Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৬
Bengali Literature

মায়া প্রপঞ্চময়

আপনি ঠিক জানেন যে, এখানে জীবজন্তুরা ঠিকমতো খেতে পায় না? মানে, এই চিড়িয়াখানায় কী-কী খাবার কতটা দেওয়া হয়, তার সম্পর্কে একটা ফার্স্টহ্যান্ড আইডিয়া আছে তো!

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৬
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: হরিশ্চন্দ্র ঘাট থেকে মানিককে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে অন্নু। গেস্টরুমে রাতে থাকতে দেয় তাকে। মানিককে দেখে নিশ্চিন্ত হয় প্রীত। তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতে পারে না সে। অন্নুকে সে বলে, বিষাণলাল নামে এক বন্ধুর প্ররোচনাতেই তার মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। তখন থেকেই সে অন্নুকে বিয়ের জন্য জেদ ধরে। সবটা জেনে কষ্ট বাড়ে অন্নুর। কষ্ট হয় নিজের দাম্পত্য শান্তির জন্য মানিককে কষ্ট দিতে হল বলেও। সকালে তাকে বিদায় জানায় মানিক।

গান শুনতে শুনতে দু’চোখ জ্বালা করে ওঠে অন্নুর, কথাগুলো কি সত্যি? হাজারও লোকের মাঝে মানিক কি আর কখনও ফিরে আসবে না?

ঘোর কাটে বিশপাতিয়ার গলার আওয়াজে। কালকে টিভিতে মানিকের সাক্ষাৎকার দেখার পর থেকে ও মাঝে-মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে গাড়ি এসে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করছে। শুধু অডিটের কাজ নয়, আরও একটা কী যেন জট পাকিয়েছে ওর কর্মক্ষেত্রে, ওকে খুব তাড়াতাড়ি দরকার। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অন্নু গাড়িতে চাপে, মোবাইলে প্রীতকে জানিয়ে দেয় ওর ফিরতে দেরি হবে। প্রীত আজকাল প্রায়ই বলে, কিছু দিন ধরেই হিরের বাজার আর আগের মতো ভাল নেই। হিরেতেও ভেজাল ঢুকছে। কিছু তথাকথিত নামী কোম্পানি দামি জুয়েলারি সেটে নকল হিরে ঢুকিয়ে বাজারে ছাড়ছে। সেগুলো আজই হয়তো ধরা পড়বে না, তবে এক দিন এই প্র্যাকটিস হিরের বাজারে ধস নামিয়ে দিতে পারে। অন্নুর চিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাড়ি ছুটে চলে অফিসের দিকে।

চেম্বারে বসে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর জটিল একটা বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল অনিকেত, সঙ্গে ড. দেবাশিস, সিকিয়োরিটি অফিসার এক্স-সার্ভিসম্যান মি. হালদার আর চিড়িয়াখানার চিফ ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ মইনুদ্দিন সাহেব। বিষয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কী করা উচিত। কেন না কিছু দিন আগেই জর্জিয়ার বিলিসি চিড়িয়াখানায় বিধ্বংসী বন্যায় বহু প্রাণীর যেমন মৃত্যু হয়েছে, তেমনই ভালুক, হিপো, এমনকি বাঘ-সিংহের মতো হিংস্র জীবজন্তুও বন্যা-বিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে দিল্লি চিড়িয়াখানায় বিগত বছরের সেপ্টেম্বরে এক জন দর্শকের বাঘের খাঁচায় পড়ে যাওয়া এবং মারা যাওয়ার ঘটনাটাও উঠল। ডাক্তারবাবু তো জোর দিয়ে বললেন, ‘‘দু’হাজার পঁচিশ সালের পর আর এ সব নিয়ে ভাবতে হবে না, কারণ এই চিড়িয়াখানাসুদ্ধ পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বছরদশেক চালিয়ে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে!’’

সৈয়দসাহেব আবার এর মধ্যে ‘রোজ ক্যয়ামত’ এনে ফেলায় ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠল। অনিকেত ওঁদের ঝগড়া থামিয়ে মি. হালদারকে বলল, ‘‘আপনাকে যে দু’টো রোপ ল্যাডার আনতে বলেছিলাম, একটায় মোটা বেতের স্টেপ বা রাং, আর-একটা অ্যালুমিনিয়ামের— সেগুলো এনেছেন তো? এ বার আমাদের কিছু কমবয়সি ছেলে আর আপনার কয়েকজন জওয়ান গার্ডকে নিয়ে কয়েকদিন মক ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্টের প্র্যাকটিস করান, আমাকেও প্রথম দিনে ডেকে নেবেন।’’
ঝড়ের বেগে দরজা ঠেলে বড়বাবু ঢুকলেন, যেন বাঘে তাড়া করেছে, ‘‘স্যর, ইয়ে ম্যাডাম মিষ্টি পান কলা নিয়ে এক্কেবারে...’’ ওঁর কথা জড়িয়ে যায়।

অনিকেত বলে, ‘‘বড়বাবু, বসে একটু দম নিন, তার পর ঠিক করুন যে ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করবেন না ‘ম্যাডাম’ বলে। তার পর মিষ্টি পান আর কলা নিয়ে এক সঙ্গে কী করতে চান, সেটা বলুন।’’
বাকি তিন জন চোখের ইশারা করে একে-একে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। বড়বাবু যখন ঢুকেছেন, তখন ঘণ্টাখানেকের আগে অন্য কোনও আলোচনার সময় হবে না। বড়বাবু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করেন, ‘‘আপনি হলেন ডিরেক্টরস্যর, আর আমি বলছি ম্যাডাম পান সম্বন্ধে। ওঁর ডাক নাম মিষ্টি, একসময় দাপিয়ে অভিনয় করতেন, কোনও একটা চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে ডাকনামটা চালু হয়ে যায়। তবে এখন কিন্তু উনি ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী, স্যর! উনি দু’কাঁদি কলা নিয়ে আসছেন, সব্বাইকে খাওয়াতে।’’
এ বার অনিকেতের মাথায় ব্যাপারটা কিছুটা ঢোকে, তবু মজা করার জন্যে বলে, ‘‘এতে সমস্যাটা কোথায়? ভাল কলা হলে খেয়ে নেবেন, জানেন তো কলার অনেক পুষ্টিগুণ।’’

বড়বাবু নাছোড়বান্দা, ‘‘এত সোজা নয় ব্যাপারটা, স্যর! আমাদের নয়, উনি চিড়িয়াখানার ইনমেটদের কলা খাওয়াবেন। এ দিকে আপনার তো কড়া হুকুম যে, আমাদের নিজস্ব সাপ্লাই ছাড়া বাইরের কোনও খাবার এখানকার জীবজন্তুকে দেওয়া যাবে না। উনি কিন্তু কোনও কথা শুনবেন না স্যর, আমরা আপত্তি করলে আরও জোরালো কোনও প্রতাপশালীকে ফোন করবেন। কী যে করি এখন, এ দিকে আমি ছাড়া আর কারও হেডেক নেই। সব কিছু আমার উপর ছেড়ে দিয়ে বাকিরা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে।’’
কথাটা অনিকেতের কানে খট করে লাগে, বড়বাবুর লেগপুল করার লোভটা সামলাতে পারে না ও। তাই বলে ওঠে, ‘‘বাব্বা, ‘নির-’ দিয়ে কী যেন একটা বললেন? এই তো বলেন যে, কেউ নাকি কাজ করে না! তা হলে আপনার ‘নির-’ দিয়ে যে কড়াক্কড় শব্দটা বললেন তার মানে কী?’’

বড়বাবু না বুঝে ওর ফাঁদে পা দেন, জোর গলায় বলেন, ‘‘ঠিকই তো বলি স্যর, এক বার নিজে গিয়ে দেখুন না, এ টু জ়েড সবাই কেমন নীরবে আর বিচ্ছিন্ন ভাবে বসে কাজের ভান করছে! ঝামেলার কাজগুলো কিন্তু করবে এই বুড়ো বড়বাবু। অথচ রিটায়ার করলে আমিও পাব আড়াই হাজার টাকা পেনশন— আমরা যে অটোনমাস বডির কর্মচারী!’’

ওঁর ক্ষোভ বিপথগামী হচ্ছে দেখে অনিকেত সামলায়, ‘‘দেখুন আমি বলতে চাইছিলাম যে, কথাটা হবে ‘নিরবচ্ছিন্ন’, যার মানে একটানা, কোনও ছেদ না দিয়ে। অথচ আপনি এর ঠিক উল্টো মানেটা জানেন আর প্রয়োগ করেন। যাক আপনার আর চিন্তা করার দরকার নেই, আপনার থেকে আমার পেনশন তো বেশি হবে, তাই উনি এলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। দেখি, কী করা যায়!’’
বড়বাবু একগাল হাসেন, ‘‘এই তো ইডিসাহেবের মতো কথা, আমি জানি স্যর, আপনি হাতে নিলে এ সব কিচ্ছু নয় আপনার কাছে। আপনি আমার কথার যত খুশি ভুল ধরুন, আমি কিচ্ছুটি মনে করব না। আর এ বার থেকে বলব আমাদের অফিসে কেউ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে না। ঠিক আছে, তা হলে আসি, স্যর। উনি এলেই আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’

বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, স্প্রিং-ডোর ঠেলে পানপাতার মতো মুখ নিয়ে মিষ্টিদেবী গলা বাড়ান, ‘‘আসতে পারি? নমস্কার, অফিস থেকে বড়বাবু আপনার কাছেই পাঠিয়ে দিলেন, আপনি না কি আমার ছবির খুব ভক্ত!’’ বড়বাবুর উপর রাগতে গিয়েও রাগতে পারে না অনিকেত, কী করে এখানে পাঠাবেন বুঝতে না পেরে বড়বাবু সহজ চালটাই চেলেছেন। ও হাসিমুখে ওঁকে প্রতিনমস্কার করে বসতে বলে। উনি দ্রুত কাজের কথায় চলে আসেন, ‘‘দেখুন, আমি তো খুব ব্যস্ত শিডিউল মেনটেন করি। তাই বেশি সময় দিতে পারব না। ঘটনা হল, পুজো থেকে ছট পরব পর্যন্ত প্রচুর ভক্ত আমাকে নানা উপহার দেয়। তার মধ্যে কলা হল একটা আইটেম, অথচ কলা আমার দু’চক্ষের বিষ, আমার কাজের লোকেরাও কলা খেতে খেতে পাগল হয়ে গিয়েছে। তাই অনেক দিন ধরেই আমি এই মরশুমে সপ্তাহে এক-দু’দিন কালীপুর চিড়িয়াখানায় জমে যাওয়া কলা ডোনেট করতে আসি। গত বছরতিনেক এই সময়ে খুব ব্যস্ত থাকায় আসা হয়নি। এখানে বেচারা জীবগুলো তো ঠিকমতো খেতে পায় না, তাই শিবজ্ঞানে জীবপূজা হয়, আবার এ দিকে কলাগুলোরও সদ্গতি হয়। কী বলেন, ভাল ডিসিশন না?’’

এই সময়টার জন্যেই অনিকেত অপেক্ষা করছিল। খুব ইনোসেন্ট মুখ করে বলে, ‘‘বটেই তো, বটেই তো, নিশ্চয়ই খুব ভাল ডিসিশন। অবোলা জীবজন্তুকে দয়ামায়া করা আর তার চেয়েও ভাল, খাবার জিনিস নষ্ট না করা। তবে ম্যাডাম, একটা কথা জানার খুব কৌতূহল হচ্ছে, আপনি ঠিক জানেন যে, এখানে জীবজন্তুরা ঠিকমতো খেতে পায় না? মানে, এই চিড়িয়াখানায় কী-কী খাবার কতটা দেওয়া হয়, তার সম্পর্কে একটা ফার্স্টহ্যান্ড আইডিয়া আছে তো! আপনাদের তো জানা দরকার সরকারি টাকায় সরকারি জীবজন্তুরা কতটা কী খাচ্ছে না খাচ্ছে? আপনি যদি দশটা মিনিট অবোলা জীবগুলোর জন্যে স্পেয়ার করতে পারতেন, তা হলে আপনাকে কিছু দেখাতে পারতাম।’’

মিষ্টিদেবীর চোখে কৌতূহলের একটা ঝলক দেখা যায়। তবু নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়িটা দেখার ভান করে বলেন, ‘‘আসলে আমার জরুরি কাজ রয়েছে তো, আচ্ছা, পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারি, যদি তার মধ্যে আপনাদের স্টোর আর কিচেনটা দেখাতে পারেন অ্যাট আ গ্ল্যান্স!’’
অনিকেত বলে, ‘‘ইট’স মাই প্লেজ়ার, তবে আপনাকে কষ্ট করে উঠতেও হবে না। এখানে বসেই আপনি স্টোর আর কিচেন দেখবেন, সেই সঙ্গে দেখবেন কী ভাবে ওদের খাবার তৈরি করা হয়, কারা কখন সে সব তৈরি করে এই সব কিছু...’’

টেবিলে রাখা কম্পিউটারের মনিটরটা ও ঘুরিয়ে দেয় বড়বাবুর ভাষায় ’প্রতাপশালী মহিলা’-র দিকে, বলে, ‘‘ছবিগুলো আমার নিজের হাতে তোলা, সঙ্গে ডেট আর টাইমও দেওয়া আছে। দেখুন ম্যাডাম, অক্টোবর মাসে সকাল ছ’টা। চিড়িয়াখানার গেট দিয়ে ট্রাক ঢুকছে, শীত-গ্রীষ্ম একই সময়। দেখুন, বড়-বড় ঝাঁকায় কলা নামছে। বেশি সংখ্যায় সিঙ্গাপুরি আর কাঁঠালি, কম পরিমাণে মর্তমান আর চাঁপা। বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন ধরনের কলা পছন্দ করে। এত কলা গুনে নেওয়া সম্ভব নয়, সে জন্য ওজন করে নেওয়া হচ্ছে, টেন্ডার করার সময় ওজন-ভিত্তিক রেটই চাওয়া হয়।’’

মিষ্টিদেবীর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে করতে অনিকেত মাউস ক্লিক করে একের পর-এক ছবি দেখিয়ে চলে, ‘‘দেখুন, প্রচুর পাকা পেঁপে খোসা ছাড়িয়ে, বীজ ফেলে কাটছে এক জন স্টাফ, দেখে মনে হচ্ছে না, যেন পুজোর ফল কাটা হচ্ছে? ও দিকে ঝাঁকাভর্তি আপেল, সব স্টিকার লাগানো কোয়ালিটি প্রুফ হিসেবে, দেখুন ছুরি দিয়ে স্টিকারের কাছটা কেটে কেমন ফেলে দিচ্ছে যাতে জীবজন্তুর পেটে না চলে যায়। জানেন, এখানে এক-একটা জিরাফ দু’-আড়াই কেজি আপেল খায়, তাই ওদের স্কিন এত চকচকে আর ব্রিডিং ক্যাপাসিটিও অন্য সব চিড়িয়াখানার চেয়ে ভাল।’’ অনিকেত একটু থামে।
মিষ্টিদেবীর চোখদুটো আগেই বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। এ বার উনি মুখ খোলেন, ‘‘বাব্বা, এ তো রীতিমতো রাজসিক ব্যাপার! এরা তো মানুষের চেয়েও ভাল খাবার পায়! খরচও তো তা হলে অনেক হয় খাওয়াদাওয়ার পিছনে?’’

অনিকেত বলে, ‘‘খরচ হয় বইকি, বছরে প্রায় ছ’কোটি টাকা আয় হয়। তার থেকে খাবারদাবারেই খরচ হয় অর্ধেকেরও বেশি। এটা ওদের ন্যায্য পাওনা। চিড়িয়াখানায় লোকে জীবজন্তু দেখতেই আসে। সারা দিন দর্শক ওদের দেখে আনন্দ পায়। এত মানুষের হইচই, পায়ে পায়ে ধুলো উড়ে পরিবেশদূষণ আর চোরাগোপ্তা অ্যানিম্যাল টিজ়িং, এ সবের মাঝখানে ওরাই আসল কুশীলব। ওদের স্বাধীনতা আর কষ্ট স্বীকারের বিনিময়ে স্বাস্থ্যকর খাবার ওদের ন্যায্য দাবি। ফলমূল, শাকপাতা, শস্যদানা, তরিতরকারি, বিভিন্ন ডাল, তৈলবীজ, রুটি, পাঁউরুটি, দুধ, ছোটবড় নানা মাছ, কয়েক রকমের মাংস— আশিটারও বেশি আইটেমের উপর আমরা টেন্ডার করি।’’

মিষ্টিদেবী কিছু বলার আগেই একটা ঝাঁকড়াচুলো মাথা দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল, ‘‘ম্যাডাম, তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছিলেন যে, অনেক দেরি হয়ে গেল তো!’’
ম্যাডাম চোখ পাকালেন, ‘‘তোমায় সে কথা ভাবতে হবে না। যাও, গাড়ি থেকে কলার ব্যাগদু’টো নিয়ে এস। অফিসে ঢুকলে নক করে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয়, খেয়াল রাখবে।’’
লোকটা বেরিয়ে যেতে উনি বললেন, ‘‘স্যরি, আমার ড্রাইভারটা একদম ম্যানার্স জানে না। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন...’’
অনিকেত বুঝল ভবি ভোলার নয়, উনি সেই কলা এনেই ছাড়বেন। সে তাই এ বার কাজের
কথায় আসতে চাইল, ‘‘ম্যাডাম, এ বার ডিরেক্টর হিসেবে আমার কিছু বক্তব্য ছিল যে! যদি অভয় দেন তো বলি...’’
মিষ্টিদেবী হেসে ফেলেন ওর বলার ভঙ্গিতে, বলেন, ‘‘এত ক্ষণ ধরে তো টিচারের মতো বোঝালেন, এত বিনয় না করলেও চলবে। কী বলবেন, বলুন?’’
অনিকেত শুরু করে, ‘‘আপনাকে তো মোটামুটি একটা ধারণা দিলাম। স্টোর আর কিচেনের গত এক মাসের মধ্যে যে কোনও দিনের সিসিটিভি ফুটেজও দেখাব। কিন্তু কী জানেন, সব জিনিসই টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়, তার অন্যতম শর্ত হল যে, প্রতিটি জিনিসের গুণগত মানের গ্যারান্টি সাপ্লায়ারদের দিতে হবে। কোনও খাবার খেয়ে যদি কোনও প্রাণীর বিষক্রিয়া বা ও রকম কিছু হয়, তবে তার জবাবদিহি সাপ্লায়ারকে করতে হবে। আইনে জরিমানা ও জেল দুটোরই প্রভিশন আছে। জানেন, এখানে স্লটার-হাউস থেকে যে বিশাল পরিমাণ মাংস আসে, তাতে কলকাতা কর্পোরেশনের স্যানিটারি ইনস্পেক্টরের চেকিং আর সিল হয়ে তবে আসে। এ বার আপনিই বলুন, এর মধ্যে বাইরের অন্য খাবার মিশে গেলে ওই শর্তের কোনও দাম থাকবে? মানছি, আপনার আনা কলাগুলো একশো পার্সেন্ট ভাল, কিন্তু এখানে অন্য ভাবে আনা খাবারও প্রাণীদের দেওয়া হয়, এটা জানলে সেই ফাঁক দিয়ে তো দোষীরাও বেরিয়ে যাবে। সেটা কি ঠিক হবে?’’

মিষ্টিদেবী এ বার ধর্মসঙ্কটে পড়ে যান, তাঁর চিন্তা করার ফাঁকে ড্রাইভার দু’ব্যাগ কলা ঘরে রেখে যায়। সে দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘বড় মুখ করে এগুলো নিয়ে এলাম, এখন ফেরত নিয়ে যাই কী করে? অথচ আজ আপনার কথা শুনে আর চোখে দেখে কী করেই বা বলি যে, অবোলা জীবগুলোকে এ সব খেতে দিয়ে নিয়ম ভেঙে কাজ করুন!’’

অনিকেত এই টানাপড়েনের সুযোগটা নেয়।
সে মিষ্টিদেবীকে বলে, ‘‘ফিরিয়ে নিতে হবে কেন? আজ আমাদের এখানে জনাপঞ্চাশ এনসিসি ক্যাডেট ক্রাউড কন্ট্রোল করতে এসেছে, এ রকম ফ্রি সার্ভিস ওরা মাঝে মাঝে দেয়। আমরা ওদের জন্যে একটা ওয়ার্কিং টিফিন প্যাকেটের ব্যবস্থা করি। তাতে কেক-মিষ্টি থাকে, আজ সঙ্গে যদি দু’টো করে কলা দিই তা হলে ওদেরও পেট ভরবে, আপনারও মন ভরবে, কেমন?’’
মিষ্টিদেবী যেন হাতে চাঁদ পান। আনন্দে ঝলমল করে ওঠেন, ‘‘আপনি আমায় বাঁচালেন! আজকে চিড়িয়াখানা সম্বন্ধে যেমন অনেক কিছু জানলাম, তেমনই আমার সম্মানটাও বাঁচল।’’

(ক্রমশ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Literature Bengali Novel Maya Prapanchamoy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy