চিরজীবী: ফুটবল-সম্রাট পেলে।
দুখী মানুষের পৃথিবীর কাছে পেলে দিশা, তিনি আশীর্বাদ। তিনি লড়াই করার প্রতীক। তথাকথিত ‘সুখী’ পৃথিবীর প্রতিনিধি নন তিনি। এমন এক খেলার ঋত্বিক তিনি, যার সঙ্গে গরিবি, বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার দীর্ঘ ইতিহাস সংযুক্ত ছিল এবং এখনও রয়ে গিয়েছে।
এ ভূগোলকে বেশ কিছু ‘স্বর্গের দেশ’ আছে। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য দেশটিকে নিয়েই ভাবনা সব চেয়ে বেশি। সেখানে অনেকেই যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, যানও। সেখানে থাকতে পারা, সেখানকার নাগরিকত্বের ‘কার্ড’ পাওয়া তাঁদের কাছে স্বর্গপ্রাপ্তিরই সমতুল। এরই উল্টো দিকে রয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ, যাদের সম্পদের ছটা নেই, দারিদ্র আছে।
আমার ভারত তেমনই এক দেশ। যদিও সম্পদের অভাব মোটেই নেই এখানে। কিন্তু তা মুষ্টিমেয়ের হাতে বন্দি। তার পিছনে রয়েছে শাসনব্যবস্থা আর বণিকবলয়ের নানা স্তর। এই রকম একটি দেশের সামাজিক আয়োজন বা খেলাধুলোর উপরও অর্থনৈতিক অবস্থা-অবস্থানের প্রভাব পড়তে বাধ্য। প্রকৃতিগত কারণেই আমরা ছোটবেলায় যেমন পুকুরে সাঁতার দেওয়াকে বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, তেমনই একটু বড় হয়ে বেছে নিয়েছিলাম ফুটবল। কারণ, তাতে আয়োজন সামান্যই লাগে। লাফাতে পারে এমন একটা বল আর খুঁটি পেলেই চলে। এ খেলা গরিবের খেলা। বড়লোক আমেরিকার গরিব মানুষজনের যেমন বাস্কেট বল। তাই ফুটবল ভারতের, এই বাংলার প্রাণের খেলা হয়ে উঠতে পেরেছিল। আমরা ফুটবল পেয়ে সব ভুলে ছিলাম। এই সব ভুলে থাকার দায়ও থাকে। তার মাশুলও দিতে হচ্ছে। চোখের সামনে ফুটবলকে মরে যেতেই দেখলাম বাংলায়, দেশে, উপমহাদেশে। বদলে উঠে এল অন্য একটি সুন্দর খেলা, যা খরচসাপেক্ষ এবং আদতে ধৈর্যসাপেক্ষ। ক্রিকেট দখল করল খেলার জগত। এর পিছনে কৌশলী নানা কারণ রয়েছে। কেন ফুটবলের তাৎক্ষণিক আনন্দ থেকে আমাদের মন ক্রিকেটের ধৈর্যের দিকে চলে গেল, তা সত্যিই ভেবে দেখার। যদিও ক্রমে ক্রিকেটও বাণিজ্যধর্মে ছোট সময়ের হয়ে উঠল। টেস্ট ক্রিকেটের মাধুর্য রইল না। আর ফুটবল দর হারাল এ দেশে।
কিন্তু খেলার কাঠামো যতই বদলাক, বাণিজ্যমূল্যের যতই ফারাক তৈরি হোক, খেলার ইতিহাসধর্ম আর ঐতিহ্যের শিকড় মুছে যায় না। পেলে এখানেই প্রণম্য আর এখানেই ইতিহাস। তাঁকে এ পৃথিবী, এই দেশ, বাঙালি পেয়েছে অস্থির সময়ের কান্ডারি হিসেবে। গরিবের খেলা হিসেবেই ফুটবল বাঙালির প্রাণ হয়ে উঠেছিল এক দিন। ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটি আকাশ থেকে পড়েনি। আমাদের নান্দীকারের ‘ফুটবল’ প্রযোজনাটি চারশো বারেরও বেশি অভিনীত হয়েছে। তার পিছনে বাঙালির ফুটবলপ্রেমই। মনে আছে, এক বার ইডেন থেকে ক্রিকেট ম্যাচ দেখে বেরিয়ে হেঁটে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস যাচ্ছি। সে দিন অভিনয় আছে। আমার পাশ দিয়ে কয়েক জন নবীন চলে গেল আমায় ডাকতে ডাকতে। কী নামে ডাকল? ‘ফুটবল’ নাটকেরই এক চরিত্রের নামে— ‘কালীদা! কালীদা!’ এই ভালবাসায় ফুটবলই জড়িয়েছে!
পেলে ক্রিকেট খেললেও হয়তো তুমুল ইতিহাস তৈরি করতেন। এমনই হয় জিনিয়াসদের। কিন্তু আদত কথা, তিনি শুধু ফুটবলার নন, নিছক এক জন খেলোয়াড়ও নন, তিনি জাতির পরিচয়। অগণন নিতান্ত সাধারণ মানুষের কাছে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রতীক।
পেলে শপথের নাম। সেই কারণেই তিনি চিরজীবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy