Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

বৃক্ষ ও যক্ষপুজোর অন্তরালে প্রান্তিক ইতিহাসের আখ্যান

গৌতম বুদ্ধের বোধিলাভের আগে থেকেই পূজিত হত বোধিবৃক্ষ। কুষাণ আমলের নিদর্শনে কদম গাছ যেমন কৃষ্ণের সঙ্গে, অশোক গাছ তেমনই শিবের সঙ্গে একাত্ম। আজও বাংলায় মনসাদেবীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সিজবৃক্ষ। বেদের ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ পর্যায়ে আবির্ভাব যক্ষদের। তারা বন ও গ্রামের অধিদেবতা। সিন্ধু-পরবর্তী ভারতের প্রাচীনতম মূর্তিগুলি যক্ষ-যক্ষীদেরই।

picture of sculpture.

শিল্পরূপ: সাঁচী তোরণে বোধিবৃক্ষের ভাস্কর্য। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)

সুদীপ্ত পাল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৩
Share: Save:

বৌদ্ধ শিল্পকলার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলিতে দেখা যায়, ভক্তরা যাকে বুদ্ধ রূপে উপাসনা করত, সেটি একটি গাছ। বোধিবৃক্ষ। এই দৃশ্যায়ন সাঁচীর তোরণ আর ভারহুতের প্রাচীর দু’জায়গাতেই দেখা যায়। দ্বিতীয় থেকে প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নির্মিত এই দৃশ্যগুলিতে গাছকে কেন্দ্র করে বুদ্ধের উপাসনা হচ্ছে, কিন্তু অন্য ভাবে দেখলে বুদ্ধকে কেন্দ্র করে আসলে গাছটিরই পুজো হচ্ছে। গাছ এখানে কেন্দ্রীয় বস্তু, আর বুদ্ধ অনুপস্থিত। প্রথম শতাব্দীর আগে বুদ্ধের চিত্রণ কোথাও পাওয়া যায়নি। শক ও কুষাণদের হাত ধরে বুদ্ধের রূপনির্মাণ শুরু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পাঁচ শতক পরে। আরও পরে গুপ্তযুগে সাঁচীতে বুদ্ধমূর্তি যোগ হয়। অর্থাৎ সাঁচী-ভারহুতে বুদ্ধের অনুপস্থিতিকে পূরণ করছে একটি গাছ। এ তো গেল বোধিবৃক্ষের ভাস্কর্যরূপ, এ বার আসা যাক বুদ্ধগয়ায় যেখানে বাস্তবে ওই গাছটি ছিল এবং আজও আছে, তার প্রসঙ্গে। বোধিবৃক্ষ হল সেই অশ্বত্থ গাছ যার নীচে নির্বাণ লাভ করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধগয়ার মূল মন্দির অর্থাৎ মহাবোধি মন্দির তৈরি হয়েছে বোধিবৃক্ষটিকে ঘিরেই। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থে বুদ্ধমূর্তি নয়, বরং একটি বৃক্ষকেই মানুষ উপাস্যরূপে পুজো করত। এর ভিতরে আরও গভীর ইতিহাস নিহিত আছে।

গয়ায় নৈরঞ্জনা নদীর কাছে একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে ধ্যান করতে বসেছিলেন সিদ্ধার্থ। তখনও তাঁর নির্বাণ লাভ হয়নি। নৈরঞ্জনা নদীর অন্য পারে সেনানী গ্রামে থাকতেন সুজাতা। সুজাতার পরিচারিকা সুজাতাকে খবর দিল,যে গাছটিকে সুজাতা এত দিন সন্তানলাভের আশায় পুজো করে এসেছেন, সেই গাছের দেবতা আজ মনুষ্যরূপ ধরে স্বয়ং গাছের নীচে বসে আছেন। সুজাতা পায়েসের বাটি হাতে এলেন বৃক্ষদেবতাকে অর্পণ করার জন্য। এসে বুঝতে পারলেন ইনি মানুষ। বৃক্ষদেবতার জন্য তৈরি অর্ঘ্য তিনি সিদ্ধার্থকেই নিবেদন করলেন। এই সামান্য পায়েসের বাটি সিদ্ধার্থকে ‘মজঝিমাপতিপদা’ বা মধ্যপন্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়েছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘নিদানকথা’য় এই উপাখ্যান মেলে। কিন্তু এই আখ্যানের অন্যান্য দিকের মাঝে চাপা পড়ে যায় এক অন্তর্নিহিত কাহিনি। উপেক্ষিত হয় যে, ওই অশ্বত্থ গাছটির উপাসনা হত গৌতম বুদ্ধের বোধিলাভের আগে থেকেই। বুদ্ধের সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বেও সুজাতা সন্তানলাভের আশায় গাছটির পূজা করতেন। অর্থাৎ সাঁচী-ভারহুতের স্তূপে যে বোধিবৃক্ষকে ঘিরে ভক্তদের উপাসনার ভাস্কর্য আমরা দেখতে পাই, সেই দৃশ্যের অনুরূপ দৃশ্য ওই একই অশ্বত্থ গাছকে ঘিরে বুদ্ধের অনেক আগে থেকে অনুষ্ঠিত হত। গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ লাভের ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই গাছটির ধর্মীয় গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু কত পুরনো সেই পরম্পরা? কতটা গভীর অতীতে আমরা যেতে পারি? বুদ্ধের আরও অন্তত দেড় হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতায় বৃক্ষ উপাসনার নিদর্শন পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতায় অশ্বত্থ গাছের উপাসনার সবচেয়ে ভাল নিদর্শন হল ‘এম-১১৮৬এ’ নামক সিলমোহর যা ‘ডিভাইন অ্যাডোরেশন সিল’ নামেও পরিচিত। এটিতে দেখা যায় একটি অশ্বত্থ গাছ আর তার এক জোড়া শাখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শিঙের মুকুট-পরা এক মানুষ। তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে এক উপাসক। উপাসকের উপস্থিতি আর শিরোস্ত্রাণের আড়ম্বর দেখে বোঝা যায় এই মানুষ সাধারণের থেকে আলাদা, তিনি দেবতা বা দেবতুল্য। এই দৃশ্যটিকে ব্যাখ্যা করতে ওই মানুষটিকে বৃক্ষদেবতা হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেছেন। এ ছাড়াও একাধিক সিলমোহর ও মৃৎপাত্রে অশ্বত্থ গাছ ও পাতার উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, এগুলি সিন্ধুবাসীদের কাছে পবিত্র বস্তু ছিল। সিন্ধুবাসীর অশ্বত্থ আর গৌতম বুদ্ধের অশ্বত্থের মধ্যে সরাসরি যোগ নেই, তবু সহস্রাধিক বছরের ব্যবধানে একই গাছের পূজা বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

লক্ষণীয় হল, এই দুইয়ের মাঝের যুগে ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশগুলিতে কিন্তু গাছের পুজো আমরা দেখতে পাই না। যাযাবর বৈদিক আর্যদের কাছে বৃক্ষপূজার গুরুত্ব বিশেষ ছিল না। কিন্তু প্রাগার্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ যত গভীর হল, ধর্মবিশ্বাসেও পরিবর্তন আসতে থাকল। ঋগ্বেদে তুলনামূলক ভাবে পরবর্তী কালের সংযোজন দশম মণ্ডলের অরণ্যানী সূক্তে (১০/১৪৬) অরণ্যানী অর্থাৎ বনদেবীর বন্দনা করা হয়েছে। তিনি সম্বোধিত ‘অঞ্জনগন্ধী সুরভি’ নামে। তিনি ‘মৃগাণাম্ মাতা’ অর্থাৎ পশুদের মাতৃস্বরূপা। এই সূক্তে গ্রাম এবং অরণ্যের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ আর প্রকৃতির সংঘাতকে তুলে ধরা হয়েছে।

বেদের ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ পর্যায়ে আবির্ভাব হল যক্ষদের। বন ও গ্রামের অধিদেবতা ছিল যক্ষরা। যক্ষ উপাসনা ভারতে অন্য যে কোনও ধৰ্মবিশ্বাসের থেকে কোনও অংশে কম প্রাচীন নয়। তাঁরা গাছ ও গ্রামের রক্ষাকর্তা, গাছের মূলের নীচে রাখা গুপ্তধনের রক্ষকও তাঁরাই। মহাভারতের ‘সাদার্ন রিসেনশন’ ১২/৬৯/৪১-এ আমরা দেখতে পাই চৈত্যবৃক্ষের কথা। পবিত্র চৈত্যবৃক্ষগুলি দেব, যক্ষ ও রাক্ষসদের বাসস্থান, তাই এই গাছগুলিকে আঘাত করা নিষেধ।

বোধিবৃক্ষেরও এক নিজস্ব যক্ষ ছিল। ‘দংষ্ট্রানিবাসী’ তার নাম। বৌদ্ধ শিল্পে যক্ষ-যক্ষীদের বহুল উপস্থিতি তো ছিলই, প্রাচীনতম বৌদ্ধ ধর্মস্থানগুলিও বিভিন্ন যক্ষের উপাসনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। বুদ্ধ অনেক যক্ষস্থলকে বৌদ্ধ ধর্মের ছত্রছায়ায় এনেছিলেন। গয়ায় আসার পর খর এবং সূচিলোম, এই দুই যক্ষকে জয় করেন গৌতম বুদ্ধ। বিভিন্ন প্রাক্‌-বৌদ্ধ উপাসনাস্থল, যেখানে গাছের পুজো হত বা গাছের সঙ্গে যুক্ত যক্ষের উপাসনা হত, তাদের অনেকগুলিই বৌদ্ধ ধর্মস্থানে রূপান্তরিত হয়েছিল। বোধিবৃক্ষও এ রকম একটি উদাহরণ।

মহাবোধি মন্দিরে বোধিবৃক্ষের সঙ্গে আর একটি বস্তুর উপাসনা হয়, সেটি হল বজ্রাসন। এটিও ২৬০০ বছর পুরনো যক্ষ-পরম্পরার ধারাবাহিকতা। এই ধরনের আসন যক্ষদের উপাসনাস্থলে গাছের নীচে থাকত এবং আসনগুলিকে মঞ্চ বলা হত। এই তথ্য বিভিন্ন বৌদ্ধ সুত্ত থেকেই পাওয়া যায়।

যক্ষ ও গাছকে ঘিরে কী ধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ হত, তার জীবন্ত চিত্রণ পাওয়া যায় জৈনদের ঔপপাতিক সূত্রে। যক্ষ পূর্ণভদ্রের উপাসনাস্থলে কলাকৌশল প্রদর্শন করার জন্য আসতেন বিভিন্ন অভিনেতা, নর্তক, গায়ক, আবৃত্তিকার, কথক, মল্লযোদ্ধা প্রমুখ। একটি অশোক গাছকে কেন্দ্র করে এর অবস্থান। ছত্র-ঘণ্টা-পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত সেই অশোক গাছটির নীচে মূল মঞ্চটি অষ্টভুজাকার, ভাস্কর্যমণ্ডিত এবং মসৃণ কালো পাথর দিয়ে নির্মিত। এটি অবস্থিত ছিল চম্পানগরীর উপকণ্ঠে, বিহারের ভাগলপুরের কাছাকাছি।

আধুনিক যুগের বাংলায় সিজবৃক্ষকে দেবী মনসারূপে পূজা করা হয়, এই গাছের আর এক নাম মনসা গাছ। গাছের নীচে বেদি, তার উপর মনসার মূর্তি বা ঘট রেখে তাঁর পূজা হয়। এটি দূর অতীতের যক্ষদের মঞ্চের কথা স্মরণ করায়।

সিন্ধু-পরবর্তী ভারতের প্রাচীনতম মূর্তিগুলি যক্ষ-যক্ষীদেরই, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির চেয়ে তারা পুরনো। সাঁচীর তোরণে আছে যক্ষী শালভঞ্জিকা। তার ঊর্ধ্বোত্থিত বাহু দিয়ে তিনি ধারণ করে থাকেন গাছের ডাল। শালভঞ্জিকা বৌদ্ধ ও হিন্দু মূর্তিতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আধুনিক যুগ অবধি বহুল ব্যবহৃত। শুধু মূর্তি নয়, মূর্তির সঙ্গে যক্ষদের নামও খোদিত দেখা গেছে ভারহুতের স্তূপে এবং মথুরায়। সুন্দর শিরোস্ত্রাণ, কোমরবন্ধ ও অন্যান্য অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিত তাঁদের মূর্তিরূপগুলির মাধ্যমে সমাজে তাঁদের বিশেষ অবস্থান সূচিত। বাংলার প্রাচীনতম উল্লেখযোগ্য কারুশিল্পের নিদর্শন হল চন্দ্রকেতুগড়ের পোড়ামাটির অনবদ্য সুন্দর মৃৎফলকসমূহ, সেখানেও যক্ষীদের প্রাধান্য।

কুষাণ যুগে হিন্দুরাও তাদের দেবতাদের বিভিন্ন বৃক্ষের সঙ্গে একীকরণ শুরু করে। তার কিছু পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরায়। তবে অশ্বত্থ নয়, সেগুলি কদম্ব আর অশোক গাছ। মথুরায় পাওয়া গেছে কুষাণ যুগের চতুর্ব্যূহ মূর্তি। দ্বিতীয় শতকের এই মূর্তিতে আছেন বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ— এই চার যদুবংশীয় বীর। কেন্দ্রে বাসুদেব অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ, পিঠে কদম্ব গাছ ও তার তিনটি শাখা। পিঠের কদম্ব গাছটি চেনা যায় খোদাই করা কদম ফুল দেখে। ডান দিকের শাখায় সঙ্কর্ষণ অর্থাৎ বলরাম, উপরের শাখায় বাসুদেবপুত্র প্রদ্যুম্ন। বাম দিকের শাখায় প্রদ্যুম্নর পুত্র অনিরুদ্ধ, তবে এটি ভেঙে গেছে। বৈষ্ণবধর্মের আদিরূপের নাম ছিল ভাগবত ধর্ম, যা তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তারও আগে থেকে প্রচলিত। ভাগবত ধর্মের একটি অঙ্গ ছিল পাঞ্চরাত্র উপাসনা। পাঞ্চরাত্র মতে প্রকৃতি থেকে পঞ্চভূতের জন্ম হয় চারটি ব্যূহের মাধ্যমে। চার যদুবংশীয় বীরের নামে চারটি ব্যূহ। গাছ হল সৃষ্টিক্রিয়ার প্রতীক। শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত কদমগাছ এখানে পাঞ্চরাত্রের সৃষ্টিতত্ত্বের দ্যোতক। বাসুদেব হলেন সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। তিনি আর কদম গাছ এখানে অভিন্ন। কুষাণ যুগের চতুর্ব্যূহ মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল মথুরার সপ্তসমুদ্রী কূপে। সেই কূপেই পাওয়া গেছে সমসাময়িক আর একটি একই রকমের মূর্তি, তবে শিবের। এখানেও মূর্তির পিঠে অশোক গাছ। এর সঙ্গে অশোকের ফুলও এখানে খোদিত রয়েছে।

কদম গাছের সঙ্গে বাসুদেবের যোগ আজও আছে। এখনও বাংলার গ্রামাঞ্চলে কদম গাছের নীচে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করে গোষ্ঠগান, ঝুলন ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়। আজও কৃষ্ণ-বলরামের সঙ্গে গাছের একীকরণ দেখা যায়, পুরীতে। এখানে ঈশ্বরের নাম দারুব্রহ্ম। নিমগাছের কাঠ এবং কৃষ্ণ-বলরাম এখানে একীভূত, এবং এই কাঠ ব্যবহার করেই তাঁদের মূর্তি নির্মাণ হয় প্রতি বারো বা উনিশ বছরে। স্থায়ী পাথরের মূর্তির নিয়ম সেখানে নেই।

বাংলায় শিবের গাছ হল অশ্বত্থ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঝিকুরবেড়িয়াতে বড়কাছারি নামক শিবক্ষেত্রটি একটি অশ্বত্থ গাছকে ঘিরে তৈরি। এখানে প্রতি ফাল্গুন মাসে বড় মেলা বসে, মানুষ সন্তানকামনায় দূরদূরান্ত থেকে আসেন। এটা ঔপপাতিক সূত্রের যক্ষ পূর্ণভদ্রের মেলার কথা মনে করায়। সন্তানকামনায় সুজাতাও গাছেরই পুজো করতেন। গাছ প্রজননশীলতার প্রতীক। সুদূর অতীত থেকে উদ্ভিদের উর্বরতার সঙ্গে মানুষের উর্বরতাকে যুক্ত করা হয়েছে।

মানালির হিড়িম্বা মন্দিরে একটি গাছকেই ঘটোৎকচ রূপে উপাসনা করা হয়। সেই গাছের গায়ে অজস্র চমরি গাইয়ের শিং, বেদিতে গাঁথা অনেকগুলি ত্রিশূল, এগুলিই ঘটোৎকচের প্রতীক। প্রান্তিক দেবতা, তাই পূজাপদ্ধতিও স্বতন্ত্র। বৈদিক যুগের ধর্ম ছিল যজ্ঞকেন্দ্রিক, তার পরের যুগের ধর্ম মন্দির এবং চৈত্যকে ঘিরে। আপাতদৃষ্টিতে বৃক্ষপূজার লোকাচার চিরকালই প্রান্তিক ধর্ম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও কম, কারণ গাছ মরণশীল, মূর্তির মতো দীর্ঘস্থায়ী নয়। মন্দির-মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন যতটা থাকে, লোকাচারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ততটা থাকে না।

বৈদিক যজ্ঞে কাঠ পুড়িয়ে পশু ও খাদ্য-সহ বহুবিধ প্রাকৃতিক সম্পদকে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত। বৈদিক পরম্পরার কিছুটা বাইরে যক্ষ-পরম্পরা, যেখানে গাছকে দেবতার স্থান দেওয়ার মধ্যে প্রকৃতিকে রক্ষা করার একটা অঘোষিত উদ্দেশ্যও ছিল। বৈষ্ণব পাঞ্চরাত্র পরম্পরায় যেখানে বাসুদেবকে কদম্ব গাছ রূপে দেখা গিয়েছিল, সেই পাঞ্চরাত্র পরম্পরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাও কিছুটা ব্রাত্যজনের ধর্মই ছিল এবং পতিত ব্রাহ্মণরাই এই ধর্মে পৌরোহিত্য করত। অথর্ববেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে যক্ষদের রাজা কুবেরকে রাক্ষস এবং গুহ্যাধিপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী হিন্দু সাহিত্যে তিনি দেবতার স্থানে উত্তীর্ণ। বৌদ্ধ কিংবদন্তি অনুসারে ব্রাহ্মণ্যধর্মী রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যখন বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলতে আসেন, গাছটির রক্ষাকারী যক্ষ দংষ্ট্রানিবাসীর সঙ্গে তাঁর তুমুল লড়াই হয়। এই কাহিনি কাল্পনিক, তবে এর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘাত প্রতিফলিত। সব মিলিয়ে বলা যায়, এই যক্ষ ও বৃক্ষের উপাসনায় একটা প্রান্তজনের ইতিহাস (সাব-অল্টার্ন হিস্ট্রি) আর অন্তর্নিহিত ইতিহাস (এমবেডেড হিস্ট্রি) লুকিয়ে আছে। সেই ধারা আজও বহমান লোকসংস্কৃতিতে, পথে-প্রান্তরে, সাধারণ মানুষের মধ্যে।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy