সংগ্রামী: ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কর্মরত নারায়ণ কোঁয়ার (ডান দিকে) —ফাইল চিত্র।
সে দিন মা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন আমায়। জলের ফোঁটা পড়ছিল আমার পিঠে। বাবা শিক্ষক, আর ছেলে কিনা টুয়েলভ ফেল! পিঠে ব্যর্থতার সেই জলছবির দিব্যি কেটে ঠিক করেছিলাম, পাশ করবই। বড় অফিসার হয়ে মায়ের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেব। আধপেটা খাওয়ার দুঃখ, মাটির ঘরে থাকার দুঃখ, অপমানের দুঃখ।
ওটিটি-র ‘টুয়েলফথ ফেল’ যখন সকলের মুখে মুখে, তখনই অসমের প্রচারবিমুখ এক আইএএস অফিসার সকাল থেকে সন্ধ্যা করে চলেছেন মিটিং। রাজ্যের সব স্কুলের মূল্যায়ন পর্ব শুরু হচ্ছে। তাই দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁর। তিনিই যে রাজ্যের শিক্ষা সচিব! টিওয়া জনজাতির লাংলু গোষ্ঠীর সন্তান নারায়ণ কোঁয়ার এখন পর্যন্ত টিওয়াদের একমাত্র আইএএস!
কাজের চাপে সিনেমাটি দেখা হয়নি তাঁর। কিন্তু ছবির গল্প আঁচ করতে অসুবিধে হয় না তাঁর। এ তো তাঁর নিজেরও কাহিনি।
প্রাইভেট স্কুলের অনিয়মিত শিক্ষক হরেন কোঁয়ার যখন চোখ বুজলেন, তাঁর বড় ছেলে ক্লাস ফাইভে। বাড়িতে আরও দুই ভাই, এক বোন। পাঁচটা পেটের দায় এসে পড়ে মায়ের ঘাড়ে। স্কুলের তরফে জানানো হল, আপাতত পেনশনের প্রশ্ন নেই। ফলে মাকে সাহায্য করতে বড় ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। পর্দার মনোজকুমার এপিজে আবদুল কালামের লন্ঠনের আলোয় লেখাপড়ার কথা বলতেন। নারায়ণের চামকোটা গ্রামেও বিদ্যুতের বালাই ছিল না।
নারায়ণ বলছিলেন, রোজ পাঁচ কিলোমিটার যেতে-আসতে হত স্কুল করার জন্যে। ফি-বছর বন্যায় ফসল নষ্ট হত। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সংসারের হাল ধরতে ছ’মাস লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছিল। সে সব রাতে বাড়ির সকলকে খালি পেটেই শুয়ে পড়তে হত। তাঁর বয়সি ছেলেরা ক্লাস পালিয়ে মাছ ধরে। তিনিও তা-ই করতেন। তবে পেটের দায়ে।
বাতাবাড়ি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হরেন মাস্টারের ছেলেকে ক্লাসে না দেখে খোঁজ শুরু করেন। দেখতে পান, ক্লাসে না এসে সংসার চালাতে মাছ ধরছে সে। তিনিই নারায়ণকে ফিরিয়ে আনেন ক্লাসে। জোগাড় হয় পুরনো ইউনিফর্ম ও আগের ক্লাসের ছেলেদের পুরনো বইপত্র। তত দিনে বাবার পেনশন চালু হয়েছে। ১৩৪৫ টাকা মাত্র।
মাটি কামড়ে পড়ে থেকে দ্বিতীয় ডিভিশনে দশম শ্রেণি পাশ করে নারায়ণ। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের সময় এল ধাক্কা! নারায়ণ বলে চলেন, “গ্রাম থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ছিল কলেজ। বাসের ভাড়া অধিকাংশ দিনই থাকত না। তার উপর ভয়ঙ্কর বন্যায় সব ভেসে যায়। শুধু আমি নই, আশপাশের সব শিক্ষার্থীই তখন প্রাণ ও পরিবারকে বাঁচাতে ব্যস্ত। প্রয়োজনীয় উপস্থিতি না থাকায় অনিয়মিত ছাত্র হয়ে গিয়েছিলাম। প্রাইভেটে কোনও রকম লেখাপড়া ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে হয়। ফল যা হওয়ার তা-ই হল। ফেল করার খবর নিয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ি। সংসারে টাকা না থাকলেও, গ্রামে সম্মান ছিল বাবার। হরেন মাস্টারের ছেলে কি না দ্বাদশ ফেল! মা আমার কষ্টটা জানতেন। তাই দু’জনেই নীরবে কাঁদতে থাকি অন্ধকার ঘরে।”
কিন্তু ‘টুয়েলফথ ফেল’ সিনেমার পোস্টারে ছোট্ট করে লেখা ‘রিস্টার্ট’ শব্দটা যে তাঁর জীবনেরও মূল মন্ত্র। দারিদ্র আর বন্যা তাঁকে বছরের পর বছর শূন্য থেকে শুরু করতে শিখিয়েছে। সেই জেদেই পরের বার উচ্চ মাধ্যমিকে এল প্রথম বিভাগ!
দারিদ্রের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে নারায়ণ দেখতেন, আলফা জঙ্গিরা অস্ত্র নিয়ে প্রায়ই গ্রামে আসে। মাঝেমধ্যে ভাবতেন, নাম লিখিয়েই ফেলবেন জঙ্গি দলে। কিন্তু বাবার সম্মান, পরিবারের কথা ভেবে পিছিয়ে যেতেন। মেধাবী নারায়ণ গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও এমএ পাশ করে ফেললেন। নেট পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হলেন! মনে তখন আমলা হওয়ার দুঃসাহস, কিন্তু সামর্থ্য নেই। সুযোগ এল নওগাঁওয়ের একটা কলেজে লিয়েন ভ্যাকেন্সিতে পড়ানোর। সেই টাকা জমিয়েই পাড়ি দিলেন দিল্লির মুখার্জিনগর। বলছিলেন, “গরমে কষ্ট হয়নি। কিন্তু দিল্লির শীত যে এমন ভয়ানক জানতাম না। গরম কম্বলের দাম আটশো টাকা চাইছিল। তত দিনে জমানো টাকা প্রায় শেষ। এত দাম দিয়ে কম্বল কেনার প্রশ্নই নেই। সঙ্গের সম্বল শোয়ার গদিটাকেই গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।”
মাত্র এক বছরের কোচিং করেই গ্রামে ফিরে আসেন নারায়ণ। তার পর নিজেই পড়াশোনা চালান। ২০০৮ সালে ‘প্রিলিমস’ পাশ করলেও ‘মেন’ পাশ করা হল না। ফের ‘রিস্টার্ট’। এ বার আরও মন দিয়ে পড়াশোনা চলল। সেই সঙ্গে নগাঁও কলেজে পড়ানোও। ২০০৯ সালে প্রিলিমস তো বটেই, মেন-ও পাশ করে ফেললেন। তাঁর মতে অসমিয়া মাধ্যম ইউপিএসসি-তে বাধা হতে পারে না। এবং তাঁর পরামর্শ, দিল্লিতে কোচিং নিতে গেলে নামী ইনস্টিটিউট নয়, ভাল শিক্ষক খুঁজে নিতে হবে।
এ বার ইন্টারভিউয়ের পালা। ইন্টারভিউয়ের প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লি গেলেন তিনি। কিন্তু, সেখানকার সব কোচিংয়েই বলল, ইন্টারভিউ মানেই পার্সোনালিটি টেস্ট। পার্সোনালিটি দু’দিনে বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কার্যত বিনা প্রস্তুতিতে, আত্মবিশ্বাস সম্বল করেই ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে এসে বসলেন অসমের ‘টুয়েলফথ-ফেল’ ছাত্র।
প্রায় ৪৫ মিনিট চলেছিল ইন্টারভিউ। নারায়ণের মতে, তাঁকে সেই চূড়ান্ত পর্বের ইন্টারভিউ উতরে দিতে সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছে চা বাগানের ‘চোলাই মদ’!
কী ভাবে?
বোর্ডের এক সদস্য নিয়মিত অসমে আসতেন। তিনি জানতে চান, “আচ্ছা বলুন তো, ইংরেজরা অনেক আগেই অসমের চা-বাগানগুলিতে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা, বাজার, আবাসন সবই তো তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার পরেও চা-বাগান এলাকা এতটা পিছিয়ে পড়ল কেন?”
নারায়ণ বলেন, “এমন প্রশ্নের কোনও তৈরি জবাব আমার কাছে ছিল না। ভাবার সময়ও নেই। হঠাৎ বলে দিলাম, ওই সব পরিকাঠামোর পাশাপাশি ইংরেজরা চা-বাগানে চোলাই মদের সংস্কৃতিও চালু করে— যা শ্রমিকদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ওই সদস্য যেন আমার এই জবাবেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, ‘ঠিক তা-ই।’ পরের পাঁচ-ছ’মিনিট আমায় কিছু বলতে হল না। চা বাগানে চোলাই সংস্কৃতি ও তার কুফল নিয়ে তিনিই বোর্ডকে বোঝাতে থাকলেন।”
ইন্টারভিউয়ের ফল? ২০১০ ব্যাচের আইএএস নারায়ণ কোঁয়ার। সর্বভারতীয় র্যাঙ্ক ১১৯।
টিওয়া সম্প্রদায়ের মেধাবী ছেলেমেয়েদের সাহায্য করে চলেছেন নারায়ণ। রাজ্য পর্যায়ে এসিএস, এপিএস অফিসারও হয়েছেন তাঁদের কয়েক জন। গুয়াহাটি পুরসভার কমিশনার হিসেবে রাজ্যের সেরা প্রশাসকের পুরস্কার ও শিবসাগরের জেলাশাসক থাকাকালীন গ্রামীণ প্রকল্প রূপায়ণে উৎকর্ষের স্বীকৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছেন নারায়ণ।
মায়ের জন্য মাটির ভঙ্গুর ঘরের জায়গায় ভাল একটা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া স্বপ্ন ছিল তাঁর। চাকরি পেয়েই বাড়ি পাকা করার কাজে হাত দেন নারায়ণ। গত বছর দেহ রেখেছেন মা। ‘টুয়েলফথ ফেল’ ছেলের গড়ে দেওয়া পাকা বাড়িতেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy