Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Story

শ্যামাসঙ্গীতে মুছে গিয়েছে জাতি ধর্মের বিভেদরেখা

বহু শতাব্দী ধরেই এটাই বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত ধারা। রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা দাশরথি রায়ের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছেন আলি রজা, নওয়াজিস খাঁ, মির্জা আলি হুসেন থেকে হাছন রাজা পর্যন্ত বহু মুসলিম কবি। তাঁদের শ্যামাবন্দনা ছুঁয়ে গিয়েছে মানুষের হৃদয়।

গীতিকবি: হাছন রজা এবং ডান দিকে কাজী নজরুল ইসলাম। শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা মুসলমান কবিদের মধ্যে তাঁরা ছিলেন অন্যতম ।

গীতিকবি: হাছন রজা এবং ডান দিকে কাজী নজরুল ইসলাম। শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা মুসলমান কবিদের মধ্যে তাঁরা ছিলেন অন্যতম ।

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৬
Share: Save:

জায়গাটা জনবহুল। নাম হুগনিতলা, পুরনো মফস্‌সল শহরের মাঝামাঝি। পাশের যে গলি এই মোড়টায় এসে মিশছে তার নাম চাঁদসড়ক। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। একেবারে কাছেই হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষিত হওয়া ‘গ্রেস কটেজ’। ১৯২৬ থেকে ১৯২৮, দু’বছর ওই বাড়িতেই সপরিবার বাস করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

পাড়াটার ঠিক মুখেই মূলত মুসলমান যুবকদের পরিচালনায় ‘সবাই মিলে’ ক্লাবের কালীপুজোটা হয়ে আসছে অনেক বছর ধরেই। সেই প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে পান্নালাল ভট্টাচার্যের অন্তর্লীন কণ্ঠে ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’। গানটির বিস্তার লাল-হলুদ গুঁড়ো গুঁড়ো জবাফুলের রেণু হয়ে ভাসছে হাওয়ায়। এলাকার বাতাস উতলা আজ সকাল থেকেই।

পুজো রাতে, কিন্তু বারো ফুটেরও বেশি উচ্চতার শ্যামাঙ্গী মুক্তকেশী মাতৃমূর্তি পাটে উঠেছেন গতকাল সন্ধেয়। সেই থেকে দর্শকের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। একেশ্বরবাদী মূর্তিপুজোয় অবিশ্বাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনের উদ্যোগে দেবীপুজো বলে কথা, তাই জনসাধারণের কৌতূহল একটু বেশিই। পুজো ঘিরে আশপাশের মানুষের নানা রকম ফিসফাস। ও সব নিয়ে কোনওকালেই চিন্তিত নয় ভারতবর্ষের খোলা আকাশ।

এ দিকে হেমন্তের ছোঁয়ায় মৃদু একটা শিরশিরানি বাতাসে। তদুপরি তার শরীর জুড়ে শ্যামাগানের রেণু ছড়িয়ে পড়ায় আজ সকাল থেকেই সে রোমাঞ্চিত। এই একটু আগেই সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর গানে প্রশ্ন তুলে গেলেন ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’। তার পরেই সাধক কমলাকান্তের প্রশ্নে চরাচর উঠেছে টলমলিয়ে ‘ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’। পর পরই কাজী নজরুল ইসলামের ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন, আমার দেহ-ধূপকাঠিতে’।

দিগ্বিদিকশূন্য পাবলিকের কাছে আজকাল এ এক মহাঝকমারি। এখনকার এই মেমরি কার্ড বা চিপের যুগে কার পরে যে কে গাইবেন বোঝা ভার। এলোমেলো ভাবে পান্নালালের পরেই এসে পড়ছেন স্বাগতালক্ষ্মী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরে কুমার শানু, মানবেন্দ্রর পাশেই অনুরাধা পড়ওয়াল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ঘাড়ে অমৃক সিংহ অরোরা, হীরালাল সরখেলের গায়ে গায়েই শ্রীকান্ত আচার্য। তবে এখন যে গানটি বাজছে ‘আমার শ্যামামায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’, সেটা যে অনুপ ঘোষালের গাওয়া, নির্ভুল ধরে ফেলেছে প্যান্ডেলের উল্টো দিকে মতিউরের চায়ের ঠেকে বেঞ্চিতে বসা বিশু বোস। পাশে বসা নিরঞ্জন শীল গানের টিউশনির মাস্টার। ধোঁয়া-ওঠা লিকার চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে মাস্টার যখন জিজ্ঞেস করে ওঠে, “এ গানটা কার লেখা জানা আছে?” উত্তর দিতে পারেনি বিশু। এই গানটাও নজরুলের লেখা শুনে সেতো হাঁ, আর মাস্টার যখন বলে কাজীসাহেবের লেখা শ্যামাসঙ্গীতের সংখ্যা ২২১, প্রকাশিত অপ্রকাশিত মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো, জেনে সে তো রীতিমতো থ।

মাস্টার আরও বলেন, “উনি একা নন, আরও অন্তত সাত-আট জন মুসলমান কবির কথা বলতে পারি, যাঁরা শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। গত পাঁচশো ধরে বাংলার কত মুসলমান কবিই যে শ্যামাগান, বৈষ্ণবপদ লিখেছেন তার কি ইয়ত্তা আছে!”

“বলিস কী? যেমন, শুনি শুনি, কয়েক জনের নাম শুনি...” এত ক্ষণ আনমনা বসে থাকলেও এ বার কাছে ঘেঁষে আসে সুরেন। ঘাড় ঘোরায় ধর্মনির্লিপ্ত গ্রন্থাগারকর্মী সিরাজুলও।

কর গুনে গুনে বলতে শুরু করে নিরঞ্জন, “এই যেমন ধর আলি রজা, জন্ম ১৭৫৬, মৃত্যু ১৮৩৭। নওয়াজিস খাঁ, তাঁর জন্ম আরও আগে, ১৬৩৮-এ আর মৃত্যু ১৭৬৫। আকবর আলি, জন্ম আঠারো শতকের শেষ দিকে। মির্জা আলি হুসেন, জন্ম আনুমানিক ১৭৫১-৫২ আর মৃত্যু ১৮২১-২২। মুন্সী বেলায়েত হুসেন আর সৈয়দ জাফর খাঁ অবশ্য উনিশ শতকের মানুষ। আর হাছন রাজা মানে হাছন রাজা চৌধুরীর কথা কে না জানে।”

“বাপ রে! এত জন?”

“বাংলাদেশের চট্টগ্রাম নিবাসী নওয়াজিস খাঁ-এর গানটার কথা যদ্দূর মনে পড়ছে— ‘তোমার পদে লইলুঁ শরণ।/ জননী মাই কালি/ ষড়ানন সুজননী হরপত্নী কাত্যায়নী / সর্বপূজা করিলুঁ তর্পণ।’ আর আলি রজা ওরফে কানু ফকিরের যে গানটার কথা মনে আছে ‘করুণা দধি নানান বরনী শ্যামা কালী॥/ তুমি নারায়ণ হরি তুমি হর ব্রহ্মা গৌরী/ দেবের দেবতা তুয়া মূল।/ অষ্টলোকে পরিহার রাতুল চরণে যার/ শরণ মাগে সব দেবকুল॥” এই দুটোকেই ‘মালসী’ গান বলা হয়। ‘মালসী’ হল তখনকার এক ধরনের শাক্তদেবী বন্দনা গান, কবিগানের আসরে গাওয়া হত।”

“তোর স্মৃতিশক্তির বলিহারি ভাই!” ঠোঁট থেকে চায়ের ভাঁড়টা নামায় সিরাজুল।

“এক সময় জনাব আহমদ শরীফের ‘মুসলিম কবির পদ সাহিত্য’ বইটা হাতে এসে গিয়েছিল। আর অমিয়শঙ্কর চৌধুরীর ‘মুসলিম কবির শ্যামাসঙ্গীত’। একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম এই নিয়ে, তাই মনে আছে। তবে শ্রীহট্টবাসী আকবর আলির গানটি অবশ্য ‘শলখা’— ‘মা আমারে অভয় দিলি না।/ জগদম্বা নাম ধর হর অঙ্গনা॥/ শিবশূলী ব্রহ্মময়ী জগত তারিণী তুমি।/হর বক্ষে পদ দিএ লাজ বাসনা॥’ বা ‘মায়ের চরণে নিবেদি জননী মাগো,/ হরে যারে হৃদে ধরে সে পদ কি পাবনি রে॥’ তিনি যেমন ‘হদিসের কথা’, ‘সখিনার বার মাস’, ‘হানিফার বারমাস’ লিখেছেন, লিখেছেন এমন সব শ্যামাগানও।

“আর মির্জা হুসেন আলি ছিলেন বাংলাদেশের ত্রিপুরা জেলার সবচেয়ে বড় পরগনা ‘বরদা খাল’-এর একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। তাঁর গান লেখা ভৈরবী মধ্যমানে ‘যারে শমন এমন ফিরি/ এসো না মোর আঙ্গিনাতে দোহাই লাগে ত্রিপুরারি।/ যদি কর জোর জবরি সামনে আছে জজ কাছারি।/’ আর দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাংলা গান’-এ পাওয়া যায় মুন্সী বেলায়েত হোসেনের গান ‘হৃদয় মন্দিরে দাঁড়াও।/ ত্যজে বাঁশি ধর অসি, লোল জিহ্বা অট্টহাস॥/ পীত ধড়া ত্যাগ করে বেড় কটী নরকরে,/ দৈত্যের মুণ্ড ধরে ঘুচাও ভক্তের মন মসি।’ তিনি অবশ্য ছিলেন এ-পার বাংলার কবি, বাস ছিল কলকাতা শহরের শিয়ালদহ অঞ্চলে। সৈয়দ জাফর খাঁ-র বাসও ছিল ত্রিপুরাতে, আসল নাম দরাব আলি খাঁ। তাঁর গানও বাঁধা ভৈরবীতেই, ‘কেন গো ধরেছ নাম ওমা দয়াময়ী তায়/ আমায় কি দিবে ধন, নিজে তোমার নাই বসন,/ ...সৈয়দ জাফর তরে, কি ধন রেখেছ ধরে, / সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়।’”

“আর হাছন রাজা তো বিখ্যাত কবি। লালনের মতো রবীন্দ্রনাথ হাছন রাজাকে নিয়ে লিখেছেন কত কথা। তিনি আবার শ্যামাসঙ্গীতও লিখেছেন জানতাম না তো!” সিরাজুল বলে।

“হ্যাঁ, হাছন রাজা বা হাছন উদাসের শ্যামাগান অনেক। একটা গান তো রীতিমতো বিখ্যাত— ‘হে মা করুণাময়ী কৃপাকর, মুই অধমেরে।/ কাকুতি মিনতি করি ডাকি মা তোমারে॥/ ঘিরিয়াছে মায়াজালে, এখনি মারিবে কালে।/ তুলিয়া লও গো ওমা কোলে তব সন্তানেরে॥/ পড়িয়া মা বিষম বিপাকে, হাছন রাজায় তোমায় ডাকে।/ ত্বরা করি কর রক্ষে, মা ওগো আমারে॥’ আর একটা গানের শেষটা শুনলে বুঝবি ভাবের গভীরতা, ভেদ অভেদের কী মজার খেলা— ‘কত রঙ্গ ডঙ্গ কর দেখি তুমার নাচানাচি/ তুমি ঘরে তুমি বারে তুমিহি সবার অন্তরে॥/ কে বুঝিতে পারে পরবু তোমার পেছাপেছি।/ হাছন রাজার এই উক্তি সকলেই তুই মা শক্তি/ তুমি আমি ভিন্ন নহি একই হৌয়েছি।’

বিশু বোসের হাঁ আজ যেন বন্ধ হতেই চাইছে না। কী বলা উচিত বুঝে উঠতে না পেরে শেষে বলে ওঠে, “আচ্ছা, বাঙালি মুসলমান কবিরা তো এত সব শাক্তগান বৈষ্ণবগান লিখেছেন দেখছি, তা উল্টোটাও নিশ্চয়ই হয়েছে? বাঙালি হিন্দু কবিরাও নিশ্চয়ই লিখেছেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে?”

সিরাজুল বলে, “তা লিখবেন না কেন। আমি যত দূর জানি ইন্দ্রনারায়ণ নামের এক কবি লিখেছিলেন ‘যোগ কালন্দর’ বলে এক কাব্য। রাধাচরণ গোপ লিখেছিলেন ‘বড় জঙ্গনামা’। কারবালার যুদ্ধ নিয়ে এই কাব্যের লেখকও আঠারো শতকের। আর এক জনের কথা জানি, তিনি মালী ধর্মদাস, তিনি লিখেছিলেন ‘হুসেন পর্ব’ নামক কাব্য। ইনিও অষ্টাদশ শতকের মানুষ।”

“তবে হিন্দু কবিদের তুলনায় মুসলমান কবিরাই পরধর্ম নিয়ে কাব্য গান বেশি লিখেছেন। আর শ্যামাগানের ক্ষেত্রে তাঁদের ভাবের এই গভীরতা আর আর্তি বিস্ময়কর। আসলে হিন্দু হোক বা মুসলমান, পুরো বাঙালি জাতিটাই এমন মাতৃভাবে আপ্লুত, শ্যামাগান যেন তারই সহজাত প্রকাশ।”

আজ ছুটির দিন, তাই বিশেষ তাড়া নেই। তিন বন্ধুর এই সব আলোচনা যখন চরমে উঠছে তখন ক্লাবের মাইক বাতাসে ছড়াতে শুরু করেছে দাশরথি রায়ের সেই আশ্চর্য গীতিকাব্য, ‘দোষ কারও নয় গো মা/ আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।/ আমার ধর্মাধর্ম হল কোদণ্ডস্বরূপ/ পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ/ সে কূপে বেরিল কাল রূপ জল/কালো মনোরমা, মা...”।

গানের ‘মা’ শব্দের তীব্র অনুরণন উঠছে আকাশ ফুঁড়ে। মাটির পৃথিবী ছুঁয়ে থাকলেও সঙ্গীতময় এই দেশের বাতাস এই উৎসারকেই চিরকাল ইষ্ট মেনেছে, জাতি ধর্ম ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে বিশুদ্ধ এই শিহরনই তার পরম ঈশ্বর।

গ্রন্থঋণ: মুসলমান কবির পদ সাহিত্য - আহমদ শরীফ; মুসলমান কবির শ্যামাসঙ্গীত – অমিয়শঙ্কর চৌধুরী; বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত –অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়; বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Kaji Najrul Islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy