E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

এমনি করে রথযাত্রার পরে আরও কয়েক মাস কেটে গেল। মহাপ্রভু আর কোনও প্রবোধ মানলেন না।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

অবিন সেন

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:১১
Share
Save

পূর্বানুবৃত্তি: প্রতাপরুদ্রদেবকে ঈশ্বরের সেবায় ব্রতী হতে দেখে প্রীত হলেন মহাপ্রভু। কিন্তু অন্য দিকে, মহারাজের মহাপ্রভু-প্রীতি অসহ্য হয়ে উঠল গোবিন্দ বিদ্যাধরের কাছে। তাঁর আরও জ্বালা হল মন্দিরের তত্ত্বাবধানের ভার শূদ্র রাম রায়ের হাতে যাওয়ায়। উপরন্তু বিদ্যাধরের বিরোধিতা সত্ত্বেও মহারাজের সমর্থনে রাম রায় মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তরে একটি মণ্ডপ নির্মাণ করালেন। সেখানে বৈষ্ণবগোষ্ঠীর দিবারাত্র নামকীর্তন শুরু হলে গোবিন্দ বিদ্যাধরের বিরক্তি ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হল। গোবিন্দর চর বটুকেশ্বরও তাকে কোনও আশানুরূপ খবর দিতে পারে না। ক্ষুব্ধ গোবিন্দ বটুকের কিশোরী বধূকে নিজের জিম্মায় রেখে বটুকেশ্বরকে কিছু দায়িত্ব দিয়ে দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেয়। সে সময় গৌড়নগরীর এক সরাইখানায় নৃসিংহ উপরায়ের সঙ্গে দেখা করে মাধব মিশ্র জানান, সুলতান হুসেন শাহ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তিনি যেমন করেই হোক উৎকলঅধিকার করতে চান। জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করে সেখানে গৌড়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। তখনই মহাপ্রভুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে কাশী মিশ্রের গৃহে ছদ্মবেশেপৌঁছলেন মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব। সজলচোখে স্থান প্রার্থনা করলেন মহাপ্রভুর পায়ে।

মহাপ্রভু তাঁকে থামিয়ে দিলেন। মহারাজের মনের অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত। এমনকি রাজ্যের সাম্প্রতিক অবস্থা, যুদ্ধ, খরা, ষড়যন্ত্র, সমস্ত কিছুর বিষয়েই তিনি জানেন। তাই তিনি মহারাজকে আরও কিছু বলতে নিষেধ করলেন। তার পর আবার গবাক্ষপানে বাইরে তাকিয়ে দৈববাণীর মতো বললেন, “বিষয়কর্মে ব্যাপৃত থেকেও সর্বদা ঈশ্বরের চিন্তায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখবে। কর্ম আর ঈশ্বর— এতেইতোমার মুক্তি।”

মহারাজের চোখের জল যেন বাধা মানছে না। মহাপ্রভুর বাণী শ্রবণে তাঁর সারা দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তিনি যেন বুঝতে পারছেন, আঁকড়ে ধরার মতো একটি শক্ত অবলম্বন তিনি পেয়েছেন।

আরও এক দণ্ডকাল মহাপ্রভু নানা উপদেশ দিলেন মহারাজকে। সেই সব নিভৃত কথার সাক্ষী থাকল কেবল মহাকাল আর আকাশের চন্দ্রমা।

মহারাজা বিদায় নিলে মহাপ্রভু মন্থর পদসঞ্চারে গম্ভীরা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পায়ে পায়ে হেঁটে চলে গেলেন অতুল সমুদ্রের দিকে। বালুকাবেলায় তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। সামনে অবারিত জ্যোৎস্না সাগরের বিপুল ঊর্মিমালার মাথায় যেন নৃত্য করছে।

অদূরে একটি ঢালু বালিয়াড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি অপলক নয়নে মহাপ্রভুর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে সেই ব্যক্তি এগিয়ে এসে মহাপ্রভুর সামনে দাঁড়ালেন। অনেক দূর থেকে তিনি মহাপ্রভুর জন্য এক বার্তা বয়ে এনেছেন। মহাপ্রভু তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলেন। তার পর মৃদু হেসে মুখে মুখেই সেই বার্তার উত্তর দিলেন তিনি।

কয়েক দিন পর মহাপ্রভু রামানন্দকে ডেকে বললেন, “রামরাজা, এক বার বৃন্দাবন ঘুরে আসি।”

এই প্রস্তাব রাম রায়ের একেবারেই মনের মতো হল না। আসলে তিনি একদণ্ড মহাপ্রভুকে চোখের আড়াল করতে চান না। তিনি বললেন, “ঠিক আছে প্রভু। আমি মহারাজের কাছে এই প্রস্তাব দেব। তিনি সানন্দে ব্যবস্থা করে দেবেন।”

মহাপ্রভু খুশি হলেন।

কিন্তু মহারাজেরও একই মত, রামানন্দের মতো। মুখে বললেন, “এই দেবভূমি ছেড়ে কেন তিনি যেতে চাইছেন? তোমরা ওঁকে বুঝিয়ে বলো।”

সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুকে বুঝিয়ে বললেন, আর তো মাসাধিক কাল পরেই দোলযাত্রা। প্রভু বরং দোলযাত্রা দেখে তার পর উত্তর ভ্রমণে যাবেন।

উৎসবের আবহে দোলযাত্রা কেটে গেল।

তার পরে রামানন্দ প্রভুকে বললেন। রথযাত্রা সামনে। রথযাত্রা না দর্শন করে প্রভু কী করে বৃন্দাবন যাবেন? নদে থেকে ভক্তবৃন্দ আসবেন। প্রভুকে না দেখে তাঁরা যে বিলাপ করবেন।

এমনি করে রথযাত্রার পরে আরও কয়েক মাস কেটে গেল। মহাপ্রভু আর কোনও প্রবোধ মানলেন না। সেই বছরই এক শীতের দিনে মহাপ্রভু পুরী থেকে বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সঙ্গে নিত্যানন্দ, হরিদাস, মুকুন্দ, রামানন্দ ও আরও অনেকে। এই যাত্রার উদ্দেশ্য কী, তা মহাপ্রভু ছাড়া আর কেউ জানলেন না।

তিনি যে পথ দিয়ে চলেছেন, সেই পথ হরিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠতে লাগল। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ তাঁদের যাত্রার সঙ্গী হল। চলতে চলতে তাঁরা রেমুনাতে এসে হাজির হলেন। সেখানে মহাপ্রভু বিদায় দিলেন রায় রামানন্দকে।

রামানন্দর বিদায় নিতে মন চায় না একেবারেই। তিনি বার বার প্রভুকে অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু মহাপ্রভু তাঁর সেই অনুরোধ শুনলেন না। কিন্তু পরস্পরকে ছেড়ে যেতে দু’জনেরই মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। মহাপ্রভু তাঁকে আলিঙ্গন করে চোখের জলে বিদায় দিলেন। বুকের ভিতরে প্রভূত কষ্ট নিয়েও যেন মহাপ্রভু এই কাজ করতে বাধ্য হলেন। মহাপ্রভুর মনের ভিতরে কী আছে, তা অনুধাবন করার সাধ্য তো কারও নেই!

সেখান থেকে তাঁরা পিছলদায় এসে হাজির হলেন। এখান থেকেই গৌড়ের অধিপতির সীমানা। কেউ কেউ মহাপ্রভুকে সাবধান করে দিলেন। মদ্যপ দুর্বিনীত রাজা। সে অতি ভয়ঙ্কর। কোথায় কী বিপদ নেমে আসবে! কিন্তু মহাপ্রভু অকুতোভয়। মুখে হরিনাম। চোখে প্রেমময় দৃষ্টি। সে দৃষ্টির সামনে যেন পাহাড়ও টলে যায়। পর্বতও সরে গিয়ে পথকরে দেয়।

এক যবন গুপ্তচর হিন্দুর ছদ্মবেশে মহাপ্রভুর ভক্তদের সঙ্গে মিশে গেল। কিন্তু সে কথা মহাপ্রভুর অগোচর থাকল না। তিনি এক দিন ছল করে সেই ভক্তবেশী চরকে স্পর্শ করলেন, তার চোখের দিকে তাকালেন। বরফের মতো সেই চরের হৃদয় যেন প্রেমের বারিধারায় তরল হয়ে গেল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেই যবন চর মহাপ্রভুর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। মহাপ্রভুর পাদস্পর্শে সেই যবনের যেন নবজন্ম হল। সে ফিরে গেল তার অধিপতির কাছে। গৌড়াধিপতি তো তার মুখে হরিনাম শুনে অবাক হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, কে সেই আশ্চর্য পুরুষ!

দিনে দিনে সেই দলে ভক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। যিনি এক বার মহাপ্রভুর দর্শন পাচ্ছেন, তিনি আর এই দল ছেড়ে যেতে চাইছেন না। মহাপ্রভুও কাউকে বিরত করছেন না। তিনি ভাবে বিভোর। দুই চোখ দিয়ে অবিরত ঝরে যাচ্ছে প্রেমের অশ্রু। মুখে কৃষ্ণনাম। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে সকলে একই সঙ্গে হরির নাম গেয়ে উঠছে। মহাপ্রভুর এত লীলা দেখে দেখেও যেন মানুষের চোখ ভরছে না। তিনি কখনও আকুল হয়ে কীর্তন করছেন, কখনও বা আত্মহারা হয়ে নৃত্য করছেন। সে এক অপূর্বদৃশ্য। মানুষ ভাবছে, স্বয়ং ঈশ্বর স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন ধরাধামে। কৃষ্ণনামে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে।

চলতে চলতে সেই হাজার হাজার মানুষের ঢল গৌড়ের কাছে গঙ্গাতীরে এসে উপস্থিত হল। সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণদের গ্রাম। নাম রামকেলি। মহাপ্রভু সেখানে এসে এক তমাল বৃক্ষের তলে উপবেশন করলেন।

তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। মাঘের তীব্র শীতল বাতাসে সকলে কাঁপতে লাগলেন। অথচ মহাপ্রভুর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি মহা উল্লাসে কৃষ্ণনাম করে যেতে লাগলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু ও সঙ্গীরা চিন্তান্বিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলে মহাপ্রভুকে গোল হয়ে ঘিরে বসলেন যাতে কিছুটা হলেও মাঘের উত্তুরে বাতাস প্রতিহত করতে পারেন। কয়েক জন ভক্ত শুষ্ক কাঠ জোগাড় করে নিয়ে এসে ধুনি জ্বালালেন কয়েকটি। ধুনির আগুনের তাপে শীত কিছুটা প্রতিহত হল।

মহাপ্রভু কখনও প্রমত্ত হয়ে হরিনাম করছেন, কখনও আত্মহারা হয়ে নৃত্য করছেন। সেই সঙ্গে ভক্তরাও। নিত্যানন্দ প্রভু মনে মনে একটু শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি শুনেছেন, গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের রাজধানীতে এই ভাবে প্রকাশ্যে নামসঙ্কীর্তন নিষিদ্ধ। সুলতানের ভয়ে এই গ্রামের ব্রাহ্মণ সমাজও প্রকাশ্যে যথাযথ ধর্মাচরণ থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা যেটুকু বা করেন তাও সঙ্গোপনে, আপন আপন গৃহের অন্তঃপুরে। মহাপ্রভু তা ভাল করেই জানেন। তবে কেন তিনি এমন এক জন সুলতানের রাজধানীর এত কাছে এসে এই ভাবে নামগান শুরু করলেন? কেন? কেনই বা তিনি এই স্থানে ঘাঁটি পেতে বসে পড়লেন! তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মহাপ্রভুর মনের হদিস পাওয়া তাঁর মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য।

এই ভাবে নামসঙ্কীর্তন, নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে তিন-চার দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এই হাজার হাজার মানুষের জন্য খাদ্য-পানীয় বয়ে আনছেন গ্রামের মানুষই। কিন্তু তাঁরা কোথা থেকে জোগাড় করছেন এত মানুষের আহার্য! নিত্যানন্দ প্রভু কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না। মহাপ্রভু তো যাবেন বৃন্দাবন। নদীপথে নৌকায় সেখানে যাওয়ার আয়োজনও তৈরি। অথচ মহাপ্রভুর এখান থেকে রওনা হওয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই যেন। গঙ্গার তীরে রামকেলি গ্রামে অবস্থান করে তিনি হরিনাম করে যেতে লাগলেন। মহাপ্রভুর উদ্দেশ্য কী? মনে মনে নিত্যানন্দ প্রভু নিজেকে প্রশ্ন করলেন। তিনি অবাক হয়ে এও লক্ষ করলেন, সুলতানের দিক থেকে কোনও প্রতিরোধ উপস্থিত হয়ে তাঁদের নামগানে ব্যাঘাত ঘটাল না! তিনি আশ্চর্য হয়ে শুধুদেখতে লাগলেন।

আরও দিন দুই পর নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পরিস্ফুট হল।

তখন প্রায় মধ্যরাত্রি। উত্তরের বাতাস বইছে তিরতির করে। গঙ্গার শীতল জলের আবেশ মিশে সেই বাতাস যেন শরীর ভেদ করে অস্থিতে গিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ইতস্তত প্রজ্জ্বলিত ধুনির আগুনও যেন শীতের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু মহাপ্রভু অবিচল। অনেক ভক্ত এ দিকে সে দিকে বৃক্ষতল খুঁজে নিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে কিছুটা বিশ্রাম করে নিচ্ছে। কিন্তু মহাপ্রভু সেই তমাল বৃক্ষের বেদির উপরে বসে আত্মমগ্ন হয়ে হরির নামজপে রত। তাঁর পায়ের কাছে চিন্তামগ্ন হয়েবসে আছেন নিত্যানন্দ প্রভু। সহসা ধুনির অস্পষ্ট আলোয় দেখলেন, দু’জন মানুষ তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন। নগ্ন পদ, কৃষ্ণবর্ণ দেহ। দেহের আকৃতি খর্বকায়।

তাঁরা দুই জন সাষ্টাঙ্গে মহাপ্রভুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

দুই ভ্রাতার মধ্যে তুলনায় খর্বকায় যিনি, তাঁর নাম সাকর মল্লিক ওরফে সনাতন। সুলতান হুসেন শাহের যুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী। ভীষণ ধুরন্ধর আর যুদ্ধকুশলী বলে সুলতান তাঁকে নগর কোতোয়াল থেকে যুদ্ধমন্ত্রীতে উন্নীত করেছেন। তারই আর এক ভ্রাতা রূপ। তিনি সুলতানের রাজস্ব-বিষয়ক মন্ত্রী। পরম পণ্ডিত ও চিন্তাশীল মানুষ। তাঁরাদু’জন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের রাজসভার দুই স্তম্ভ। সুলতানের যাবতীয় সাফল্যের অন্যতম কারিগর এই ভ্রাতৃদ্বয়।

মহাপ্রভু তাঁদের দু’জনকেই হাত ধরে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

মহাপ্রভুর স্পর্শে রূপ-সনাতনের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। দু’জনের চোখ থেকেই জলের ধারা নামতে লাগল। মহাপ্রভুও ভাবে আকুল হয়ে উঠলেন। তাঁর আঁখি বেয়েও অঝোরে অশ্রুধারা বইতে লাগল।

নিত্যানন্দ প্রভু অবাক হয়ে দেখছিলেন। এত ক্ষণে তাঁর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগল। তিনি বুঝতে পারছেন মহাপ্রভুর এই রামকেলি গ্রামে অবস্থানের কারণ।

মহাপ্রভু দুই ভাইকে বললেন, “তোমরা তো আমার পুরাতন ভক্ত। নীলাচলে আমি তোমাদের বার্তা পেয়েছি। তার উত্তরও আমি তোমাদের বলে পাঠিয়েছি। তোমাদের মনের ভাব আমি সম্যক জানতে পেরেছি।”

প্রভু ধীরে ধীরে তাঁদের নানাবিধ উপদেশ দিতে লাগলেন। পরামর্শ দিলেন কী ভাবে সংসারী হয়েও ঈশ্বরের সেবা করে যেতে হবে। তার পর মহাপ্রভু আবার বলতে লাগলেন, “গৌড়ে আসার আমার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আমি শুধু তোমাদের দু’জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এখানে এসেছি।”

একটু থামলেন তিনি। কিছু যেন ভাবলেন। ঊর্ধ্ব আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি, ভগবান কৃষ্ণ তোমাদের অন্তরে ডাক দিয়েছেন। তোমরা বরং ভগবানের ডাকে সাড়া দিয়ে বৃন্দাবন চলে যেয়ো। তার পর যথাসময়ে আমি তোমাদের নীলাচলে ডেকে নেব।”

এই কথা শ্রবণ করে রূপ-সনাতন যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। মহাপ্রভু তাঁদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

ভাবের প্রাবল্য স্তিমিত হলে সনাতন সঙ্গোপনে মহাপ্রভুকে বললেন, “প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার এ বার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল। কারণ আমাদের সুলতানকে বিশ্বাস নেই। তিনি প্রকাশ্যে হয়তো আপনার সুখ্যাতি করছেন। আবার শুনতে পেলাম, কেশব খাঁকে ডেকে বলছেন, ‘এ কেমন সন্ন্যাসী, হাজার হাজার মানুষ সৈন্যদলের মতো তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তীর্থযাত্রায় চলেছে!’ জানি না প্রভু, তাঁর মনে কী চলছে!”

মহাপ্রভু তাঁর কথা বুঝতে পারলেন। আসলে তিনি সবই বুঝতে পারেন। কোনও কিছুই তার অজ্ঞাত নয়। তা ছাড়া এখানে অবস্থান করার প্রয়োজনও তাঁর ফুরিয়েছে।

পরদিন প্রাতে মহাপ্রভু বললেন, “নিত্যানন্দ, এত মানুষ সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবন যাত্রা ঠিক হবে না। চলো, আমরা আবার নীলাচলে ফিরে যাই।”

নিত্যানন্দ প্রভু হাসলেন। মনে মনে বললেন, ‘সে আমি বুঝতে পেরেছি প্রভু। বৃন্দাবন যাত্রা! সে তো তোমার ছল মাত্র।’

১৯

মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরে আসার পরবর্তী সময়কালে কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার আরও প্রবল হয়ে উঠল। দিনে দিনে বৈষ্ণব ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগল। জগন্নাথ মন্দিরের উত্তর দিকে রায় রামানন্দ যে মণ্ডপ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, সেই মণ্ডপে বসেই দিনের একটা দীর্ঘ সময় মহাপ্রভু নামসঙ্কীর্তন করছেন। ভক্তদের নানা উপদেশ দিচ্ছেন।

এই মণ্ডপে এসে যোগ দিয়েছেন পরম ভাগবত পণ্ডিত জগন্নাথ দাস। কখনও কখনও তিনি ভক্তদের ভাগবতের ভক্তিতত্ত্বের বিষয় ব্যাখ্যা করেন। ফলে মন্দির নাম-সঙ্কীর্তনের এক জমজমাট আসরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে।

রামকেলি গ্রাম থেকে আবার নীলাচলে ফিরে আসার পর মহাপ্রভু ও মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের সম্পর্কের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। মহাপ্রভু পূর্বে মহারাজা প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে সাক্ষাতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু এ বার মহারাজা একেবারে নিজেকে মহাপ্রভুর শ্রীচরণে সঁপে দিলেন।

বললেন, “প্রভু, আপনি আমার পরম গুরু। আমায় কৃপা করুন।”

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।