E-Paper

কমে আসা বিকেলের শীতযাপন

খেলা শেষে বাড়ি ফেরা। শীতের বেলার মতোই দ্রুত শেষ হয় শৈশব। আসে কৈশোর-প্রেম। ভালবাসার সাক্ষী থাকে নদী, বালির চর আর কুয়াশা। আর কখনও তাদের কাছে ফেরা হয় কি?

শীতগোধূলি: ঝুপ করে সন্ধে নামবে বলেই কমে আসত খেলাধুলো।

শীতগোধূলি: ঝুপ করে সন্ধে নামবে বলেই কমে আসত খেলাধুলো।

দ্বৈপায়ন মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৫
Share
Save

দুপুর একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয় এই সময়। বিকেল এখন ছোট।
স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠে যেতে যেতেই দিনের খেলা শেষ। মফস্সলে বেশ বড় বড় মাঠ আছে। আছে খেলা শেষে ঘাসের বুকে আড্ডা। কেউ তখন কপিল দেব, কেউ বা রজার মিল্লা। আমরা ছোট, তাই আমাদের স্বপ্নে এসে গেছেন সচিন তেন্ডুলকর। রাস্তার পাশের আলো জ্বলতে শুরু করছে। ফিরতে দেরি হলে বাড়িতে বকুনি।

কিছু বাড়ি থেকে ভেসে আসে হারমোনিয়াম তবলার শব্দ। গানের মাস্টারমশাই এসেছেন। সেই গান কানে নিয়ে বাড়ি ফিরেই ঘেমো জামা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হবে। নিয়ম মেনে চলে যায় বিদ্যুতের আলো। শীতের সময় লোডশেডিং কিছুটা অন্য রকম। বেশ একটা ঝিম-ধরা গোয়েন্দাগল্পের পরিবেশ। লন্ঠনের আলো দেওয়ালে পড়লে আঙুল দিয়ে হরেক রকম ডিজ়াইন তৈরি করা যায়। আর এই করতে করতেই ফের চলে আসে আলো।

আমাদের বাড়িগুলোর মাথায় থাকে অ্যান্টেনা। শীতের শুরুর দিকে তাদের সঙ্গী ছাদজোড়া লেপ-কম্বলের পসরা। এই সময় ছাদে দুপুরের আড্ডা জমে। শীত বাড়লে ছাদে খাওয়াদাওয়া হয়। আমরা বলি ছাদে ‘ফিস্টি’ হচ্ছে।

বাড়িতে সাদা-কালো টিভি। প্রতিদিন দূরদর্শনের বাংলা খবর শোনা হয়। রাতের দিকে ইংরেজি খবর। সপ্তাহে এক দিন ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’, গোটা পৃথিবীর হরেক খবর তাতে। আমাদের মফস্সলের এত সুবিধে নেই যে, চাইলেই অনেক উপাদান হাতের কাছে পাব। এমনকি অনেক দিন পর্যন্ত খবরের কাগজে যে সকালে পাওয়া যায় সেটাই জানতাম না। অনেক দিন কাগজ আসতে আসতে বেশ বেলা হয়ে যায়। শুধু কাগজ কেন, আমাদের মফস্সলে সিনেমাও বড় শহরের অনেক পরে আসে। আমরা আগে গানগুলো শুনি, আর আমাদের কেউ যদি সিনেমাটা কলকাতায় দেখে আসে তা হলে সে গল্পটা বলে দেয়। তবু আমাদের মফস্সলের হলগুলো তার অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে।

শীতের শুরুর দিকে সকালে একটা কুয়াশার পাতলা চাদর ঝোলে। ঘুম থেকে উঠলে বাইরেটা ঝাপসা দেখায়। একটু বেলা পড়লে খেজুর রস নিয়ে আসেন গ্রাম থেকে কিছু মানুষ। স্বচ্ছ হালকা বাদামি ওই তরলে থাকে স্বর্গীয় ছোঁয়া। রোদ উঠলে স্কুল। পুজোর ছুটির পরই হাফ-ইয়ারলির খাতা বেরিয়ে গেছে। সামনে আর কোনও পরীক্ষা নেই। খেলার মাঠগুলো থেকে বিদায় নিয়েছে ফুটবল। মাঠে ব্যাট-বল চলে এসেছে। এ বার আসবে সার্কাস। সার্কাস ছাড়াও অন্য ধরনের খেলা নিয়ে কিছু মানুষ আসেন শীত শুরু হতেই। এদের কেউ কেউ খেলা দেখান সাইকেল চালিয়ে। পুরো দিন সাইকেল চেপে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘোরা। সাইকেলে চেপেই খাওয়া-দাওয়া। এ ভাবেই দিন দুই-তিন কাটান। আমরা দেখতে যাই দল বেঁধে।

একটু বড় হতেই আমাদের স্কুলের পড়ার বইয়ে জীবনানন্দ প্রবেশ করলেন। এক মাস্টারমশাই জীবনানন্দ আর হেমন্তের বিষণ্ণতা নিয়ে এক বার পড়িয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলবয়সে হেমন্তের বিষণ্ণতা বুঝতে পারার আগেই যে জিনিসটা বোঝা যায়, তা হল একটা পরমপ্রিয় সময় আসতে চলেছে হেমন্তের পরেই। শুধু বিকেলের খেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হচ্ছে, এই ছিল আফসোস।

খেলার মাঠে মাথার উপর মশারা গোল হয়ে চক্কর দেয়। রাজাদের মাথার উপর যেমন ছাতা ধরা থাকে, আমাদের মাথায় আছে মশাদের ছাতা। আমরা এই ছাতা এড়াতে একটু ছুটে যাই। মশার দলে ভাঙন ধরে। তার পর তারা আবার জড়ো হয় মাথার উপর। আমাদের মাথার চুল ওদের কেন পছন্দ, এটা বুঝতে বুঝতেই ছোটবেলাটা দুর্বার গতিতে শেষ হতে শুরু করে।

গল্পের মধ্যে তখন প্রবেশ করে ভালবাসা, প্রেম এবং অবশ্যই টিউশন ব্যাচগুলোয় তৈরি হওয়া ছোট ছোট মিষ্টি সম্পর্ক। বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে থাকে চিঠির দল। আমাদের মফস্সলে ঝুপ করে প্রেম নামে, না জানিয়ে। অনেকটা শীতের সন্ধের মতো। প্রেমের শুরুটা অনেক সময় হয় বিকেলের টিউশন ব্যাচগুলো থেকে। সাইকেলের ক্রিং-ক্রিং শব্দে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে বাড়ি ফিরত। এর মধ্যেই একটা সাইকেল টুক করে দল থেকে হারিয়ে যেত। হলদে বাল্‌ব জ্বলা রাস্তায় তখন কুয়াশার আস্তরণ। সাইকেল থেকে নেমে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে টুকটুক করে এগিয়ে যায়। অনেকটা রাস্তা জুড়ে আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের স্বপ্ন দেখা শুরু।

টেস্ট পেপারের মধ্যে চিঠি লিখে সেই স্বপ্নের আদানপ্রদান চলে বেশ কিছু দিন। এর পর সেই ছেলেটা আর মেয়েটা নিয়মিত দেখা করে। পুজোর ছুটিতে টিউশন ব্যাচ বন্ধ হলে তাদের শ্বাসকষ্ট হয়। কোনও বন্ধুর মাধ্যমে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে তারা টুক করে বেরিয়ে পড়ে কোনও অজুহাত দেখিয়ে। মফস্সলের গা দিয়ে বয়ে চলে নদী। বর্ষায় উপচে ওঠে, বাকি সময় বিস্তীর্ণ বালির রাজ্য। নদীর ধারে সেই ছেলেটা আর মেয়েটা হাত ধরে দাঁড়ায়। না-বলা জমে ওঠা কথাগুলো এক সঙ্গে বলতে শুরু করে দু’জনেই। ছেলেটার পকেটে বিশেষ টাকা নেই। লম্বা কোনও চকলেট বার মেয়েটার জন্য আনতে পারেনি সে। নদীর উপর দিয়ে ভেসে আসে হিমেল হাওয়া, শীতের আগমনবার্তা নিয়ে। ছেলেটার ঠোঁট নেমে আসে মেয়েটার ঠোঁটে। জীবনের প্রথম চুম্বন।

পুরো শীতকাল তারা ভালবাসায় ডুবে যায়। মেয়েটার টিউশন ব্যাচের বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। মেয়েটা জানে কোথায় আছে তার রাজকুমার। বন্ধুদের এড়িয়ে খুঁজে নেয় ছেলেটার সাইকেল। মফস্সলের প্রেমে অনেক সময় গোলাপ থাকে না, হয়তো হাতের সামনে পাওয়া চন্দ্রমল্লিকা থাকে। আসলে বেশ কিছু বাড়ির সামনে আর ছাদে থাকে ফুলের টব। তাতে ফোটে গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা। তাই মফস্সলের প্রেমে ফুল মানে শুধু গোলাপ নয়, সদ্য গোঁফের রেখা-ওঠা ছেলেটা চোখের সামনে যে ফুল, দেখতে পায় সেটাই।

এই ভাবে আমাদের মফস্সলের রাস্তায় অভিমান, ঝগড়া, আদরে বেড়ে ওঠে গল্পগুলো। তার পর হঠাৎ এক দিন রাস্তা বদলে যায়। কখনও মাধ্যমিক অথবা কখনও উচ্চ মাধ্যমিক, স্বপ্নগুলো ক্রমশ আলাদা রাস্তা ধরে। ছেলেটা অথবা মেয়েটা অথবা দু’জনেই হয়তো পাড়ি দেয় এই মফস্সল ছেড়ে কোনও বড় শহরে, অনেক বড় হতে হবে তাদের। দূরের বড় শহরে তখন ছেলেটা আর মেয়েটা বিশ্বাস করে তারা আবার ফিরে আসবে ফেলে আসা মফস্সলে। কিন্তু গল্পগুলো অনেক সময় এক সঙ্গে না-ফেরার দেশেই থেকে যায়।

এর মধ্যেই মফস্সলের সেই নদীর বালুচরে তখন উপস্থিত হচ্ছে নতুন মুখের দল, নতুন লুকোচুরি, নতুন পথ চলা। এদের মধ্যেই হয়তো কোন গল্প না-ফেরার দেশ থেকে এক দিন ফিরে আসবে মফস্সলে। নদী এই বিশ্বাস নিয়ে আজও বেঁচে থাকে। শীত প্রতি বার তার বুকের উপর কুয়াশা সাজায়। কুয়াশার ঝালর সরে গেলে হয়তো দেখা যাবে কোনও হারানো চেনা মুখ, এটাই বহতা নদীর চিরকালের অপেক্ষা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Feature Winter

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।