E-Paper

অসুস্থ শরীরেও স্থাপন করেন অখণ্ড বঙ্গের ভিত্তিপ্রস্তর

শুধু রাজনীতি বা প্রশাসন নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। ইতিহাস আনন্দমোহন বসুকে মনে রেখেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া প্রথম ভারতীয় হিসাবে।

—ফাইল চিত্র।

অর্ণব নাগ

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:১৪
Share
Save

দিনটা ছিল ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫। ঘরে ঘরে অরন্ধন পালিত হচ্ছে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ পাঠ করছেন বাংলার মেয়েরা। রবীন্দ্রনাথ পথে নেমে রাখি পরিয়ে দিচ্ছেন বাংলার মানুষের হাতে। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে অখণ্ড বঙ্গের প্রতীক হিসেবে উত্তর কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। অসুস্থ আনন্দমোহন বসু ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। চলচ্ছক্তিহীন আনন্দমোহনকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে কাঁধে করে কয়েক জন যুবক অনুষ্ঠান-প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। তাঁর লিখিত সভাপতির অভিভাষণ পড়ে শোনান সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়— “আজ এই নবীন ও অখণ্ড ‘বাঙালি জাতি’র জন্মক্ষণে আমাদের প্রাণ মন মহোল্লাসে বিশ্ববিধাতার মহাসিংহাসন পানে উত্থিত হউক।” ইতিহাস আনন্দমোহন বসুকে মনে রেখেছে প্রথম ভারতীয় ‘র‌্যাংলার’ হিসেবে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণকে ‘র‌্যাংলার’ মর্যাদায় ভূষিত করা হত।

আনন্দমোহনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহের জয়সিদ্ধি গ্রামে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে মাত্র পনেরো বছর বয়সেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন নবম স্থান অধিকার করে। এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ এবং বি এ পরীক্ষায় পাশ করেন, দু’টি পরীক্ষাতেই প্রথম হয়ে। কলেজের জনৈক অধ্যাপক এক বার ক্লাসে গণিত সংক্রান্ত তিনটি কঠিন প্রশ্ন করে মন্তব্য করেছিলেন, যে এর মধ্যে অন্তত দু’টির উত্তর দিতে পারবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তার প্রথম হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। আনন্দমোহন সকৌতুকে জানতে চেয়েছিলেন, যদি কেউ তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে তবে কী হবে! উত্তেজনার বশে সেই অধ্যাপক বলে ফেলেছিলেন, যে ছাত্র সবগুলি জটিল অঙ্কের প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারবে, সে এক দিন তাঁর আসন অলঙ্কৃত করবে। বলা বাহুল্য, আনন্দমোহন সবগুলি প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, গণিতে স্নাতকোত্তর করে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজেরই ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

তৎকালীন সুবিখ্যাত ছাত্রবৃত্তি প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারশিপ নিয়ে ১৮৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনন্দমোহন উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যান। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি যেমন মেধাবী ও কৃতী ছাত্র হিসেবে সবার নজর কাড়েন, অন্য দিকে দেশের কাজেও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হয়ে গণিত পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেন।

গণিতশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি পেশাগত ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ড থেকেই আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইচ্ছে করলেই আনন্দমোহন ওকালতি করে বহু অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, কিন্তু নিজের প্রয়োজনীয় অর্থটুকু রোজগার করা ছাড়া তিনি এ ব্যাপারে নিস্পৃহ ছিলেন। আর্থিক কষ্ট তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল। তাঁর প্রয়াণের কয়েক বছর পর ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে সংসার-নির্লিপ্ত কিন্তু কর্তব্যে অবিচল আনন্দমোহনের কথা লেখেন তাঁর সহধর্মিণী স্বর্ণপ্রভা দেবী।

ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রবৃত্তির অর্থে রীতিমতো রোজগেরে ছিলেন আনন্দমোহন। মাত্র ন’বছর বয়সেই ময়মনসিংহ বাংলা বিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষায় পাশ করে মাসিক চার টাকা বৃত্তি পান। ১৮৬২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় আঠারো টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির টাকায় তাঁর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা সুসম্পন্ন হয়েছিল। কেমব্রিজে ভর্তি হয়ে অঙ্কে প্রথম স্থান অধিকার করে পাঁচশো টাকা স্কলারশিপ পান। অমৃতবাজার পত্রিকা (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৭০) লিখেছিল: “আনন্দমোহন বাবুর বয়স চব্বিশ বৎসর মাত্র। ইহার মধ্যে তিনি কেবল ছাত্র-বৃত্তি দ্বারা তেরো হাজার টাকা উপার্জন করিয়াছেন।”

আনন্দমোহন বসু যখন কলকাতায় ফিরলেন, তখন বাংলায় স্বাদেশিকতার জোয়ার। প্রতি বছর শীতের শেষে কলকাতা বা তার উপকণ্ঠে নবগোপাল মিত্রের আয়োজনে জাতীয় মেলা— যা ‘হিন্দু মেলা’ নামে সুপরিচিত ছিল— অনুষ্ঠিত হত। ১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পার্সিবাগানের হিন্দুমেলায় শরীরচর্চা বিভাগে ভারতবাসীর শারীরিক শক্তির উৎকর্ষ নিয়ে আনন্দমোহন একটি অনুপম বক্তৃতা করেন। ওই বছরেই এপ্রিলে তাঁর সভাপতিত্বে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বা ছাত্রসভার প্রতিষ্ঠা হল। ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতে এই প্রথম সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের এক মঞ্চ নির্মিত হয়। সে বছরই তিনি পরাধীন ভারতের বুকে স্বাধীন রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে আগ্রহী হন, যাতে দেশবাসী তাঁদের মতামত সরাসরি শাসকের দরবারে পৌঁছে দিতে পারে। দুই সুহৃদ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে আনন্দমোহনের ঐকান্তিক উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে জন্ম নেয় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’।

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হলে আনন্দমোহন বসু তার নেতৃস্থানীয় ছিলেন। ১৮৯৮ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেসের অধিবেশনগুলিতে তিনি ব্রিটিশ শাসকের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দমদম মিউনিসিপ্যালিটির পুরকর্তা হিসেবে তাঁর সুদক্ষ ভূমিকা সুবিদিত। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পেয়ে ছোটলাট স্টুয়ার্ট তাঁকে ১৮৮৬-৮৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। পরে আরও দু’বার তিনি এই পদে মনোনীত হন।

আনন্দমোহনকে শিক্ষাবিদ হিসাবেও আমরা পেয়েছি। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ দান সিটি স্কুল ও কলেজ। ১৮৭৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাঁর উদ্যোগে ও অর্থানুকূল্যে সিটি স্কুল স্থাপিত হয়। স্কুল বিভাগ কলেজে উন্নীত হয় ১৮৮১ সালে। বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের পাঠক্রম নির্ধারণ করা থেকে শিক্ষকদের দায়িত্ব-প্রদান, সমস্ত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন তিনি। তাঁরই নিরলস প্রচেষ্টায় ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অব ইনকর্পোরেশন’ এমন ভাবে সংশোধন করা হয় যাতে এটা শুধুমাত্র একটি পরীক্ষা গ্রহণকারী সংস্থা না থেকে পরীক্ষা গ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপ পায়। ভারতে ভূ-বিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাঁর বক্তৃতার ফলেই তৎকালীন শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর স্যর আলফ্রেড ক্রফট প্রেসিডেন্সি কলেজে ভূবিদ্যার পাঠক্রমের ব্যবস্থা করেন।

স্ত্রী-শিক্ষায় তাঁর অপরিমেয় অবদানের কথা অবিস্মরণীয়। ১৮৭৬ সালের পয়লা জুন বালিগঞ্জ অঞ্চলে এক প্রকাণ্ড বাগানবাড়িতে তিনি ‘বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন। ১৮৭৮-এর পয়লা অগস্ট ‘বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়’ বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিলে গিয়ে বেথুন কলেজের গোড়াপত্তনও করে দিয়েছিল। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতিকল্পেও তাঁর ভূমিকা অপরিসীম।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে আনন্দমোহন বসুর সর্বোত্তম অবদান সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ। ১৮৬৯ সালের ২২ অগস্ট সস্ত্রীক আনন্দমোহন বসু কেশবচন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরে কোচবিহার বিবাহকে কেন্দ্র করে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতানৈক্য চূড়ান্ত আকার ধারণ করলে ব্রাহ্ম আন্দোলনের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ১৮৭৮ সালের ১৫ মে টাউন হলে আনন্দমোহনের সভাপতিত্বে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন। নবগঠিত এই ব্রাহ্মসমাজের সভাপতির দায়িত্ব অর্পিত হয় সদ্য ত্রিশ-পেরোনো যুবক আনন্দমোহন বসুর কাঁধে। মোট তেরো বার তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আনন্দমোহন বসুর জন্মের ১৭৬ বছরও (১৮৪৭-২০২৩) নীরবে অতিক্রান্ত হয়ে গেল। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের বছরেও, আনন্দমোহন বসু সম্পর্কে এই উদাসীন নীরবতা খুবই দৃষ্টিকটু।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Feature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।