Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali Feature

যে বেদনা আজও অমলিন

ইতিহাসের পাতায় তার নাম দেশভাগ। ভাবা হয়নি, এর পরিণামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে বহু সুখস্মৃতির জন্মভূমি, আশৈশব চেনা পথ ও প্রান্তর। তাদের নতুন পরিচয় হবে ‘উদ্বাস্তু’। পিছনে পড়ে থাকবে স্বজনের শ্মশান। স্বাধীনতার আনন্দও ম্লান হয়ে যাবে এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায়।

ছিন্নমূল: এই ভাবেই ১৯৪৭ সালে জন্মভূমি ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে চলে আসতে হয়েছিল অন্য দেশের শরণার্থী শিবিরে।

ছিন্নমূল: এই ভাবেই ১৯৪৭ সালে জন্মভূমি ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে চলে আসতে হয়েছিল অন্য দেশের শরণার্থী শিবিরে। —ফাইল চিত্র।

নিখিল সুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪০
Share: Save:

বরিশালের ফিরোজপুরে জন্ম নেওয়া অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার স্মৃতিরঞ্জন মৃধা ১৯৮৬ সালে লিখেছিলেন, ‘র‌্যাডক্লিফের কলমের আঁচড়ের দাগ মাটিতে বা জমিতে পড়েনি, দাগটা পড়েছে জন্মসূত্রে দুর্ভাগা এক কোটি এগারো লক্ষ মানুষের বুকের পাঁজরে।’ সেই আঁচড়ে ‘জন্মভূমি-মায়ের বুকখানা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে।’ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী এবং ১৯৫২-তে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নির্বাচিত সদস্যা মণিকুন্তলা সেন দেশভাগের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘আমার জন্মস্থান বরিশাল হবে অন্য দেশ, বুক ভেঙে যাবে আমার।’

১৯৪৭-এর এপ্রিলেও বোঝা যায়নি অগস্টে দেশভাগ হবে। এ পারের মানুষ যাবে ও পারে, ও পারের মানুষ আসবে এ পারে। প্রাক্তন ইংরেজ ব্যারিস্টার সিরিল র‌্যাডক্লিফ আগে কখনও ভারতে আসেননি। মানচিত্র পড়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যেও ছিল না তাঁর। অভিজ্ঞতা ছিল না এ দেশের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ভাষা ও আবেগ সম্পর্কে। তাঁকে মাত্র সাত সপ্তাহ সময় দেওয়া হল দেশ ভাগ করে মাঝখানে সীমারেখা টেনে দিতে। এক বারও ভাবা হল না এর পরিণামে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য অনিশ্চয়তা ও বিপর্যয়। তাদের নতুন পরিচয় হবে ‘উদ্বাস্তু’। ছেড়ে যেতে হবে পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটে, বহু সুখস্মৃতির জন্মভূমি, আশৈশব হেঁটে যাওয়া চেনাপথ, প্রান্তর। পিছনে পড়ে থাকবে শুধু স্বজনের শ্মশান।

পূর্ববাংলার হিন্দুরা সাধারণ ভাবে দেশ ছেড়ে চলে আসার কথা ভাবেননি। অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, এই ভাগাভাগি সাময়িক। সাধারণ মানুষ কেন, স্বয়ং নেহরু লিয়োনার্ড মোজলেকে বলেছিলেন, ‘পার্টিশন উড বি টেম্পোরারি’। ঢাকার মুন্সীগঞ্জের অসিতকুমার মুখোপাধ্যায় দেশভাগের পরেও কখনও ভাবেননি, ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। এমনকি, অনেকে স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা মোটামুটি স্থির করেছিলেন, পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে থাকবেন পিতৃপুরুষের ভিটের টানে। দেশভাগের পর যাঁরা এ পার বাংলায় এসেছিলেন, ঢাকার নরসিন্ধি গ্রামের সন্ধ্যা ভট্টাচার্যের মতো বিশ্বাস করতেন, ‘ও পার বাংলায় ফিরে যাওয়া কোনও সমস্যা হবে না।’

এড়ানো যায়নি অভাবিত অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর জীবনে ঘনিয়ে আসে অকল্পনীয় বিপর্যয়। দেশভাগের জন্য মানসিক প্রস্তুতির সময় মেলে না অনেকের। সব কিছু ফেলে কেবল বয়ে নিয়ে আসে দেশছাড়ার হৃদয় মথিত করা বেদনার স্মৃতি। ধানসিঁড়ি, সন্ধ্যা আর কীর্তনখোলা নদীর দেশ বরিশালে জন্ম নেওয়া কবি জীবনানন্দ দাশ হয়তো তাঁদের জীবনের কথা ভেবেই লিখেছিলেন, ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে দেখা হয় নাকো তার।’ চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘দেশভাগের বেদনার ভাষা আজও তৈরি হয়নি, যে ভাষায় বেদনার এই অতলান্ত গভীরতাটা তুলে ধরা সম্ভব।’ ছেড়ে আসা জন্মভূমির জন্য অন্তরের কাতরতা ফুরোয় না কোনও দিন। সে কাতরতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না বলে অনেকে নীরব থাকেন, কেউ বাঙ্ময়।

বাংলার মতো বিভক্ত হয়েছিল পঞ্জাবও। দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে ঊর্বশী বুটালিয়া তাঁর ‘দ্য আদার সাইড অব সাইলেন্স’ বইটি লেখার জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পঞ্জাবের উদ্বাস্তু মেয়েদের। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি লক্ষ করেছিলেন, দুঃস্বপ্নসম অভিজ্ঞতা অর্জন করে এসেছিলেন যে সব মহিলা, অধিকাংশই নির্বাক। যদিও কথা বলেন, বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে যান। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’-য় লিখেছেন, ‘যারা কখনোই, কোনো কারণেই দেশত্যাগ করবে না, দেশত্যাগের কল্পনা পর্যন্ত যাদের মাথায় আসেনি, তাদের যখন হাজারে হাজারে লাখে লাখে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হয়েছে— আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সেই বৃহত্তম বেদনা ও যন্ত্রণার কথা কেউ লেখেননি।’

অনেকে মনে করেন, সেই স্মৃতি উসকে দেওয়া নিরর্থক। ঊর্বশী বুটালিয়ার ভাষায়, ‘দেশভাগের কথা ভোলা খুব কষ্টকর, কিন্তু তা মনে করাও আতঙ্কের বিষয়।’ কমিউনিস্ট নেতা, প্রয়াত মন্ত্রী প্রশান্ত শূরের বাবা রায়সাহেব নগেন্দ্রকুমার শূরকে হত্যার আগে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল নিজের কবর খুঁড়তে। উদ্বাস্তুদের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তাঁর বাবার নিষ্ঠুর হত্যার কথা উঠলে তিনি চুপ করে যেতেন।

একই অভিজ্ঞতা পশ্চিমে পঞ্জাবের মানুষের জীবনেও। দেশভাগের সঙ্কটময় দিনে ত্রিলোক সিংহের বয়স ছিল নয় বছর। ধর্মান্তরকরণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অভিভাবকরা পরিবারের মেয়ে ও শিশুদের সঙ্গে ত্রিলোককেও হত্যা করতে উদ্যত হয়। ত্রিলোকের কাতর অনুনয়ে নরম হয় তাদের মন। সে রক্ষা পায়। পরিবারে বেঁচে থাকে শুধু কাকা মঙ্গল সিংহ ও ত্রিলোক। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার বাৎসরিক দিনটিতে, প্রত্যেক বছর তারা দু’জন স্বর্ণমন্দিরে যায়। মৃত পরিজনদের স্মরণ করে নীরবে, ফিরে আসে নীরবে। পঞ্জাবে উদ্ধার করা মেয়েদের অতীত নিয়ে কেউ প্রশ্ন করত না। সকলে চাইত মেয়েরা ভুলে যাক সেই ক্ষতকে। বিস্মৃতিই একমাত্র প্রলেপ দিতে পারবে সেই ক্ষতে।

তবে, দেশভাগের ভয়ঙ্কর স্মৃতির মধ্যেও ভেসে ওঠে শরতের শিউলির মতো স্নিগ্ধ মানবিকতার স্মৃতি, যার সংখ্যা কম হলেও বিরল নয়। কিছু স্মৃতিকথায় মেলে তার মনোজ্ঞ দৃষ্টান্ত, যেখানে দেখা যায়, যখন মানুষের মধ্যে অমানুষ জেগে ওঠে, তখনও থেকে যায় কিছু মানুষ। মনোময়ী বসু উল্লেখ করেছেন, দু’টি ঘটনা। তাঁর এক ধনী বিধবা আত্মীয়া, ঢাকায় তাঁকে বোরখা পরিয়ে তাঁর ভৃত্যরাই তাঁকে নিরাপদে পৌঁছে দেয় সীমান্তে। দ্বিতীয় ঘটনায়, খুলনার রূপশ্রী মণ্ডল পরিবারের সকলকে হারিয়ে শিশুপুত্র নিয়ে এক প্রতিবেশিনীর সাহায্যে সীমান্ত পার হন তাঁরই বোরখা পরে। মণিকা দাস ও তাঁর পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল প্রতিবেশী খান পরিবার। মণিকার মা চলে আসার সময় খান পরিবারের কর্ত্রীকে বাড়ির চাবি দিয়ে বলেন, এখন থেকে এ বাড়ি তাঁর। মহিলা চাবির গোছা কুয়োর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দ্যাখলা তো, চাবি ফ্যালাইয়া দিলাম। ঐহানেই রইলো। তুমি আবার আইস্যা বাইর কইরা লইয়ো।’

১৯৩৪-এ বিয়ে হয়ে চলে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহের মামুদপুরের সীতা সরকার। দেশভাগের পর ফিরে এসে ট্রেন থেকে নামলে দীর্ঘ দিন পরে যে মানুষটা তাঁকে এক লহমায় চিনে ফেলেছিলেন, তিনি স্কুলের বৃদ্ধ মৌলবি স্যর। সীতা দেবী লিখেছেন, ‘মনে হল, এই প্রথম নিজের কারও স্নেহস্পর্শ পেলাম। আজ এতগুলি বছর পার করে দেশের কথা মনে করতে গিয়ে সেই মৌলবী স্যারের মুখটাই মনে পড়ছে।’

দাঙ্গা, হিংসা, বীভৎসতার ভয়ঙ্কর স্মৃতির পাশাপাশি অনেকের মনে বার বার উঁকি দিয়েছে ফেলা আসে জন্মভিটের স্মৃতি, যা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার উৎস। বহু দিন পরে কীর্তনখোলা নদীর ধারে দাঁড়ালে কবি শঙ্খ ঘোষের মনে হত, ‘আমার শরীর শুধু জেগে ওঠে তার কাছে গেলে।’ তাঁর কবিতায় উথলে উঠেছে তাঁর বেদনার স্মৃতি— ‘তোমার মাটির কাছে পড়ে আছে পঞ্চাশ বছর/ সে মাটির নাম আজ মনে পড়ে বহুদিন পরে/ সে-মাটির নামে আজ বয়স ভেঙেছে বাঁধ/ তবুও তোমার কাছে যাবার পাইনি কোনো পথ/ তোমার হৃদয় আজ হয়ে আছে হৃদয়ের মঠ।’ নির্বাসিতের চূড়ান্ত বেদনা হল, যে-মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের তৃপ্তি, তা থেকে বঞ্চিত হওয়া। ‘পিতামহী’ শান্তা সেনের ছদ্মবেশী আত্মজীবনী। বইয়ের অনেকটা অংশই দেশ-আকুলি স্মৃতিতে বেদনার্ত। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বরিশালে যাওয়ার স্মৃতি— পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো বড় চত্বরে শিউলির মোটা আস্তরণ, শাপলা, ‘আকাশে মাটিতে উঠোনে গাছগাছালিতে জ্যোৎস্নার শাদা,’ নদী-নৌকো-স্টিমার ঘাট। সেই জগতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না।

আসলে পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলি এমন নৈসর্গিক শোভায় শোভিত যে, এক বার সেই নান্দনিক দৃশ্য যার মনকে মথিত করেছে সে চিরকাল আবিষ্ট থেকেছে সেই স্মৃতিতে। ১৯৪৯ সালে যখন আমি এগারো, যশোরে ভৈরবের তীরে সিদ্ধিপাশা গ্রামে গিয়েছিলাম মামাবাড়ি। সে সময় থাকতাম জামশেদপুরে। সিদ্ধিপাশা গ্রামে পা দিয়ে লৌহনগরীর রুক্ষ মাটিতে লালিত আমার মনে জেগেছিল এক অভূতপূর্ব উল্লাস। প্রাণ ভরে গিয়েছিল একটা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের আনন্দে। আজ অশীতিপর বয়সে এসে আজও ভুলতে পারেনি সিদ্ধিপাশা গ্রামের হেমন্তের শিশিরমাখা শান্ত সকাল, অসীম নির্জনতা, সেই নির্জনতাকে টুকরো করে দেওয়া কুবোপাখির অক্লান্ত ডাক; নারকেল, সুপুরি, বাঁশ, আম, কাঁঠাল, রয়না এবং আরও নাম না-জানা গাছগাছালি, আসন্ন শীতের শান্ত নাতিপ্রশস্ত ভৈরব, তার নিচু স্বরে কথা বলার মতো ঢেউয়ের আলতো স্পর্শে তীরে বাঁধা গনি মাঝির নৌকোকে দুলিয়ে দেওয়া, ভৈরবের বুকে মাঝে মাঝে শুশুকের চকিত ওঠানামা।

একটা কথা শুধু ভাবি, মাত্র দশ-বারো দিন সেই গ্রামে থাকার ফলে সাত দশক আগে দেখা গ্রামটিকে যদি দেখার জন্য আজও প্রাণটা আনচান করে, তা হলে যারা আজন্ম গ্রামে লালিত হয়ে গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের মনের কষ্ট, বেদনা কতটা গভীর হতে পারে।

বরিশালের অভীক মজুমদার লিখেছেন, “মা এবং বোন যখন এক সঙ্গে গাইছিল, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি, তখন হঠাৎ ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটা গোলমাল লুকোনো আছে এখানে। বোন যে জন্মভূমির কথা ভাবছে তাকে যদি ‘স্বদেশ’ বলি তাহলে এক্ষেত্রে মায়ের মনে তরঙ্গ তুলছে, যাকে বলা হয় ‘বিদেশ’।” বরিশালের মেয়ে মণিকুন্তলা সেন স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘বরিশালের কথা মনে হলেই যেন দেখতে পাই লাল সুরকির রাস্তা। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দেখেছি, হয় শোবার ঘর, নয়তো রান্নাঘরে পিছনে অযত্নে বর্ধিত করবী, জবা, শিউলি, গন্ধরাজ আর কাঠচাঁপা। শহরের পূর্বদিক ঘিরে কীর্তনখোলা নদী।’

দেশভাগের অনেক পরে যাঁরা আবার গিয়েছিলেন ফেলে আসা জন্মভূমিকে দেখতে, তাঁদের স্মৃতি বিষাদে বিলিখিত। দেশভাগের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে বরিশালের এক গ্রামে বড় হয়ে ওঠা মিহির সেনগুপ্ত তাঁর স্মৃতিকথা ‘বিষাদবৃক্ষ’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি দেখেছিলেন কোথাও টিনের চালা, কাঠের ফ্রেমের সুন্দর বাড়িগুলোর ভিত কেবল অবশিষ্ট। তুলসীমঞ্চে সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বলে না, বাজে না শঙ্খ, গাছের গোড়ায় জল দেয় না কেউ। ওই সব বাড়ির দিকে তাকালে বুক ভেঙে যায়।

সাংবাদিক দক্ষিণারঞ্জন বসু সম্পাদনা করেন ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’। রচনাগুলির লেখকের নামের উল্লেখ নেই। তাঁরা নিজেদের গ্রামের স্মৃতিচারণ করেছেন, যাতে মিশে আছে একই সঙ্গে ক্ষোভ ও বেদনা। ময়মনসিংহ জেলার বিন্যাফৈর গ্রামের লেখক লিখেছেন, ‘মানচিত্রে একটা রেখার একটানে নিজের বাড়ির হয়ে গেল বিদেশ? ভাবতেও পারি না।’ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তার পরই বেদনা বয়ে যায় কথার মধ্যে— ‘কতো মুখ মনে পড়ে! কচি, কাঁচা, ছেলে, বুড়ো; কাকা, চাচা, দিদি, বৌদি কতোরকম সম্পর্ক। “দ্যাশে আইলেন?”— একগাল হাসি। কি একরকম খুশিতে মনটা লাফ দিয়ে উঠতো নদীর ঘাটে স্টিমার থেকে নামতেই।... বাতাবিলেবু ফুলের ঘ্রাণ চিনতে চিনতে গুন গুন করে মায়ের মুখে সেই বাড়িতে আমার রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান শোনা... এসব কি ভোলা যায়!’

সাঁকরাইল গ্রামের লেখক মাকে হারিয়েছিলেন অনেক দিন আগে। দেশভাগের পর তাঁর মনে হয়েছিল ‘জননী জন্মভূমি’কে হারালেন। তানভীর মোকাম্মেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁর বাবাকে যশোরের নড়াইলের এক হিন্দু উকিল বলেছিলেন, ‘আমি কোনও দিন নড়াইল ছেড়ে যাব না মোকাম্মেল সাহেব। চিত্রা নদীর পাড় ছেড়ে স্বর্গে গিয়েও সুখ পাব না।’ আসন্ন বিপদের আঁচ পেয়েও বহু হিন্দু তাঁদের গ্রাম ছেড়ে আসতে চাননি। আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন ভিটেমাটি। কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, দেশভাগের পর এত সব সম্পত্তি বাড়ি-ঘর ফেলে উদ্বাস্তু হওয়ার পরামর্শ তাঁর ঠাকুরদার কাছে বিষবৎ লাগত।

তখন সার্বিক অবিশ্বাসের মরুভূমিতেও অনেক গ্রামে ছিল হিন্দু-মুসলমান সুসম্পর্কের মরূদ্যান। বহু মুসলমান চাননি হিন্দুরা দেশত্যাগ করুক। চাঁদসী গ্রামের হিন্দুদের দেশত্যাগ আটকাতে চেয়েছিলেন প্রভাবশালী মুসলমানরা। ভেড়া গ্রামের গরিব প্রজা আলিমুদ্দিন আর কলিমুদ্দিন হিন্দু মনিবকে দেশত্যাগে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘জমি জায়গা বিক্রি করবেন না বাবু। দেশ ছেড়ে কোথায় যাবেন?’

হিন্দুদের দেশত্যাগে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান কষ্ট পেয়েছিলেন প্রাণে। কবি জসীমউদ্দিন লিখেছিলেন, ‘ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে/ তোমাদের কতো অতীত দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।’ অমিয়কুমার মজুমদার বেশ মনে করতে পারেন, গ্রাম ত্যাগ করে আসার সময় জব্বর চাচা তাঁর বাবার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন শিশুর মতো।

বস্তুত, দেশভাগের আগে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছে গিয়েছিল আত্মীয়তার পর্যায়ে। সেই মানবিক সম্পর্কের স্মৃতি বার বার নাড়া দিয়েছিল গ্রাম ছেড়ে চলে আসা মানুষের হৃদয়কে। মণিকুন্তলা সেন লিখেছেন, মুসলমান দুধওয়ালা রান্নাঘরের দাওয়ায় একটু জিরিয়ে নিয়ে জল চাইলে তাঁর মা ঘরে যা থাকত দিতেন। খুশি হয়ে খেত সে। তার পর দুধের কলসিটা উপুড় করে ঢেলে দিত একটা কড়াইয়ে। তাঁর মা বাধা দিলে সে বলত, ‘ভাবেন না মাঠাইরেন, আপনার পোলাডার দিয়া গেছে।’ অতি সরল মনে নিজেকে তাঁর ছেলে বলতে দ্বিধা করত না বিন্দুমাত্র।

হিন্দুপ্রধান গ্রাম সাভার। এই গ্রামের দুর্গাপুজোয় মুসলমানদের আনন্দের খামতি ছিল না। নতুন কাপড় আসত তাদের ঘরে হিন্দুদের মতোই। মুসলমান মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় প্রতিমা দেখে বেড়াত। রংবেরঙের লুঙ্গি পরে গলায় গামছা ঝুলিয়ে মুসলমান ছেলেরা সকাল সকাল ঠাঁই করে নিত যাত্রার আসরে। ‘রামচন্দ্র’ অথবা ‘হরিশ্চন্দ্র’ যাত্রাপালায় চোখের জল মুছত হিন্দুদের সঙ্গে। সাভার গ্রামের মানুষটি প্রায় বিলাপের সুরে লিখেছেন, ‘এতো স্মৃতি, এতো স্বপ্ন-রঙীন সে মোহন পরিবেশ থেকে আজকে আমি নির্বাসিত। দেশ-বিভাগের পাপে আমার মতো ছিন্নমূল আরও অনেকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে গেছে। ভেঙেছে সমাজ, ভেঙেছে ঘর-সংসার।... অমন অনাবিল স্নেহের উৎসটি আজ কত দূরে!’ ‘পিতামহী’ উপন্যাসে শান্তা সেন তাঁর পিসিমার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বিধ্বস্ত এই শরীরটা মাগো টেনে এনেছিলেন শুধু একটা কথাই জানিয়ে যেতে— কীভাবে চিরদিনের একটা পথ এদেশের মাটিতে চিরকালের জন্য মুছে গেল।’ তাই শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘জন্মভূমি? কোথায় আমার জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।’

পদ্মার তীরে নটাখোলা গ্রামের মানুষটির বাবাকে গোপাল সেখ ‘বাবা’ বলেই ডাকত, কারণ ডাক্তার হৃদয় ভট্টাচার্য গোপালের প্রাণরক্ষা করেছিলেন কলেরার হাত থেকে বাঁচিয়ে। জহিরুদ্দীন সেখের স্ত্রী ছিলেন বড় চাচি। মোল্লাপাড়ার মাজুদিদিকে মানুষটি ভুলতে পারেননি কোনও দিন। তাঁর কোলে বসে তিনি কত দিন দুধভাত খেয়েছিলেন মর্তমান কলা আর খেজুর গুড় দিয়ে। তাতে তাঁর ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়নি।

এ পার বাংলায় আসা মানুষগুলোর প্রাণ যেমন কেঁদেছিল ও পার বাংলার ‘দেশ’-এর জন্য, ঠিক তেমনই ঘটেছিল এ পার বাংলা ছেড়ে ও পার বাংলায় যাওয়া মানুষগুলোর জীবনে। হাসান আজিজুল হক-এর জন্ম ১৯৩৯-এ বর্ধমানের যবগ্রামে। দেশভাগের পর চলে যান পূর্ববঙ্গে রাজশাহীতে। লিখেছিলেন, ‘মনে পড়েনি পাকিস্তান বলে একটা আলাদা দেশ আছে মুসলমানদের জন্য। ’৪৭-এ দেশভাগ হল, আর আমি গেলাম ’৫৪-তে। মাঝের সাত বছরে একবারও মনে হয়নি বর্ধমান আমার দেশ নয়।’ তাঁর বাবা পাকিস্তানে যাওয়ার কথা বললে তিনি বলতেন, ‘পাকিস্তান হয়েছে তো কী হয়েছে? তাই বলে নিজের দেশ ছেড়ে যাব নাকি? ও আমি পারব না।’

নানা মানুষের স্মৃতিকথা, সমকালীন পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্য থেকে উঠে আসে দেশভাগের আগের এক নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রা, অন্য দিকে এক ভিন্ন সামাজিক বিন্যাসের ছবি, যা ঐতিহ্যগত ভাবে শিকড় চালিয়ে দিয়েছিল পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য-জীবনে। ফলে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ ও পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক। উভয়ে বাঁধা পড়েছিল আত্মীয়তার বন্ধনে। প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’-য় মজিদ মিঞা যখন অবনীমোহনকে বলেন, ‘ঠাউর ভাইয়ের নাতি-নাতনী ভাগনা-ভাগনীজামাই আমারও নাতি-নাতনী ভাগনা-ভাগনীজামাই। তাগো কিছু খাওয়াইতে বুঝিন সাধ লয় না’, অবনীমোহন অভিভূত হয়ে যান তাঁর গভীর আন্তরিকতায়। এই উজ্জ্বল ছবি কেবল কথাশিল্পীর কল্পনা নয়, সে দিনের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল এমনই স্বাভাবিক। ময়মনসিংহ জেলার কমলপুর গ্রামের লেখক স্মৃতিচারণ করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বারোয়ারি তলায় যাত্রার— ‘আসর বসত দুর্গাপুজো উপলক্ষে। নিমাই সন্ন্যাসের পালা দেখতে দেখতে দর্শকরা ভেসে যেত ভক্তিরসে। ছল ছল করত তাঁদের চোখ। তিনি দেখতেন, দর্শকের আসনে বসা রহিমউদ্দিন সামলাতে পারছে না চোখের জল।’

কিন্তু বহু কাল ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই সুসম্পর্কের ছবিটা ঝলসে গিয়েছিল রাজনীতির আঁচে। রাজনীতিবিদরা কেবল দেশকে ভাগ করেননি, করেছিলেন মানুষকে, মানুষের হৃদয়কে, ভাবনাকে। বাঙালি জাতিকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করে সে দিনের তথাকথিত দেশহিতৈষীরা পূর্ববাংলা থেকে যে উদ্বাস্তুস্রোতের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁদের জীবনে অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও বেদনা সৃষ্টি করেছিলেন, তা ভুলতে চেয়েছিলেন অনেকেই। কারণ বিস্মৃতি দিয়ে হৃদয়ের ক্ষতের উপশম করা যায়। সকলের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দেশের স্মৃতি, বিচ্ছেদের বেদনা অনেক মানুষকে তাড়া করে বেড়িয়েছে আমৃত্যু। মিহির সেনগুপ্ত ভুলতে পারেননি, তাঁর যে বালবিধবা পিসিমার চোখে কোনও দিন জল দেখেননি, সেই পিসিমা বাড়ি ছেড়ে নৌকোয় ওঠার আগে বাড়ির সব ঠাকুর-দেবতা, উঠোনের গাছপালা, মন্দিরে প্রণাম করার সময় ভেঙে পড়েছিলেন আকুল কান্নায়।

অনেকের কাছে সময়টা থমকে গিয়েছিল ১৯৪৭-এ, যে বছরের এক পিঠে ছিল স্বাধীনতা, অন্য পিঠে দেশভাগ। নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, দেশভাগের অনিবার্য পরিণতির বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই, তা সেই বাস্তব যতই বেদনার হোক না কেন। কিন্তু কয়েকটা প্রশ্ন আজও তাদের তাড়া করে বেড়ায় উত্তরের অন্বেষণের জন্য— সাতচল্লিশের দেশভাগ কি সত্যিই ঠিক এবং অনিবার্য ছিল? আর কি কোনও বিকল্প ছিল না? বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ এবং ভয়ঙ্কর গণপ্রব্রাজন ঘটেছিল কোন স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলি কোনও দিন মুছে যাবে না ছিয়াত্তর বছর আগে দেশভাগের পরিণতির শিকার হওয়া মানুষের মন থেকে, ইতিহাস থেকে। হয়তো কখনওই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিতে পারবে না কেউ।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Partition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy