বহুরূপা: দশাননা কালী (দক্ষিণ চেতলা সর্বজনীন মহাকালী পূজা কমিটি, সি আই টি পার্ক)। ডান দিকে, চেতলা ইয়ং স্টারের গুহ্যকালী।
দক্ষিণ কলকাতার ঝকঝকে আধুনিকতার মাঝে পুরনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে আজও উজ্জ্বল চেতলা অঞ্চল। আদিগঙ্গার পাড়ে কালীঘাটের কালীমন্দির, কেওড়াতলার মহাশ্মশান আর চেতলার হাট সমসাময়িক। পুরনো কলকাতায় ইতিহাসের গন্ধমাখা এই জনপদের প্রসিদ্ধির অন্যতম দিক হল কালীপুজো। একই সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিটের পায়ে-হাঁটা দূরত্ব অতিক্রম করলেই এত বিচিত্র ধরনের কালীমূর্তির আরাধনা বাংলার অন্যত্র বিরল। শুধু শাস্ত্রে বর্ণিত রূপই নয়, নানা ঘটনার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেও, কিংবা কোনও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিতা লৌকিক রূপের আদলেও কালীর বিভিন্ন রূপের আবির্ভাব ঘটে চেতলায়। বহু পুজো উদ্যোক্তা আবার বছরের পর বছর আহ্বান করেন সেই বিচিত্ররূপা দেবীপ্রতিমাকেই। থিম বা নতুনত্বের সন্ধান, কোনও কারণেই এঁরা নিজস্ব বৈচিত্র বা বৈশিষ্ট্য থেকে সরে যান না।
চেতলা ও নিউ আলিপুরের সংযোগকারী সেতুর মুখেই হয় চামুণ্ডা কালী। সুউচ্চ প্রতিমার পাশে তাঁর অর্ধেকের সামান্য বেশি উচ্চতার শিব হাঁটু গেড়ে প্রণামের ভঙ্গিতে উপবিষ্ট। দেবীর দু’পাশে ভয়াল চেহারার ডাকিনী-যোগিনী।
প্যারীমোহন রোডের চেতলা যুব সঙ্ঘের বৈশিষ্ট্য দশমহাবিদ্যা। বিশাল মণ্ডপে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলার আলাদা আলাদা বিগ্রহ পুজো হয়। সঙ্গে থাকেন আদিকালী। প্রতি বছর রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও সন্ন্যাসী আসেন পৌরোহিত্য করতে।
সি আই টি পার্কের বিখ্যাত পুজোটি করে দক্ষিণ চেতলা সর্বজনীন মহাকালী পূজা কমিটি। এখানে দেবী দশাননা। শুধু মস্তক নয়, দেবীর হাত এবং পা-ও দশটি করে।
চেতলা প্রদীপ সঙ্ঘ ৩৮ বছর ধরে পঞ্চমুণ্ডা অর্থাৎ পঞ্চমুখী কালীর আরাধনা করে আসছে। কালীঘাটের শান্তি আশ্রমের মহারাজ ধ্যানে বসে পঞ্চমুণ্ডা মূর্তির রূপ অনুভব করেন। মা জাগ্রতা, বীরভূমের কোনও গভীর জঙ্গলে মায়ের প্রাচীন শিলামূর্তি আজও পূজিতা হন। বগলা, শ্যামা, চামুণ্ডা, রক্ষাকালী ও ধূমাবতী, এই পাঁচ মুখের সমাবেশ পঞ্চমুণ্ডার মূর্তিতে। শিব নয়, পায়ের নীচে শুয়ে আছেন পঞ্চানন। মায়ের উপরের বাঁ হাতে খাঁড়া, রুদ্রাক্ষ। নীচের বাঁ হাতে গীতা। উপরের ডান হাতে চাঁদমালা, উপবীত, নীচের ডান হাতে রক্তপাত্র।
গোপালনগর গোল্ডেন ক্লাবের ৭৯ বছরের আরাধ্যা মা এলোকেশী গিরিশ ভবনের কালীমূর্তির আদলে তৈরি। মায়ের গায়ে সোনা-রুপোর গহনা, সোনার জিভ, রুপোর ছাতা।
চেতলা গীতাঞ্জলি স্পোর্টিং ক্লাবের বৈশিষ্ট্য— নবদুর্গার তৃতীয় রূপ, দেবী চন্দ্রঘণ্টার আরাধনা। ভৈরবের বুকে পা রেখে বিশাল প্রতিমা দণ্ডায়মানা। দেবী চতুর্ভুজা, মুখের দু’পাশে গজদন্ত, লোহিতবর্ণা, ব্যাঘ্রচর্মা পরিহিতা, নরমুণ্ডধারিণী, চন্দ্রশোভিতা, মাথায় জটাজূট। অস্ত্রের মধ্যে খণ্ডশূল, ঘণ্টা, কুড়ুল ইত্যাদি। তিন দিন ধরে পুজো হয়। ভূতচতুর্দশীর দিন ঘটস্থাপন, সে দিন চন্দ্রঘণ্টা দেবীর পুজো। কালীপুজোর রাতে শ্যামাপুজো আর পর দিন দর্পণপুজো ও বিসর্জন। তিন দিন ধরে হোম ও ভোগদান চলে। ৪১ বছর ধরে এই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে।
পাশেই চেতলা ফাইভ স্টারের পুজো। বয়স ৩২ বছর। তারাপীঠের তারামায়ের আদলে তৈরি মূর্তি। নীচে বসে আছেন বামাক্ষেপা। তন্ত্রমতে পুজো করেন তারাপীঠের তান্ত্রিক। আখ, শশা, চালকুমড়ো, কলা ও শোলমাছ বলি হয়।
চেতলা অঞ্চলের জাঁকজমকপূর্ণ পুজোগুলির অন্যতম ৮৬ পল্লির ছিন্নমস্তা পুজো। ৪০ ফুটের বেশি উঁচু মণ্ডপে ১৬ ফুটের প্রতিমা। বেশ কিছু বছর সাধারণ কালীপুজো করার পর পরিবর্তনের চিন্তা সদস্যদের মনে দানা বাঁধতে থাকে। এঁদের ক’জন রাজারাপ্পায় ঘুরতে গিয়ে ছিন্নমস্তার মূর্তি দেখে আপ্লুত হয়ে এখানে সেই মূর্তি প্রচলন করেন। অবিকল সেই মূর্তি গড়া হয়। লাল টকটকে গাত্রবর্ণ, নিজের ছিন্ন মুণ্ড নিজেরই হাতে ধরা। তিনটি রক্তের ধারা পান করছেন দেবী নিজে, তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনী। পদ্মের উপরে কাম ও রতির মিলনাবদ্ধ শয়ানমূর্তির উপর ছিন্নমস্তা দাঁড়িয়ে। মণ্ডপ ও সংলগ্ন এলাকার আলোকসজ্জাও দর্শনীয়।
কাছেই চেতলা হাট রোডে চেতলা সঙ্ঘে পূজিতা কৃষ্ণকালী। আট ফুট মূর্তির ধড় কৃষ্ণের, মুখ শ্যামাকালীর। এক হাতে বাঁশি, অন্য হাতে খড়্গ ।
চেতলা হাট রোডের অন্য একটি পুজো, সৎসঙ্ঘের দুর্গাকালী। প্রতিমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বালম্বি ভাগ। এক দিকে কালীর রূপ, সে দিকে দু’টি হাত। অন্য দিকে দুর্গার রূপ, সে দিকে পাঁচটি হাত।
চেতলা শহিদ স্মৃতি সঙ্ঘের ঐতিহ্য ডাকাতকালী। স্থায়ী মন্দিরে সারা বছর প্রতিষ্ঠিত মূর্তি। আঠারো ফুট উঁচু কালো কুচকুচে বিশাল প্রতিমা বেঁধে রাখা হয় মোটা শেকলে।
বীরভূম জেলার আকালীপুরের রাজা নন্দকুমারের আরাধ্যা দেবী গুহ্যকালীর অনুকরণে চেতলা ইয়ং স্টারের ৫৫ বছরের পুজো। সাপের সিংহাসনে বসা, মাথায় সাপের মুকুট। দেবী দ্বিভুজা। এখানে বলি নেই, তবে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়।
আলিপুর ইয়ং স্টারের পূজিতা দেবীবিগ্রহ রাজবলহাটের রাজবল্লভী। দুধসাদা বিশাল প্রতিমা। দু’টি হাতের একটিতে কৃপাণ, অন্যটিতে বরদান মুদ্রা। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের দুলালচন্দ্র ভড়, যিনি তালমিছিরির জন্য বিখ্যাত, তিনি মায়ের এই রূপ স্বপ্নে পান। একেবারে অন্য রকম কালীর দেখা মেলে চেতলা ইয়ং স্টারের পুজোয়। এঁরা করেন আকালী কালীর পূজা। শিবের মূর্তি লাগানো সিন্দুকের উপর উপবিষ্টা কালী, দু’টি হাতে সাপ ও আশীর্বাদ, সর্বাঙ্গে সাপের ভূষণ। মাইথনে এমন মূর্তির দেখার মেলে। কথিত আছে, এক ব্রাহ্মণ এক বার পুজো সেরে ভোগ নিবেদন করে দরজা বন্ধ করার সময় বলে যান, “মা যা রইল সব খেয়ে নিস।” তিনি জানতেন না তাঁর মেয়ে ওই ঘরে লুকিয়ে আছে। পরে মেয়ের খোঁজে ঘরে ঢুকে দেখেন দেবী তাঁর মেয়েকেও খেয়ে নিয়েছেন, মেয়ের শাড়ির কোণ দেখা যাচ্ছে মূর্তির মুখে। রাগে-দুঃখে ব্রাহ্মণ বলে ওঠেন, “তোর মুখ আর দেখতে চাই না।” তখনই বিগ্রহ পিছনে ঘুরে যায়। সেই রূপই অনুসৃত এখানে বহু বছর ধরে।
চেতলা ইয়ং ফ্রেন্ডশিপ ৪৮ বছর ধরে জহুরা কালীর পুজো করে। স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ মালদহের কালীমন্দির দর্শন করে এসে এখানে পুজোর সূচনা করেন। পূর্ণপ্রতিমার বদলে এখানে জহুরা কালীর লাল টকটকে মুখমণ্ডল পূজিতা।
অঞ্চলের জনপ্রিয় পুজোগুলির অন্যতম মিলন সঙ্ঘের রক্তচামুণ্ডা। রক্তবীজকে বধের পর দেবী অসুরদের একের পর এক গ্রাস করতে লাগলেন, সমস্ত অসুর নিধন করে তাঁর বমির উদ্রেক হল। বমি করে কঙ্কালসার চেহারা হল তাঁর। কালীঘাটের শান্তি আশ্রমের সত্যানন্দ গিরি মহারাজ প্রথম এই মূর্তির প্রচলন করেন। নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে এই পুজো করেন উদ্যোক্তারা।
চেতলা ৭৩/জি আলিপুর রোডে শেতলা স্মৃতি সঙ্ঘের পুজো পান সিংহবাহিনী কালী। রাজপুরের বাবা দুলালের স্বপ্নাদিষ্ট বিপত্তারিণী চণ্ডীর আদলে তৈরি মূর্তি, উচ্চতা ১৪ ফুট। মণ্ডপও বিশাল। দেবীর অঙ্গে গয়নার চমক। সিংহের মাথাতেও মুকুট।
গোবিন্দ আঢ্য রোডের ইয়ং ইনস্টিটিউট প্রতি বছর দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীরূপের পুজো করে। নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদল।
মৃন্ময়ী প্রতিমার সঙ্গে জীবন্ত প্রতিমা দেখতে চাইলে যেতে হবে দুর্গাপুর জাগরণী সঙ্ঘের পুজোয়। আট থেকে পনেরো বছরের ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জীবন্ত কালী সাজানো হয়। শায়িত শিবের উপর কালী সেজে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে তারা। দফায় দফায় এই দর্শন চলে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত।
চেতলার কালীপুজোর পরিক্রমা শেষ করা যাক কেওড়াতলা শ্মশানের শ্মশানকালী দিয়ে। প্রায় দেড়শো বছর ধরে শ্মশানের হরিজন ডোম সম্প্রদায়ের মানুষের পরিচালনায় হয়ে আসছে এই পুজো। এখন এই পুজোর সঙ্গে অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরাও যুক্ত। পাঁচ জন কাপালিক এক কালে এই মূর্তির খোঁজ পান গভীর জঙ্গলে। তাই আজও পাঁচ জন পুরোহিত সমবেত ভাবে পুজোয় বসেন। রামঠাকুরের পরিবারের পুরোহিত পুজো শুরু করেন। সে সময় মূর্তির মাপ ছিল ১৪ হাত। এখন ১৪ ফুট প্রতিমা হয়। দেবীর জিভ দেখা যাচ্ছে না। দু’টি হাত, ডান হাতে মানুষের মাংসখণ্ড, বাম হাতে কারণপাত্র।
চেতলার কালীবিচিত্রায় বড় বড় পুজোর পাশাপাশি কলেবরে ছোট পুজোও থাকে বিস্তর— উৎসাহ, নতুনত্ব তাঁদেরও কম নয়। সব মিলিয়ে কালীপুজোর ক’টা দিন চেতলার নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। বৈচিত্রসন্ধানী দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করতে প্রতি বারের মতো এ বারেও তৈরি তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy