Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

পিঠে খেলে পেটে সয়

হেমন্ত আর শীত, দুই ঋতুতেই বাঙালির পিঠে পার্বণ। নতুন ফসলের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মসজিদে পড়া হয় মিলাদ। পাশ্চাত্যেও হয় থ্যাঙ্কসগিভিং উৎসব। বাংলায় নবান্নের নতুন চালের গুঁড়ো আর খেজুর রস। সঙ্গে দুধ আর নারকেল কোরা। এ ভাবেই লেখা হয় বাঙালির পিঠে-কাব্য। সুমনা সাহাহেমন্ত আর শীত, দুই ঋতুতেই বাঙালির পিঠে পার্বণ। নতুন ফসলের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মসজিদে পড়া হয় মিলাদ। পাশ্চাত্যেও হয় থ্যাঙ্কসগিভিং উৎসব। বাংলায় নবান্নের নতুন চালের গুঁড়ো আর খেজুর রস। সঙ্গে দুধ আর নারকেল কোরা। এ ভাবেই লেখা হয় বাঙালির পিঠে-কাব্য। সুমনা সাহা

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ২৩:৫১
Share: Save:

হেমন্ত বাঙালির বড় প্রিয় ঋতু। এই হেমন্তের প্রাণ হল ‘নবান্ন’ উৎসব। মাঠভরা সোনার ধান আর বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, কৃষক ধান কেটে গোলায় তোলে, ওই নতুন ধানের চাল থেকে ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠে। পিঠের জুটি হেমন্তের নতুন গুড়। সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকেই ‘পিঠা’ বা ‘পিঠে’ কথাটা এসেছে। এই ‘পিঠে’-র সঙ্গে বাঙালির প্রেম অনেক দিনের। পৌষ মাসের শেষ দিন, যে দিনটাকে মকরসংক্রান্তি বলে, সেটাই আনুষ্ঠানিক পিঠে খাওয়ার দিন। আর ‘নবান্ন’ অর্থাৎ নতুন অন্নের উৎসব পয়লা অগ্রহায়ণ। ‘অগ্র’ মানে প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে মাস। অনেক আগে অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস হিসাবে ধরা হত।

বাঙালি পিঠে খেতে ভালবাসে, খাওয়াতেও ভালবাসে। পিঠেকে কেন্দ্র করে গ্রামবাংলায় ব্যাপক আয়োজনের সাড়া পড়ে যেত। চিতই পিঠে তৈরির জন্য মাটির সরা তৈরি করা হত, চাল গুঁড়ো করার জন্য মেয়েরা মিলে ঢেঁকিতে চাল কুটত। পাশাপাশি খেজুর রস সংগ্রহ থেকে গুড় তৈরি পর্যন্ত ইতিহাস তো রীতিমতো এক কাব্য। বাতাসে হিম পড়তে শুরু করলেই খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধা শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন সন্ধেয় খেজুর গাছে নতুন হাঁড়ি লাগানো হয়, পর দিন সূর্যোদয়ের আগেই রস সংগ্রহ করা হয়। অনেক সময় হাঁড়ি পাল্টে নতুন হাঁড়ি বসিয়ে যায় ‘গাছি’রা। খেজুর গাছে যাঁরা ওঠেন, তাঁদের বলে ‘গাছি’ বা ‘গাছিয়া’। গাছে ওঠার বিশেষ পদ্ধতি আছে। যে কেউ এ সব পারে না। গাছের রস এক দিন জিরিয়ে নিলে তা আরও সুস্বাদু হয়, একে বলে ‘জিরেন রস’। পিঠের আর-এক সঙ্গী হল নারকেল। আর চাই দুধ। চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড়, দুধ ও নারকোল কোরা সহযোগে তৈরি হয় নানা ধরনের পিঠে।

বাংলার পিঠে এক অপরূপ শিল্প। পৌষসংক্রান্তি বা পয়লা অঘ্রান যদিও বিশেষ দিন, কিন্তু সমস্ত শীতকাল, অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাস জুড়েই চলে পিঠের উৎসব। হ্যাঁ, পিঠে নিজেই এক আস্ত উৎসব! বাংলাদেশের বিশেষ কিছু পিঠের মধ্যে অন্যতম বিনি বা বেনি পিঠে, চালগুঁড়ি সেদ্ধ করে আটার মতো মেখে বিনুনির আকারে গড়ে এই পিঠে তৈরি হয়। এ ছাড়া আছে সিমুই পিঠে, পুলি পিঠে, ঝিনুক পিঠে, চিতই পিঠে, নকশাই পিঠে, ঝাল-কুশ পিঠে, মালপো পিঠে, রস-চিতই পিঠে, সূর্যমুখী পিঠে, চুষি পিঠে— আরও যে কত রকমের পিঠে আগেকার দিনে ঘরে ঘরে মেয়েরা তৈরি করত, তার লেখাজোখা নেই! পাটিসাপটার কথা আলাদা ভাবে না বললে তার মানহানি হবে। আজকাল লোকে পাটিসাপটা গড়ে ময়দা বা সুজি দিয়ে, ভিতরে নারকোলের পুর না দিয়ে ক্ষীরের পুর দেয়।

শ্রীরামকৃষ্ণের অনবদ্য কথনশৈলীতেও উঠে এসেছে গ্রামবাংলার এই পিঠে ও তার ভিতরে ঠাসা পুরের উপমা। তিনি ভক্ত-অভক্ত নানা শ্রেণির মানুষের উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘কি জানো? মানুষগুলো বাইরে থেকে দেখতে একরকম, কিন্তু কারু ভিতরে ক্ষীরের পোর, কারু বা কলায়ের ডালের পোর!’’ সাবেকি পাটিসাপটার বদলে আধুনিক ‘সুজি-ময়দা’-র পাটিসাপটা তৈরি তুলনায় সহজ। চাটুতে আটকে যায় না, এখনকার নন-স্টিক প্যান-এ চমৎকার তৈরি হয় এই দিশি প্যানকেক। ‘দুধ-পুলি-পিঠে’ হল আর-এক প্রেমের কবিতা। এই পিঠে তৈরিতে সাধনার মতোই ধৈর্য ধরতে হয়। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ক্ষীরের মতো ঘন করে তুলতে হবে। তাতে মিষ্টি স্বাদের জন্য চিনি নয়, দিতে হবে নতুন গুড়। বেশি কটকটে মিষ্টি হলেই রসভঙ্গ। চালের তৈরি পদ্মকোরকের মতো পুলির ভেতর ঠাসা থাকবে নারকোল-গুড়ের ঘনিষ্ঠ প্রেমের পুর, তাকে অন্তরে ধারণ করে সাধিকা পুলি ব্রহ্মসমুদ্রে, থুড়ি, ঘন ক্ষীরতুল্য দুধসায়রে ডুবে থাকবেন! আনাড়ির হাতে তৈরি শক্ত থান ইটের মতো পুলি এ নয়, যা চামচ দিয়ে কাটতে গেলে চামচ ছিটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি হওয়ার আশঙ্কা! সাধিকাকে সাধনায় ‘সিদ্ধ’ হতে হবে। উপযুক্ত গুরুর হাতে পড়লেই তো শিষ্যের উন্নতি! পটু হাতের তৈরি নরম ওই ‘পুলি-সাধিকা’ই পিঠে-প্রস্তুতকারক বা কারিণী গুরুর ‘পহেচান’। বড় চামচে দুধ-মালাইসহ অর্ধেক পুলি ভেঙে মুখে দিয়ে সাধনার ‘ফল’ আস্বাদন এক শিহরন জাগানো অনুভূতি। জিভের ডগা থেকে কণ্ঠা পর্যন্ত পিঠে প্রবেশের যাত্রাপথে অনন্য স্বাদের উচ্চ-নীচ ভূমি স্পর্শ করে ভোক্তা পৌঁছে যাবেন এক আনন্দময় জগতে!

মুসলমানদের মধ্যেও নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে ‘মিলাদ’ পড়া হয়। মসজিদে সিন্নি চড়ানো হয়। আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় হিন্দু-মুসলমান ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে, অগ্রহায়ণে মাঠের পাকা নতুন ধান ও ফসল কাটা ও ঝাড়াই হয়ে গোলায় উঠলে গৃহস্থ পরিবারে উৎসব হত। সামর্থ্য অনুযায়ী পিঠে-পুলি-ক্ষীর-পায়েস যে যেমন পারে, রান্না করে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া, পাড়াপড়শিকে খাওয়ানো, বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে পিঠে খাওয়ানোর চল ছিল।

শুধু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই এই নতুন ফসল নিয়ে, পিঠে-পুলি নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠার উৎসব প্রচলিত আবহমান কাল ধরে। আমেরিকায় নভেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার দিনটিকে ধার্য করা হয়েছে নতুন ফসলের উৎসব উদ্‌যাপনের দিন—‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে। সারা বছর পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদনের আশীর্বাদ করেছেন ভগবান, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, আর সেই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে মিলিত হয়ে প্রার্থনা, সঙ্গে একত্রে ভূরিভোজের আয়োজন, এই হল এই দিনের উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। আমেরিকায় মূলত এটি একটি সপরিবার আনন্দোৎসবের দিন— এক বিরাট নৈশভোজ উপলক্ষ করে কাছে-দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সকল সদস্য একত্রিত হয়। ডিনারের মেনুতে অতি অবশ্যই থাকবে একটি আস্ত ঝলসানো টার্কি ও ভুট্টা সিদ্ধ। ওই ভুট্টা ওখানে ওই ঋতুর নতুন ফসল। অর্থাৎ, আমাদের দেশের গ্রাম-বাংলার ‘নবান্ন’ উৎসবই ও দেশের ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’।

বাঙালির পিঠে পার্বণ সাম্প্রদায়িকতাহীন; ঐতিহ্যবাহী ও চিরন্তন বঙ্গ-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হেমন্তের প্রেমিক কবি জীবনানন্দের আকুতি ছিল এই ধানসিড়ি নদীতীরে, এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ফিরে আসার। বেঁচে থাক আমাদের ‘নবান্নের দেশ’ আর তার পিঠে-সংস্কৃতি!

অন্য বিষয়গুলি:

Pitha পিঠা Food Recipe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy