Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2023

অল্পেই সন্তুষ্টির বাহনে ছোটবেলার আগমনী

দু’-তিনটে নতুন জামাকাপড়, ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক, মহালয়ার ভোরেই শুধু বড়দের সঙ্গে চা। ছোট ছোট প্রাপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত শরতের আকাশ। জীবনের সিন্দুক খুলে উঁকি দিলে দেখা যায়, শিবঠাকুরের বেলপাতার গল্প মিথ্যে নয়। সামান্য আয়োজনে খুশি হতে পারা মানে বিরাট আনন্দের চাবিকাঠি। আকাশছোঁয়া বাজেট, রকমারি প্যান্ডেল, হাজারো থিমের দেখনদারির দৌড়ে শামিল হতে গিয়ে সেই চাবি কি হারিয়ে গেছে?

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৫৪
Share: Save:

বর্ষা সবে যায়-যায়। কালো মেঘের ঘোমটা সরিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে শরতের নীল আকাশ। হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো কমলারঙা সূর্যের শেষ আভাটুকু নিভে যেতেই আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ। যেন পা ছড়িয়ে চরকা কাটছে কোন বুড়ি! থই-থই জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। মৃদুমন্দ বাতাস। রাধাবল্লভ মন্দিরে কীর্তন গাইছেন কানাইলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

গাইছেন ব্যাখ্যা করছেন প্রতিটি শব্দের অর্থ। কোঁকড়ানো চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। গলায় গোলাপ-গাঁথা রজনীগন্ধার মালা। গাড়ি-দুর্ঘটনা একটি পা কেড়ে নিয়েছে সেই কবে। তবু গাইছেন, আর নাচছেন!

বগলে কষ্টের ক্রাচ, মুখে অমলিন হাসি। বলছেন, “এই যে শরতের মৃদুমন্দ বাতাস, এই যে মন মাতাল করা দুধসাদা জ্যোৎস্না, এই যে বাতাসে হাজারো ফুলের সুগন্ধ— তারই মধ্যে অভিসারের জন্য বৃন্দাবনে কুঞ্জ সাজিয়েছেন শ্রীরাধা। গোবিন্দের অপেক্ষায়।” সঙ্গে মজার ছলে জুড়ে দিচ্ছেন, “রাধা-গোবিন্দের আর দোষ কী? শুধু কি বসন্ত! শরতেরও এত রূপ, এমনই মহিমা, শরীর এমনিই চঞ্চল হয়। মনে অকারণ পুলক জাগে। নইলে এক বার ভাবুন মায়েরা, আমার মতো খোঁড়া মানুষকেও কি না নাচিয়ে ছাড়ে!”

পালা শুনতে আসা যে মা-পিসিমা-ঠাকুমারা এত ক্ষণ উলুধ্বনি আর হরিধ্বনি দিচ্ছিলেন, এ বার হাসির রোল উঠল তাঁদের মধ্যে। দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন কেউ-কেউ। কেউ আবার খোলের বোলের লয় দ্রুত হতেই হরির লুট দিলেন বাতাসা। আর আঁজলা ভরে তা কুড়িয়ে নিতে নিতেই সেই কোন ছোটবেলায় শরৎ এক আজীবন প্রেমের মতো বাসা বাঁধল বুকে।

‘সহজ পাঠ’-এর পাতায় সেই ভালবাসাকেই আরও পোক্ত করলেন রবি ঠাকুর। কালিমাখা লন্ঠনের আলোয় দুলে-দুলে পড়া ‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ...’ কখন যেন সিঁধ কাটল প্রাণে। মনের কোন গোপন কুঠুরিতে বড় যত্নে, বড় আদরে, হয়তো নিজের অজান্তেই চিরকালের মতো খোদাই হয়ে গেল ওই কথা— ‘এ ঋতু এমনই মধুময়, এতটাই ভালবাসায় মোড়া, যে তা এক জন পা-হারানো মানুষকেও নাচিয়ে ছাড়ে!’

নাচ তো দূর, এ জীবনে গলা ছেড়ে দু’কলি গান গাওয়ারও সাহস করিনি কখনও। কিন্তু তা বলে শরৎ মনে দোলা দিতে ছাড়েনি। নীল আকাশ। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। মন ভাল করা রোদ। দেমাকি হাওয়া। হাওয়ায় মাথা দোলানো খেয়ালি কাশফুল। প্রকৃতি জুড়েই উৎসবের মেজাজ, আগমনীর আলপনা, আনন্দের যজ্ঞ, পুজোর আয়োজন। এই অপরূপ শরতের ভেলায় ভেসেই পুজো আসত ছোটবেলায়। প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধারও অনেক আগে, আমাদের হৃদয়ে, মনে, প্রাণে।

জীবন চলে গিয়েছে প্রায় চার দশকের পার। অথচ এখনও চোখ বুজলে কত শত স্মৃতি মুহূর্তে ডানা মেলে প্রজাপতির মতো। এখনও কানে বাজে ছুটির সেই ঘণ্টা। যার উচ্চকিত শব্দে শুরু হত পুজোর ছুটি! এক মাস প্রাণ ভরে বাঁচার, যা খুশি করার শর্তহীন ছাড়পত্র।

শ্যামলা রং, উল্টে আঁচড়ানো চুল, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর মুখে সর্বদা পান ঠেসে রাখা যে শিবরামদা সেই ছুটির ঘণ্টায় হাতুড়ির ঘা দিতেন, অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও তাঁর সঙ্গে কীর্তনিয়া কানাইলালের মিল পাওয়া শক্ত। তবু এক আশ্চর্য জাদুতে দু’জনকেই যেন দেবদূত বলে মনে হত! যেন তাঁদের হাতেই রূপকথার সেই সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি। তার ছোঁয়ায় ফিরে যেত বৃষ্টিক্লান্ত মেঘ। দরজায় কড়া নাড়ত শরৎ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠত আলোকমঞ্জীর। মন্দিরের কীর্তন, ফুলের ঝুড়িতে পদ্ম, চর ঢেকে দেওয়া কাশফুল, টুপটাপ ঝরে পড়া শিউলি, অকারণ খুশি আর শিবরামদার ছুটির ঘণ্টাই জানান দিত, ‘মা আসছেন’।

এখন গ্রিল-মোড়া ফ্ল্যাটের জানলায় চোখ রেখে বৃষ্টির বদলে যাওয়া চালচলন দেখে ভয় হয়, এই বুঝি ছুটির ঘণ্টা বেজে যেতে বসেছে শরতেরই! পুজোর মুখে কোথায় সেই নীল আকাশ? কোথায় সেই সাদা মেঘের দল? গত কয়েক বছর ধরে, এমনকি এ বার, এত দেরিতে পুজোর বছরেও মহালয়ার সপ্তাহখানেক আগে পর্যন্ত শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি!

বিশেষজ্ঞেরা বলেন, দূষণের জেরেই ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্বাভাবিক ঋতুচক্র। পিছিয়ে যাচ্ছে বর্ষা। উষ্ণায়নের শোধ তুলছে প্রকৃতি। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা মনে পড়ে। ওবামা লিখছেন, “আমরাই প্রথম প্রজন্ম, যারা পুরোদস্তুর টের পাচ্ছি এবং পাব উষ্ণায়নের কুফল। আবার আমরাই শেষ প্রজন্ম, যারা সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ পাচ্ছি এখনও। এর পরে বোধহয় অনেক দেরি হয়ে যাবে।” ভয় হয়, দেরি কি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে? শরতের ‘সোনা রোদ’ এর পরে কি শুধু বইয়ের কথাই হয়ে থাকবে? প্রতি বারই কি মা দুর্গা আসবেন বৃষ্টির আশঙ্কার পিঠে চেপে?

আগে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেও ঝকঝক করত আকাশ। উড়ত অসংখ্য ঘুড়ি। ভোকাট্টা ঘুড়িকে ধাওয়া করে অচিন গলিতে দাপিয়ে বেড়াত শৈশব। হাতের লাটাই বোঁ-বোঁ করে সুতো ছাড়ত মর্জিমাফিক, যত ক্ষণ না ঘুড়িটা অনেক, অ-নে-ক দূরে একটা বিন্দুর মতো দেখায়। চিনা মাঞ্জার থেকেও ধারালো ‘পড়ার চাপের’ সুতোয় সেই শৈশবও শেষে ভোকাট্টা হতে বসেছে কি না, কে জানে!

পুজোর ছুটি বলতে আমরা জানতাম, এই ক’দিন তৈলাক্ত বাঁশ ধরে ওঠা-নামা বারণ কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্কবইয়ের সেই বাঁদরের। চৌবাচ্চার নল দিয়ে কত জল ঢুকল আর বেরোল, এই ক’দিন তার হিসাব রাখবে না কেউ। বন্ধ ব্যাকরণ বইয়ের পাতা। মাথা থেকে উধাও শিবাজি আর ঔরঙ্গজেবের সালতামামি। শিকেয় তোলা থাকত গাছের সালোকসংশ্লেষ কিংবা মানুষের পাচনতন্ত্র। এই ক’দিন শুধু নির্ভেজাল ছুটি। এক মাস, নিদেনপক্ষে পুজোর ক’দিন জীবন নির্ভার আনন্দে টইটম্বুর।

সাফল্যের নিরন্তর ইঁদুর-দৌড় আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার চোরাবালিতে কি ক্রমশ তলিয়ে যেতে বসল সেই নিশ্চিন্তির ছুটিও? আজও কি শিবরামদা ঘণ্টা দিলেই ছুটি পড়ে? নইলে কেন শুধু জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ব্যর্থতার আশঙ্কায় পুজোর মুখে নিজের প্রাণ কেড়ে নিল দশম শ্রেণির এক ছাত্র? দ্বাদশ পেরিয়ে যে পরীক্ষা, তাতে ব্যর্থতার ভয় তার জীবনে দাঁড়ি টেনে দিল পরীক্ষায় বসার দু’বছর আগেই! আর দু’দিন পরেই তো বাড়ির পাশের মণ্ডপে পুজোর ঢাক বাজত। রাস্তা সেজে উঠত অজস্র আলোয়। না কি মনের অতল আঁধার দূর হত না তাতেও? কী হত দু’দিন পড়া থেকে ছুটি নিলে? জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার তুলনায় তা তো ঢের ভাল ছিল!

এমন নয় যে, এখন পুজোয় সবাই শুধু বইমুখী। এখনও আড্ডা আছে, হাসি আছে, গল্প আছে, বেড়ানো আছে। কিন্তু তার মধ্যেও চিন্তার জ্যামিতি অনেক কচিকাঁচার মুখের রেখার পিছু ছাড়ে না, পুজোর ছুটিতেও মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে পারে না মন, ছুটির আমেজের মধ্যেও মন বিষণ্ণ করে তোলে পড়ার চাপের মহিষাসুর। সেই অসুরের বুকে ত্রিশূল না বিঁধলে, এই দুশ্চিন্তার ঘূর্ণি খরস্রোতা হবে ক্রমশ।

প্রতি বার পঞ্চমীতে ঢাক বেজে উঠতেই কোলের কাছে টেনে নিত মেজপিসি। বলত, “ওই দেখ, মা দুর্গাকে বেলতলা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন শিব। শিবঠাকুরের কিচ্ছু চাই না। সামান্য জল আর একটি বেলপাতা— ব্যস, তাতেই তৃপ্তি, তাতেই সন্তুষ্টি। সাধে কী আর দেবতারাও শিবের পূজারি!”

তার মানে, ‘অ্যাম্বিশন’ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, অল্পে সন্তুষ্টিকেই বড় গুণ হিসেবে মেনে শিবের পুজো করতেন পিসি-ঠাকুমারা! সেই সন্তুষ্টিও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত উবে যাচ্ছে কর্পূরের মতো? পুজোর জামার সংখ্যা থেকে পরীক্ষার নম্বর— ঠিক ক’টা কিংবা কত হলে এখন খুশি হই আমরা? আদৌ হই কি?

স্মৃতির সমুদ্রে সাঁতরাতে নামলেই দেখা পাই এক আশ্চর্য ভোরের। চুলে পাক ধরলেও যার ঘোর কাটেনি আজও। তখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি, বাসা ছেড়ে ডানা মেলেনি পাখির ঝাঁক। বাড়ি শুনশান, পৃথিবী নিস্তব্ধ। তারই মধ্যে গায়ে মৃদু ঠেলা দিতেন মা। হাতে চায়ের কাপ। জিজ্ঞাসা করতেন, “কী রে, মহালয়া শুনবি না?” বড়দের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসে হাতে চায়ের কাপ ধরার সৌভাগ্য হত ওই এক দিনই। কোনও মতে চোখ রগড়ে বিছানায় উঠে বসতাম দুই ভাই। বাবা রেডিয়ো চালু করতেই যেন শতসহস্র ঢাক বেজে উঠত প্রাণে। সেই মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরে কী যে জাদু! কী যে অসীম মায়া! কী অসামান্য নিবেদন! রেডিয়োর ও পার থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলে উঠতেন, “আশ্বিনের শারদপ্রাতে...” ব্যস, দেবীপক্ষের সূচনা। পড়াশোনা শিকেয়। তার পরে শুধু নতুন জামার গন্ধ গায়ে মেখে ক্যাপ ফাটানোর বন্দুকে নারকেল তেল দেওয়ার দিন!

এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওই অল্পে সন্তুষ্টিই সম্ভবত দু’হাত ভরে দিয়েছিল এত কিছু, ভরিয়ে রেখেছিল জীবনকে। খান দুই-তিন নতুন জামা মানে হাতে চাঁদ। কোনও দিন তার দাম জানতে আগ্রহই দেখায়নি মন। কত বার যে একই জামা উল্টেপাল্টে দেখা! কবে কোনটা পরা হবে, সেই অঙ্ক যেন আর মিলতেই চাইত না! বেশ মনে পড়ে, প্রথম যে বার স্টাইল মেপে ব্যাগি জামা কেনা হল আর টিভির মিলিটারি-সিরিয়াল দেখে জেদ ধরে জলপাইরঙা উর্দি ছাপের পোশাক কিনল ভাই, সে দিন ঘুমোনোর সময়েও তাদের জায়গা হল মাথার বালিশের নীচে। দিনভর দেখে-ছুঁয়েও যেন আশ মেটে না। যেন সত্যি
হওয়া স্বপ্নকেই মাথার কাছে নিয়ে শুতে যাওয়া!

হাতে আর সময় নেই। বাড়িতে প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে। একগাল হাসি আর যত রাজ্যের উদ্ভট সমস্ত গল্পকে সঙ্গী করে গনগনে আঁচের উনুনের সামনে উবু হয়ে বসে খই, মুড়ি ভাজতেন ছায়াপিসি। পরনে সাদা থান। হাতে উল্টো করে ধরা নতুন কাঠির ঝাঁটা নড়ে চলেছে নাগাড়ে। কড়াই থেকে ছিটকে আসছে এক-আধটা খই। আর কথার খই ফুটছে সেই ছায়াপিসির মুখে। আমাদের কান বন্ধ, কিন্তু চোখ কড়াইয়ে। ওই তো, এর পরেই ছোলাভাজা হবে, ভাজা হবে বাদাম। গুড়ের পাক ঘন হয়ে এলে তৈরি হবে মুড়কি। খাওয়ার লোভে কত যে গল্প শোনার ভান করেছি তখন।

ঘুরছি-ফিরছি, কিন্তু সদা-সতর্ক চোখ তখন সদ্য মেজে রোদে দেওয়া খালি কাচের বয়ামে। এরই মধ্যে কোনওটার পেটে বোঝাই হবে গুড়ের নাড়ু। ধবধবে সাদা চিনির নাড়ু তাকে তোলা থাকবে তার পাশেই। দুপুরে সবাই যখন একটু গড়িয়ে নেবে, তখন সাবধানে হাত বাড়িয়ে চুপিচুপি নামিয়ে আনতে হবে নিমকির কৌটো। বাড়িতে তৈরি হরেক মিষ্টি আর নোনতা পদ চেখে দেখতে হবে একটু করে। কেউ দেখে ফেলবে না তো? ‘রক্ষা কোরো মা গো!’

এখন ভাবি, আর হাসি পায়। তখন কথায়-কথায় এত চাইনিজ়-মোগলাই-কন্টিনেন্টালের বাহার ছিল না। বাড়ি বয়ে এসে খাবার দিয়ে যেত না পুজোর দিনেও আধপেটা খেয়ে পিঠে মস্ত ব্যাগ-বওয়া কোনও ছেলে। টিভিতে চ্যানেল কম ছিল। আলমারিতে জামাকাপড় ছিল গোনা-গুনতি। এমনকি মা দুর্গাও টিভির পর্দায় মহিষাসুরমর্দিনী হতেন বছরে এক বারই— দূরদর্শনে। কত কম, কত সংক্ষিপ্ত আয়োজন। কিন্তু তাতেই যেন ‘এত সুখ আছে, এত সাধ আছে, প্রাণ হয়ে আছে ভোর’।

কেন? অল্পে সন্তুষ্টি? কে জানে? আজকের নতুন প্রজন্মের যে অংশ একটা চাইতেই দশটা পায়, তা সে জামা হোক বা কলম, তারা কোনও দিন বুঝবে কষ্টে কেনা একটি জামার মূল্য? আজ জীবনের সিন্দুক খুলে বসলে বুঝি, শিবঠাকুরের বেলপাতার গল্প মিথ্যে নয়। সন্তুষ্টি, অতি অল্পে সন্তুষ্টিই সম্ভবত অনেক আনন্দের চাবিকাঠি। দেখনদারির দৌড়ে শামিল হতে গিয়ে সেই চাবি আমরা অনেকেই হারিয়ে ফেললাম কি না, কে জানে!

জামা তো তবু প্রতি বছর নতুন হত, কিন্তু ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক? পুজো গেলে, ভাল ভাবে সাফসুতরো করার পরে বড় যত্নে তুলে রাখতে হত সেই ‘অস্ত্র’। বাড়িতে চেয়ে পাওয়া ছেঁড়া, নরম কাপড়ে মুড়ে। মহালয়া পেরোতেই শুরু হত তার যত্ন-আত্তি। মরচে পরিষ্কার, তার পরে ড্রপার চুঁইয়ে নারকেল তেল। যাতে ‘সাপ’ কিংবা ‘লায়ন’ মার্কা ক্যাপের রিল ফাটতে থাকে পর পর। একটাও ‘মিস’ না গিয়ে। ইজ্জত কা সওয়াল।

বাজির বাজারেও কত বিচিত্র জিজ্ঞাসা, কচি গলায় কত অনুরোধ-উপরোধ, অপটু অঙ্কেও কত মরিয়া দরদাম! যদি একটা তুবড়ি অন্তত বাড়তি মেলে, নিদেনপক্ষে একটা পেটমোটা চরকি। আমাদের কিচিরমিচিরে দোকানে কান পাতা দায়। তবু ঠোঁটে হাসি ঝুলে থাকত দোকানিকাকুর। কোনও দিন তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। এই রংমশালের আগুন কত দূর যাবে? কত ক্ষণ জ্বলবে এই তাজমহল-ফুলঝুরি? আচ্ছা, ফণা তোলার আগেই মিইয়ে যাবে না তো সাপবাজি? আমার হাউই ওর থেকে বেশি উঁচুতে উঠবে? কেমন হবে ইলেকট্রিক তারের আগুনের রং? লাল, না কি গোলাপি?

দোকানিকাকু শুধু হাসতেন। কাউকে বলছেন, “ওরটা হাউই, তোরটা রকেট!” কাউকে বলছেন, “তোর চরকি ঘুরেই যাবে বহু ক্ষণ, তুই-ই তখন থামতে বলবি দেখিস।” কী অনন্ত আস্থায়, কত সরল বিশ্বাসে টপাটপ বাজি কিনে বাড়িমুখো হত ছেলেমেয়ের দল। দরজা খুলেই এক ছুটে ছাদে। কেউ রোদ-ঝলমলে জানলা কিংবা বারান্দায়। বাজি রোদে দিতে হবে তো! আর বাড়ির লোক ডেকে ডেকে হয়রান, “ওরে নেমে আয়, স্নান করতে যাবি কখন?”

তার পরের কয়েক দিন সেই বাজি আগলে রাখা বুকের পাঁজরের মতো। তখন যেন এক ময়দানবের কেরামতিতে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। প্যান্ডেলে বাঁশ বাঁধা প্রায় শেষ। কী রঙের কাপড় লাগাচ্ছে দেখতে দে-ছুট। চাঁদার রসিদ হাতে শেষ বারের মতো পাড়া টহল দিয়ে যাচ্ছে ক্লাবের দাদারা। বাকি থাকলে চাঁদার অঙ্ক সামান্য বাড়াতে দরাদরি, নইলে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনুরোধ, “কাকু, মহাষ্টমীতে প্যান্ডেলে প্রসাদ নিতে আসবেন কিন্তু। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।”

প্রতি বার পুজোয় পাড়ার বসাকবাড়িতে ঢাক বাজাতেন যে ঢাকী, তাঁর সঙ্গে কাঁসর বাজাত একটি ছোট ছেলে। সম্ভবত নাতি। ওই চার দিনে সারা পাড়ার সঙ্গে কত আপন হয়ে যেতেন তাঁরা। পরনে নতুন, পাটভাঙা ধুতি আর গেঞ্জি। হাত যেন ঝড় তুলছে ঢাকে। ষষ্ঠীর বোধনে, সপ্তমীর পুজোয়, মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে, নবমী-নিশির ধুনুচি নাচে সেই ঢাকের বোল, সেই কাঁসরের সঙ্গত যেন সারা পাড়াকে জানান দিত, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ’।

ফি-বছর অধিকাংশ মণ্ডপে একই ঠাকুরমশাই। দক্ষিণা সামান্য। কিন্তু পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে, মায়ের কাছে আকুল-নিবিড় প্রার্থনায় তাঁদেরই কারও-কারও চোখে জল। কত সময়ে গলাও কাঁপে আবেগে। পুজোয় এখন আকাশছোঁয়া বাজেট, রকমারি প্যান্ডেল, হাজারো থিমের ঝাড়বাতি। কিন্তু এই আলো পুজোর আবেগকেই খানিকটা শুষে নিল কি না, জানি না।

পুজো এলেই গ্রামের দিদার কথা মনে পড়ে। ওই চার দিনও নতুন কাপড় পরার সময়টুকু পর্যন্ত নেই! খড়-ছাওয়া মাটির বাড়ির নিকানো দাওয়ায় লোক এসেই চলেছে অহরহ। কেউ আপন, কাউকে আপন করে নেওয়া। কাউকে মুড়কি, কাউকে পুকুরের মাছের ঝাল। কাউকে হাঁসের ডিম-সেদ্ধ, কারও হাতে বাড়তি দু’টো গুড়ের নাড়ু। অক্লান্ত পরিশ্রমেও মুখে অমলিন হাসি। আচ্ছা, খানিকটা কি সেই কানাইলালের মতো?

এক বার জিজ্ঞেসও করেছিলাম, “বিরক্তি লাগে না? এখনও মণ্ডপে পর্যন্ত যাওনি! চলো।” হেসে উত্তর এসেছিল, “বিরক্তি লাগতে দিলে, তবেই লাগে। এই যে সবাই আসছে, এ-ও কি কম?” মনে হয়েছিল,
প্রতিমা মণ্ডপে থাকতে পারে, দেবী সত্যিই সর্বভূতেষু।

অর্ধেক সেতু পেরোনো জীবনের স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ে দেখি, এ ভাবেই পুজো আসত আমাদের ছোটবেলায়। প্রতি বার। বাহন সন্তুষ্টি। ‘যশ’ নয়, ‘ধন’ নয়, ‘সন্তান’ নয়...এ বার পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে উঠলে, অন্তত প্রাণভরা সন্তুষ্টি দিয়ো মা গো!

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2023 Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy