সংগ্রামী: দীনেশচন্দ্র মজুমদার। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস।
বিপ্লবের অনেক ইতিহাসই হারিয়ে গেছে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে। অবহেলায় মুছে যেতে বসেছে দীনেশচন্দ্র মজুমদারের মতো বহু শহিদের স্মৃতি। যাঁরা নির্মম ভাবে তাঁর স্মৃতিসৌধগুলিতে বুলডোজ়ার চালাচ্ছেন, ইতিহাস জানা থাকলে তাঁদের হাত কেঁপে ওঠার কথা।
দেশকে স্বাধীন করতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যাঁরা, দীনেশচন্দ্র মজুমদার তাঁদেরই এক জন। দেশের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীনতার এক যুগেরও আগে, ১৯৩৪ সালের ৯ জুন মারণ রোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত ২৭ বছরের যুবক দীনেশচন্দ্র মজুমদারকে ইংরেজ সরকার প্রায় নিঃশব্দে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা দীনেশচন্দ্র মজুমদারের জীবনগাথা ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল।
১৯০৫ ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সময়। লর্ড কার্জনের নির্দেশে বাংলা দ্বিখণ্ডিত। সারা দেশ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। এমনই এক সন্ধিক্ষণে, ১৯০৭ সালের ১৯ মে বসিরহাটের নিমতলায় পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের দ্বিতীয় সন্তান দীনেশের জন্ম। শৈশবেই পিতৃহারা। চার পুত্র ও তিন কন্যাকে নিয়ে চরম আর্থিক সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা বিনোদিনী দেবী। ইংরেজের খাজনা আদায়ের অত্যাচারে আরও বিপর্যয় নেমে আসে তাদের পরিবারে। খাজনা দিতে না পারলে ঘর-বাড়ি ‘ক্রোক’ করা হবে, চৌকিদারের এই হুমকির উত্তর খুঁজে পায় না দীনেশের শিশুমন। মায়ের সে দিনের যন্ত্রণাকাতর মুখ বিচলিত করেছিল দীনেশকে। এই যন্ত্রণাই পরে প্রেরণা দিয়েছে ইংরেজের অত্যাচারের যোগ্য জবাব দেওয়ার।
ছোটবেলায় খুব ডাকাবুকো ছিলেন দীনেশ। আপাতদৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট, কিন্তু কোণঠাসা হলেই মরিয়া হয়ে উঠতেন। লাঠিখেলা, ছোরাখেলায় বার বার তার সাক্ষী প্রতিপক্ষরা। ১৯২৪ সালে ১৭ বছর বয়সে বসিরহাট হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। স্কুলের রাস্তাটি বর্তমানে তাঁর নামেই নামাঙ্কিত। তবে স্কুলের ভিতর ঢুকে দেখা গেল, সেখানে বহু মনীষীর মূর্তি থাকলেও তাঁদেরই প্রাক্তন ছাত্র, শহিদ দীনেশ মজুমদারের মূর্তি অনুপস্থিত।
বসিরহাট হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে দীনেশ চলে আসেন কলকাতায়, জ্যাঠামশাই হরিমোহন মজুমদারের আশ্রয়ে, তাঁর সাত নম্বর রামমোহন রায় রোডের বাড়িতে। এখানেই লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকে শরীরচর্চা, বিপ্লবী কাজকর্ম। কলকাতার সিটি কলেজে আইএসসি পড়ার সময়ই লাঠি ও ছুরি খেলার অনুশীলনের জন্য সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে ভর্তি হন। ক্রমশ এই দু’টি খেলায় তিনি এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, বহু জনের বিরুদ্ধে একটি লাঠি নিয়ে একাই প্রতিরোধ গড়তে পারতেন। আশ্চর্য ঘটনা, সিমলা ব্যায়াম সমিতি ক্লাবে গিয়েও তাঁর কোনও স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া গেল না।
অন্যায় অবিচার দেখলেই সুদর্শন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দীনেশের লাঠি গর্জে উঠত। এক বার এক ধনী ব্যক্তি অন্যায় ভাবে এক বিধবাকে বাস্তুচ্যুত করতে এলে দীনেশ একাই লাঠি হাতে তার মোকাবিলা করেন। আবার ছুটে যান হরিশপুরে আগুন নেভাতে। সহযোগী বিপ্লবী শৈলেশ্বর বসু যক্ষ্মায় আক্রান্ত, দীনেশ ছুটে যান তাঁর সেবা করতে। এই সেবা ও লড়াইয়ের কাজে তিনি সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে পেতেন কলকাতায় কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে থাকা খুলনার সেনহাটির অনুজাচরণ সেনকে। সেনহাটির রসিকলাল দাস বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন যুবকদের সংগ্রহ করতেন অনুজাচরণের মাধ্যমে। ১৯২১-এ তাঁর হাত ধরেই দীনেশের বৈপ্লবিক জীবনে প্রবেশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে উৎখাত করতে দীনেশ সশস্ত্র সংগ্রামের পথকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন। অনুজাচরণের সঙ্গে রসিকলাল দাসের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর সদস্য হয়ে যান ১৯২৬ সালে। অল্প দিনের মধ্যেই যুগান্তর-এর ২৪ পরগনা জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতা হন।
দীনেশের সহচররা দুর্গাপুজোর মতো নানা ধর্মীয় উৎসবে লাঠি, ছোরা, কুস্তি প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের প্রচার করে বেড়াতেন। তরুণ ছাত্র-যুবকদের আত্মগঠন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দীনেশ একাধিক লাঠি খেলার আখড়া তৈরি করেছেন। বসিরহাটে ব্যায়ামপীঠ জাতীয় পাঠাগারটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে ছাত্র-যুবকদের বিনোদনের আখড়া। আসলে এটি ছিল বিপ্লবীদের ‘রিক্রুটিং সেন্টার’ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বোমা বানাতেও পারদর্শী ছিলেন দীনেশ। ভাই ভবেশকে নিয়ে কালীপুজোয় বোমা বানাতে গিয়ে এক বার বিপত্তি ঘটান। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা বাড়ি। পরে এই বাড়িটি ‘বোমার বাড়ি’ নামে চিহ্নিত হয়ে যায়। কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চালর্স টেগার্টকে বোমা মেরে হত্যা করার জন্য ডাক আসে দীনেশের। টেগার্টকে মারতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছেন বিপ্লবীরা। টেগার্টের বদলে ভুল করে আর্নেস্ট ডে-কে গুলি চালিয়ে হত্যা করে নবম শ্রেণির ছাত্র গোপীনাথ সাহা। তার ফাঁসি হয় প্রেসিডেন্সি জেলে ১৯২৪ সালের ১ মার্চ। গোপীনাথের মৃত্যুর পর প্রায় অর্ধযুগ আর কেউ টেগার্টকে হত্যার চেষ্টা করেনি।
১৯৩০ সালের ২৫ অগস্ট। ডালহৌসি স্কোয়ারের কর্মব্যস্ত ভিড়ের মধ্যে লালবাজারগামী টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারেন দীনেশ। কেঁপে ওঠে ডালহৌসি স্কোয়ার। চার দিকে ধোঁয়ার আস্তরণ। ধোঁয়া কাটতে নিজেই কেঁপে ওঠেন দীনেশ। টেগার্ট অক্ষত। বোমা গাড়ির দরজায় লেগে বাইরে ফেটেছে। তখনই তাড়াহুড়োয় পরের বোমাটি ছুড়তে গিয়ে নিজের হাতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেন অনুজাচরণ। ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। উন্মত্তের মতো অনুজাচরণের কাছে ছুটে যান দীনেশ। চোখের সামনে দেখেন, তাঁর বিপ্লবের ছায়াসঙ্গী চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখেন, টেগার্ট পিস্তল হাতে তাঁর দিকে ছুটে আসছে। দীনেশ নিজেও জখম হয়েছিলেন। পিস্তল হাতে নিয়েও চালাতে পারেননি। ধরা পড়ে যান। আলিপুর স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়। যদিও নানা কারণে দীনেশকে দ্বীপান্তরে না পাঠিয়ে রেখে দেওয়া হয় মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে। এই ঘটনায় রামমোহন রায় রোডের বাড়ি ছেড়ে দিতে হয় তাঁর দাদা অবিনাশচন্দ্র মজুমদারকে। কোনও হোটেলেও তার স্থান হয় না। অন্যের বাড়ির রকে শুয়ে ভাইয়ের জন্য মামলা লড়তেন তিনি। এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে পড়ে মজুমদার পরিবার।
মা-কে খুব ভালবাসতেন দীনেশ। পালিয়ে বেড়ানো জীবনে সু্যোগ পেলেই ছুটে গেছেন বসিরহাটে মায়ের কাছে। যেতে না পারলেও চিঠি দিয়ে যোগাযোগ রাখতেন মায়ের সঙ্গে। ১৯৩১-এর ১৭ অক্টোবর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি দীনেশ মেদিনীপুর জেল থেকে মাকে লিখলেন, “মা, তুমি কিছু ভেবো না। ব্রিটিশের জেলে পচে মরার জন্য তোমার মেনির (দীনেশের ডাকনাম) জন্ম হয়নি। আমি খুব তাড়াতাড়িই এখান থেকে বেরোব।”
মাকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন দীনেশ। জেলের প্রাচীর বেশি দিন তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলের পাঁচিল টপকে পালালেন দীনেশ। লম্বা হাতা-চামচকে গায়ের জোরে বেঁকিয়ে হুকের আকার দিয়ে, তার সঙ্গে কয়েকটা ধুতি দড়ির মতো করে গিঁট বাঁধলেন। দুই সঙ্গী, শচীন করগুপ্ত ও সুশীল দাশগুপ্তকে আগে পালাতে দিয়ে নিজে ঝাঁপ দেন পাঁচিলের উপর থেকে। পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে সেই অবস্থাতেই বেলেঘাটায় দিদির বাড়িতে আশ্রয় নেন দীনেশ।
শুভানুধ্যায়ীরা দীনেশকে বোঝালেন কিছু দিন আত্মগোপন করে থাকতে। কারও কথায় কর্ণপাত না করে দীনেশ শুরু করেন পরবর্তী পরিকল্পনা। লালবাজার ও রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ২৪ পরগনা জেলার সমস্ত থানা আক্রমণ করে দখল নেওয়া এবং সেখানকার মানুষদের সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার বিজয়বার্তা ঘোষণা করা।
দীনেশকে ধরার জন্য মরিয়া ইংরেজ সরকার ১৫০০ টাকা অর্থমূল্যের পুরস্কার ঘোষণা করেন। দলের নির্দেশে শুরু হয় তার অনির্দিষ্ট পথ চলা। কখনও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, আবার কখনও বা ঝরিয়ায়। জীর্ণ পোশাক, ক্ষুধার্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহে পৌঁছন রানিগঞ্জে। সাঁওতাল সেজে টিঙ্কু মাঝি নাম নিয়ে কোলিয়ারিতে দিনমজুরের কাজ নেন। চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ, তাই সেখানে ইংরেজের আইনকানুন, অস্ত্র আইন সরাসরি প্রয়োগ করা যেত না বলে বিপ্লবীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে চন্দননগরকেই বেছে নিত। সন্দেহের চোখ এড়াতে এখানে পালিয়ে আসেন দীনেশ। প্রথমে ডা. হীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পরে দাশরথি ঘোষের বাড়িতে আশ্রয় নেন দীনেশ। সঙ্গী হিজলি জেল পলাতক বিপ্লবী নলিনী দাস ও ওয়াটসন হত্যা প্রচেষ্টার আসামি বীরেন্দ্র রায়। ইংরেজ গুপ্তচর সন্ধান পেয়ে যায় ওঁদের। ইংরেজের দালাল বলে খ্যাত ফরাসি পুলিশ কমিশনার মঁসিয়ে ক্যাঁ নিজেই সদলবলে যান দীনেশদের গ্রেফতার করতে। কিছু ক্ষণ খণ্ডযুদ্ধের পর দীনেশের গুলিতেই নিহত হন ক্যাঁ। বীরেন্দ্র ধরা পড়লেও দীনেশ পালিয়ে যান গঙ্গার ঘাটের দিকে। সেখানেই জটাধারী সাধুর বেশে গঞ্জিকাসেবন করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন। এক দিন গভীর রাতে ফিরে আসেন হীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইন্দ্রালয়’ বাড়িতে। চন্দননগর বাগবাজারের ৩৭ নম্বর চারুচন্দ্র রায় লেনের এই বাড়িটি বর্তমানে জরাজীর্ণ, ভগ্নস্তূপে পরিণত। বাড়িটির হস্তান্তরও হয়ে গেছে। তালা দেওয়া বাড়িটিতে হীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতনি জবা গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েও প্রবেশ করা গেল না। হেরিটেজ হওয়ার ‘আশঙ্কা’য় বর্তমান মালিক আতঙ্কিত। পরিচয় দিয়ে শুধুমাত্র বাড়িটির ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া গেল। জানা গেল ঐতিহাসিক এই বাড়িটি শীঘ্রই ভেঙে ফেলা হবে।
‘ইন্দ্রালয়’-এ দু’দিন কাটিয়ে দীনেশ চলে যান উত্তরপাড়ায় বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেখানেও এক দিনের বেশি থাকতে পারেননি। কলকাতায় এক ঘোড়ার আস্তাবলে আশ্রয় নেন। তিন দিন ঘোড়ার খাবার খেয়ে আবার অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ান। অপুষ্টি, কাশি, জ্বর-সহ নানা ব্যাধিতে তিনি তখন আক্রান্ত। দুর্বল শরীর নিয়ে আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দীনেশ। সাধুর বেশ ধরার সময় গঞ্জিকা সেবনের ফলে তীব্র কাশি বাসা বাঁধে শরীরে। সঙ্গে জ্বর। টালিগঞ্জের একটি বাড়িতে যক্ষ্মা রোগী সেজে থাকতে শুরু করলেন। এই সাজটাই সাজা হয়ে উঠল। সত্যিই মারণ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন দীনেশ। টালিগঞ্জ থেকে মুসলপাড়া লেন, মেছুয়া বাজার হয়ে ১৯৩৩ সালে ১৩৬ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে আনা হয় তাঁকে। সঙ্গী হলেন নলিনী দাস এবং জগদানন্দ। মারণ রোগ তীব্র, মাঝে মধ্যেই বেঁহুশ হয়ে পড়ছেন। তার মধ্যেই তীব্র আর্থিক সঙ্কট। এমন সময় ত্রাতা হয়ে আবির্ভাব হলেন গ্রিন্ডলেজ় ব্যাঙ্কের কর্মচারী কানাই বন্দ্যোপাধ্যায়। সই জাল করে ২৭ হাজার টাকা দীনেশের হাতে তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে কারাবরণ করলেন। দীনেশের শরীর অত্যন্ত খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে সহকর্মীরা ঠিক করলেন ওই টাকায় তাঁর চিকিৎসা করাবেন। দীনেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। নিজের চিকিৎসার জন্য একটি টাকাও খরচ করতে দিলেন না।
২২ মে, ১৯৩৩। ভোর পাঁচটা। ১৩৬ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ির বাইরের কোলাহলে ঘুম ভাঙল দীনেশের। প্রচণ্ড কাশিতে ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে কোনওক্রমে টেনে নিয়ে গেলেন জানলার কাছে। দেখলেন, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সারা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। ওই অবস্থাতেই নলিনী ও জগদানন্দকে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াই চালালেন। শেষরক্ষা হল না। পুলিশের হাতে তিন জনই ধরা পড়লেন। এটাই দীনেশের শেষ লড়াই। ইতি ঘটল এক লড়াকু বিপ্লবীর দীর্ঘ বিপ্লবজীবনের।
নলিনী, জগদানন্দের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর সাজা ঘোষণা হল। দীনেশের জীবনে যবনিকা টানার নির্দেশ দিল আদালত। শোচনীয় অসুস্থতার জন্য ফাঁসির দিনের বিলম্ব ঘটলেও রেহাই দেওয়া হল না তাঁকে। কলকাতা পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; আর জেল পালানো, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁরই ঘর থেকে আসা গুলিতে পুলিশকর্মী মুকুন্দ ভট্টাচার্যর গুরুতর জখম হওয়া, তাঁর ঘর থেকে রিভলভার, কার্তুজ, প্রচুর বুলেট উদ্ধার এবং চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার মঁসিয়ে ক্যাঁ-কে হত্যার অপরাধে দীনেশের ফাঁসির সাজা। ফাঁসির দিন ধার্য হয় ১৯৩৪ সালের ৯ জুন।
ফাঁসির কিছু দিন আগে ১৪ এপ্রিল, জীবনের শেষ বাংলা নববর্ষে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে দাদাকে চিঠিতে লিখলেন, “পয়লা বোশেক। শনিবার। নতুন বছর আসবে বলেই বুঝি বুধবার রাত্রিতে এবারের প্রথম বৃষ্টি এসে সব কিছু ধুয়ে দিয়ে গেল। একদিনের বৃষ্টিতেই যেন পৃথিবীর রঙ গন্ধ বদলে গেল। হাওয়ার গর্জন এসে বাজে কানে। বুঝি কালবোশেকের হাওয়া। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে আজ আর মনটা তেমনি ভাবে নাচতে চাইছে না। গর্জনের ভিতরেও এক নীরব, শান্তি ভরা সুর শুনছি।...”
ভাইপো, ভাইঝিকে উদ্দেশ করে বৌদিকে লেখা তার চিঠিতে যুবসমাজকে সচেতন করার আহ্বান, “তোমাদের ছেলে মেয়েদের আমার আন্তরিক স্নেহাশীষ জানিও। তারা যেন নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে উঠতে পারে। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানবসমাজের ব্যথা যেন মনে প্রাণে অনুভব করতে পারে।”
১৯৩৪-এর ৯ জুন ভোররাতে দীনেশচন্দ্র মজুমদারের ফাঁসি হল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। মৃত্যুর আগে কারও সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাঁর দেহও ছাড়তে সাহস পায়নি ইংরেজ প্রশাসন। দীনেশের প্রাণদণ্ডের খবর তাঁর অভাগা মাকে সরকারি ভাবে জানানো হয় ফাঁসির দশ দিন বাদে। খবর পেয়ে মা আছড়ে পড়েছিলেন দীনেশের জেল থেকে পাঠানো সেই চিঠির উপর, যেখানে লেখা— “মা, তুমি আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তোমার জন্য শত শত সন্তান রইল। তাদের মা হয়ে তুমি আমার দুঃখ ভুলে যেও।” আর এখানেই যুবক দীনেশের সঙ্গে সারা বিশ্বের স্বাধীনচেতা, মুক্তিকামী সংগ্রামী বিপ্লবীদের ভাবনা একাকার হয়ে যায়।
এক দেশপ্রাণ বিপ্লবীর বৈচিত্রময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল নিঃশব্দে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক যুগেরও পরে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাঁর দেখানো পথেই স্বাধীনতার পথ অনেকটা মসৃণ হয়েছে। কিন্তু এই বীর সন্তানকে আমরা মনে রাখিনি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তাঁর নাম জানে না। তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে বসিরহাটে তাঁর জন্মভিটের ধ্বংসাবশেষ-সহ সারা বাংলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া গেল কয়েকটি আবক্ষ মূর্তি, লাঠি ও ছোরা খেলার কয়েকটি আখড়া, চন্দনগরের ভগ্ন আশ্রয়স্থল, নানা শরিকে ভাগ হয়ে যাওয়া উত্তর কলকাতার ৭ নম্বর রামমোহন রায় রোডের বাড়ি, ১৩৬ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ির গেটের ফলক, বসিরহাটে গোপাল চন্দ্র রোডের শহিদ দীনেশ মজুমদার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির আর্থিক অসচ্ছল অফিসঘর— আর দিলীপ মজুমদার, কৌশিক মজুমদারদের মতো কয়েক জন দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
কিছু দিনের মধ্যেই দীনেশ মজুমদারের বসিরহাটের জন্মভিটে এবং তাঁর ও বহু বিপ্লবীর আশ্রয়স্থল ‘ইন্দ্রালয়’ বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হবে।
কৃতজ্ঞতা: দিলীপ মজুমদার, কৌশিক মজুমদার, জবা গঙ্গোপাধ্যায়
তথ্য সহায়তা: দীনেশ মজুমদার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন স্মারক পুস্তিকা, দীনেশচন্দ্র মজুমদার জীবন ও সাধনা: নির্মল কুমার নাগ।
(লেখক রাজ্য ক্রীড়া পর্ষদের প্রাক্তন ক্রীড়াসাংবাদিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy