Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

কোঁচার ফুলই যেন রুচির জয়নিশান

বছর-বছর সেই ফুল ফোটান ধুতি কোঁচানোর শিল্পীরা। কারও মিহি কুঁচি, কারও কড়া চুনোট-করা কোঁচা ফুটে থাকবে পদ্মফুলের মতো। প্রত্যেক বাবুর পছন্দ কোঁচানো-শিল্পীদের নখদর্পণে।

শিল্পী: কোঁচায় ফুল ফোটাতে ব্যস্ত কৈলাস বারিক। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

শিল্পী: কোঁচায় ফুল ফোটাতে ব্যস্ত কৈলাস বারিক। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৪৮
Share: Save:

শোভাবাজারের অ-বাবু সটান ডাক পাঠান। হাটখোলার আ-বাবু তাঁর ‘ম্যান ফ্রাইডে’ পাঠিয়ে দেবেন।

কোন বাবুর কেমন পছন্দ চোখ বুজে বলবেন কৈলাস বারিক। নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের বাগওলা বাড়ির ঠাকুরদালানে, সন্ধেগুলোয় এখন মরার সময় নেই তাঁর। লিকপিকে কালো আঙুল চলছে মাখনের মতো। বাবুদের কোঁচার বায়না সামলাতে গলদঘর্ম কৈলাস ভদ্রক থেকে তনিমাকে আনিয়েছেন।

জামাইষষ্ঠী, নববর্ষ এবং দুগ্গাপুজোয় বাবুদের কোঁচার পত্তন যেন ধ্রুপদী রুচিবিলাসের জয়নিশান।

বিশ্বকর্মা পুজো থেকে দম ফেলার ফুরসত পাননি কৈলাস। তনিমা থাকবে লক্ষ্মীপুজো অবধি। তত দিন অন্তত হাত পুড়িয়ে খেতে হবে না। ক’দিন বড়বাজারে ইলেকট্রিক সারাই সামলে মাঝরাত অবধি কাপড় কোঁচানোর ফাঁকে ভাতে-ভাত করে নিতে হয়েছে কৈলাসকে।

‘বাগওলা বাড়ি’র ঠাকুরদালানের পিছনপানে ঘুপচি ঘরের দালানে সন্ধেগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধুতি বিছিয়ে ব্যস্ত। ধুতির উপরে পাথর রেখে কৈলাস ডান পা চেপে ধরেছে। ডান হাতের আঙুলের ছোঁয়ায় চোখ মেলছে ফুলের পাপড়ি। বাঁ হাতও সমান তালে কাপড়টা সাইজ় করে চলে। একেই বলে সব্যসাচী! বরের জন্য গর্বে বুকটা ভরে ওঠে তনিমার। দোকানের রেডিমেড ধুতিতেও কোঁচার বাহার এতটা খুলবে না!

কৈলাসের ধুতি-শিল্প দিন-দিন ধারালো হচ্ছে। গ্রে স্ট্রিট লাগোয়া তল্লাটে কৈলাসের বিকল্প নেই। শোভাবাজারের বাগওলা বাড়ির রথীন্দ্রনারায়ণ দেবকে ক্যালকাটা ক্লাবেও ধুতি ছাড়া দেখাই যেত না! তিনি কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। আবার শোভাবাজারেরই গোপীনাথ বাড়ির অলককৃষ্ণ দেবের দৌহিত্র সৃজন মিত্র পুজোর ছুটিতে শহরে ফিরেছেন। বেঙ্গালুরুতে চাকরিরত তরুণ সৃজন গত এক মাস দিদিমা নন্দিনী দেববৌরানিকে ফোনে অস্থির করে দিচ্ছিলেন, “দিদাই, তুমি কিন্তু কৈলাসকে আমার কাপড়টা দিতে ভুলবে না! আমার দু’বেলাই কুঁচোনো কাপড় চাই!” মহালয়ায় নাতির আসার আগেই কৈলাসকে দিয়ে কাজ সারিয়ে রেখেছেন নন্দিনী। আজকালকার মোটা-পাড় ধুতির চুনোট করা চাট্টিখানি কথা নয়। নাগাড়ে কাজ করে যেতে আঙুল টনটন করে। একটু থেমে পান মুখে কৈলাস হাসেন! মেঝেয় থেবড়ে বসে বলেন, “আমাদের ঠাকুরদালানে দু’বেলা কোঁচানো ধুতি ছাড়া এক জন বাবুকেও দেখবেন না!”

বছর পঁচিশ আগে কৈলাসের বাবা বাসুও এক ভঙ্গিতে বসতেন। বাবার কথায় চোখে গর্বের ঝিলিক। কৈলাস বলেন, “আমি আর কী পারি! বাবাকে যদি দেখতেন। বাবা ধরার পরে কোরা ধুতি ভাঁজ খুলে উঠোনে ছুড়ে দিন। কোঁচার চুনোট পদ্মফুলের মতো ফুটে থাকবে।” বাসুও থাকতেন বাগওলা বাড়িতেই। রাজবাড়ির জলের ভারী। পাড়াময় বাড়ি-বাড়ি বাঁক কাঁধে জল দিয়ে যেতেন। আর বাবুদের রাশি-রাশি ধুতির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ফিরতেন। মিহি চুনোটে কাপড় কুঁচিয়ে পাট করে পৌঁছে দিতে হত।

তখন টালিগঞ্জপাড়ায় ড্রেস-আর্টিস্ট বিশুবাবু, শিবুদের রমরমা। পাগড়ি পাকানো, ধুতি কোঁচানোর বাঘা ওস্তাদ! হাটখোলার দত্তদের বাড়ি কুশো, পাথুরেঘাটায় মন্মথ ঘোষেদের বাড়ির দেবী, ভবানীপুরের মল্লিক-বাড়ির সাগর, পূর্ণদাদের যুগ। সে যুগে চাদরেও চুনোটের বাহার। আস্তিক দত্তের মনে পড়ে বাবা সুধাংশুকুমারের কথা। সোনালি পাড় জোড়ের সঙ্গে মিলিয়ে সোনারঙা লপেটা জুতোর সাজ। পাম্পশু, গ্রিশিয়ান, লপেটা জুতোর কেতাই আলাদা। পুজো এলে দাদুর ঈগলের মুখ-বসানো রুপোর ছড়ির শোকে অলককৃষ্ণ দেবের বুকটাও হু-হু করে।

বাসুর ছেলে কৈলাসের মতো পাথুরেঘাটার গ্যারাজঘরে দেবী পোদ্দারের মেয়ে তারামণিও দশ হাতে চুনোট করতেন। গিলেফল ধরে পাঞ্জাবি গিলেটা না-হয় বাড়িতেই হল। কিন্তু ধুতি কোঁচানো মহা ঝকমারি। বেহালায় সাবর্ণদের বড়-বাড়ির কত্তারা কয়েক বছর আগেও বাগবাজারের শরণ নিতেন। সব ধুতি গিন্নি ইভাদেবীর বাপের বাড়ির পাড়া থেকে কুঁচিয়ে আসত। ভবানীপুরের গিরিশ ভবনের কর্ত্রী ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ও শ্যামপুকুরে বাপের বাড়ির পাড়ার ভরসা করেন।

এ কালে ধুতিবাবুদের জীবন আরও জটিল হয়েছে। হাটখোলার আস্তিকবাবুর সঙ্গে তাঁর দক্ষিণ কলকাতাবাসী মামাতো দাদা, প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্তিরের কথা হচ্ছিল। কাপড় কোঁচানোর নামে সব বড়বাড়িই এ কালে কোণঠাসা। কৈলাসেরা ব্যতিক্রম! কাপড় কোঁচানোর বাঁধা ঠাইগুলি সর্বত্র নড়বড়ে। আস্তিক নিজে এখন মিলের নিরাভরণ দশ হাতি ধুতির বৈরাগ্য অবলম্বন করেছেন। তবে তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এলগিন রোডে জজ-ব্যারিস্টারের ঘর স্যর প্রভাসচন্দ্র মিত্র, বিনোদচন্দ্র মিত্রদের কোঁচা-সংস্কৃতি অটুট।

ধুতি-পিছু বাড়তি উপায়ও হয় কোঁচা-শিল্পীদের। তবে লন্ড্রিতে বাক্সে ভরা আনকোরা ধুতির মতো করে দিতে হলে খরচা আছে। বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের সাবেক ধুতির দোকান পূর্ণচন্দ্র সুরাইরা কোঁচানোর ঝামেলায় ঢুকবেন না। সুকুমার সুরাই বললেন, “আমরা কোঁচাই না, শুধু ধুতি বিক্রি করি! সাবেক ধুতি, দড়ি-বাঁধা ধুতি নয়!” তবে কোঁচানোর জন্য ফড়েপুকুরের শ্রী কালী লন্ড্রির নাম জোরদার ‘রেকমেন্ড’ করছেন তিনি। পিকনিক গার্ডেনের দুলাল দাসের লন্ড্রিতেও ধুতি ধুয়ে পালিশ করে কোঁচানোর ব্যবস্থা আছে। ধুতি-পিছু ২৫০-৩০০ টাকা হাঁকছেন দুলালবাবু। বাবা বাসুর আমলের ১০ টাকা
থেকে কৈলাসের রেট এখন বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে।

“কোঁচার দু’টো স্টাইল বাবু, লুটোন আর গুটোন,”— কোঁচা-তত্ত্ব বোঝান কৈলাস! ছোট রাজবাড়ির অলকবাবুর জন্য একটু উঠিয়ে রাখতে হবে। সত্তরের কোঠাতেও বাবু ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। পারলে কোঁচা হাতে জয়পুরিয়া কলেজের ফুটে ঘেঁষাঘেঁষির ছাদ টপকে ঠাকুরদালানে নামতেন। এখন আশি পেরিয়ে পুজোর দায়িত্ব ছোটদের ভাগ করে দিয়েছেন। কৈলাসের পর্যবেক্ষণ, ইয়ং বাবুরা আবার শো-বাজি করে ফেন্সি ঢঙে চলেন। গুলিয়ে ফেললে হবে না।

ধুতি চুনোটের এই আর্ট কৈলাসের বাবাকে শিখিয়েছিলেন বাগওলা বাড়ির অমলনারায়ণ দেব। তাঁর তুতো ভাই রথীন্দ্রনারায়ণও ছিলেন ঘোর কোঁচা-সচেতন। ছোট রাজবাড়ির ঠাকুরদালানের সন্ধেয় একদা কোঁচার কম্পিটিশন হত। কত্তা দ্বিজেন্দ্রকৃষ্ণ দেব। তিনি নিজে বিচার করবেন, ঘোরাঘুরি, ছুটোছুটির শেষে বাড়ির কোন ছেলের কোঁচার ফুলের সব পাপড়ি অটুট। এক দুষ্টু ছেলে চুপিচুপি সাদা সুতোয় কোঁচার মাথায় একটা সেলাই মেরে রাখলেন। তাতেই কেল্লা ফতে। অলকবাবু হেসে বলেন, “আজকের দড়ি-বাঁধা রেডিমেড ধুতিতে তো সেই সেলাই-করা কোঁচার চুনোটই চলছে। সে-দিক দিয়েও নতুন যুগের পথপ্রদর্শক আমাদের বাড়িই।”

দড়ি-বাঁধা ধুতি মিহি করে কুঁচোতে পাঠিয়ে দেন কোনও বাবু। ফুলের মতো চুনোটে কড়া মাড় চাই। অর্ধেক কুঁচোতেই ডান হাতের আঙুল ধরে আসে! একটু দম নিতে হয়। পুজোর চাপে রাত বারোটা বাজে রোজ।

ঠাকুর গড়ার থেকে এ কাজ কম কিসে! শুধু একটি বার কৈলাসের বুকটা ঢিপঢিপিয়ে উঠবে। বোধনের দিন রাজবাড়ির গণেশবাবার ধুতিও তাঁকেই কুঁচোতে হয়। লাল পাড়-সাদা ধুতিটায় পাথর রেখে ডান পায়ে চাপ দিতে গিয়ে ফি-বছর জিভ কাটেন কৈলাস, “ভুল হলে ক্ষমা কোরো। আমার কর্ম আমি করছি, ঠাকুর। আর কিছু জানি না।”

দেবী মায়ের অঙ্গে সোনার গয়না ওঠে। আর গণেশবাবাও কোঁচানো ধুতিতে সাজেন। ‘যাক, আমার কলকাতা আসা সার্থক!’ ভেবে সন্ধের ঠাকুরদালানে পারলে গর্বে কলার তোলেন কৈলাসজায়া তনিমা।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Durga Puja 2023
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy