ক্রীড়াবিদ: ফ্রেডি হির্শ।
মৃত্যু হলেন জার্মানির এক প্রভু। নীল তাঁর চোখ, অব্যর্থ তার সিসার বুলেট। প্রভু ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো সর্পদল নিয়ে খেলেন আর মেঘের মধ্যে কবর সাজিয়ে দেন। কাদের কবর? ওই যারা মৃত্যু শিবিরে, ‘বাঙ্ক বেড’-এর মধ্যে শরীরটাকে কোনও রকমে পেঁচিয়ে নিয়ে শোয় আর ভোর থেকে সকাল, সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত, পান করে চলে কালো দুধ… ‘ডেথফিউগ’ কবিতায় এমনটাই লিখছেন পল সেলান, জন্মসূত্রে যিনি ইহুদি। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের হাড় হিম করা ছবি উঠে আসে এই কবিতায়, ইহুদি বন্দিরা যেখানে মৃত্যু পান করে দিবারাত্র, মৃত্যুর ‘কালো দুধ’। কিন্তু দুধের সাদার মধ্যে যেমন চারিয়ে যেতে পারে কালো অন্ধকার, তেমনি অন্ধকারের মধ্যেও তো সেঁধিয়ে যেতে পারে আলো। কালো দুধ বা ‘শোয়ার্জে মিলশ’ যদি হয়, তবে ‘হেভেন ইন আউশউইৎজ’ ও সম্ভব। আউশউইৎজ তো নরকের আর এক নাম। সেখানে এক টুকরো স্বর্গের বাগান? ‘হেভেন ইন আউশউইৎজ’ (২০১৬, অ্যারন কোহেন) বা ‘ডিয়ার ফ্রেডি’ (১৯১৭, রুবি গাট) -এর মতো তথ্যচিত্র দেখে জানতে পারি যে, নাৎসিদের ‘আউশউইৎজ ২-বিরকেনাও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’-এ চেক ইহুদিদের এক ‘ফ্যামিলি ক্যাম্প’ ছিল। সেই ‘বি২বি ফ্যামিলি ক্যাম্প’, বন্দি শিশুদের জন্য অল্প সময়ের জন্য হলেও স্বর্গের বাগান হয়ে উঠতে পেরেছিল, এক ইহুদি তরুণের জন্য। নাম তাঁর ফ্রেডি হির্শ। ১৯৩৮ সালে, অবিভক্ত চেকোস্লোভাকিয়া নাৎসিদের দখলে চলে আসার পর, প্রথমে টেরেজিনস্টাটের-এর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর পরে কুখ্যাত আউশউইৎজ-এ বন্দি ইহুদি শিশুদের জীবন, কিছু দিনের জন্য হলেও আনন্দে ভরিয়ে তোলার জন্য ফ্রেডিকে মনে রেখেছে পৃথিবী।
ফ্রেডির ব্যক্তিত্বের যে দিকটা মনে রাখতে চাওয়া হয়নি, তা হল তাঁর সমকামী সত্তা। তাঁর নেতৃত্ব, কর্মোদ্যম, সাহস, স্নেহ, শাসন, আত্মদান— এ সব নিয়ে চর্চা চললেও তার যৌন জীবনকে আড়ালে রাখার চেষ্টা হয়েছে দীর্ঘ দিন। অক্টোবর মাসটা পৃথিবীর বহু দেশে ‘এলজিবিটি হিস্ট্রি মান্থ’ বা সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনের ইতিহাসের মাস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। তাই এ সময়, ফ্রেডির মতো মানুষের নাম জেগে ওঠে স্মরণের দাবি নিয়ে।
জার্মান-ইহুদি ক্রীড়াবিদ আর ইহুদি জাতীয়তাবাদের যুবনেতা ফ্রেডি হির্শ জার্মানির আকেন শহরে জন্মেছিলেন। সালটা ১৯১৬। ফ্রেডির দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই বাবা মারা যান। মা ছিলেন শীতল আর বিষণ্ণ। দুই ছেলের প্রতি খানিক অমনোযোগী। স্নেহহীন শৈশব হয়তো শিশুদের প্রতি ফ্রেডিকে সংবেদনশীল হতে শিখিয়েছিল।
ফ্রেডি ‘আকেন ইহুদি যুব সংস্থা’-র স্কাউটিং শাখার ক্যাপ্টেন হন ১৯৩১ সালে। পরে ডুসেলডর্ফ-এ কাজ নিয়ে চলে যান। কয়েক বছর পরেই সেখান থেকে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে চলে আসতে বাধ্য হন। তত দিনে নাৎসি-নেতৃত্বে জার্মানিতে সমকামী-নিপীড়ন শুরু হয়ে গিয়েছে। ইহুদি ক্রীড়া সংস্থা ‘মাকাবি হাটজেয়ার’-এর সঙ্গে কাজ শুরু করেন ফ্রেডি। ইহুদি-গণচেতনা জাগিয়ে তোলার কথা বলতে থাকেন তিনি। এ দিকে ১৯৩৮ সাল থেকে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার নানা অঞ্চল দখল করে নিতে থাকে জার্মানি। ১৯৪১ সাল থেকে চেকোস্লোভাকিয়ার ইহুদিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে সরানো হতে থাকে।
ফ্রেডি ছিলেন একদম শুরুর দিকের বন্দি। টেরেজিনস্টাট গেটোতে যুব পরিষেবা দফতরের হয়ে তিনি কাজ করতেন। লক্ষ্য ছিল শিশুদের ভাল রাখা, যে ভাবেই হোক। তারা যেন একটু ভাল খাবার পায়, যেন কর্মঠ, পরিচ্ছন্ন থাকে, নিয়মিত শরীরচর্চা করে। ১৯৪৩-এ পোল্যান্ডের বিয়ালিস্টক গেটো থেকে টেরেজিনস্টাটে প্রায় বারোশো ইহুদি বাচ্চাকে সরিয়ে আনা হয়। তাদের মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য বন্দির থেকে কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছিল তাদের। তাদের কাছে পৌঁছনোর জন্য ফ্রেডি কাঁটাতারের ও পারে ঝাঁপ দেন। ধরা পড়ে যাওয়ার পর তাঁকে পোল্যান্ডের কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আউশউইৎজ-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়েও ফ্রেডি ভেঙে পড়েননি। বন্দিদের জুটিয়ে ‘চিলড্রেন’স ব্লক’ তৈরি করেন। সেখানকার জার্মান সেনাদের বোঝান যে, বাবা মায়েরা যখন পাথর ভাঙতে, বুলেট বানাতে, সেনার পোশাক বানাতে অথবা নিজেদের জন্যই গণকবর খুঁড়তে বা আত্মীয়-বন্ধুর মৃতদেহ স্তূপীকৃত করতে ব্যস্ত থাকবেন, ছানাগুলো তখন শোরগোল না করে কিছু না কিছু করবে। জার্মান অফিসারদের ফ্রেডির প্রতি সম্ভ্রমের ভাব ছিল। তাই চিলড্রেন’স ব্লকের ক্ষেত্রে আপত্তি ওঠেনি। ফ্রেডির তৈরি সেই ব্লকে কী না করত ছোটরা! দেওয়াল জুড়ে রঙিন ছবি আঁকা, নাটকের মহড়া দেওয়া, পড়াশোনাও। বন্দিরা লুকিয়ে সামান্য যে ক’টা বই সঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, সেগুলো দিয়েই তৈরি হয়েছিল আউশউইৎজ-এর গোপন লাইব্রেরি। গ্রন্থাগারিক ছিলেন কিশোরী ডিটা ক্রাউস। ডিটার আত্মজীবনী ‘আ ডিলেড লাইফ: দ্য ট্রু স্টোরি অব দ্য লাইব্রেরিয়ান অব আউশউইৎজ’ পড়ে সেই লাইব্রেরির কথা জানতে পারি। এই কাজে তাকে বহাল করেছিলেন ফ্রেডি নিজেই। চুপি চুপি ক্লাস বসত, কারণ শিবিরের মধ্যে বই ছিল নিষিদ্ধ। চিলড্রেন’স ব্লকে মঞ্চ বানিয়ে বহু অভিনয় করেছে কচিকাঁচারা। সেই অভিনয় দেখে, মৃত্যুর পরোয়ানাপ্রাপ্ত বন্দিরা ভুলে যেতেন তাঁদের দুর্ভাগ্যের কথা। সে সব থিয়েটার দেখতে আসতেন জার্মান অফিসারেরাও, হাসতেন প্রাণ খুলে। সমবেত কণ্ঠে বন্দিরা যখন বেঠোফেনের ‘ওড টু জয়’ গাইতেন, তখন সেই অফিসারেরা হাততালি দিয়ে উঠতেন। অথচ তাঁরাই হাজার হাজার শিশুকে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়েছেন।
তবে বাচ্চাদের সামনে গ্যাস চেম্বারের কথা বলতে নিষেধ ছিল ফ্রেডির। বাচ্চাদের শারীরিক, মানসিক সুস্থতা আর পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রবল কড়াকড়ি ছিল তাঁর। ভয়ানক ঠান্ডা থাকলেও স্নান করতেই হবে, আর শরীরচর্চা সবার আগে। ফ্রেডির শাসনে বাচ্চাগুলো সুস্থ থাকত। ফ্রেডি জানতেন, অপরিচ্ছন্ন, অসুস্থ শিশুকে সবার আগে ‘এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্প’-এ পাঠানো হবে।
ইজ়রায়েলের বিখ্যাত আঁকিয়ে ইয়েহুদা বেকন আর নামী চেক সাংবাদিক রুথ বন্ডি সে সময় ছিলেন ফ্রেডির কচিকাঁচাদের দলে। তাঁরা জানাচ্ছেন ফ্রেডির সঙ্গী ইয়ান মাউটনারের কথা। ফ্রেডি আর ইয়ান সব সময় এক সঙ্গে থাকতেন। এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতেন, গল্প করতেন, ছোটদের খেলার প্রশিক্ষণ দিতেন, এক সঙ্গে ঘুমোতেন। ছোট ছেলেমেয়েরাও জানত যে, তাঁরা পরস্পরের ভালবাসার মানুষ।
চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নোতে দেখা হয়েছিল ইয়ান আর ফ্রেডির। এক ইহুদি ক্রীড়া সংস্থায় দু’জনে খেলার প্রশিক্ষণ দিতেন। এক সঙ্গে বাচ্চাদের দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শীতের সফরে। ইয়ানের মা দুর্দান্ত সব রান্না করে দিতেন তাঁদের জন্য। ইয়ান আর ফ্রেডির সম্পর্কে সম্মতি ছিল তাঁর। তবে চেকোস্লোভাকিয়াতেও সমকাম নিষিদ্ধ ছিল।
ফ্রেডিকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র, ‘ডিয়ার ফ্রেডি’তে দেখি, শিবিরের বহু তরুণী সুপুরুষ ফ্রেডির প্রতি আকৃষ্ট। ফ্রেডি তাঁদের ভদ্র ভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন। ডিটা ক্রাউসের আত্মজীবনী পড়ে জানতে পারি যে, এক বার ছোট্ট ডিটা ফ্রেডিকে তাঁর পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেন। তখন তার মনে অনেক রকম অজানা অনুভূতির স্রোত বয়ে গিয়েছিল।
চেক হার্পিকর্ডিস্ট জুজানা রুজিকভা যখন ফ্রেডিকে প্রথম নাৎসি শিবিরে দেখেন, তখন তিনি তখন রুগ্ণ, ভিতু, ছোট্ট একটা মেয়ে। মৃতপ্রায় ইহুদি-বোঝাই ট্রেন থেকে সবেমাত্র নেমেছে সে। কিন্তু প্রথম দেখায় ফ্রেডির মোমবাতির নরম, উজ্জ্বল শিখার মতো চোখ দুটো কখনও ভোলেননি। নব্বই বছর বয়সে তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ও সেই চোখের কথা বলতে গিয়ে তাঁর মুখে মুগ্ধতার রেশ। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ডিনা গটলিবভা ব্যাবিট সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন ফ্রেডিকে প্রথম বার দেখার কথা, সমস্ত মালিন্য মুছিয়ে দেওয়া তাঁর শ্বেতশুভ্র হাসির কথা। ফ্রেডিকে মনে করতে গিয়ে তাঁদের কারও চোখ শুকনো থাকে না। সাতসকালে ব্যারাকের ছাদে উঠে রেকর্ডারে গান বাজিয়ে বাচ্চাদের জড়ো করতেন ফ্রেডি। জিমন্যাস্টিক্স করাতেন, ফুটবল খেলাতেন। তাঁর গলায় সব সময় ঝোলানো থাকত হুইসল। ফ্রেডির হুইসল-এর আওয়াজ শুনলেই লাফিয়ে উঠত ছোটরা।
টেরেজিনস্টাটের বি২বি ফ্যামিলি ক্যাম্পের মানুষগুলো ধীরে ধীরে কিন্তু বুঝতে পারছিল যে, খুব বেশি দিন তারা শান্তিতে থাকতে পারবে না। ফ্রেডিও কেমন যেন চিন্তিত আর ক্ষিপ্ত হয়ে যান মাঝে মাঝে। এক দিন জার্মান রেড ক্রস তাদের শিবির পরিদর্শনে এল। সে দিন ডিটারা বুঝতে পারল, গোটা ব্যাপারটাই নাটক। জার্মান রেড ক্রস-এর সামনে তাদের ফ্যামিলি ক্যাম্প দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা যে, নাৎসি শিবিরে কোনও রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয় না। সে জন্যই তাদের মাথা নেড়া করা হয়নি, কুখ্যাত ‘স্ট্রাইপড পাজামা’ পরতে হয়নি, তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পেরেছে।
এর পর কানাকানি শুরু হয়ে যায়, ক্যাম্পের ‘লিকুইডেশন’ শুরু হয়ে যাবে খুব দ্রুত। গোপনে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে বিপ্লবের প্রস্তুতিও। ফ্রেডি নিজেও সেই গুপ্তবাহিনীর সদস্য। বিপ্লবের অস্ত্র বলতে অনেক দিন ধরে সংগ্রহ করা জ্বালানি। ১৯৪৪ সালের ৮ মার্চ দলের কয়েক জন সদস্য ফ্রেডির কাছে আসেন। ফ্রেডিকে তাঁরা বলেন, সব সদস্য প্রস্তুত। ফ্রেডি তাঁর হুইসল এক বার বাজালেই সকলে মিলে ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে দেবে। ফ্রেডি জিজ্ঞেস করেন, তাঁর বাচ্চাদের কী হবে। উত্তর আসে, তারা মরবেই, বিদ্রোহ হলেও, না হলেও। সকলেই মরবে। মরার আগে অন্তত কয়েক জন জার্মান অফিসারকে মেরে মরতে পারলে ক্ষতি কী? ফ্রেডি অবশ্য জানতেন যে, না। সকলে মরবে না। যে ক’জনকে নাৎসিদের প্রয়োজন, তারা বেঁচে যাবে, থেকে যাবে ক্যাম্পে, যেমন কয়েক জন ডাক্তার, নার্স, শিল্পী ডিনা গটলিবভা আর ফ্রেডি নিজে। কিন্তু ফ্রেডি বাঁচবেন, অথচ তাঁর বাচ্চারা শ্বাসে ভরে নেবে বিষাক্ত গ্যাস, এমনটা তিনি সহ্য করবেন কেমন করে?
ফ্রেডি এক ঘণ্টা সময় চেয়ে নিলেন ভাবার জন্য। বিপ্লবী দলের সদস্যরা এক ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখলেন ফ্রেডি কোমায় চলে গিয়েছেন। ডাক্তারেরা জানালেন, উদ্বেগ কমানোর জন্য তাঁদের থেকে ‘বারবিচুরেট’ নিয়েছিলেন ফ্রেডি। সেটাই অতিরিক্ত সেবন করে আত্মহত্যা করেছেন তিনি।
ফ্রেডির চলে যাওয়া স্বেচ্ছামৃত্যু না হত্যা, নাকি দুটোই, সে নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। ফ্রেডির মতো মৃত্যুবিমুখ মানুষ, যিনি নেক্রোপোলিসে বসেও শিশুদের সকালবেলার রোদ্দুর চিনতে শিখিয়েছিলেন, তিনি কেমন করে মৃত্যুর সঙ্গে যেচে করমর্দন করতে যাবেন? ডিটা ক্রাউসের মতো আরও অনেকেই বলেন, সে দিন ডাক্তাররাই অতিরিক্ত সিডেটিভ ‘লুমিনাল’ প্রয়োগ করে ফ্রেডিকে কোমায় পাঠিয়ে দেন, যাতে ফ্রেডি হুইসল বাজিয়ে বিদ্রোহ শুরু করতে না পারেন, যাতে তাঁরা নিজেরাও বেঁচে যান। ইয়ান তখন একটু দুধ জোগাড় করে সংজ্ঞাহীন ফ্রেডিকে খাওয়ানোর মরিয়া চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে ‘শোয়ার্জে মিলশ’ তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে রাতে আউশউইৎজের প্রায় তিন হাজার আটশো বন্দিকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আঠাশ বছরের অচৈতন্য ফ্রেডি আর তাঁর অনেক ছোট ছোট বন্ধু।
হিটলার সমকামী পুরুষদের বিশুদ্ধীকরণের পথে বাধা হিসাবে দেখতেন। বেয়াড়া পুরুষ সমকামীদের ‘ক্যাস্ট্রেশন’, এমনকি হত্যাও করা হত। অন্য দিকে ইহুদি সমকামীদের সঙ্কট কল্পনা করাও বেশ কঠিন। তাঁদের আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য তাঁদের বন্দি শিবিরের পোশাকে গোলাপি ত্রিভুজ আঁকা থাকত। ভয়ঙ্কর সব পদ্ধতিতে অত্যাচার হত তাঁদের উপর। ফ্রেডির অসামান্য ব্যক্তিত্বের কারণেই হয়তো তাঁর ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি।
ফ্রেডির প্রেমিক ইয়ান মাউটনার শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরেছিলেন নাৎসি শিবির থেকে। ডাক্তারির পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছিলেন। এক নতুন সঙ্গীও হয় তাঁর। মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে, ১৯৫১ সালে চেকোস্লোভাকিয়াতেই যক্ষ্মায় মারা যান তিনি।
দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ফ্রেডির সমকামী পরিচয়কে যেন গোপনেই রাখতে চেয়েছিলেন আউশউইৎজ থেকে বেঁচে ফেরা মানুষেরা। পরবর্তী সময়ে ডিটা ক্রাউস, জুজানা রুজিকোভা, ওটো ডোভ কুলকা কিংবা ইয়েহুদা বেকনের সাক্ষাৎকার শুনলে বোঝা যায়, কী ভীষণ সম্ভ্রম আর সহমর্মিতা নিয়ে তাঁদের ভালবাসার কথা উচ্চারণ করছেন ওঁরা। ছোটরা যেটা সহজে গ্রহণ করতে পারে, প্রাপ্তবয়স্করা সে বিষয়ে সারা জীবনই যেন অনমনীয় থেকে যান। হলোকস্ট-এর ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রেও পুরোমাত্রায় রয়েছে এই সংস্কার।
শিশুরাই ছিল ফ্রেডির প্রাণ। তারাই যদি না বাঁচে, তাঁর বাঁচা তো অৰ্থহীন… সে জন্যই কি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন ফ্রেডি? সেই চিরঘুমের কুয়াশা-ঘেরা মাঠে ফ্রেডি হয়তো এখনও শায়িত। তাঁর বোজা চোখে, গালে, কপালে ধীরে ধীরে জমেছে হিমবিন্দু। ফ্রেডি হয়তো স্বপ্নে দেখছেন, চিলড্রেন’স ব্লকের দেওয়ালে ডিনার আঁকা স্নো হোয়াইট আর সাত বামনের ছবির সামনে বি২বি ফ্যামিলি ক্যাম্পের বাচ্চারা খেলছে, কিংবা সকলে মিলে নাটকের মহড়া দিচ্ছে… ফ্রেডি তখন হয়তো হুইসল বাজিয়ে তাদের কিচিরমিচির থামাচ্ছেন। হয়তো ঘুরে দেখছেন গোটা ব্যারাক, আর তাঁর হাতটা ধরা আছে ইয়ানের হাতে। এই স্বপ্নটুকু অনিঃশেষ হলে ক্ষতি কী?
রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো সুদীর্ঘ ঘুম ভেঙে ওঠার পর, ফ্রেডি রামধনু পতাকা হাতে প্রাইড প্যারেডে মিশে যেতে পারবেন হয়তো। কিন্তু ঘুম ভেঙে তিনি কি সেই আকাশ দেখতে পাবেন, যেখানে রামধনু নেই? আবারও ধোঁয়ার কুণ্ডলী? গাজ়ার আকাশ… তিনি কি দেখতে পাবেন, তাঁর একদা স্বপ্নের ইজ়রায়েল কেমন বোমা মেরে গুঁড়িয়ে, পূর্ণ অবরোধ জারি করে, গাজ়াকে করে তুলেছে নতুন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প? যেখানে শিশুরা পোকামাকড়ের মতো মরছে ক্ষেপণাস্ত্রের হানায়, কিংবা ধুঁকে ধুঁকে মরছে জল, খাবার, ওষুধ না পেয়ে— ফ্রেডি কি তখন পাল্টা প্রশ্ন করবেন, হামাসের হানায় শিশুদের মৃত্যুর দাম কে দেবে? ফ্রেডি কি তখন ওই শিশুদের জন্যও বানিয়ে দেবেন চিলড্রেন’স ব্লক, ওদেরও শেখাবেন ফুটবল কিংবা জিমন্যাস্টিক্স? অথবা হয়তো, এ পৃথিবী শেষ পর্যন্ত শিশুর বাসযোগ্য নয়, এ সত্যটি মেনে নিয়ে হুইসল ছুড়ে ফেলে ঘুমিয়ে পড়তে চাইবেন আবারও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy