বর্ষবরণ: তাইল্যান্ডে ‘সোংক্রান’ উৎসবে গৌতম বুদ্ধের স্মারকবস্তুর উপাসনা। মাঝে, তাইল্যান্ডে বালিনির্মিত বৌদ্ধস্তূপ এবং বাঁ দিকে, লাওস-এ বুদ্ধের জলাভিষেক। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)।
পয়লা বৈশাখের আন্তর্জাতিক বিস্তার বোঝা যায়, যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে— তাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া— সর্বত্র এর উদ্যাপন দেখা যায়। প্রতি বছর তেরো থেকে পনেরো এপ্রিলের মধ্যে এই দেশগুলিতে নববর্ষ পালন হয় ধুমধাম করে। তাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস এই দেশগুলিতে নতুন বছর উপলক্ষে জল-খেলার উৎসব হয়, যার সূচনা হয় বুদ্ধমূর্তির জলাভিষেক দিয়ে। হাতিদের আনা হয় শুঁড় দিয়ে মানুষের উপর জলবর্ষণ করার জন্য। অনেকে এই দিন বালি দিয়ে বুদ্ধের স্মারক স্তূপ বানায়, বর্ণময় পোশাকে নাচগান করে। গৃহীরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এবং পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে খাবার উৎসর্গ করে। সংক্রান্তির দিন শুরু হয় বলে, তাইল্যান্ড ও লাওসে এই উৎসবের নাম হল ‘সোংক্রান’, আর কম্বোডিয়াতে ‘মহাসংক্রান্ত’। মায়ানমারে নাম হল ‘থিংয়ন’— এই শব্দটিও আসলে ‘সংক্রান্তি’ কথাটারই অপভ্রংশ।
ভারতীয় উপমহাদেশের ভিতরেও ঠিক এই সময়টাতেই নববর্ষ হয় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, তামিলনাড়ু, কেরল, পাঞ্জাব, বাংলা, অসম ও ওড়িশায়। বিহার-ঝাড়খণ্ডের মৈথিলীভাষীদের নূতন বছরও পয়লা বৈশাখেই। পয়লা বৈশাখের এই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার কাহিনি বুঝতে গেলে জানতে হবে ভারতীয় পঞ্জিকার আন্তর্জাতিক বিস্তার এবং ভারতীয় সংস্কৃতির বহির্বিশ্বে প্রসারের ইতিকথা।
চিনা লেখকদের বিবরণে পাওয়া যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির উপস্থিতির সবচেয়ে পুরনো প্রামাণ্য তথ্য। প্রায় দু’হাজার বছর আগে ‘ফুনান’ নামে এক রাজ্যের বর্ণনা তাঁরা দিয়েছেন। সেখানকার সংস্কৃতি ছিল ভারতীয় ভাবধারায় প্রভাবিত। সেই ‘ফুনান’-এর আধুনিক নাম কম্বোডিয়া। চৈনিক সূত্র অনুযায়ী, এক ভারতীয় ব্রাহ্মণ আর স্থানীয় নারীর বিবাহবন্ধন থেকে ‘ফুনান’ রাজ্যের সূচনা। এই কাহিনিটি কিংবদন্তি, তবে কিছু ঐতিহাসিক সূত্র এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। আরও পরের, পঞ্চম শতকের চৈনিক নথি অনুযায়ী, কম্বোডিয়ার তুন-সুন রাজ্যে সহস্রাধিক ব্রাহ্মণের বাস ছিল। তুন-সুন রাজ্যের স্থানীয় অধিবাসীরা ব্রাহ্মণদের কন্যাদান করত। দুটো কাহিনি একটাই বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়— এখানে বহিরাগত ভারতীয় ব্রাহ্মণ পুরুষ আর মূলনিবাসী নারীদের বৈবাহিক সম্বন্ধ গড়ে উঠত। ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ভিক্ষু, হিন্দু ব্রাহ্মণ, দুই ধর্মেরই বণিক সম্প্রদায় ওই অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার ঘটাল। একে একে ভারত-প্রভাবিত রাজ্য গড়ে উঠতে থাকল, যেমন, চেনলা, চম্পা, আঙ্কোর, শ্রীক্ষেত্র, দ্বারাবতী, শ্রীবিজয়।
চৈনিক লেখাগুলোর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত কাহিনি আছে। ভারত থেকে ব্রাহ্মণদের ওখানে আমন্ত্রণ করা হত এবং অভিবাসিত করা হত। বণিকদের বিদেশযাত্রার কারণ সহজবোধ্য। বাণিজ্যসূত্রে তারা চিরকালই দূরদেশে পাড়ি দিত। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ওই অঞ্চলে যাওয়ার কারণটাও বোধগম্য, তা হল ধর্মপ্রচার। কিন্তু ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে এ রকম কোনও কারণ ছিল না। হিন্দুধর্মে ধর্মপ্রচারকের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। ব্রাহ্মণদের অন্য একটি গুণের কদর ছিল ওই দেশে, সেটি জ্যোতিষবিদ্যা। জ্যোতিষ-গণনার জন্য তাঁদের আনা হত। এ ভাবেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যার বিস্তার হয়, আর সেই সঙ্গে ভারতীয় ক্যালেন্ডারেরও। ক্যালেন্ডার আর জ্যোতিষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
গ্রহ-নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ সঞ্চারপথ জ্যোতিষীরা বলতে পারতেন, তাই রাজারা তাঁদের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে দেখতেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজাদের বিশ্বাস ছিল যে, শুভকর্মের পৌরোহিত্য ব্রাহ্মণদের দিয়ে না করালে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এখনও তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বৌদ্ধ রাজাদের অভিষেক ব্রাহ্মণদের হাতেই হয়। মায়ানমারেও হত, ঊনবিংশ শতক অবধি। তাইল্যান্ডে পয়লা বৈশাখে রাজা আমন্ত্রণ করেন ব্রাহ্মণ জ্যোতিষীদের, তাঁরা আগামী বছরের পূর্বাভাস জানান। এই ব্রাহ্মণরা ধর্মে বৌদ্ধ, তবে অতীতের ব্রাহ্মণদের বংশধর। এখনও হিন্দু দেবদেবীর পুজো তাঁরা করেন, ব্যাংককের ‘দেবস্থান’ মন্দিরটিতে তার প্রতিফলন দেখা যায়।
অতীতে জ্যোতির্বিদ্যা আর জ্যোতিষের বিশেষ পার্থক্য ছিল না। রাজস্ব, কৃষি পরিকল্পনার জন্য ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন হত। সে কারণে প্রয়োজন ছিল এমন কিছু মহাজাগতিক বস্তুর, যাদের ঘূর্ণনগতি সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায়, যাদের ঘূর্ণনের ভিত্তিতে সময়ের একক তৈরি করা যায়, যেমন দিন, পক্ষ, মাস, বছর। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও পাঁচটি দৃশ্যমান গ্ৰহ— এই জ্যোতিষ্কগুলি মানুষের নজরে ছিল। কিন্তু শুধুই পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ছিল গণনার, কারণ প্রতিটির জ্যোতিষ্কর ঘূর্ণনগতি স্বতন্ত্র। সেই গণনার জন্য গড়ে উঠেছিল জ্যোতিষশাস্ত্র।
ভারতের সবচেয়ে পুরনো শিলালেখগুলিতে বছর গণনা হয়েছে রাজাদের সিংহাসনে ওঠার বছর থেকে। অশোক, সাতবাহন রাজবংশ, কণিষ্ক এঁরা প্রচলিত সাধারণ সম্বৎ ব্যবহার না করে নিজেদের রাজত্ব শুরুর সাল থেকে বছর গণনা করে যাবতীয় শিলালিপি লিখিয়েছেন। ইরান এবং মধ্য এশিয়া থেকে শকদের আবির্ভাবের পর থেকে ওই ধরনের রাজত্ববর্ষের বদলে একটা সাধারণ সর্বজনীন বর্ষের প্রয়োগ শুরু হয়। শক ক্ষত্রপ চষ্টনের শিলালিপি আর দমসেনের মুদ্রায় এই সর্বজনীন বর্ষের প্রাচীনতম প্রস্তরপ্রমাণ আছে। এগুলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের। এই নতুন বর্ষগণনার নাম হল ‘শকাব্দ’। এর পর একে একে বিভিন্ন জ্যোতিষ গণনার বই রচিত হয়— যবনজাতক, পৌলিষ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত, এটি মূলত গ্রিক ও রোমান জ্যোতিষের অনুসরণে। তার পর গুপ্তযুগের শেষ পর্যায়ে রচিত হয় ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’। বাংলা ক্যালেন্ডার-সহ বেশির ভাগ ভারতীয় ক্যালেন্ডারের ভিত্তি হল ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’।
‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ পরিচিত তার পূর্ণাঙ্গতা, কাব্যগুণ ও নিখুঁত গণন পদ্ধতির জন্য। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এ বেশ নির্ভুল ভাবে পাঁচটি গ্রহের বার্ষিক গতির হিসাব, সাইন টেবল, চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় গণনা পদ্ধতি, ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতির বহুবিধ বিষয় আলোচিত হয়েছে। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ একটি পূর্ণাঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যার বই হিসাবে আরব জগতে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খ্যাতিলাভ করেছিল। মায়ানমারে এই বইটি ‘থুরিয় থিদ্দান্ত’ নামে পরিচিত। সপ্তম শতকে মায়ানমারের শ্রীক্ষেত্র রাজ্যে পুরনো ক্যালেন্ডারগুলির সংস্কার সাধন করে আধুনিক বর্মি ক্যালেন্ডারের সূত্রপাত হয়। এই ক্যালেন্ডার ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র ভিত্তিতে নির্মিত। সেখান থেকে জন্ম হয় তাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়ার ক্যালেন্ডারের।
এই সব ক’টি দেশে এবং ভারতবর্ষে দু’রকম বর্ষগণনা পদ্ধতি আছে— সৌর বা সোলার ও চান্দ্রসৌর বা লুনি-সোলার। সৌর সম্বতে বছরের দৈর্ঘ্য হয় ৩৬৫/৩৬৬ দিন। চান্দ্রসৌর সম্বতে বছরের দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৩৫৪ বা ৩৮৪ দিন হয়। চান্দ্রসৌর সম্বতে মাসগণনা সহজ। দুই পক্ষ মিলে এক চান্দ্রমাস। চাঁদের এক অমাবস্যা থেকে আর এক অমাবস্যা মাপলেই মাস গোনা হয়ে যায়। বারো চান্দ্রমাসে হয় ৩৫৪ দিনের বছর, আর তেরো চান্দ্রমাসে ৩৮৪ দিনের বছর। এই তেরো নম্বর মাসকে বলা হয় ‘অধিক মাস’ বা ‘মলমাস’। কোনও বছরে বারো মাস থাকবে, কোন বছরে তেরো— সেটা একটু জটিল গণনার বিষয়। অন্য দিকে সৌর সম্বতে মাসের সংখ্যা স্থির, কিন্তু মাসের দৈর্ঘ্য ঠিক করার পদ্ধতিটা কঠিন। তার জন্য আকাশে সূর্যের বার্ষিক গতির পথকে বারো ভাগে ভাগ করতে হয়, ফলে বারোটি নক্ষত্রমণ্ডল অর্থাৎ রাশির প্রয়োজন। সৌর সম্বতে সূর্য মেষরাশি থেকে মেষরাশিতে ফিরে এলে একটা সৌর বছর শেষ হয়। সূর্যের মেষরাশিতে প্রবেশের দিন অর্থাৎ মেষ সংক্রান্তিই হল পয়লা বৈশাখ।
মেষ সংক্রান্তির দিনটার এমন কী বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ওই দিনটাই বছরের শুরুর দিন দাঁড়াল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আরও দুটো সম্পর্কিত প্রশ্ন দেখা যাক। আমরা কয়েক দশক আগে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ করতাম। এখন ১৫ এপ্রিল কেন করি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশ আর ভারতে আলাদা আলাদা দিনে কেন পয়লা বৈশাখ, যেখানে দু’দেশেই একই সৌরবর্ষ ব্যবহার হয়?
এই সব ক’টি প্রশ্নের জন্য বুঝতে হবে সৌরবর্ষের প্রকারভেদ। সৌরবর্ষ দু’রকম— সায়ন আর নিরয়ণ। সায়ন বা প্রকৃত সৌরবর্ষের (ট্রপিক্যাল ইয়ার) দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট। এটি নির্দিষ্ট নির্ভুল সৌরবর্ষ, অর্থাৎ সূর্যের চার দিকে পৃথিবীর এক পাক ঘোরার সময়, বা একই সূর্যোদয়ের স্থানে সূর্যের ফিরে আসার সময়। এটি ঋতুচক্রের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। উদাহরণ, গ্রেগরিয়ান বর্ষ, যা সারা পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হয়। আর এক ধরনের সৌরবর্ষ হল নিরয়ণ বা নাক্ষত্র-সৌরবর্ষ (সাইডিয়ারিয়াল ইয়ার), যেটির দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ৯ মিনিট। এটিতে নক্ষত্রের ভূমিকা থাকে। এটি সূর্যের মেষরাশি থেকে মেষরাশিতে ফিরে আসার সময়। উদাহরণ, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ক্যালেন্ডার। এই কারণে পয়লা বৈশাখকে মেষ সংক্রান্তিও বলে।
সৌরবর্ষ এবং নাক্ষত্র-সৌরবর্ষের মধ্যে এই কুড়ি মিনিটের পার্থক্য হয় পৃথিবীর তৃতীয় গতি বা অয়নচলনের (প্রিসিশন) জন্য। হিন্দু জ্যোতিষে সৌরবর্ষ বলতে সাধারণত নাক্ষত্র-সৌরবর্ষই বোঝায়। নাক্ষত্র-সৌরবর্ষ আর প্রকৃত সৌরবর্ষের যে ২০ মিনিটের ফারাক, সেটা ৭২ বছরে ১ দিনের পার্থক্যে পরিণত হয়। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ১৬০০ সালে হত ৯ এপ্রিল নাগাদ। এক হাজার বছর পর পয়লা বৈশাখ হবে পয়লা মে নাগাদ, আর চার হাজার বছর পর বর্ষাকালে। এই হিসাব ধরে অতীতে গেলে দেখা যাবে, তৃতীয় শতকে পয়লা বৈশাখ হত বসন্তবিষুবের সময়, ২১ মার্চ নাগাদ, যে দিন দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সমান হয়। সেই যুগেই ভারতের প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রের বইগুলো লেখা শুরু হয়। কেরলে পয়লা বৈশাখকে ‘বিষু’ বলা হয়, আর অসমে নাম ‘বিহু’, চাকমারা বলে ‘বিজু’— সবই ‘বিষুব’-এর অপভ্রংশ। পাশ্চাত্য জ্যোতিষে খাতায় কলমে একুশে মার্চকে মেষ সংক্রান্তি ধরা হয়, যদিও বাস্তবে সেটা মেষ সংক্রান্তি নয়। এই তথ্যগুলি একত্র করে বোঝা যায়— মেষ সংক্রান্তি যে যুগে বসন্তবিষুবের দিনে হত, সেই যুগে মেষ সংক্রান্তিকে নববর্ষ হিসাবে গণ্য করা শুরু হয়েছিল। অন্য এগারোটা রাশির সংক্রান্তিকে বাদ দিয়ে মেষ সংক্রান্তি অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিনটাকেই বছরের প্রথম দিন হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই কারণেই।
বাঙালির বৎসরগণনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গে মিললেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের অনেক রাজ্যের সঙ্গে মেলে না। মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্নাটক, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, কাশ্মীর (হিন্দুদের মধ্যে) ও মণিপুরে চান্দ্রসৌর সম্বৎ অনুযায়ী বছরের শুরু হয়, তাই এদের নববর্ষের তারিখ প্রতি বছর বদলায়, এগারো দিন বা এক মাসের ব্যবধান হয় এক বছর থেকে অন্য বছরে, বেশির ভাগ হিন্দু উৎসবের মতো। চান্দ্র চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদের দিন নতুন বছর শুরু হয়। অর্থাৎ সৌর তারিখ নয়, চান্দ্র তিথির হিসাবে নববর্ষ হয়। এই দিনটি মহারাষ্ট্রে ‘গুডি পাডবা’, অন্ধ্র-তেলঙ্গানা-কর্নাটকে ‘যুগাদি’ বা ‘উগাদি’ নামে পরিচিত। কাশ্মীরে নাম ‘নওরেহ’।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চান্দ্রসৌর সম্বৎ-ও প্রচলিত ছিল এবং এখনও কিছু ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হয়, যেমন বুদ্ধজয়ন্তী। তবে নববর্ষটা সৌর সম্বৎ অনুযায়ী পয়লা বৈশাখের দিনই পালিত হয়। লক্ষণীয়, ভারত আর নেপালের বাইরে যতগুলো দেশে পয়লা বৈশাখে নববর্ষ হয়, সব ক’টিতেই এই মুহূর্তে প্রধান ধর্ম হল থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম— তাইল্যান্ড, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা— সর্বত্রই। কিন্তু এই দেশগুলোর বেশ কয়েকটিতে রাজারা ব্রাহ্মণদের দিয়ে ধর্মীয় কাজ করান। আজও তাইল্যান্ডের রাজার নাম হয় রাম, আর দীর্ঘ দিন তাইল্যান্ডের রাজধানী ছিল ‘অয়ুত্থয়া’ অর্থাৎ অযোধ্যা।
বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের পয়লা বৈশাখের পার্থক্যটা বোঝা যাক। সায়ন আর নিরয়ণ সৌরবর্ষের কুড়ি মিনিটের পার্থক্যটা মাথায় রেখে হিন্দু সৌরবর্ষকে প্রকৃত সৌরবর্ষের রূপ দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগী হন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তাঁর নেতৃত্বে ভারত সরকার নিয়োজিত ‘সাহা কমিটি’ নূতন পঞ্জিকা-গণন পদ্ধতি তৈরি করে, যেটা পশ্চিমবঙ্গে গৃহীত হয়নি, বাংলাদেশে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে পয়লা বৈশাখ বরাবরই এপ্রিলের মাঝামাঝি থাকবে। পশ্চিমবঙ্গে পিছোতেই থাকবে। এখানে মূল প্রশ্নটা দাঁড়ায়, আমরা সৌর ঋতুচক্র অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ করতে চাই, না কি মেষ সংক্রান্তির দিন পয়লা বৈশাখ করতে চাই? বাংলাদেশে প্রথমটা হয়, পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়টা। এর কোনও ঠিক বা ভুল উত্তর হয় না, কারণ বাণিজ্যিক কাজের জন্য, ঋতুচক্রের সঙ্গে যুক্ত কাজের জন্য আমরা গ্রেগরিয়ান বর্ষই ব্যবহার করি। সেই বিচারে দেখলে বাংলা ক্যালেন্ডার মূলত উৎসব অনুষ্ঠানের জন্যই। ঋতুচক্রের সঙ্গে সাযুজ্য না থাকলেও অর্থাৎ বর্ষাকালে পয়লা বৈশাখ হলেও ক্ষতি নেই।
ওই অয়নচলন আর কুড়ি মিনিটের পার্থক্যটা হিন্দু জ্যোতিষে অজানা ছিল না। এটা জানা সত্ত্বেও কেন প্রাচীন ভারতের পঞ্জিকাকাররা সংশোধন করেননি? একাধিক কারণ সম্ভব। সম্ভবত, এর ফলে এক জন মানুষের জীবদ্দশায় এক-দু’দিনের বেশি তারতম্য চোখে পড়ে না, তাই কেউ গা করেননি। আবার, এটাও সম্ভব যে জ্যোতিষীরা এমন একটা ক্যালেন্ডার নিজেদের পেশার খাতিরে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, যেটা শুধু সূর্য আর ছায়া দেখে হিসেব করা যায় না। নক্ষত্রের জন্য কিছু বাড়তি গণনা প্রয়োজন, সেই কারণে গণকের জীবিকাওসুরক্ষিত থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy