Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Education

এ দেশে পালি সাহিত্য শিক্ষার প্রথম পথিকৃৎ

তিনি বেণীমাধব বড়ুয়া। এম এ পাশ করার আগেই সুযোগ পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার। তিনিই প্রথম বাঙালি বৌদ্ধ যিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যান। পরিচিত ছিলেন ‘বিশ্বকোষ’ নামে। তবু এশিয়ার প্রথম ডি লিট উপাধিধারী এই শিক্ষাবিদের কথা আজ কারও মনে নেই।

বেণীমাধব বড়ুয়া।

বেণীমাধব বড়ুয়া।

ইন্দ্রনীল বড়ুয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:১০
Share: Save:

বাংলাদেশের বন্দর-শহর চট্টগ্ৰামের বর্ধিষ্ণু গ্রামটির নাম পাহাড়তলি মহামুনি। সেখান থেকেই উঠে আসা মেধাবী ছাত্রটির নাম বেণীমাধব বড়ুয়া। কলেজজীবন থেকেই পালি ভাষার প্রতি আগ্রহ। পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও আকর্ষণ ছিল। ভালবাসতে শুরু করেন প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়সমূহও। এফ এ পাশের পরে কিন্তু ইংরেজি বাংলা কিংবা ইতিহাস নয়, তিনি বেছে নিলেন পালি ভাষায় অনার্স। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে বি এ কোর্সে ভর্তি হন। স্কটিশ কলেজে সেই সময় পালি ভাষায় ক্লাস করার কোনও সুযোগ না থাকায় অনার্স ক্লাসের জন্য তাকে প্রেসিডেন্সিতেই যেতে হত। এখানেই তিনি পরিচিত হন শৈলেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে, যিনি পরে পালি ভাষাবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পালি পড়তে এসে প্রেসিডেন্সিতে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পান সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে। শেষ পর্যন্ত বেণীমাধব অনার্স-সহ বি এ পাশ করেন বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে।

পাহাড়তলি মহামুনি গ্রামে কবিরাজ রাজচন্দ্র তালুকদার ও ধনেশ্বরী দেবীর সন্তান বেণীমাধব তালুকদার। ১৮৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। গ্ৰামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ‘তালুকদার’ পদবি পরিবর্তন করে ‘বড়ুয়া’ পদবি ব্যবহার করে তাকে ভর্তি করা হয়। এর পর চিটাগাং (অধুনা চট্টগ্ৰাম) থেকে এফ এ পাশ করেন। পালি ভাষায় স্নাতক হওয়ার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। এই সময় তিনি অধ্যাপক হিসেবে পান সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ ও ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁদের সংস্পর্শে এসে মিউজ়িয়ামে গিয়ে প্রাচীন শিলালিপির পাঠগ্ৰহণে সুবিধা লাভ করেন। ১৯১৩ সালে একমাত্র তিনিই পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম এ পাশ করেন। লাভ করেন স্বর্ণপদক। প্রবেশিকা থেকে বি এ পর্যন্ত পরীক্ষায় তিনি উল্লেখযোগ্য ফল না করলেও এম এ পরীক্ষায় চমকপ্রদ ফলাফল তার জীবনের অন্যতম মোড় ঘোরানো ঘটনা।

বেণীমাধব বড়ুয়াই সেই বিরল পণ্ডিত, যিনি এম এ পাশ করার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ লাভ করেন। তখন তিনি কেবল আংশিক সময়ের শিক্ষক ছিলেন। এর বছরখানেক পরেই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যাত্রা করেন। এই সময় শতাব্দীপ্রাচীন বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ‘বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার’-এর প্রতিষ্ঠাতা কৃপাশরণ মহাস্থবির ও ‘বাংলার বাঘ’ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বেণীমাধবের জন্য বিশেষ উদ্যোগ করেন। তাঁরা বেণীমাধবের উচ্চশিক্ষার জন্য দরবার করলে ভারত সরকার স্কলারশিপ মঞ্জুর করে। বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে তিনিই প্রথম উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গবেষক ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গবেষণার বিষয় নির্দিষ্ট করে দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান ফিলসফি— ইটস ওরিজিন অ্যান্ড গ্ৰোথ ফ্রম বেদাস টু দ্য বুদ্ধ’। কলকাতার মতোই লন্ডনেও তিনি সেই সময়ে বহু দিকপাল অধ্যাপকদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। অবশেষে তিন বছরের অক্লান্ত অধ্যবসায়ে প্রকাশিত হয় তাঁর অভূতপূর্ব গবেষণাপত্র, পরে যা গ্ৰন্থ আকারেও প্রকাশিত হয়। তিনিই এশিয়ার প্রথম ডি লিট উপাধিকারী ব্যক্তি। লন্ডন থেকে ফিরেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। তার সঙ্গে প্রাচীন ‘ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগে শিক্ষকতার অতিরিক্ত দায়িত্বও লাভ করেন। তার গবেষণাপত্রকে গ্ৰন্থরূপে প্রকাশে উদ্যোগী হন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, যা ১৯২১ সালে ‘আ হিস্ট্রি অব প্রি-বুদ্ধিস্টিক ইন্ডিয়ান ফিলসফি’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয় এই গ্ৰন্থটি পরবর্তী কালে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। ‘প্রাক্‌ বৌদ্ধ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস’ গ্ৰন্থে ভারতের প্রথম দার্শনিক জনৈক মহীদাস ঐতরেয় ও দার্শনিক ঋষি অঘমর্ষণের মৌলিক মূল্যায়ন পাওয়া যায়। এর কিছু দিন পর সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের অকালমৃত্যুজনিত কারণে তাকেই পালি বিভাগ পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। তিনি লাভ করেন ‘ইউনিভার্সিটি প্রফেসর’-এর বিশেষ মর্যাদা। দায়িত্ব গ্ৰহণ করেই তিনি পালিতে বি এ ও এম এ কোর্সের পাঠ্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন। এর অঙ্গস্বরূপ তিনি প্রাকৃত, সংস্কৃত, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস ও ভূগোল, ভারত ও বহির্ভারতে বৌদ্ধ শাস্ত্র, বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন, শিল্পকলা, মূর্তি তত্ত্ব ও সংস্কৃতির সঙ্গে পালি ভাষা ও সাহিত্য চর্চার এক সর্বাঙ্গীণ মেলবন্ধন রচনা করেন। তাঁর অসামান্য উদ্যোগের জন্য সেই সময়ে পালি ভাষা শিক্ষায় বিশেষ আগ্ৰহের সঞ্চার হয়।

১৯৩৫ সালের ১ জুলাই তিনি ১ নং বুদ্ধিস্ট টেম্পল রোডের বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারের ভবনে প্রতিষ্ঠা করেন নালন্দা বিদ্যাভবন। উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বেণীমাধবের মূল উদ্দেশ্য ছিল পালি ভাষা-সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কলেজ স্থাপন, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষাধারার সমন্বয় সাধিত হবে। তিনি নিজে ক্লাসে এসে ছাত্রদের বলতেন বুদ্ধের ধর্মদর্শন সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞানার্জনের জন্য সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা। তাঁর অভিমত ছিল, হিন্দু, জৈন ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের যাবতীয় গ্ৰন্থসমূহ সবই সংস্কৃত ভাষাতেই লিখিত। এই কারণে তিনি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সংস্কৃত ভাষায় অনভিজ্ঞ হলে সমগ্ৰ বৌদ্ধ ধর্মগ্ৰন্থ ত্রিপিটক (পালি তিপিতক) অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ থাকবে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নালন্দা বিদ্যাভবনের পক্ষ থেকে ‘নালন্দা’ শীর্ষক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। আজও তা প্রকাশিত হয়ে চলেছে।

শিক্ষাদানে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। অনেক শিক্ষক ও অধ্যাপক গবেষক তাঁর কাছে ভারততত্ত্ব সম্পর্কিত নিত্যনতুন তথ্যসংগ্ৰহে সাগ্ৰহে প্রতীক্ষা করতেন। বিনয়ী ও উদার এই মানুষটিকে সকলেই পুজো করতেন চলমান ‘বিশ্বকোষ’জ্ঞানে। স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। সংস্কৃত, পালি, দর্শন, বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, বেদ, উপনিষদ, সাহিত্য, ইতিহাস, শিলালিপি তত্ত্ব, প্রত্নশাস্ত্র প্রভৃতি সব বিষয়ে তিনি বিস্ময়কর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ভারততত্ত্ববিদ ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের এই দিকপালকে মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সমাজ ও সরকার নানা ভাবে সম্মানিত করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দুর্লভ ‘ত্রিপিটকাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সম্রাট অশোকের শিলালিপি, বুদ্ধগয়া শিলালিপি, বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন,শিল্প ও ভাস্কর্য বিষয়ে তিনি বহু বই ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তার মূল্যবান গ্ৰন্থসমূহ ‘ওল্ড ব্রাহ্মী ইনসক্রিপশনস ইন দি উদয়গিরি অ্যান্ড খণ্ডগিরি কেভস’, ‘ভারহুত ইনসক্রিপশনস’, ‘গয়া অ্যান্ড বুদ্ধ গয়া’, ‘ফিলসফি অব প্রগ্ৰেস’, ‘প্রাকৃত ধম্ম পদ’, ‘দি আজিবিকস’ প্রভৃতি। বৌদ্ধগ্ৰন্থ কোষ, বৌদ্ধপরিণয়পদ্ধতি, মণিরত্নমালা, লোকনীতি, বাংলা সাহিত্যে শতবর্ষের বৌদ্ধ অবদান বিষয়ক বাংলা ভাষায় কয়েকটি বইও রচনা করেন তিনি।

রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্স, ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল কংগ্ৰেস, ইন্ডিয়ান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস, বেঙ্গল বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বিধবাবিবাহ সহায়ক সভা, হিন্দু সৎকার সমিতি-তেও তিনি বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন।

অনাদৃত পালি সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি অবিচল ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন, প্রাচীন ভারতের প্রত্নতত্ত্বসাহিত্য ও দর্শনের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হলে পালি ভাষা জানা আবশ্যক। ১৯৪৮ সালের ২৩ মার্চ এই মনীষীর প্রয়াণ ঘটে।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy