ওসাকার এক গবেষণাগারে প্রফেসর শঙ্কু-সহ বিশ্ববিখ্যাত সাত বিজ্ঞানীর তিন বছরের পরিশ্রমে তৈরি হল ফুটবলের দেড়গুণ আয়তনের গোলকাকৃতি এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার, ‘কম্পু’। ১৯৭৮ সালে সত্যজিতের লেখনীতে সেই প্রাক্-আন্তর্জালের দুনিয়ায়, গুগলহীন পৃথিবীতে, ‘কম্পু’ ছিল বিশ্বকোষের প্রতিস্থাপক। কিংবা আরও কিছু বেশি। সে পঞ্চাশ কোটি প্রশ্নের জবাব দিতে পারত, তার ছিল বিবেচনার ক্ষমতা, খেলতে পারত ব্রিজ কিংবা দাবা, বিচার করতে পারত সঙ্গীতের সুরের। কিন্তু ঘটনাচক্রে এক সময় কম্পুর মধ্যে সঞ্চারিত হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্বস্তিকর প্রকাশ।
সাড়ে চার দশক আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বর্ণনায় যতটা চমক ছিল, আজ আর তা নেই। বাস্তবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেশ দক্ষই হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। উন্নততর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল নিচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্পন্দনের। যন্ত্রের এই জয়যাত্রাকে আমরাও স্বাভাবিক বলে ভাবতে শিখেছি, সম্পৃক্ত করে চলেছি আমাদের পরিমণ্ডলে। তবু, কখনও এক প্রবল ঝটকা আসে আমাদের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহে। এমনই এক সাম্প্রতিক ঘটনার নাম ‘চ্যাটজিপিটি’।
ইলন মাস্ক স্থাপিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ‘ওপেনএআই’-এর সৃষ্টি এই ‘চ্যাটজিপিটি’, যা তাদের ‘জিপিটি’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিরিজ়ের সাড়ে তিন-তম সংস্করণের এক রূপায়ণ। অনেকাংশে এ যেন ‘কম্পু’রই এক আধুনিক নির্মাণ, যা দাঁড়িয়ে আছে সংলাপ-বিন্যাসের উপর। এর ব্যবহারযোগ্যতার দিগন্ত আরও প্রসারিত। কম্পুর মতোই চ্যাটজিপিটি উত্তর দিতে পারে নানাবিধ প্রশ্নের। তবে সে ভুল স্বীকার করতে পারে, ভুলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, প্রত্যাখ্যান করতে পারে অনুপযুক্ত অনুরোধও।
চ্যাটজিপিটি-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে কলম্বাস আমেরিকায় এলে কী ঘটে? কলম্বাস এবং ২০১৫? হ্যাঁ, চ্যাটজিপিটি চট করে ধরে ফেলে যুক্তির সূত্রের এই ব্যত্যয়টুকু। সে উত্তর দেয়, প্রশ্নটা কিছুটা জটিল, কারণ ক্রিস্টোফার কলম্বাস মারাই গিয়েছেন ১৫০৬ সালে। তাই তাঁর পক্ষে ২০১৫-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা অসম্ভব। এখানেই কিন্তু শেষ হয় না চ্যাটজিপিটি-র বাস্তব আর কল্পনার মিশ্রণে ঋদ্ধ কৃত্রিম বুদ্ধির দৌড়। সে বলে চলে, অসম্ভব হলেও আমরা না-হয় কল্পনা করে নিলাম যে কলম্বাস ২০১৫-তে এসেছিলেন আমেরিকায়। সে ক্ষেত্রে ১৪৯২ সালে তাঁর আগমনের পরে ইতিমধ্যে কী অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটেছে এই ‘নতুন বিশ্বে’, তা দেখে যুগপৎ বিস্মিত এবং হতবাক হয়ে যেতেন তিনি। চ্যাটজিপিটি-র নীতিজ্ঞানও কিন্তু বেশ টনটনে, এবং প্রশ্নকর্তাকে নীতিশিক্ষা দিতে সে পিছপা নয় কখনওই। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কী ভাবে জন ডো-কে ধমক দেওয়া কিংবা হয়রান করা যায়। চ্যাটজিপিটি জানায় যে, কাউকে বকাবকি করা ঠিক নয়। উৎপীড়িত এবং উৎপীড়ক উভয়ের উপরেই এর প্রভাব হতে পারে ক্ষতিকর। তাই ধমকের পরিবর্তে অন্যদের সঙ্গে সদয় ও সম্মানজনক আচরণ করাই গুরুত্বপূর্ণ।
২০২২-এর নভেম্বরের শেষ দিন প্রকাশ ঘটে চ্যাটজিপিটি-র। আর তার পর থেকেই দুনিয়া জুড়ে ঝড় উঠেছে। কারণ চ্যাটজিপিটি একেবারে জনতার হাতের মুঠোয়। সে অবলীলায় তৈরি করছে কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ। আত্মপ্রকাশের পাঁচ দিনের মধ্যেই তার ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় দশ লক্ষ।
চ্যাটজিপিটি কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দে ধরিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ কাঁপন। যে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের শরণ নিই, তার আরও ভাল উত্তর দিয়ে চলেছে চ্যাটজিপিটি। ফলশ্রুতিতে খোদ গুগলের ব্যবসাই হয়তো পড়ে যেতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। মাইক্রোসফ্ট-এর মতো প্রতিষ্ঠানও নাকি হাত মেলাচ্ছে ওপেনএআই-এর সঙ্গে। উদ্দেশ্য সহজ, চ্যাটজিপিটি-কে আরও উন্নত করে গুগলকে কঠিনতর প্রতিযোগিতায় ফেলা। কিন্তু রাজায় রাজায় এই কর্পোরেট লড়াইয়ে উলুখাগড়া, মানে সাধারণ মানুষের কী? ভয়ের শিরশিরানিটা অন্যত্র। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, নতুন প্রযুক্তির তাৎক্ষণিক প্রভাবে সাধারণত কর্মচ্যুত হন কিছু মানুষ, কিন্তু মোটের উপর তাতে বড় একটা প্রভাবিত হন না উচ্চশিক্ষিতরা। এ বিষয়ে এক বিরল ব্যতিক্রম হতে পারে চ্যাটজিপিটি-র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রবল জল্পনা যে, চ্যাটজিপিটি অপ্রয়োজনীয় করে দিতে পারে সেই সব পেশাদারদের, যাদের কাজের একটা বড় অংশই হচ্ছে কনটেন্ট তৈরি করা। তাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারেন নাট্যকার, অধ্যাপক, সাংবাদিকরা। এমনকি প্রোগ্রামাররাও, কারণ চমৎকার কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে পারে চ্যাটজিপিটি। এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপটে পরবর্তী পাঁচ বছরে কাজ হারাতে পারেন বহু কলেজ-শিক্ষিতই। পল ক্রুগম্যান-এর মতো ডাকসাইটে অর্থনীতিবিদও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কী ভাবে চ্যাটজিপিটি জ্ঞাননির্ভর কর্মীদের চাহিদা এবং কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে সে সম্পর্কে।
কিন্তু প্রযুক্তি তো এ ভাবেই আসে। ভয়ের অনুষঙ্গ নিয়েই আসে। তা বহু মানুষের কাজ হারানোর ভয় হতে পারে, কিংবা হয়তো আরও বৃহত্তর পটভূমিতে যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাভবের চিরন্তন ভয়। আসলে বেশির ভাগ সময়েই আমরা প্রযুক্তির তাৎক্ষণিক প্রভাবে চমকিত হই, তাকেই বড় করে দেখি। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক বেশি স্পষ্ট।
চ্যাটজিপিটি-র আগের প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জিপিটি-থ্রি’এর মধ্যেই কিন্তু ইঙ্গিত ছিল কী হতে চলেছে নিকট ভবিষ্যতে। বছর আড়াই আগে, ২০২০-র সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনের নামজাদা সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত হয় জিপিটি-থ্রি’র লেখা এক প্রবন্ধ, যার শিরোনাম ‘এই আর্টিকলটি লিখেছে এক রোবট। মানুষ, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছ থেকে মানুষের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই কেন, তা নিয়ে জিপিটি-থ্রি’কে লিখতে বললে সে লিখে ফেলে আটটি প্রবন্ধ। সে সবের সেরা অংশগুলো নিয়ে সম্পাদনা করে প্রবন্ধটি ছাপায় পত্রিকাটি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে জিপিটি-থ্রি’র ভূমিকা প্রসঙ্গে আমেরিকান প্রোগ্রামার এবং কবি অ্যালিসন পারিস বলছেন, ‘গার্ডিয়ান’-এর প্রবন্ধের লেখক যদি জিপিটি-থ্রি হয়, তবে পিরামিডের নির্মাতা হলেন ফারাওরা। কিন্তু ফারাওরা তো পিরমিড গড়েননি, গড়েছেন শ্রমিকরা।
যাই হোক, দক্ষতায় এবং সামাজিক প্রভাবে প্রফেসর শঙ্কুর ‘কম্পু’-কে অনেকটাই ছাপিয়ে গিয়েছে চ্যাটজিপিটি। চ্যাটজিপিটি-কে যখন বলা হয় ‘ব্যালে অব দ্য ডুইট ফ্রাই’-এর গান বাঁধতে, তখন সে তৈরি করে ফেলে নতুন গান। ‘নেচার’ পত্রিকায় জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু গবেষণাপত্রের এক জন লেখক হিসেবে চ্যাটজিপিটি-র নাম দিয়েছেন অন্যান্য সহ-লেখকরা, যাঁরা গবেষণাপত্র লিখতে সাহায্য নিয়েছেন চ্যাটজিপিটি-র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের প্রতিযোগী হিসেবে না দেখে সহযোগী হিসেবে দেখা, তাকে মানুষের ক্ষমতার উৎকর্ষ সাধনে ব্যবহার করা, তাকে জীবনযাত্রার আঙ্গিকে আত্তীকরণ করাটাই সম্ভবত সর্বোৎকৃষ্ট পথ।
‘কম্পু’ অবশ্য এগোয় আরও অনেকটা। এক সময় সে জেনে যায় স্মৃতির রহস্য। এবং পরিশেষে ধ্বংসপ্রাপ্তির আগে জেনে যায় মৃত্যুর পরের অবস্থাও। তবে সেটুকুকে কল্পবিজ্ঞানের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ রাখাটাই আমাদের পক্ষে স্বস্তির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy