Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Corporate World

লাভের গুড় যায় কোথায়

কর্পোরেট দুনিয়ায় থামার উপায় নেই। ভাল থেকে আরও ভাল, তার চেয়ে আরও ভাল— নতুন নতুন টার্গেট বেঁধে দেওয়া হবে প্রতি বছর। মোটা বেতন মানেই বেতের শাসন। অসাধু প্রতিযোগিতায় পণ্যে মিশে যাচ্ছে দূষণ। তবু কমছে না মুনাফার লোভ। এত লাভে কার লাভ? কে খায় লাভের গুড়?

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী।

অমিতাভ গুহ সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ০৫:০৪
Share: Save:

কর্পোরেট দুনিয়া একটি আলাদা জগৎ। গতি এই বিশ্বের মূল মন্ত্র। কোনও অবস্থাতেই এখানে থামা চলে না। যে সব কথা এখানে খুব চলে, তার মধ্যে অন্যতম ‘স্ট্যাগনেশন ইজ় ডেথ’ অথবা ‘সেল অর সিঙ্ক’— অর্থাৎ থেমেছ কি মরেছ। যে কোনও অবস্থাতেই এগিয়ে চলতে হবে। ক্রমাগত বাড়াতে হবে গতি। এক বছর ভাল করলে তো পরের বছর আরও ভাল করতে হবে। তার পর আরও। এখানে ভালর কোনও শেষ নেই। গতিরও কোনও সীমা নেই। অনেকটা ১০০ মিটার দৌড়ের মতো। কিছু বছর আগে প্রয়াস ছিল দৌড়ের সময় ১০ সেকেন্ডের নীচে নামিয়ে আনা। সেটা হল। তার পর ক্রমাগত প্রয়াস চলল তাকে আরও কমানো। মাঝে মধ্যেই ভাঙতে লাগল বিশ্ব রেকর্ড। ক্রমাগত বাড়তে থাকল দ্রুততম মানুষের গতি। ২০০৯ সালে উসেন বোল্ট পুরুষদের ১০০ মিটার দৌড়লেন মাত্র ৯.৫৮ সেকেন্ডে। এই সময়টা অসম্ভব মনে হলেও এখানেই মানুষ থেমে যাবে না। কর্পোরেট দুনিয়াটাও অনেকটা সে রকম। সব কিছুতেই গতি বাড়াতে হবে। ভালকে আরও ভাল করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে বিক্রি। লক্ষ্য আরও বেশি লাভ।

এই লাভেরও কোনও সীমা নেই। এক বছর ভাল লাভ হলে পরের বছর ধীরে চলার কোনও প্রশ্ন নেই। কারণ, পরের বছর লাভ আরও বাড়াতে হবে। লাভ কমলে অথবা আশানুরূপ না বাড়লে বড় প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে কর্তৃপক্ষকে। কর্পোরেট দুনিয়ার বেশির ভাগ ভাল কোম্পানি শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ হয়। বড় মাপের কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই বিরাট জনতার প্রত্যাশার বড় চাপ থাকে কোম্পানির পরিচালকদের উপর। যেমন ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের উপর চাপ থাকে মাঠে উপস্থিত অসংখ্য এবং টিভির সামনে বসা কয়েক কোটি মানুষের। পান থেকে চুন খসলেই ক্ষমা নেই। প্রত্যাশা মতো লাভ যদি না বাড়ে, তারা খসার মতো পড়বে শেয়ারের দাম। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ— এই তিন মাসে এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের নিট লাভ ১২,০০০ কোটি এবং ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ওএনজিসি-র লাভ ৩৮,৮০০ কোটি টাকার বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই দুই সংস্থার শেয়ারের দাম তেমন ওঠেনি প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায়।

উৎপাদন, বিক্রি এবং লাভ বাড়ানোর জন্য প্রবল চাপ থাকে সংস্থার কর্মী, বিশেষ করে উঁচুতলার পরিচালকদের উপর। এঁদের অনেককেই বছরের শুরুতে বিক্রি উৎপাদন ইত্যাদির লক্ষ্যমাত্রা বা টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়। লক্ষ্যমাত্রা পেরোলে পরের বছর তা আরও বাড়ে। অর্থাৎ, চাপ সব সময়েই তাড়া করে বেড়ায় উঁচু পদে থাকা কর্মীদের। এঁদের শুয়েবসে আয়েস করে কাজ করার ফুরসত থাকে না। হেলেদুলে হাঁটলে চলে না। সব সময়ে থাকে ছোটার প্রবণতা। একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠা এঁদের কাছে বিলাসিতা। উঠতে হয় দু’টো-তিনটে করে সিঁড়ি লাফিয়ে। এঁদের শারীরিক ভাষাই যেন একটু অন্য রকম। দশটা-পাঁচটার নয়, এঁদের চাকরি ২৪ ঘণ্টার! যখন ডাক পড়বে, তখনই দমকল কর্মীদের মতো সব ফেলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এই জগতের মানুষদের আমরা হামেশাই এয়ারপোর্ট পৌঁছে এবং প্লেনে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসতে দেখতে পাই।

যে সব উঁচু পদের কর্মী উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মোটা লাভ অর্জনে সাহায্য করে, ভাল কোম্পানিও তাঁদের কথা ভাবে। মোটা বেতন ছাড়াও এঁদের অনেকেই পান ভাল বোনাস, কমিশন, বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, গ্যাস, বিদ্যুতের বিল, ফি বছর বেড়ানোর জন্য টাকা, এক থেকে তিনটি ক্লাবের মেম্বারশিপ, পরিবারের সবার চিকিৎসা বাবদ প্রায় সব খরচ, সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ এবং অনেক ক্ষেত্রে একটির জায়গায় পেট্রল সমেত দু’টি গাড়ি। এত কিছু দেওয়া হয় শুধু সংশ্লিষ্ট কর্মীকেই নয়, তাঁর পরিবারকেও সব সময়ে খুশি রাখতে। এ ছাড়া বাজারে যে সব কোম্পানির শেয়ারের ভাল কদর আছে, তারা কর্মীদের মুখের কাছে শেয়ারের ‘ললিপপ’ ঝুলিয়ে রাখে। সংস্থার ‘স্টক অপশন স্কিম’ অনুযায়ী মাঝে মধ্যেই এঁদের শেয়ার পাওয়ার সুযোগ থাকে এবং তা দিয়ে বড় মেয়াদে মোটা সম্পদ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকায় অনেক ভাল কর্মী সংস্থা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবেন না। বেসরকারি কিছু ব্যাঙ্ক এবং প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলির মধ্যে কর্মীদের শেয়ার বণ্টনের প্রথা চালু আছে। সাবান এবং প্রসাধনী পণ্য উৎপাদনকারী একটি বহুজাতিক সংস্থায় বছরে এক কোটি টাকার বেশি বেতন পান, এমন কর্মীর সংখ্যা সম্প্রতি ২০০ ছাড়িয়েছে।

এত সব যাঁরা পান, তাঁদের চাপও নিতে হয় উদয়াস্ত। ভালর যেমন পুরস্কার আছে তেমন ত্রুটির কোনও ক্ষমা নেই। কর্পোরেট দুনিয়া সব সময়েই বাস্তব-চালিত। আবেগ-চালিত নয়। এই চাপের কারণে অনেকের অনেক সুপ্ত প্রতিভা আজীবন চাপাই থেকে যায়। এই চাপ সহ্য করে গল্প-কবিতা লেখা, সঙ্গীতের রেওয়াজ করা, ক্রিকেট-ফুটবল মাঠে নিজের ক্রীড়াশৈলী দেখানো ইত্যাদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ যাঁদের মন সৃষ্টিধর্মী, এই জগতে তাঁদের পক্ষে দু’কূল রক্ষা করা বেশ শক্ত। কর্পোরেট দুনিয়ায় প্রচলিত যে কথাগুলি সব সময়েই এঁদের চাপে রাখে তা হল— ‘পারফর্ম অর পেরিশ’ এবং ‘ডেলিভার অর ডিপার্ট’। এই চাপ সইতে সইতে গতির দুনিয়ায় বাস করে বয়সকালে যখন তাঁদের কর্পোরেট দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়, তখন প্রতিভা বিকাশের খুব একটা সময় থাকে না। থাকে আফসোস।

আজকাল এক-এক করে সরকারি কোম্পানি শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ হচ্ছে। নথিবদ্ধ হওয়া মাত্র কর্পোরেট দুনিয়ার প্রত্যাশার চাপ এসে পড়ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরিচালকদের উপরে। বাজারে নথিবদ্ধ হলে শুধু লাভ বাড়ালেই চলে না। বাজার-নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’র নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন ভাল-মন্দ সব খবর তাৎক্ষণিক ভাবে জানাতে হয় স্টক এক্সচেঞ্জকে। সংস্থার ফলাফল খারাপ হলে, ডিভিডেন্ড কম হলে, শেয়ারের বাজারদর মাথা নামালে, পরিচালকদের ছেড়ে কথা বলবে না শেয়ারহোল্ডার এবং ইকুইটি বিশ্লেষকরা। গত বছর নিজের মালিকানা থেকে ‘এলআইসি’-র মাত্র ৩.৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে ভারত সরকার বাজার থেকে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। এই শেয়ার কিনেছেন ৪০ লক্ষ মানুষ। বাজারে নথিবদ্ধ হওয়ার দিন থেকে পড়েই চলেছিল দেশের বৃহত্তম জীবন বিমা কোম্পানির শেয়ার। ৯৪৯ টাকা পর্যন্ত দামে বাজারে ছাড়া প্রতিটি এলআইসি শেয়ারের বাজারদর এখন ঘোরাফেরা করছে ৬২৫ টাকার আশপাশে। ফলে লোকসান পৌঁছেছে প্রত্যেকের ঘরে। প্রতি শেয়ারে লোকসান যখন কমবেশি ৩০০ টাকা, তখন ডিভিডেন্ড সুপারিশ করা হয়েছে মাত্র ৩.০ টাকা। ফলে বড় রকমের চাপে পড়েছে সংস্থাটির প্রধান মালিক ভারত সরকার এবং পরিচালন পর্ষদের সদস্যরা। বাজারে নথিবদ্ধ হওয়ার কারণে এখন থেকে প্রতি পদে এই সংস্থার কাজকর্ম তুলনা করা হবে বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলির কাজকর্মের সঙ্গে। অর্থাৎ, ছোটার দিন শুরু হল এলআইসি-র পরিচালক কর্মী, এজেন্ট সবার জন্যে। কর্পোরেট দুনিয়ার আঁচ এখন পৌঁছেছে এলআইসি-র অন্দরেও। ফলে আরও জোরদার হতে হবে পলিসি বিক্রি, প্রিমিয়াম বাবদ আয় এবং লাভ বৃদ্ধি তথা উন্নত পরিষেবা দেওয়ার প্রয়াস।

‘লাভ’ দু অক্ষরের একটি ছোট শব্দ। শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, সর্বত্রই এর প্রভাব অপরিসীম। সমাজ, সংসার, রাজনীতি, অর্থনীতি— কেউই একে এড়িয়ে চলতে পারে না। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে লাভের চিন্তা প্রায় প্রত্যেকেরই মাথায় থাকে। সন্তানকে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার করার তাগিদে সমাজের অনেকেই যখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালেন, তখন তার পিছনে সুপ্ত ভাবে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকে ভবিষ্যতে লাভের চিন্তা।

কর্পোরেট দুনিয়ার মতো লাভের পিছনে ছুটতে দেখা যায় বেসরকারি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রকেও। বেশ কয়েকটি নামী হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য সংস্থা গত দু’-তিন দশকে বাজারে শেয়ার ছেড়ে শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ হয়েছে। নথিবদ্ধ হওয়ার দিন থেকেই তারা ঢুকে পড়েছে কর্পোরেট দুনিয়ায়। সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে লাভের পিছনে ছোটা। প্রতি বছর এদের লাভ বাড়ানোর দায় অনেক ক্ষেত্রেই বর্তায় রোগীর পরিবারের উপর। ছোটখাটো চিকিৎসাতেও কোনও কোনও কর্পোরেট হাসপাতালের বিল দেখলে চোখ কপালে ওঠে।

স্বাস্থ্য কমিশন বার বার অস্বাভাবিক বিলের সমালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে জরিমানা করা সত্ত্বেও আকাশচুম্বী বিল কিন্তু হয়েই চলেছে বলে অভিযোগ। লক্ষ্য একটাই— ফি বছর লাভ বাড়িয়েই চলতে হবে। নচেৎ গোঁত্তা খাবে কর্পোরেট হাসপাতালের শেয়ার! ২০২২-২৩ বছরে একটি কর্পোরেট হাসপাতালের আয় হয়েছে ৬,৫০০ কোটি টাকারও বেশি। নিট লাভ ছাড়িয়েছে ১০০০ কোটি টাকা। এদের ৫ টাকার শেয়ার গত এক বছরে ঘোরাফেরা করেছে ৩৬৩৯ টাকা থেকে ৫২৯০ টাকার মধ্যে। লাভ এতটা হয়েছে বলে কিন্তু সন্তুষ্টির কোনও জায়গা নেই। পরিষেবা উন্নতির পাশাপাশি প্রয়াস চালু থাকবে লাভ আরও বাড়ানোর। কয়েকটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিযুক্ত মোট ৩৬টি কোম্পানি এখন শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ। এদের সবার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও বেসরকারি উদ্যোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সারা দেশে স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি এবং ম্যানেজমেন্ট কলেজ। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গেই আছে ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বেশ তীব্র। যত বেশি ছাত্র ভর্তি করা যাবে, তত লাভ। এর জন্য পরিকাঠামোর পাশাপাশি বাড়াতে হয় গুণগত উৎকর্ষ এবং শিক্ষার মান। শিক্ষার শেষে যে প্রতিষ্ঠান পড়ুয়াদের জন্যে যত চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবে, তার তত নাম। এই সবের পাশাপাশি এদের লক্ষ্য থাকে ব্যয়ের তুলনায় যেন আয় বেশি হয়। এখানে ‘লাভ’ কথাটা স্পষ্ট করে বলা হয় না। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান নিয়ে চলতে পারে না। এই কারণে এদের উদ্বৃত্তের কথা ভাবতেই হয়। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে এদেরও কষতে হয় লাভের অঙ্ক।

জনপ্রিয় বিভিন্ন খেলার দুনিয়ায় এখন লাভই লাভ। আইপিএল-এর পাঁচ বছরের মিডিয়াস্বত্ব গত বছর বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। এই সুবাদে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনী ক্রীড়া সংস্থা।

প্রশ্ন হল, এত লাভে কার লাভ, লাভের গুড় কে বা কারা খায়? অনেক সময়ে আমরা যা ভাবি, তা ঠিক নয়। শুধু মালিক গোষ্ঠী নয়, এই লাভের ভাগীদার সমাজের অনেকেই। মালিকের পরেই সব চেয়ে বড় ভাগীদার ভারত সরকার। কোম্পানি এবং অন্যান্য ব্যবসা থেকে লাভের একটি বড় অংশ কর হিসেবে চলে যায় সরকারি কোষাগারে। এই কর খরচ করা হয় দেশের নানা কাজে। অর্থাৎ, তার সুফল ভোগ করে দেশের জনসাধারণ। কর দেওয়ার পর বাকি লাভ থেকে কোম্পানির সদস্যদের দেওয়া হয় ডিভিডেন্ড। লাভ এবং ডিভিডেন্ড ভাল হলে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজারদর ফুলে ফেঁপে ওঠে। লাভ পৌঁছয় লগ্নিকারীদের ঘরে। সম্প্রতি এক নামী টায়ার উৎপাদনকারী কোম্পানির দশ টাকা মূল্যের শেয়ারের দাম এক লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছিল, অর্থাৎ তার বাজারদর মূল দামের ১০,০০০ গুণ পর্যন্ত উঠেছিল।

এ তো গেল প্রত্যক্ষ লাভের কথা। লাভের পরোক্ষ সুবিধাভোগীও আছে অনেক। লাভের হাতছানিতেই শিল্প এবং ব্যবসাতে টাকা লাগান লগ্নিকারীরা। দেশে যত শিল্প হয় এবং তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা যত বাড়ে, তত তৈরি হয় নানা ধরনের কর্মসংস্থান। সংস্থার লাভ ভাল হলে কর্মীদের বেতন ঊর্ধ্বমুখী হয়। যত কর্মসংস্থান বাড়ে এবং বেতন বৃদ্ধি হয়, তত বাড়ে পণ্যের চাহিদা, যা শিল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ, লাভের সুবিধা চক্রাকারে ঘোরে কোম্পানি থেকে সরকার এবং সরকার থেকে জনসাধারণের দুয়ারে। অন্য দিকে এই লাভই সৃষ্টি করে নতুন কর্মসংস্থান, জোগায় বেতন বাড়ার ইন্ধন। আইপিএল এখন আর শুধু খেলা নয়, এটি একটি বড় বিনোদন এবং ব্যবসার জায়গাও বটে। এখানে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দলগুলি পরিচালিত হয় অনেকটা কর্পোরেট ঢঙে। ব্যবসা এবং লাভ অর্জনের এই প্রক্রিয়ায় ক্রিকেট-বিশ্ব প্রতি বছর পায় এক ঝাঁক উদীয়মান তরুণ খেলোয়াড়। ম্যালেরিয়া, কলেরা এবং কুসংস্কারে জর্জরিত ভারতে ইংরেজরা সমাজসেবা করতে আসেনি। এসেছিল ব্যবসা এবং লাভের হাতছানিতে। এ দেশ থেকে বহু মূল্যবান সামগ্রী তারা নিয়ে গিয়েছে নিজেদের দেশে। পাশাপাশি তাদের প্রায় দু’শো বছরের শাসনকালে রেখেও গিয়েছে অনেক কিছু। তাদের তৈরি অনেক পরিকাঠামো এবং ব্লক স্তর পর্যন্ত সরকারি শাসনব্যবস্থা এখনও ব্যবহৃত হয় এ দেশে।

ব্যবসা থেকে পাওয়া লাভ অনেক সময়েই ব্যবহার করা হয়েছে ভাল কাজে। কলকাতার মারোয়াড়ি সম্প্রদায়, যারা ব্যবসার জন্যেই বেশি খ্যাত, তারা অতীতে এই শহরকে উপহার দিয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান মিউজ়িয়ম, হাসপাতাল এবং আরও অনেক কিছু। এদের মধ্যে আছে শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজ, শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ, বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, বিএম বিড়লা সায়েন্স মিউজ়িয়ম, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, মারোয়াড়ি হাসপাতাল ইত্যাদি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাভের টাকা জনসেবার জন্য ব্যবহার করা হয় না। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয় সমাজের ভিতর থেকেই। সমাজকে ব্যবহার করেই এরা কলেবরে বাড়ে এবং অনেকেই মোটা লাভ অর্জন করে। ব্যবসায় সফল হলে এদেরও কিছু দায় বর্তায় সমাজের প্রতি। অতীতে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে স্বেচ্ছায় সমাজের জন্য বহু কিছু করতে দেখা গিয়েছে। আবার অনেকেই সমাজের প্রতি এই দায় পালন করেনি। ২০১৩ সালের আগে এই ব্যাপারে দেশে কোনও আইন ছিল না। ২০১৩ সালে আমরা নতুন কোম্পানি আইন পাই। সেই আইনের ১৩৫ ধারায় বলা হল, নির্দিষ্ট আকারের সব কোম্পানি আগের তিন বছরের গড় নিট মুনাফার অন্ততপক্ষে ২ শতাংশ টাকা খরচ করবে নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক প্রকল্পে। আইনের ভাষায় এই প্রকল্পগুলিকে কর্পোরেট সোশ্যাল রেস‌পন্সিবিলিটি বা ‘সিএসআর’ প্রকল্প বলা হয়। ভারতীয় কোম্পানিগুলির লাভ বাড়তে থাকায় বাড়ছে সিএসআর খাতে ব্যয়ও। সিএসআর আইন চালু হওয়ার পর ২০২০-২১ পর্যন্ত জনসেবায় আনুমানিক ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিভিন্ন জনহিতকর প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনার প্রকোপ সত্ত্বেও ২০২০-২১ বছরে সিএসআর খাতে ব্যয় হয়েছে ২৪,৮৬৫ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে লাভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে সিএসআর প্রকল্পে ব্যয়।

বিভিন্ন সরকারি কোম্পানিতে যে লাভ হয়, তার সিংহভাগ ডিভিডেন্ড হিসেবে যায় সরকারি কোষাগারে। শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ সরকারি কোম্পানির কিছু ডিভিডেন্ড যায় সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের ঘরেও। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে লগ্নিকারীরা যে ডিভিডেন্ড পান, তার উপর তাঁদের কর দিতে হয়। অর্থাৎ, লাভের উপর কোম্পানি এক বার কর দেয় এবং সেই লাভের একাংশ যখন লগ্নিকারীর অ্যাকাউন্টে ঢোকে, তার উপর তাকে আবার কর দিতে হয়। অর্থাৎ, দু’বার স্ফীত হয় ভারত সরকারের ভান্ডার। এই টাকা আবার লাগে জনগণের কাজে। অর্থাৎ, লাভের গুড় বহু মানুষ খান বিভিন্ন ভাবে। সরাসরি অথবা ঘুরপথে।

যে লাভের একাংশ বহু মানুষের মধ্যে নানা ভাবে বণ্টিত হয়, সেই লাভই আবার গড়ে দেয় বিরাট বৈষম্য। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ব্যবসার মালিকানা আছে বিভিন্ন পরিবারের হাতে। ব্যবসার লাভ যত বাড়ে, তত বাড়ে এই সব পরিবারের সম্পদের পরিমাণ। বাড়তে থাকে ধনী এবং অতি ধনী মানুষের সংখ্যা। এই সংখ্যা অবশ্য দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় একটি বিন্দুমাত্র। লাভের সিংহভাগ যে-হেতু যায় মালিকের ঘরে, সেই কারণে লাভ যত বাড়ে, তত বাড়ে বৈষম্য।

ব্যবসা এবং অন্যান্য নানা সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন লাভের প্রয়োজন, তেমন এই লাভই আবার প্রশ্রয় দেয় নানা দুর্নীতিমূলক কাজ করতে। অনেক ক্ষেত্রেই লোভ এবং লাভকে একাকার হয়ে যেতে দেখা যায়। লাভ এবং অতি লাভের লোভে অনেক সংস্থাকে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে দেখা যায়, যা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক। ছোট থেকে বড়, এমনকি কিছু বহুজাতিক সংস্থাকেও এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে দেখা গিয়েছে। ঠান্ডা পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক এবং চটজলদি তৈরির নুড‌্লে মাত্রাতিরিক্ত সিসা মেশানোর অভিযোগে অতীতে অভিযুক্ত হয়েছিল বড় মাপের দু’টি কোম্পানি। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানো, অসত্য বিজ্ঞাপন, নকল পণ্য বাজারজাত করা ইত্যাদি সবই লোভে পড়ে অনৈতিক পথে লাভ বাড়ানোর প্রয়াস মাত্র।

অতীতে ভারতীয় অর্থনীতি চলত সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে। এই পথ থেকে দেশ এখন অনেকটাই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সরকার ধীরে ধীরে ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। হাঁটছে বিলগ্নিকরণের পথে। বাড়ছে বেসরকারি মালিকানা। বেসরকারি উদ্যোগকে জিইয়ে রাখতে হলে লাভের লক্ষ্যকে সবার সামনে রাখতেই হবে। লোকসান নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগ চলতে পারে না। এই সব উদ্যোগ টিকলে এবং বিস্তার লাভ করলে তবেই বাড়বে কর্মসংস্থান, বাড়বে পণ্য চাহিদা, প্রাণবন্ত হবে অর্থনীতি। এই লাভ যেন ন্যায়ের পথে আসে এবং তার বণ্টন যেন খুব বেশি অসম না হয়, নিয়ন্ত্রক হিসেবে সেটা দেখাই হবে সরকারের কাজ। ব্যবসায়ে এমন লাভ থাকুক যা কোনও মানুষের রক্ত না-ঝরিয়ে অর্জিত হোক এবং তা বণ্টিত হোক বহু মানুষের মধ্যে।

অন্য বিষয়গুলি:

Corporate Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy