বাসনওয়ালি তিনটে জিন্সের প্যান্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “এমন ফাটাফুটা প্যান্ট হোগা তো একটা থালার জন্য দশঠো লাগেগা। এই ফুটা প্যান্ট কাঁহা চলেগা। প্যান্ট ঠিক থাকবে তো পাঁচঠো দেবেন।” অষ্টাদশী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া এ বার গলার ডেসিবেল চড়াল বাসনওয়ালির দ্বিগুণ। বলল, “তোমার কোনও আইডিয়া আছে? কত বছর আগে বাজারে গিয়েছ লাস্ট? ফাটাফুটা বলে দশঠো দশঠো করে যে জিন্সকে আওয়াজ দিচ্ছ, তার দাম কিন্তু তোমার ওই ঠিকঠাক প্যান্টের চেয়ে অনেক বেশি। যত্তসব।” পুরনো কাপড়ের বদলে নতুন বাসন দেন যে দিদি, সেই বছরপঞ্চাশের বিহারি মহিলার চোখদুটো যাকে বলে কপালে উঠল। বললেন, “এ বাত ঠিক নাহি আছে। বিলকুল ঝুটা বাত আছে।” অষ্টাদশী বলল, “জিন্সে ফুটা আছে, আমার বাতে ঝুটা নেই। মিলিয়ে নিয়ো।”
মাসকয়েক আগের এই ঘটনার অকুস্থল আমাদের প্রতিবেশীর ফ্ল্যাট। আরও দশ বছর পিছিয়ে যাই। দেওয়ালে ছবি হয়ে রয়েছেন আমার যে মাতামহী, তাঁর শখ হয়েছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মেট্রোতে চড়বেন। বিরাশি বছরের দিদুর শখ পূরণ করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে ঠান্ডা মেট্রোয় ওঠার পরেই ওঁর দৃষ্টি চলে গিয়েছিল উল্টো দিকের সিটে বসা এক যুবকের দিকে। দামি জামা, দামি ঘড়ি আর কপালের উপরে তুলে সেট করে রাখা দামি সানগ্লাস। দিদুর চোখ সে দিকে ছিল না। ছিল প্যান্টে। যুবকের নীল জিন্সের ডান পায়ে হাঁটুর কাছে ঢেঁড়সের মতো ছেঁড়া, আড়াআড়ি ভাবে। দিদু বলেছিল, “আহারে। বেচারা নিশ্চয়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছে রাস্তায়। ভাল প্যান্টটার কী দশা।” আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “রাস্তাঘাটে খুব সাবধানে চলবি কিন্তু।”
ছেঁড়া প্যান্ট পরাটাই যে প্রকৃত স্টাইল তা জানার পরে দিদুর চোখেমুখে যে বিস্ময় দেখেছিলাম, ঠান্ডা মেট্রোয় প্রথম বার চড়ার অবাক অনুভূতি তার কাছে দশ গোল খায়। বিড়বিড় করে বলছিলেন বার বার, “পয়সা খরচা করে, জেনেবুঝে কেউ ছেঁড়া পোশাক কেনে? খুঁতওয়ালা জামাকাপড় পরলে যে অমঙ্গল হয়। হায় রে কলিকাল!”
লেভি স্ট্রস এবং জ্যাকব ডেভিস ভদ্রলোকদ্বয় দেড়শো বছরেরও আগে যখন বিশ্বের প্রথম জিন্সের প্যান্টটি বানান, তখন অন্তত পোশাকটি বানিয়ে তা ছিঁড়ে দেওয়ার কথা তাঁদের মাথায় আসেনি। ১৮৭০-৭২ সাল নাগাদ ক্যালিফর্নিয়ায় লেভি স্ট্রসের সঙ্গে আলাপ হয় জ্যাকব ডেভিসের। ডেভিস পেশায় ছিলেন বাহাদুর দর্জি। দু’জনে পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবেন। লেভি কাপড়ের জোগান দিতেন, আর জ্যাকব তা দিয়ে নানা ধরনের পোশাক বানাতেন। সুতির মোটা কাপড় দিয়ে কী ভাবে একই সঙ্গে টেকসই এবং দেখনদার প্যান্ট বানানো যেতে পারে, তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতে শুরু করেন। কাপড়চোপড়ের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এই পরিশ্রমেরই ফলশ্রুতি জিন্সের প্যান্ট। তবে এই প্যান্টের প্রকৃত ইতিহাস কী তা নিয়ে বেশ কিছু মত আছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই অবশ্য লেভি-জ্যাকবের যুগলবন্দির বিষয়টির পক্ষে ভোট দেন। অনেকে আবার বলেন, জিন্সের প্যান্টের ‘জনক’ লেভি-জ্যাকব নন। এমন প্যান্ট আগেও ছিল ইউরোপ-আমেরিকার আনাচে কানাচে। তবে এই জুটি প্যান্টটিকে ঢাক বাজিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় হাজির করার ক্ষেত্রে মস্ত বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মূলত প্যান্টের মাধ্যমে পোশাকের আলমারিতে আবির্ভাব ঘটলেও জিন্সের জয়যাত্রা অবশ্য শুধুমাত্র প্যান্টেই থেমে থাকেনি। প্রথম দিকে জিন্সের সঙ্গে নীল রং ছিল প্রায় সমার্থক। সে দিনও গিয়াছে চলিয়া। জিন্সের কাপড়ের এখন হাজার রং। মানে, শেড। শাস্ত্র মেনে শুদ্ধ এথনিক না হলে হাল আমলের ফ্যাশনে এমন কোনও পোশাক নেই যাতে শামিল হয়নি জিন্সের কাপড়। এ যেন অনেকটা এলেন-দেখলেন-জয় করলেন কাব্য। মূলত নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষদের পরার জন্য যে সস্তার প্যান্ট বানাতে চেয়েছিলেন লেভি-জ্যাকব জুটি, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে। পরিসংখ্যান বলছে, জো বাইডেনের দেশে প্রতিটি মানুষের কাছে আজকের দিনে গড়ে সাতটি জিন্সের প্যান্ট রয়েছে। এমন সমীক্ষার আতশকাচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উপর ফেলা হলেও সংখ্যার খুব একটা নড়চড় হবে বলে মনে হয় না। গুগলকে শুধিয়েছিলাম, ক’টা জিন্সের প্যান্ট বিক্রি হয় বিশ্ব জুড়ে, প্রতি বছর? নিমেষে পর্দায় ফুটে এল উত্তর, ১.২ বিলিয়ন। ডান দিকে শূন্যের জয়ধ্বনি দিয়ে যে সংখ্যায় পৌঁছনো গেল, তা হল ১২০ কোটি। ২০২০ সালে জিন্সের কাপড়ের বিশ্বজোড়া ব্যবসার পরিমাণ ছিল প্রায় ২২০০ কোটি মার্কিন ডলার। উসেইন বোল্টরুপী গ্রাফ বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে তা ছুঁয়ে ফেলবে ২৬০০ কোটি ডলার। বলাই বাহুল্য, এর সিংহভাগই দখল করে রয়েছে জিন্সের প্যান্ট।
বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে চলতে পারে যে প্যান্ট, শত ধোয়াধুয়ির পরেও যে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে মাথা উঁচু করে, তাকে হঠাৎ ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল কেন? সূর্যোদয়ের পরে ফ্যাশন ডিজ়াইনার এবং সূর্যাস্তের পরে কবি হয়ে যাওয়া আমার এক স্কুলজীবনের বন্ধু দুঃখ মিশিয়ে বলছিল, “এই অবিচারের থেকে মুক্তি পেয়ে হিজলের স্নিগ্ধ ছায়ায় দিব্যি বসে রয়েছে টপওয়্যার, মানে জামা। যত খোঁচাখুঁচি, টানাটানি, করাল কাঁচির ধ্বংসলীলা জিন্সের প্যান্টটিকে ঘিরে!” কম্পিউটারের পর্দায় কয়েকটা প্যান্টের ডিজ়াইন দেখাতে দেখাতে বলেছিল, “ফ্যাশন ট্রেন্ড বলছে, যত বেশি কাটাকুটিতত বেশি পয়সা। তাজা প্যান্টকে মেরেধরে পিটিয়ে ফাটিয়ে ছারখার করে দাও, লোকে ভালবেসে আপন করে নিয়ে যাবে ঘরে। কালিমাই রত্ন।”
বিশ্বে প্রথম বারের জন্য জিন্সের প্যান্টটি ছিঁড়ে দিয়ে বিক্রি করেছিল কে? কোন ব্র্যান্ডের ডিজাইনারের মাথায় সবার প্রথমে পাখনা মেলেছিল এমন আইডিয়া? উত্তর মেলে না সহজে। অনেকে মনে করেন, সত্তর-আশির দশকে পশ্চিমি দেশগুলোতে হার্ড রক সঙ্গীতের উত্থানের সঙ্গে এই প্যান্টের জনসমাদর লাভ করার একটা সম্পর্ক আছে। বেশ কিছু ব্যান্ডের সদস্যরা নাকি মঞ্চ মাতানো শুরু করেছিলেন এমন ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট পরে। ভালবেসে ডাকতেন, ‘ডিসস্ট্রেসড জিন্স’। অনেকের আবার মত, প্রথম দিকে দিনের পর দিন একটাই প্যান্ট পরার ফলে সামান্য যে চিড় ধরতে শুরু করে হাঁটুর কাছাকাছি জায়গায়, সেটাই ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে যায় ফ্যাশন স্টেটমেন্টে। ফলে প্যান্টটি অতিব্যবহৃত হওয়ার কারণে ছিঁড়ে গিয়ে বিখ্যাত হল, না কি ইচ্ছে করে ছিঁড়ে দেওয়ার পরে অতিব্যবহৃত হয়ে বাজার মাত করল— তা নিয়ে একশোয় একশো পাওয়ার মতো কোনও উত্তর দেওয়া যায় না।
বইমেলায় কেনা একটি লিটল ম্যাগাজ়িনের কয়েকটি পাতা ওল্টানোর পর দেখেছিলাম, একটা পাতায় বড় বড় হরফে লেখা, “এই পত্রিকার ওপর চায়ের কাপ রাখবেন না। এই পত্রিকা রাগী মানুষদের প্রত্যয়, তাকে চটকাবার চেষ্টাও করবেন না।” বলা যায়, জিন্সের প্যান্ট সম্পর্কেও এমন কথা খাটে। সাধারণ, নরম কাপড়ের বদলে কোন কারণে ক্রমশ জনপ্রিয় হল জিন্সের প্যান্ট? এই নিয়ে চর্চা করা মানুষরা বলেন, এই প্যান্টকে জনপ্রিয় করেছিল মূলত অল্পবয়সিরা। সমাজের চিরাচরিত, বাঁধাধরা নিয়মকে পাত্তা না দেওয়ার একটা অস্ত্র কি হয়ে উঠেছিল জিন্সের প্যান্ট? জামাকাপড় পরার সামাজিক ব্যাকরণকে এক হাত নেওয়াই কি মূলত উদ্দেশ্য ছিল এই পোশাকের? এমনই মত অনেক গবেষকের। জিন্সের প্যান্ট পরলে মনের মধ্যে জমে থাকা রাগ হয়তো আরও একটু বেশি করে ফুটে ওঠার অবকাশ পায়। গিটার হাতে গর্জে ওঠার সময় ইস্তিরি করা সাধারণ কাপড়ের প্যান্ট কি মানায়? ভাববার বিষয় বটে।
মজার কথা হল, আমাদের বেড়ে চলা রাগের সঙ্গেই এই জিন্সের প্যান্ট ছিঁড়ে দেওয়ার একটা যোগসূত্রের কথা বলতে শুরু করেছেন মনোবিদরা। তাঁদের দাবি, মনের মধ্যে রাগের বম্ব-বিস্ফোট না হলে একটা প্যান্টকে খামোখা ছিঁড়ে দেওয়ার কথা ভাবাও যায় না। তার চেয়েও বড় কথা, তা লোকজনের আদর পায় না এমন ভাবে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় আমার পরিচিত এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিলেন, “কারণটা বুঝতে এত কষ্ট হয় কেন? এমন উৎকট একটা প্যান্ট পরলে সবার প্রথমে লোকের চোখ যাবে তোমার হাঁটুর নীচে। এর মানে হল, ‘চোখ নামিয়ে কথা বলুন’বলে যে ধমক আমরা প্রায়ই দিয়ে থাকি রাস্তাঘাটে, সে যুদ্ধ জয় হয়ে গেল ইতিমধ্যেই। এ বার যদি এই ছেঁড়া অংশটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন, তা হলে গলা উঁচিয়ে বলা যাবে— বেশ করেছি। আপনার কী? আপনার পয়সায় কিনেছি না কি?” আন্তর্জালে এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রবন্ধে নিবন্ধে চোখ বুলিয়ে দেখেছি, এমনই মনে করেন মনের অন্দরমহলের বিশেষজ্ঞরা। ছিঁড়ে দেওয়া প্যান্টে এক চামচ ফ্যাশন স্টেটমেন্টেরসঙ্গে মিশে থাকে তিন চামচ রাগ! ছেঁড়া জিন্সের অপর নাম তো ডিসস্ট্রেসড জিন্সও বটে। এই ইংরিজি কথাটার এক কোণে লুকিয়ে রয়েছে কষ্ট আর যন্ত্রণা। রাগ শব্দটিকে তা দেয় তো এরাই।
চামড়া দেখানো, ছিঁড়ে দেওয়া জিন্স বয়কট করা নিয়ে সেই কবে থেকেই তো সরব সমাজের একাংশ। কখনও কোনও কলেজের অধ্যক্ষ বেঁকে বসেন। কখনও খেপে যান কোনও জনপ্রতিনিধি। গত বছর হুমকিনামায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন উত্তরাখণ্ডের তিরথ সিং রাওয়াতও। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন সদ্য। ‘অনাচার’ দেখে নানা কথার মধ্যে বলেছিলেন, “সামাজিক অবক্ষয়ের পথ মসৃণ করে দেয় এই ছেঁড়া জিন্স। (এই প্যান্ট পরিয়ে) বাবা মায়েরা তাঁদের সন্তানদের জন্য খারাপ উদাহরণতৈরি করছেন।” রে-রে রব উঠেছিল দেশ জুড়ে। নেতৃত্বে ছিলেন মহিলারাই। পরে অবশ্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন রাওয়াত। জানিয়েছিলেন, “জিন্সের প্যান্ট পরা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু, ছেঁড়া প্যান্ট কেন?”
এই ‘কিন্তু’ শব্দটা মেলায় উড়ে যাওয়া সাবানজলের বুদবুদের মতো নাচতে নাচতে মিলিয়ে যায় বাতাসে। এক চোখ রাগে লাল হয়, অন্য চোখ দোকানের হ্যাঙার থেকে ঝুলতে থাকা ছেঁড়া জিন্সটার দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবডেবিয়ে। বড্ড দাম যে... কবে তুমি আমার হবে?
“ও বাসনদিদি, শুনতে পাচ্ছ? তা হলে একটা থালার জন্য কয়ঠো?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy