাত্র দুটোই। বিকেল হলেই ক্রিম আর ফেস পাউডার। তবে সব ছাপিয়ে একটা মা-মা গন্ধ লেগে থাকত। আর বাবা ব্রজনারায়ণ রোজ নিয়ম করে স্নানের আগে ব্রহ্মতালুতে গন্ধতেল মাখতেন ঘসঘস করে। সময় কতটা এগিয়ে গিয়েছে, কত বদলে গিয়েছে ভেবে বিস্ময় ধরছিল না কস্তুরীর!
“বিবি, টু থাউজ়্যান্ড নাইন্টি হয়েছে। দাও।”
কস্তুরী চেয়ে দেখল মাত্র তিনটে জিনিসের বিলিং হয়েছে। এই তিনটে ছোট্ট শিশির দাম অত! দাম মিটিয়ে দিয়ে বাইরে আসতেই মিশুক বলল, “তা হলে এটাই তোমার গিফট এই পুজোয় আমাকে। এ বার খুশি? হিয়ান্তিকা দেখলে কিন্তু মারবে।”
“মারবে কেন রে?”
“বিলিভ মি বিবি, আমি এত বড় বয়স অবধি আমি কারও থেকে কোনও গিফট নিইনি। আমার ভাল লাগে না নিতে। আমি তো আর্ন করি। যদিও বেকার বসে থাকলেও নিতাম না।”
“তা হলে আমার থেকে নিলি যে?”
মিশুক কস্তুরীর হাতের নীচ দিয়ে ফের হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসল শুধু এবং তার পরেই সিঁটিয়ে গেল। কস্তুরী দেখেছে। জনাপাঁচেক মধ্যবয়স্ক মহিলার দল। মিশুকের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। তার মানে বিনা মেকআপেও চিনতে পেরেছে। মিশুক অস্ফুটে বলল, “এই এক মুশকিল।”
এড়ানো গেল না চেষ্টা সত্ত্বেও। এক জন বলল, “ওমা, তুমি রিখি না?”
সামান্য কেঠো হাসল মিশুক। আর এক জন বলল, “কী বাচ্চা মেয়ে, তাই না রে দীপালি?”
দীপালি নামের মহিলা এ বার এগিয়ে এসে মিশুকের গালটাই টিপে দিল। বাকিরা এক বার মিশুককে দেখছে, আর এক বার কস্তুরীকে। কস্তুরীর হাসি পেল। এরা তাকেও নিশ্চয়ই সিরিয়ালের ক্যারেক্টার ভাবছে। নইলে হিট হিরোইন রিখি সেন এই ভাবে কারও হাত ধরে হাঁটে? এক জন বললেন, “ইনি মা বুঝি?”
উপায়ান্তর না দেখে মিশুককে যতটা সম্ভব আড়াল করে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল কস্তুরী। বেশ বুঝতে পারল পিছনে গুজগুজ, ফুসফুস চলছে। বেশ খানিকটা তফাতে এসে মিশুক বলল, “ভাল লাগে না।”
“একটু আগেও তুই নিজেকে এতটা বড় হয়েছিস বলছিলি না?”
“খিল্লি কোরো না বিবি। প্লিজ়।”
“কুকিজ় খাবি?”
“ইশ! কী মিষ্টি! তুমি খাও।”
“তুই খেলে খাব।”
“ও সব বাদ দাও। তুমি এস তো।”
আবার কী! কস্তুরী দেখল, তাকে নিয়ে মিশুক একটা জামাকাপড়ের শপে ঢুকছে। একটা ড্রেস পছন্দ করে মিশুক বলল, “এটা নিই?”
“ভাল মানাবে তোকে। নিয়ে নে।”
“বিবি! এটা তোমার জন্য।”
“তুই খেপেছিস! এই ড্রেস আমি পরি? মা গো!”
“তা হলে মেহুলির জন্য নিই? ও পরে এই সব?”
কস্তুরী অবাক হল। মেয়েটার সব দিকে খেয়াল আছে। যাকে চোখেই দেখেনি তার জন্যও ভেবে রেখেছে। মাই গড! সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
অবশ্য এতেই কস্তুরী পার পেল না। এক জোড়া জুতো তাকে কিনে দিল মিশুক। এ যাবৎ সে ফ্ল্যাট হিল ছাড়া কিছুই পরেনি। জীবনে এই প্রথম কালারড ফ্ল্যাপড আর সামান্য হিলওয়ালা জুতো! এটা পায়ে দিয়ে সে অফিসে যাবে? ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। মিশুক বলল, “পরবে কিন্তু। ফেলে রাখবে না।”
“হ্যাঁ মা। পরব।”
বলতেই হল। কস্তুরী ভেবে নিল শাড়িটা সামান্য নামিয়ে পরলেই জুতোটা আর দেখা যাবে না। অবশ্য তমালিকার যা শকুনের নজর!
এতটা সময় নিজস্ব সাংসারিক কুটকচালি মনেই ছিল না কস্তুরীর। একটা অ্যাপ-ক্যাব হায়ার করে বাড়ির দরজায় তাকে নামিয়ে দিয়ে মিশুক বেরিয়ে যেতেই মনটা ভারী হয়ে উঠল। মিশুকের গাড়িটা যত ক্ষণ না মোড়ের কাছে গিয়ে ডান দিকে বেঁকে মিলিয়ে গেল, সেই দিকে চেয়েছিল কস্তুরী। এ বার মনে হল, গেট খুলে ভিতরে যেতে আর ইচ্ছেই করছে না। কস্তুরী রাস্তার দিকে তাকাতেই নজরে এল হরিপদবাবুকে। ভদ্রলোক মাথা নিচু করে যেন টলতে টলতে হাঁটছেন। অসুস্থ না কি?
“দাদা, আজ দোকান খোলেননি?”
ভদ্রলোক চমকে তাকাল। গেটের উজ্জ্বল আলোয় কস্তুরী দেখল, ভদ্রলোকের দুটো চোখই বেশ লাল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে!”
হরিপদবাবু অস্ফুটে বললেন, “দোকানটা বন্ধ করে দিলাম ম্যাডাম। পার্মানেন্টলি।”
“কেন? পাড়ার ছেলেরা কি...”
ভদ্রলোক অতি কষ্টে যেন হাত তুললেন, “আমার... আমার...”
কথা শেষ করতে পারলেন না। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। শশব্যস্ত হয়ে উঠল কস্তুরী। কান্নার বেগ থামলে হরিপদবাবু বললে, “আমার ছেলে... বনি... আর নেই ম্যাডাম।”
“সে কী! কী করে?”
“যে গাড়ি করে বনি এয়ারপোর্ট আসছিল, সেটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সবাই স্পট ডেড। আমি এখন কী করব ম্যাডাম? আমার... একমাত্র ছেলে...”
ভদ্রলোক ফের কেঁদে ফেললেন। আর দাঁড়ালেন না। কস্তুরীর মুহূর্তে মেহুলির মুখটা ভেসে উঠল। ওহ। তাদেরও ওই একটিমাত্র সন্তান। আর ভাবতে পারল না কস্তুরী। আহা! আর বলবেন না ভদ্রলোক, ‘গুড নিউজ় ম্যাডাম...’।
ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে কস্তুরী দেখল চন্দন বেরিয়ে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে আর শ্বশুরমশাই হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ খুঁজছেন। কস্তুরী হাতের নাগালে কাপ এগিয়ে দিতেই কী করে বুঝে ফেললেন। বললেন, “আজ অফিস যাসনি তুই?”
“গিয়েছিলাম। বেরিয়ে এসেছিলাম তাড়াতাড়ি। কিন্তু বুঝলে কী করে?”
শ্যামলেন্দু জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। বললেন, “তুই কি আমার ডান দিকে?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“অথচ দেখ, আমার ডান দিকে এক জন মহিলা। মুখটা দেখতে পাচ্ছি না, তবে সবুজ... না, কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে আছে। বোরখার মতো করে। আমি এত ক্ষণ ধরে দেখছিলাম।”
“উনি কিছু বলছেন তোমাকে?”
“নাঃ। কেউ-ই তো কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। কিন্তু...”
“কিন্তু?”
“এই মহিলা, এই যে তোর জায়গায় বসে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন রে?”
“কান পেতে শোনার চেষ্টা করছ?”
“হ্যাঁ রে। অনেকটা চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার মতো। ওখানে তবু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িক আছে। এখানে সব সাইলেন্ট। কী ব্যাপার বল তো?”
“আমি কী করে বলব বাবা?”
কস্তুরী এক বার ভাবল হরিপদবাবুর খবরটা শ্যামলেন্দুকে দেবে, কিন্তু কী ভেবে থেমে গেল। তার বাবা বলতেন, বেশি বয়সে বেশি শোক ভাল নয়। কস্তুরী উঠবে ভাবছে, এমন সময় বেল বেজে উঠল ঘন ঘন। ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন কেতকীবালা। তার পর খরদৃষ্টিতে কস্তুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকার জেল হয়েছে তুমি জানতে?”
তার পরেই প্রশ্নবাণ ধেয়ে এল পর পর, “জানতে যদি আমায় বলোনি কেন? ক্লাবের ছেলেরা না বললে আমি জানতেই পারতাম না! তুমি নাকি আকিঞ্চনকে দেখতেও যাওনি? সারা দিন তবে মরছিলে কোথায়? ওগো দেখতে পাচ্ছ, কার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি খোকার?”
ফের সেই চর্বিতচর্বণ। মাঝে কিছু দিন বিশ্রাম দিয়েছিল। কস্তুরী ভেবেছিল রণে ক্ষান্ত দিয়েছেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু এ যে ইন্টারভ্যালের পর ফের সিনেমা শুরু! মাথায় আগুন জ্বলে উঠতে গিয়েই কেমন করে ভীষণ শান্ত হয়ে গেল কস্তুরী।
“জবাব দিচ্ছ না যে!”
“কী বলব মা? আপনাদের বয়স হয়েছে। বেশি টেনশন নেওয়াটা ঠিক নয়।”
“থাক। ছেলেটা আমার। তুমি না হয় নাতনিটার হাল ছেড়ে আদাড়েবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আমি তো পারব না। তাই ছুটে গিয়েছিলাম ক্লাবে। চন্দন, এক গ্লাস জল দে। বাপ রে, এই বয়সে আমি দৌড়োদৌড়ি করতে পারি?”
কস্তুরী বুঝল একে জবাব দিয়ে লাভ নেই। যা ইচ্ছে করুক।
এই প্রথম শ্যামলেন্দু মুখ খুললেন কস্তুরীর উদ্দেশ্যে, “আমাকে বল তো মা কী হয়েছে? আকিঞ্চন কোনও ক্রাইম করেছে?”
কেতকীবালা গর্জে উঠলেন, “আমার ছেলে চোর-চামার না কি যে ক্রাইম করবে? মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”
এ বার শ্যামলেন্দু সোজা হয়ে বসে উঁচু গলায় বললেন, “তুমি থামবে? আমাকে আগে শুনতে দাও। তোমার ছেলে ভাজা মাছটাও ওল্টাল না, অমনি পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল? একদম চুপ করে থাকো তুমি।”
কেতকীবালা থমকালেন। চমকাল কস্তুরীও। শ্যামলেন্দুকে এই ভাবে চড়া গলায় কথা বলতে প্রথম বার শুনল এতগুলো বছরের মধ্যে। কিন্তু কী বলবে সে? বাবা-মায়ের সামনে কি বলা যায় তাদের একমাত্র ছেলে পরকীয়া করতে গিয়ে ফেঁসেছে? যতই ঠাট্টা-ইয়ার্কি মারুক বৃদ্ধের সঙ্গে, সম্পর্কে তিনি তো শ্বশুরমশাই। তবে উপায়ই বা কী? বাধ্য হয়ে প্রায় সবটা খুলে বলল কস্তুরী। সব শুনে কেতকীবালা চোখে আঁচল-চাপা দিয়ে ভিতরে চলে গেলেন আর শ্যামলেন্দু থম মেরে বসে রইলেন। কস্তুরী বলল, “বাবা, কাল বিকেলবেলা রেডি হয়ে থেকো। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিচ্ছি। কাল তোমাকে নিয়ে যাব।”
দোতলায় উঠে এসে কস্তুরী জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় বসল। তিতি এত ক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ি পৌঁছে গেছে। ভাবতে ভাবতেই মেসেজ ঢুকল, ‘বাড়ি উইদিন ফাইভ মিনিটস’। যাক। নিশ্চিন্ত। কস্তুরী আকিঞ্চনের ঘরে ঢুকল।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy