ছবি: কুনাল বর্মণ
সবাই এই নদীকে বলে পতিতপাবনী। নদীটির শরীর দিয়ে ধমনীর প্রবাহের মতো যে জল বয়ে যায় তার অদ্ভুত গুণ। পৃথিবীর অন্য কোনও নদীর এ গুণ নেই। নদীর জল নিজেই নিজের নোংরা পরিষ্কার করে নিতে সক্ষম। আর সে কারণেই নদীটিকে অবিরল বইতে দিতে হবে। নদীটির জল নির্মল হওয়ার গুণ পায় তার উৎস থেকে একশো কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়। এই ক্ষমতা দেয় সেই এলাকার মাটি। এটাই গঙ্গার এক্স-ফ্যাক্টর। যাকে অনেক বিজ্ঞানী বলছেন গঙ্গার নিজস্বতা, কিংবা গঙ্গার মহিমা,” কথাগুলো বলে চুপ করলেন পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেবানন্দ স্বরূপ ভার্গব। এটি তাঁর পিএইচডি-র ফাইনাল সেমিনার। কানপুর আইআইটি-র সেমিনার হল কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ। তার পরেই তুমুল হাততালি। ঘটনাটা ১৯৭৮ সালের। তার পর আশির দশকে গঙ্গার উপর তাঁর এই গবেষণা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায়।
গঙ্গার নিজস্বতা
দেবানন্দ ভার্গবের গবেষণার ‘ফাইনাল সাবমিশন’-এর আগেই তাঁর রিসার্চের কো-গাইডের পদ থেকে সরে আসেন কানপুর আইআইটি-র এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক গুরুদাস আগরওয়াল। গঙ্গার উপর বিশ্বাস রেখেই জীবন উৎসর্গ করলেন তিনি। গঙ্গার জন্য সন্ন্যাস নিলেন, নাম হল জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ। এই মানুষটি এক সময় ভারতের জাতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদস্য সচিব ছিলেন। গঙ্গার নিজস্বতা বাঁচানোর লড়াইয়ে শুরু করেছিলেন আমরণ অনশন। দাবি করেছিলেন, গঙ্গার স্বনির্মলকরণ-ক্ষমতা লুকিয়ে আছে নদীর উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখে।
তবে সেই উৎসের খোঁজ কিন্তু সহজে পাওয়া যায়নি। নদীর উৎসের রহস্য উন্মোচনের জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক।
উৎস সন্ধানের ইতিবৃত্ত
উৎসের রহস্য সন্ধানের ইতিহাস উন্মোচিত করেছিল একটা বাক্স। সেটি পাওয়া গিয়েছিল ১৯০৬ সালের সাহেবি আমলের কলকাতায়। জনৈক পাদরি কলকাতার সেন্ট পল’স চার্চের সেই প্রাচীন পরিত্যক্ত বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এসেছিল আন্তোনিয়ো দ্য মন্সারেট-এর ভ্রমণপথের বিবরণ ও তাঁর আঁকা একটি মানচিত্র। খুলে গেল ইতিহাসের দরজা। মন্সারেট ছিলেন এক জেসুইট পাদরি, যিনি ১৫৭৯ সালে আকবরের রাজসভায় আসেন। বাদশাজাদা মুরাদের গৃহশিক্ষক ছিলেন তিনি। সম্রাট আকবরের সঙ্গে তিনি কাবুলে গিয়েছিলেন। মন্সারেটের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি মনে করতেন মানস সরোবর থেকে গঙ্গার উৎপত্তি। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই সরোবরের তীরে কিছু খ্রিস্টান ধর্মালম্বী মানুষ বাস করেন।
প্রথম সন্ধানীরা
রহস্য উন্মোচনের প্রথম ঝুঁকি নিয়েছিলেন এক পর্তুগিজ পাদরি। নাম আন্তোনিয়ো দ্য আঁদ্রেদ। সময়টা ১৬২৪ সাল। বছর চুয়াল্লিশের আঁদ্রেদ তখন দিল্লিতে থাকতেন। দিল্লিতে তখন ঠান্ডার প্রকোপটা কমেছে। এপ্রিল-মে মাস নাগাদ বেরিয়ে পড়লেন গঙ্গার প্রবাহ অনুসরণ করে উৎসে পৌঁছবার লক্ষ্যে। পাদরি আঁদ্রেদও বিশ্বাস করতেন, মানস সরোবর থেকে গঙ্গার জন্ম। তিনি জানতেন সে পথ অতি দুর্গম। এই পথে তিনি সঙ্গে নিলেন এক সহকারীকে, নাম মার্কুইস। আর দু’জন খ্রিস্টান অনুচর ও কয়েক জন কুলি। এই যাত্রাপথে আঁদ্রেদ নিয়েছিলেন হিন্দু তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশ। পরনে আলখাল্লা আর মাথায় পাগড়ি। তার উপর দাড়িগোঁফ লাগিয়ে নিজের মুখের চেহারাটাকেও পাল্টে ফেলেছিলেন।
অলকানন্দা, মন্দাকিনী ও ভাগীরথীর মিলিত ধারা সমতলে গঙ্গা নামে পরিচিত। অলকানন্দা নদী আসছে বিষ্ণুতীর্থ বদ্রীধাম হয়ে। তীর্থযাত্রীরা সবাই এই পথেই চলেছেন। তিনিও তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মিশে গেলেন। বিস্ময়ভরা চোখে দেখলেন, প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে পাথরের উপর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে বদ্রীনাথের পথে চলছেন তীর্থযাত্রীরা। তাঁদের পথ দেখাচ্ছেন ছড়িদারেরা। মুখে তাঁদের একটাই ধ্বনি ‘জয় বদ্রীবিশাল কী’!
যেখানে রক্ষীর ভয়
আঁদ্রেদও সেই তীর্থযাত্রীদের অনুসরণ করতে করতে পৌঁছে গেলেন যোশীমঠে। এখানে গঙ্গা এসে মিশেছে অলকানন্দায়। এই পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘ্নে পৌঁছলেন পাদরি আঁদ্রেদ। মন্দিরকে বাঁ দিকে রেখে তিনি সোজা পথ ধরে পৌঁছে গেলেন মানা গ্রামে। এই এলাকা তখন শ্রীনগর রাজার অধীন। খ্রিস্টানদের সেই পথে ছিল প্রতিবন্ধকতা। সে কথা জানতেন আঁদ্রেদ। একটু ভয়ে ভয়েই ছিলেন তিনি। রোজ়ারিটা বুকের কাছে চেপে ধরে পরমপিতা ঈশ্বরকে স্মরণ করে সে যাত্রায় রক্ষা পেতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা গন্তব্যের কাছাকাছি এসে অতি উৎসাহী হয়ে পড়ে। ফলে বিনা অনুমতিতে সীমান্ত পেরোনোর সময় রাজার সীমান্তরক্ষীদের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান তাঁরা।
জামিন রইল বন্ধু
এতখানি কঠিন পথ অতিক্রম করার পর এই যাত্রাকে বিফলে যেতে দিতে চাইছিলেন না আঁদ্রেদ। অনেক অনুরোধের পর একটা রফা হল রাজার সঙ্গে। অভিযাত্রী দলের সঙ্গে থাকা ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি মার্কুইসকে রাজার কাছে জামিন হিসেবে গচ্ছিত রাখা হল। এর পর স্থানীয় গ্রাম থেকে এক জন পথপ্রদর্শককে নিয়ে দু’জন সঙ্গী-সহ অলকানন্দার উৎস সন্ধানের দিকে অগ্রসর হলেন আঁদ্রেদ। পথ অত্যন্ত বন্ধুর। পথশ্রমে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিলেন তাঁরা। মানা পেরিয়ে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আঁদ্রেদ দেখেছিলেন এক বরফের রাজ্য। সেই বরফগলা জলেই তৈরি হচ্ছে অলকানন্দা। আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে গঙ্গা। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, আঁদ্রেদ মানস সরোবর দেখে এসেছেন। আসলে তিনি যা দেখেছিলেন, তা একটা হিমবাহ, যা থেকে অলকানন্দা নামের একটি নদীর জন্ম, যে নদী বদ্রীনাথের পাশ দিয়ে প্রবাহিতা।
রাজার আতিথেয়তা পেলেও মার্কুইসের মন ভাল ছিল না। আঁদ্রেদ ফিরে না এলে মার্কুইস কারারুদ্ধ হবেন। একটা করে দিন যায়, মার্কুইস চিন্তায় কুঁকড়ে যান। তবে কিছু দিন পর আঁদ্রেদ ফিরে এলেন শ্রীনগরের রাজার কাছে। মার্কুইসের ধড়ে প্রাণ এল। বিশ্বাস ভঙ্গ না করায় আঁদ্রেদের সঙ্গে শ্রীনগরের রাজার ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠল। এ বার রাজার আনুকূল্যে সঙ্গী মার্কুইসকে সঙ্গে নিয়ে মানা গিরিপথ অতিক্রম করে তিব্বতের সাপারাঙ পর্যন্ত পৌঁছলেন আঁদ্রেদ। রাজার অনুগ্রহ পেয়ে সেখানে গড়ে তুললেন খ্রিস্টধর্মীয় মিশন। মিশন গড়েই আঁদ্রেদ থামতে চাইলেন না, চেপে বসল আরও দূর পর্যন্ত খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নেশা। তাই তিনি রুডক ও তাংগুট হয়ে চিনে যান। সেখানে বেশ কিছু দিন কাটিয়ে আঁদ্রেদ গোয়ায় ফিরে আসেন ১৬৩০ সালে।
অপূর্ণ ইচ্ছে অধরাই
আঁদ্রেদ বেরিয়ে পড়লেন। তখন বন্ধুর সাপারাঙ-এ প্রতিষ্ঠিত মিশনের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন মার্কুইস। ক্রমশ ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠল। সাপারাঙের রাজার সঙ্গে লামাদের সংঘাত বাধল। লামাদের হাতে বন্দি হলেন সাপারাঙের রাজা। পাদরিদের ধর্মপ্রচারকে লামারা ভাল চোখে দেখছিল না। কাজেই মার্কুইস-সহ অন্যান্য পাদরি বন্দি হলেন লামাদের কাছে। ভেঙে পড়ল মিশনের কাজকর্ম। বেশ কিছু দিন পর শর্ত সাপেক্ষে মার্কুইস-সহ বাকি পাদরিদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর সকলে ফিরে আসেন ভারতে। তত দিনে আঁদ্রেদের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর ছ’বছর পর মার্কুইস বন্ধুর অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে বেরিয়ে পড়লেন তিব্বতের উদ্দেশে, খ্রিস্টীয় মিশন খোলার চেষ্টায়। তিব্বতে পৌঁছনোর পর সেই দেশের রাজার হাতে বন্দি হন মার্কুইস। তাঁর উপর প্রবল অত্যাচারের খবর দূত মারফত দিল্লির দরবারে পাঠানো হয়। সেই সময় দিল্লি-দরবার মার্কুইসের জন্য কিছুই করেনি। শেষ পর্যন্ত মার্কুইসের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অলকানন্দা দিয়ে বয়ে গেল অনেক জল।
ঘুরপথের ভুলভ্রান্তি
ইটালির যুবাবয়সি ধর্মযাজক দেসিদ্রির বরাবরের ইচ্ছে ভারত দেখার। পোপের অনুমতি নিয়ে তিনি ভারতে এলেন, সময়টা ১৭১২ সাল। প্রথমেই তিনি এলেন গোয়ায়। সেখানে কাটালেন একটা বছর। গোয়ায় থাকার সূত্র ধরে তিনি জানতে পারেন আঁদ্রেদের ভ্রমণের কথা। ধর্মযাজক দেসিদ্রি বছরখানেক গোয়ায় অতিবাহিত করে সুরাত হয়ে দিল্লির পথে যান। দেসিদ্রির ইচ্ছে ছিল মানস সরোবরের কাছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের খুঁজে বার করা। দেসিদ্রি ছিলেন অতীব সুদর্শন। কাজেই খুব অল্প সময়েই তিনি মোগল রাজদরবারে থাকা এক পর্তুগিজ সুন্দরীর নেকনজরে পড়ে যান। যার ফলে রাজকীয় সাহায্য পেতে কোনও রকম অসুবিধে হল না।
সেই সময় সেই স্থানে গঙ্গার উৎস সন্ধানের ইচ্ছে মনে লালন করে যাচ্ছিলেন আর এক জন পর্তুগিজ ধর্মযাজক। তাঁর নাম ইমানুয়েল ফ্রায়ার। দেসিদ্রির ইচ্ছের কথা কানে আসতেই এক মুহূর্ত নষ্ট করলেন না ইমানুয়েল। ১৭১৪ সালে ইমানুয়েলের নেতৃত্বে দেসিদ্রি রওনা দিলেন মানস সরোবরের উদ্দেশে। পথ ভুল করে অভিযাত্রী দল পৌঁছে গেলেন ঝিলম নদীর ধারে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে। সামনে পিরপঞ্জাল পাহাড়। তাঁরা ভাবলেন, পাহাড় পেরোলেই বুঝি পৌঁছনো যাবে মানস সরোবরে। কঠিন পথ অতিক্রম করে তাঁরা পৌঁছলেন লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে। এর মধ্যে এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। শেষ অবধি তাঁদের আর মানস সরোবরে পৌঁছনো হল না।
জ্যামিতিবিদ লামারা
গঙ্গার উৎস সন্ধানের ইচ্ছে ছিল অনেকের মনেই। চিনা সামরিক দলের এক সদস্য তিব্বতের একটি মানচিত্র রচনা করেন ১৭১১ সালে। পিকিং-এর অধিবাসী মানচিত্রবিশারদ ফাদার রেগিজের কাছে সেই মানচিত্র পাঠালে অনেক ত্রুটি তাঁর চোখে ধরা পড়ে। ত্রুটিপূর্ণ মানচিত্রকে নির্ভুল করতে উদ্যোগ নেন চিন-সম্রাট কাংহিক। তাঁর এই উদ্যোগ ছিল প্রশাসনিক কাজের সুবিধের জন্য। সেই উদ্দেশ্যে দু’জন লামাকে সম্রাট দায়িত্ব দেন। এই দুই লামার জ্যামিতি ও গণিতশাস্ত্রে ছিল বিলক্ষণ ব্যুৎপত্তি। তাঁদের উপর নির্দেশ ছিল সি-নিন থেকে লাসা হয়ে গঙ্গার উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত ভাবে পরিভ্রমণ করার, আর মানচিত্রের ভুলগুলো সংশোধন করে দেওয়ার। সম্রাটের আশা অনুযায়ী কাজও হল। তবে তা সম্পূর্ণ নির্ভুল হল না।
খ্রিস্টান মিশনারিদেরও ধারণা ছিল, গঙ্গার উৎস মানস সরোবর। সেই মতো মিশনারি অভিযাত্রী দল মানস সরোবরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেও বরফে ঢাকা পাহাড়ের জন্য তারা সরেজমিনে মানস সরোবরকে দেখতে পায়নি। ত্রুটিপূর্ণ মানচিত্র প্রকাশের পর অন্যান্য মিশনারিরা অনুভব করলেন, মানচিত্রটির সত্যতা নিরূপণ করা দরকার। আর সেই জন্যই লামাদের তৈরি মানচিত্র সংশোধনের দায়িত্ব এসে পড়ে তখনকার নামী মানচিত্রবিদ অ্যানভেলিসের উপর। অ্যানভেলিস সাহেব ভাবলেন, লামাদের দেখানো গঙ্গার উৎস থেকে প্রকৃত উৎসস্থল আর একটু উত্তরে হওয়া উচিত ছিল। শুধুমাত্র সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি গঙ্গার উৎস দেখিয়েছিলেন ৩৬ ডিগ্রি উত্তরে। এই মানচিত্রটি প্রকাশিত হয় ১৭৩৩ সালে। ১৭১১ সাল থেকে ১৭৩৩ সাল পর্যন্ত যে মানচিত্রগুলো তৈরি হল, সব ক’টিতেই গঙ্গার উৎস দেখানো হল মানস সরোবর। ভুল পুরোপুরি শুধরোল না অ্যানভেলিস সাহেবের হাতেও।
ভূগোলের জনক রেনেল
কেটে গেল আরও তিন দশক। তখন বাংলার বড়লাট ভ্যান্সিটার্ট সাহেব। তাঁর আমলে ভাগ্য অন্বেষণের জন্য ভারতে এলেন জেমস রেনেল। মার্কিন সাহেব রেনেল ছিলেন এক জন সার্ভেয়র ও মানচিত্রবিদ। এই ম্যাপসাহেবকে ভারতের ‘ভূগোলের জনক’ বলা যায়। টানা চার বছর (১৭৬৩ থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত) অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষ করেছিলেন ভারতের গঙ্গাপথের প্রায় নির্ভুল জরিপের কাজ। রেনেল গঙ্গার উৎসকে নিরূপণ করার জন্য মূলত ভরসা করেছিলেন লামাদের তৈরি করা মানচিত্রের উপরেই, যা জনশ্রুতিনির্ভর। সেই কারণে তাঁর মানচিত্রেও গঙ্গার উৎস দেখানো হল মানস সরোবর। রেনেলের এই মানচিত্রটি প্রকাশিত হয় ১৭৯০ সালে।
১৭৮৪ সালে ভারতীয় মিশনারি টিয়েফেনথালার অনুভব করলেন লামাদের সংগৃহীত তথ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। তিনি উদ্যোগী হলেন এই সব তথ্য সঙ্কলনের জন্য। সংগৃহীত এই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই আর এক মানচিত্রকার প্যারান সাহেব একটি মানচিত্র তৈরি করলেন। প্যারান তাঁর উত্তরসূরিদের ভুলত্রুটি মাথায় রেখে একটা নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই মানচিত্রে তিনি দেখাচ্ছেন, রাক্ষস তাল ও মানস সরোবর, দুটোই একটি জলধারার সঙ্গে যুক্ত। এই ধারাকেই স্থানীয় তিব্বতীরা ‘গঙ্গা চু’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিব্বতী ভাষায় ‘চু’ মানে নদী।
গঙ্গার বদলে সরযূ
মানচিত্রবিদ কোলব্রুক সাহেব সার্ভেয়র হিসেবে যোগদানের পর আর গঙ্গার উচ্চগতি জরিপের কাজে নতুন করে টাকা খরচ করতে রাজি ছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোলব্রুক সাহেবও ছাড়ার পাত্র নন। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে অনুমতি আসে। ১৮০৭ সালে কলকাতা অফিসের সব দায়িত্ব গার্স্টিন সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে কোলব্রুক রওনা হলেন আদিগঙ্গার পথ ধরে। তিনি সুন্দরবনের পথ ধরে ঢাকা পৌঁছন। তার পর সেখানে বারো দিন কাটান। এই ফাঁকেই তিনি নবাবের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ সেরে নেন। তার পর তাঁরা রওনা দিলেন নৌকোয় করে গঙ্গার ‘আপস্ট্রিম’-এ। রাজমহলের পথ ধরে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত কোলব্রুক সাহেবের জরিপের কাজ শেষ হল। তার পরেও ব্রহ্মঘাটের ষাট মাইল পর্যন্ত জরিপ শেষ হল। কিন্তু তার পর আর এগোনো গেল না। কারণ সে দিকে ছিল গভীর ও দুর্ভেদ্য জঙ্গল। কাজেই কোলব্রুক সাহেব বক্সার গাজীপুর হয়ে সরযূ নদী সমীক্ষা করতে ঢুকলেন। সমীক্ষা শেষ করে গঙ্গার পথ ধরে তিনি ফিরে এলেন বারাণসী। গোমতী নদীর পথ ধরে কোলব্রুক সাহেব এগোতে পারলেন না। নদীতে জল প্রায় ছিলই না, ফলে নৌকো চলছিল না। অতঃপর তিনি গঙ্গার পথ ধরে পৌঁছলেন কানপুর। সেখান থেকে শুরু হল নদীর পাশ ধরে হাঁটা। কোলব্রুক সাহেবের সঙ্গে ছিল চারটে হাতির পিঠে লোকজন, পাঁচটা উটের পিঠে লটবহর, একটা পালকি, বারো জন মোটবাহক, তাঁবু খাটানোর বারো জন লস্কর, বারো জন কুলি আর পঞ্চাশ জন নিরাপত্তারক্ষী। কোলব্রুক সাহেব সার্ভের কাজে তাঁর পরিবারকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। সার্ভে করতে করতেই কার্টোগ্রাফার কোলব্রুক সাহেব খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার আগে কোলব্রুকের ইচ্ছে ছিল গঙ্গার উচ্চ প্রবাহের জরিপের কাজটাকে নির্ভুল ভাবে শেষ করার। কোলব্রুক সাহেবের অসুস্থতার খবর পাঠানো হয় ওয়েব সাহেবের কাছে। দশম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির লেফটেন্যান্ট ছিলেন ওয়েব সাহেব। টিকোলো নাক, চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল আর চুল পেছনের দিকে টান-টান করে আঁচড়ানো। সামরিক কর্মচারী হলেও জরিপে তাঁর দক্ষতা ছিল। সে কথা জানতেন কোলব্রুক সাহেব। সার্ভের ব্যাপারে ওয়েব সাহেবকে কোলব্রুক ভরসা করতেন। কোলব্রুক সাহেবের অসুস্থতার খবর পেয়ে ওয়েব সাহেব ছুটে এলেন, তাঁর পরিবারকে লখনউয়ে রেখে। কোলব্রুক সাহেবের স্থানে তাঁকে অভিষিক্ত করা হল। লখনউ থেকেই তিনি সরাসরি বরেলী পৌঁছলেন। যুক্ত হলেন জরিপ দলের সঙ্গে। জরিপ করলেন সরযূ নদীর আপস্ট্রিম-এর ধারাকে।
সাহেবত্রয়ীর আপ্রাণ চেষ্টা
অসুস্থ কোলব্রুকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ওয়েব সাহেব সঙ্গে আরও এক জনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নাম ক্যাপ্টেন ফেলিক্স রেপার। সেই সময় এই অঞ্চলটি ছিল নৈরাজ্যের আখড়া। কাজেই সার্ভেয়র বাহিনীর নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হলেন ক্যাপ্টেন জন হিয়ারসে। ওয়েব-রেপার এবং হিয়ারসে— এঁদের তিন জনেরই ছিল দুঃসাহসিক অভিযানের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। ওয়েব জানতেন, কোলব্রুক সাহেব রেনেলের গঙ্গার উৎস বর্ণনাটি একেবারেই পছন্দ করেননি। পরে ১৮১০ সালে কোলব্রুক সাহেবের যে লেখাটি ‘এশিয়াটিক রিসার্চার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়, সেখানে তিনি সে কথার আভাস দিয়েছিলেন। কাজেই কোলব্রুক সাহেবের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতেই ওয়েব-রেপার-হিয়ারসে, তিন সাহেব ১৮০৮ সালের এপ্রিল মাসে বেরিয়ে পড়লেন গঙ্গার উৎস সন্ধানে।
হরিদ্বার থেকে শুরু হল ওয়েব-রেপার-হিয়ারসে যাত্রা। বাকি অভিযাত্রীদের মতো এ বার তাঁরা অলকানন্দার পথে আর গেলেন না। বেছে নিলেন গঙ্গার তীরবর্তী পথ। উত্তরকাশী থেকে টানা সাত দিন হেঁটে তাঁরা প্রথমে পৌঁছলেন ভাটোয়ারিতে। এখান থেকেই শুরু হল পাথরের চড়াই পথ। অনেক নীচে গঙ্গা এসে তীব্র গতিতে ধাক্কা মারছে পাথরের গায়ে। আওয়াজটা অনেকটা উঁচু পর্যন্ত ভেসে আসছে। পাহাড়ের গায়ের পাথরগুলো যেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পথ চলা অসম্ভব হয়ে পড়ল। তার উপরে সকলেই অসম্ভব ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। ফলে তাঁদের যাত্রা আর সম্পূর্ণ হল না।
চেনা হল গঙ্গোত্রী
ওয়েব-রেপার-হিয়ারসে’র অসম্পূর্ণ যাত্রার কথা জানতে পেরেছিলেন জেমস বেলি ফ্রেজ়ার। তিনি গিয়েছিলেন তাঁর ভাই, দিল্লির কোম্পানির রেসিডেন্টের সহকারী উইলিয়ামের সঙ্গে দেখা করতে। তার পর দিল্লি হয়ে ১৮১৩ সালে তিনি আসেন কলকাতায়। ফ্রেজ়ারের জন্ম স্কটল্যান্ডে। পেশা তাঁর নানা রকম হলেও নেশা ছিল ছবি আঁকা। কলকাতায় এসে তিনি সৈন্যদলে নাম লেখান। নেপালের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে তিনি হিমালয়ে যান। আর যুদ্ধের পর গঙ্গার উৎস খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। মূল উদ্দেশ্যটা ছিল ছবির উপাদান সংগ্রহ। ভৈরোঁঘাটি পার হয়ে তিনি পৌঁছলেন গঙ্গোত্রীতে। সামনে দেখলেন, কেদারগঙ্গা এসে মিশছে গঙ্গায়। এর পর সেই জল এক গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই গিরিখাতের উপর একটা ছোট্ট সেতু ছিল। সেতুর ও পারে ছিল ছোট্ট গঙ্গা মন্দির। তার কয়েক বছর আগে গোর্খা সেনাপতি অমর সিংহ থাপা এই গঙ্গা মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। গঙ্গোত্রী পৌঁছলেও গোমুখ পর্যন্ত যেতে পারেননি ফ্রেজ়ার।
শেষ পর্যন্ত গোমুখ দর্শন
এই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। ভারতীয় জরিপ বিভাগে কাজ করতেন ক্যাপ্টেন হজসন। তার ওপরে দায়িত্ব পড়ে হিমালয়ের কিছু অংশ ও নদীগুলো পর্যবেক্ষণ করে তথ্য লিপিবদ্ধ করার। এই সময় তাঁর মনে পড়ে গঙ্গার উৎসমুখের সন্ধান অসমাপ্ত থাকার কথা। ১৮১৭ সালে গঙ্গাকে অনুসরণ করে যাত্রা শুরু করেন। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র বিদেশি, যিনি গঙ্গোত্রী পেরিয়ে গোমুখে পৌঁছন। তিনি দেখলেন, গোমুখ গুহার চার দিকে বরফের স্তূপ। পর পর সাজানো বরফের উপর দিয়ে জলের ধারা বইছে। চারিদিকে তুষারশৃঙ্গ ঘিরে রয়েছে এক-দেড়শো মাইল বিস্তৃত তুষারভূমি। এই তুষার সাদা নয়, নোংরা কাদা-মাখা। এখানে সেখানে বিরাট গর্ত। সেই গর্তগুলো কত গভীর, বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। হজসন সাহেব তাঁর বিবরণীতে লিখছেন, “গঙ্গার উৎস এই গোমুখের উচ্চতা সম্ভবত ১২৯৪১ ফুট। গোমুখ হিন্দুদের কাছে পরম পবিত্র তীর্থ। কারণ পবিত্র নদী গঙ্গার জন্ম এখানেই।”
আবার গোমুখকে খোঁজা নিয়ে একটি গল্পও আছে। বহু দিন আগে এক মেষপালক হিমালয়ের কোলে মেষ চরাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি মেষ দলছুট হয়ে যায়। আশপাশে খোঁজার পর কোথাও না পেয়ে মেষপালক পাহাড়ের উপরে মেষটিকে খুঁজতে যান। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে একটি গুহা, যার মুখটি অনেকটা গরুর মুখের মতো। সেই দিন থেকেই ভাগীরথীর উৎপত্তিস্থল গোমুখ নামে পরিচিত হয়। তবে সেই দিনের গোমুখের চেহারা আর আজকের গোমুখের চেহারায় অনেক তফাত। হিমালয় জুড়ে ভূমিকম্প, নানা সময়ের পাহাড়ি ধস আর উষ্ণায়নের থাবায় পাল্টে গিয়েছে গোমুখের চেহারা।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের নতুন কমপ্লেক্স আর গঙ্গা-আরতি সারা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। তাতে পতিতপাবনী গঙ্গা দূষণমুক্ত হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের নানা সময়ের রিপোর্ট এমনই কথা বলছে। সারা দেশে রব উঠেছে গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য হিমালয় নীতি তৈরি করার। আর ভারতের পার্লামেন্টে বহু দিন ধরে ঝুলে থাকা ‘গঙ্গা আইন’-কে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হল, কিন্তু সেই আশ্বাস ফলপ্রসূ হল না। কুম্ভস্নানকে সামনে রেখে পৃথিবীর সামনে রাজনৈতিক ভাবে পোস্টার-ব্যানারে দেখানো হয়, গঙ্গা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে অনেক গুণ। বাস্তবে গঙ্গা পরিষ্কারের স্বপ্ন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy