Advertisement
E-Paper

রাজধানীর বাঙালিয়ানা

রাজধানী কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে খুব একটা কম বাঙালি নয়। তার বাঙালি চালচলন স্পষ্ট ফুটে ওঠে নাটকে-গানে-গল্পে, দুর্গোৎসবে সন্ধিপুজোয়, মাছের বাজারে, মিষ্টির দোকানে, বইমেলায়, সন্ধ্যার মুড়ি-তেলেভাজামুখর আড্ডায়। স্বাধীনতার পর থেকেই আস্তে আস্তে বাঙালি হয়ে উঠেছে দিল্লি। বাংলা বর্ষের শেষ মাসটিতে প্রবাসের বঙ্গজীবনকে ফিরে দেখলেন।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৬:০৯
Share
Save

দিল্লির রাজপথ জুড়ে সকাল ন’টা থেকেই চলছে শান্ত সাইকেল মিছিল। সাউথ ব্লক, নর্থ ব্লকে আপিস করতে চলেছেন বাবুরা। কী সুন্দর যে সেই সারিবদ্ধ সাইকেল চলার ছবি! প্যান্টে পিন এঁটে সবাই প্যাডল করছেন বেতের বাস্কেট লাগানো সাইকেলে। সেই ঝুড়িতে দিনের টিফিন, অনেক সময় বাড়তি কাপড়চোপড়ও। সেই টিফিনে কোনও দিন আলুপোস্ত-রুটি। আবার কখনও ভাতের ডিব্বার পাশে সযত্নে সাজানো এক টুকরো রুইমাছ ভাজা, অন্য ডিব্বায় মুগ-মুসুরের ভালবাসা।স্বাধীনতার তখনও শৈশব কাটেনি। রাজধানীতে আজকের যে বাঙালিয়ানার ভাপ দেখি আমরা নাটকে-গানে-গল্পে, দুর্গোৎসবে সন্ধিপুজোর শেষরাতে, মাছের বাজারে, বইমেলায়, সন্ধ্যার মুড়ি-তেলেভাজামুখর আড্ডায়— তার টলমলায়মান পথ চলার তখন শুরু।

পঞ্চম জর্জ দিল্লিকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়ার পর লর্ড হার্ডিঞ্জ রাজকর্মচারীদের নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে। তাঁদের বেশির ভাগই বাঙালি। তার আরও পরে চাঁদনি চক, দরিয়াগঞ্জের বাইরে বেরিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সরোজিনী নগর, চিত্তরঞ্জন পার্ক, গোল মার্কেটের মহল্লাগুলি তার যাপন শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা আগন্তুকদের বাঁচার লড়াইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। পাশাপাশি সস্তায় আনাজপাতি আর ছিটকাপড় বিক্রি করে আজকের অনেক ধনী দিল্লিবাসীর পূর্বপ্রজন্মের নির্বাহ শুরু। শাহি দিল্লির শুখা বাতাসে মিশতে শুরু করেছে সদ্য দেশ ছেড়ে আসার হেমারেজ।

স্মৃতির মায়াগলিতে উল্টোপথে হেঁটে এক আলাপচারিতায় পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যেমন পঞ্চাশের দশকের দিল্লিতে। ৯৩ বছর বয়স্ক, চিত্তরঞ্জন পার্কের এই বাসিন্দার স্মৃতিতে কোনও ধুলো নেই আজও। স্বাধীনতা যখন এল, তাঁরা সপরিবার ফরিদপুরে। বাবা ছিলেন সেখানকার একটি স্কুলের হেডমাস্টার। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে জীবনসংগ্রাম ১৯৪৮ সাল থেকেই। ইউপিএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ’৫৬ থেকে পরিতোষবাবু পাকাপাকি দিল্লিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে।

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল সেনাছাউনি, যেখানে পর পর ছিল কটেজ। স্বাধীনতার পর সেই টানা লম্বা বারাকই হল তথ্য মন্ত্রকের অফিস। এখন সেখানে শাস্ত্রী ভবন, কৃষি ভবন তৈরি হয়েছে।” এ দিক-ও দিক ধু ধু মাঠ। উঁচু-নিচু জমির মধ্যে লু আছাড়িপিছাড়ি খেত গ্রীষ্মে। বালির ঝড়ে পাতা ঘুরত গোল হয়ে। পরিতোষবাবুর স্মৃতিচারণ, “গ্রীষ্মকালে খসখস দিয়ে ঢাকা থাকত অফিস। তাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল ছেটানোর জন্য লোক ভাড়া করে রাখা হত। ভিতরটা মোলায়েম ঠান্ডা অন্ধকার হয়ে থাকত। কাজের সময় আলো জ্বালিয়ে নেওয়া।”

তথ্য মন্ত্রকে তখন বাঙালিদের রমরমা বহু কারণেই। নয়াদিল্লির প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করতেন তাঁরা। নতুন তৈরি হওয়া বিজ্ঞান ভবনের কমিটি রুমে হত সাংবাদিক সম্মেলন। এ রকম একটা সময়ে জওহরলাল নেহরুর খুবই ঘনিষ্ঠ সাংসদ এবং তৎকালীন পুর্নবাসন মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খন্না সংসদে প্রস্তাব আনলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দিল্লিতে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের জন্য দিল্লিতে একটি কলোনি গড়া হবে। যাঁরা ‘গেনফুলি এমপ্লয়েড’, তাঁদেরই দেওয়া হবে। অর্থাৎ চুরি-ডাকাতি করে টাকা করেছে এমন ব্যক্তিদের নয়! জমি দেওয়া হবে না-লাভ না-ক্ষতি নীতিতে।

“এই সংবাদে আনন্দের ঢেউ। আমি থাকতাম তখন গোল মার্কেটে অনঙ্গ বোসের মেসে। বাঙালিদের মধ্যে তখন এই মেসের রমরমা। অনঙ্গবাবু গর্ব করে বলতেন, এখানকার ভাত না খেলে নাকি দিল্লিতে চাকরি পাকা হয় না! সেখানে থেকে চাকরিতে উন্নতি করার লেখাপড়া করার অসুবিধে হওয়ায়, চলে এলাম লোধী রোডে দাদুর মেসে। সপ্তাহে এক বার করে ৪৩০ নম্বর বাসে চড়ে চলে যেতাম কালকাজি। তার কাছেই ইপিডিপি অর্থাৎ ‘ইস্ট পাকিস্তানি ডিসপ্লেসড পার্সন’দের জন্য নির্ধারিত জমি। গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম, চার দিকে ঘন শরবন! তার মধ্যে সিমেন্টের পাইপ ছত্রাকার করে রাখা। সাপখোপ, বেজির আখড়া।শেয়ালের ডাক। সন্ধ্যায় জোনাকি জ্বলে। ওখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখতাম এক স্থায়ী বাসস্থানের, যা ফরিদপুরের পর হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে...” বললেন পরিতোষবাবু।

হারানো দিনের কথা একটানা বলে যেতে কোনও কষ্ট নেই নবতিপর এই মানুষটির। আজ যাকে দিল্লি তথা দেশের বাঙালি চিত্তরঞ্জন পার্ক বলে চেনে, তার নামকরণ নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছিল সংশ্লিষ্ট কমিটিতে। অধিকাংশের ইচ্ছে ছিল নাম হোক পূর্বাচল পার্ক। কিন্তু চিত্তরঞ্জনপন্থীরা খোদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে পাশ করিয়ে আনলেন এই নাম।

সাতচল্লিশের ১৫ অগস্ট পতাকা উড়িয়ে নয়, তার পনেরো বছর পর ওই জোনাকি-জ্বলা শরবনের মধ্যে দাঁড়িয়েই স্বাধীনতার অর্থ প্রথম বার খুঁজে পেয়েছিলেন পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মতো অনেক ‘দেশ’ ছেড়ে আসা মানুষ। রাজধানীতে বঙ্গজীবন পেয়েছে এক স্বতন্ত্র পরিচয়চিহ্ন।

*****

পাঠক, আপনি যদি ধরেই নেন লাড্ডুর কারণেই বিখ্যাত এই রাজধানীর মানচিত্র, যা খেলে বা না খেলেও আপনাকে পস্তাতে হবে, তা হলে আপনাকে এটাও মানতে হবে, দিল্লিকে ছানার নিশ্চিন্ত স্নিগ্ধতা দিয়েছে বাঙালিই। কথাটা খুব ভুলও নয়। যে কোনও মহল্লা, মিষ্টান্ন বিপণি, উত্তর ভারতীয় হালওয়াইদের দোকানে থরে-বিথরে সাজানো থাকে বেসন, খোয়া ক্ষীর, গাজর, মুগ, মোতিচুরের মিষ্টান্ন। কোথাও তা বরফি, কোথাও লাড্ডু, হালুয়া। গুজিয়া বলতে যে শুভ্র নথের মতো এক টুকরো স্বর্গ বাঙালির পাথেয় ছিল, দিল্লিতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। বসন্তে এই গুজিয়ার কদর বাড়ে, এটি হোলির শর্করা-বাহন, যা চরিত্রে অনেকটা ক্ষীরের শিঙাড়ার আত্মীয়। এ সবই ইন্দ্রপ্রস্থের সেই সব মিষ্টান্ন, যা উত্তর ভারতের পতাকা উড়িয়ে চলেছে যুগে যুগে। কিন্তু এরই পাশাপাশি এক সমান্তরাল ছানার মিষ্টান্ন-সভ্যতা বাঙালি গড়ে তুলেছে তিলে তিলে, পরম মমতা ও পরিশ্রমে। বাংলার বাইরে যে সভ্যতার জুড়ি মেলা ভার অন্য কোনও রাজ্যের বড় শহর বা শহরতলিতে।

ফিরে যাই এই মিষ্টি যাত্রাপথের সূচনাবিন্দুটিতে। ফিরে যাই প্রায় শতবর্ষ আগের চাঁদনি চকে, সিসগঞ্জ গুরুদ্বার থেকে একটু এগিয়ে ডান হাতে রাস্তার উপর তৈরি হওয়া অন্নপূর্ণা ভান্ডারে। চা-শিঙাড়া-নিমকি থেকে শুরু করে রমরম করে বিক্রি হচ্ছে রসগোল্লা-সন্দেশও। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে এতটাই যে, কারও টাইফয়েড হলে চিকিৎসকরা এই দোকানের রসগোল্লা লিখে দিচ্ছেন প্রেসক্রিপশনে! এই ছানার মিষ্টি পেটে দু’দণ্ড শান্তি এনে দেয়, এমনটাই ছিল সে যুগের মুখচলতি ভাষ্য। তবে দিল্লিতে বাঙালি মিষ্টান্ন-সংস্কৃতির প্রপিতামহ, চাঁদনি চকের সেই অন্নপূর্ণা ভান্ডারের পরিচালক পরিবারের মেয়ে ভারতী ঘোষ জানিয়েছেন এই দোকানের উৎপত্তির কথা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘সুবর্ণ-কথা’ বইটিতে ভারতী লিখছেন, “আমার দাদু মোহিনী মোহন মুখোপাধ্যায় তো ছিলেন লাহোরে। রেলে চাকরি করতেন। সেই ব্রিটিশ আমলে রেলের সূত্রে বহু বাঙালি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমার দাদুও চলে গিয়েছিলেন লাহোরে।... ১৯২০ বা ২১ সালের ঘটনা। দাদুর রেল দুর্ঘটনায় একটা পা কাটা গেল। ফলে তাঁকে অকালে অবসর নিতে হল। তার কিছুদিন পর সপরিবার দাদু চলে এলেন দিল্লিতে। তখন দিল্লি বলতে তিমারপুর, কাশ্মীরি গেট, চাঁদনি চক, দরিয়াগঞ্জ হলো সাধারণ মানুষের বসতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র। দাদু চাঁদনি চকে ফাউন্টেনের কাছে ছোট একটি জায়গা নিয়ে দোকান শুরু করলেন। সেটা ১৯২৯ সাল। লাহোর থেকে দিল্লি এলে কী হবে, দাদুর মনে তখনও রেলের স্মৃতি প্রবলভাবে নাড়া দিচ্ছে। তাই দোকানের ভিতরটি হল কাঠের। একেবারে রেলের কামরার মতো দেখতে।”

এই অন্নপূর্ণা থেকে নাকি মিষ্টি যেত সংসদে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে সঞ্জয়, রাজীব সবাই ছিলেন এর ভক্ত। কলকাতা থেকে জ্যোতি বসু এলে বঙ্গভবনে পাঠানো হত এখানকার সন্দেশ। পরে কলকাতা থেকে নলেনগুড় এনে গুড়ের সন্দেশ, কমলালেবুর খোসা দিয়ে তৈরি কমলাভোগ আসর মাত করেছে চিত্তররঞ্জন পার্কে। তা ছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিম দিল্লিতে যেখানে কালীবাড়ি অথবা বাঙালি মহল্লার আধিক্য, সেখানেই একটি করে বাঙালি মিষ্টির দোকান আজ সুলভ। প্রতি শনি বা রবিবার ভোরবেলা যেখানে লাইন পড়ে গরম গরম রাধাবল্লভী আর আলুর তরকারি কেনার। পূর্ব দিল্লির মধুবিহার কালীবাড়ির উল্টো দিকের এক গলিতে হঠাৎই একটি মিষ্টির দোকান এবং সেখানে বাংলার শুভ্র গুজিয়া আবিষ্কার করে থ হয়ে গিয়েছিলাম। স্মৃতি ঘাই মারছিল জিওল মাছের মতো। পরে দেখেছি, দিল্লিতে এই বস্তুটি বিরল নয় আর। যেমন আর ততটা বিরল নয় বাংলা কচুরির ঘ্রাণ অথবা শীতকালে আলু-ফুলকপির পুরভরা, অমৃতস্বাদ ছোট ছোট শিঙাড়াও।

*****

কলকাতার ভাপা বসন্ত থেকে দিল্লির রোস্টেড গ্রীষ্মে যখন প্রথম পা দিই সংবাদ সংগ্রহার্থে তেইশ বছর আগে, তখন ঘোর খরা চলছে উত্তর ভারতে। দীর্ঘ দিন গাছ না লাগানোর ফলাফল। জলবায়ু পরিবর্তনের খামখেয়ালের চিহ্ন তখনও নেই আর্যাবর্তে। মে মাসের গোড়া থেকেই কামারশালায় সদ্য লাল হয়ে ওঠা লোহার শলাকার মতো বাতাস। দু’-দশ কদম হাঁটলে মনে হয় বুকে সাহারা। এক কান দিয়ে লু ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এফোঁড়-ওফোঁড় করে। যতই জল খাই, ভিতরের স্পঞ্জ সব টেনে নেয়।

এ হেন এক প্রখর দ্বিপ্রহরে বাহাদুর শাহ জাফরের নামাঙ্কিত রাস্তার ধারে, অফিসে প্রথম পা দেওয়ার পরই যথারীতি আপ্যায়নে যথেষ্ট গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা! সংবাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন সব কর্মী সবে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করছেন তখন। তাঁরা পরম আতিথ্যে আমাকে বরণ করলেন। বললেন, প্রথম দিন দুপুরে এক সঙ্গেই খাওয়া হোক। কলকাতার আপিসের চতুর্দিকে ফাঁদের মতো পেতে থাকা রোল, ফুচকা, তেলেভাজা, প্রন-চাউ, থুপ্পা জয়েন্টের ছবি তখন চোখে ভাসছে। খিদেটাও লেগেছে জব্বর। সাগ্রহে হাত ধুয়ে বসলাম এই ভেবে যে, এত হাঁকডাক তোড়জোড় যখন চলছে, আজকের লাঞ্চ ভোলা যাবে না নিশ্চয়ই। প্রথম দিন বলে কথা।

ভুল ভাবিনি। আজও যে তা মনে আছে তার প্রমাণ, এই লেখা! বিশাল চারটে সাদা প্লেট আর একটা আরও বড় পাত্র। মুলো, শসা, টমেটো, পেঁয়াজ, লেবু, লঙ্কা, রংদার ঝালহীন শিমলা মির্চ, আর অসময়ের গাজরও ছিল বোধ হয়। সব মিলিয়ে দেড়-দু’কেজি তো হবেই। ব্যস, আর কিছু নয়! এই স্যালাডের পাহাড়ের সামনে আমি হতবাক। বাকিরা সাগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সেই ‘লাঞ্চ’ সারতে। সঙ্গে এল সাদা রঙের পানীয়, আমি ঘোল ভেবে চুমুক মারতেই নোনতা স্বাদে মুখ বিস্বাদ। জানলাম ওটা ছাঁচ, দিল্লির গ্রীষ্মের সঙ্গে যুঝতে ওর তুল্য আর অস্ত্র নাকি নেই আর। এই ভাবেই যস্মিন দেশে যদাচার। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম অবাক ছাঁচপানে!

গ্রীষ্মকালের সংসদেও বঙ্গবাজি চলেছে এই বদলে যাওয়া সুরে। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখতাম, গরম পড়ে গেলে সকাল ও দুপুরে ফলাহারে চলে যেতে। বন্ধ করে দিতেন মাছ-মাংস খাওয়া। শুধু মাত্র প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ছিলেন ব্যতিক্রম। বৈশাখের অসহ্য দুপুরে যখন মন ফ্রিজের মধ্যে বসে থাকতে চাইছে, উনি মহানন্দে মাটন কাটলেট, চিকেন পকোড়া খেতে খেতে আমাদের ‘সিপিএমের অত্যাচারের’ গল্প শোনাতেন!

জ্যৈষ্ঠ পড়লে আমের গন্ধে ম-ম রাজনীতির করিডোর। সঙ্গে বাঙালি মহল্লায় ইলিশের রূপকথা। কে কত সস্তায় বাজিমাত করেছেন চিত্ত পার্কের বাজার থেকে, সেই গল্পে বঙ্গ-সাংবাদিকরা তো এখনও জমিয়ে রাখেন সংসদের ক্যান্টিন। মালয়ালিরাও এ পাশ-ও পাশ জেনে নেন এ সব মহার্ঘ সমাচার। এমনও হয় যে, আষাঢ়ের অর্ধেক কেটে গেলেও বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা কোনও মালা চোখে পড়ে না ইন্দ্রপ্রস্থবাসীর। গোটা দিন দগ্ধ হওয়ার পর কোনও খাবারই যখন রাতে আর মুখে রোচে না, তখন মন ফিরে যায় সেই সনাতন পান্তাভাতের কিছুটা আধুনিক সংস্করণে। ফ্রিজের টাটকা জল, ভাত, যতগুলি সম্ভব লেবু, নুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ আর অর্ধচন্দ্রের মতো এক ফালি নারকোল। সঙ্গে ডাল বা পোস্তর বড়া থাকলে সুভান আল্লা! শরীর-মন জুড়িয়ে এর পর ঘুমের ঘোরে দ হয়ে পড়ে থাকা, পরের দিনের প্রখর সূর্যোদয় পর্যন্ত।

*****

ছোট বাচা আর বড় চ্যালা দিল্লির জলজ আত্মীয়। ওদের মিল গাত্রবর্ণের রুপোয়, মিঠে জলে ঝাঁক বেঁধে স্রোতের ভ্রমণপ্রিয়তায়। এরা উভয়েই শুধু রূপে নয়, স্বাদেও আপনাকে ভোলাতে ওস্তাদ! দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তের ফুটপাতে বসা অনেকানেক মেকশিফ্ট মাছবাজারে ছোট মাছের এই ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’ হরবখত। গ্রীষ্মকালে জল থেকে তুলে আনার পর এই দাবদাহে আর বেশি বাছাবাছির সময় থাকে না, কে চ্যালা, কে কাজলি, কে মৌরলা, ছোট বাচা, এমনকি ট্যাংরাও। একই কিলো দরে ঝাঁকে বিক্রি হয় ছোট মাছ।

আসলে দীর্ঘ প্রবাসেও বঙ্গজীবন মাছ ছাড়তে পারেনি। যদিও চিত্তরঞ্জন পার্কের দামি ও বনেদি ইলিশ-ভেটকির একচ্ছত্র রাজত্বের দিন আজ শেষ। মাছের বাজার এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে গলিতে মহল্লায় সাইকেল কেরিয়ারের পিছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা বড় হাঁড়িতে। পূর্ব এবং পশ্চিম দিল্লিতে পেশা ও ছোট ব্যবসার তাগিদে যতটাই ছড়িয়েছে বাঙালি গত পঞ্চাশ বছরে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্গাপুজো, রবীন্দ্র-নজরুল অপরাহ্ন, কবিতা উৎসব, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং হ্যাঁ, মাছের জোগানও।

দু’দশক আগে যমুনা পাড়ের লক্ষ্মীনগর এলাকায় ছিল এক পূর্ববঙ্গীয় বাজার, নাম জুগ্গি মার্কেট। সেখানে বিক্রেতাদের নিবাস জানতে চাইলে সবাই নির্ভুল ভাবে বলতেন, মালদহ! ও-পার বাংলা থেকে অনুপ্রবেশজনিত ভাবনার অবকাশ ছিল না, কারণ অবিশ্বাস্য কম দামে সেখানে ভোরবেলা ইলিশ আসত সিজ়নে। স্বাদে, গন্ধে যা ছিল মনমাতানো। বহু দূরদূরান্ত থেকে বঙ্গপ্রাণ বাঙালি এসে দু’-চারটে ইলিশ ব্যাগে পুরতেন। কিন্তু প্রতি বছর সেই বাজারেই কিনা রহস্যময় ভাবে আগুন লাগত। গুঞ্জন শোনা যেত, পুরপিতারা ওই বেআইনি বাজার তুলে দিতে চায়, কিন্তু এলাকার আবেগকে ক্ষুণ্ণ না করে। কালের চাকায় আজ সেখানকার বাতাসে আর ইলিশের ঘ্রাণ নেই। ছোট মল, বিপণি, পার্লার, মোবাইলের দোকানের সারি।

কিন্তু মাছ-হকাররা ছড়িয়ে গিয়েছেন লক্ষ্মীনগর থেকে গোটা পূর্ব দিল্লি ছড়িয়ে, নয়ডার বিস্তীর্ণ প্রান্তে। পাড়া যদি একটু ঘিঞ্জি হয় তা হলে গৃহকর্ত্রীরা ফোনে কথা বলে, পাঁচতলা থেকে নামিয়ে দেন দড়িতে বাঁধা ব্যাগ। দু’কেজি কাতলা, এক কেজি বাগদা, আধ কেজি লটে উঠে যায় উপরে। চেনা মাছওয়ালার কাছে জি পে-তে দাম চলে যায়। তবে এই সব স্পর্শহীন মৎস্য-বিপণন আরও বেশি হয়েছে কোভিডের পর। নয়তো গাজিপুরে এশিয়ার অন্যতম বড় পাইকারি দোকানে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং গোটা দিল্লির ট্রাকবাহনে মাছের যাতায়াত ছিল কাদা, মাছি, আঁশ-শোভিত সড়ক দিয়ে। এক-একখানা চিতল আসত, যার সাইজ় দেখে হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র কথা মনে পড়ে যেতে পারে!

কোভিডের পর আবার সেই বাজার জেগেছে, কিন্তু পাশাপাশি তৈরি হয়ে গিয়েছে অনেক পকেট-বাজার। বড় চৌবাচ্চা খুঁড়ে মাথায় ছাউনি দিয়ে বসে পড়েছেন ‘জিন্দা-রহু’-র কারবারি। জলের ভিতরে লাফাচ্ছে পোনা মাছ। যা বাছাই করার সময় ছিটকে পড়ে রাস্তায় ঘুরপাক খেতে থাকে চরকির মতো। অবাঙালিরা এসে ভারী সন্দেহের চোখে ট্যাংরার দিকে তাকান! তার পর বিশালাকায় বাসা বাসিঙ্গারা (হ্যাঁ, এটিই নাম) মাছের দেহ থেকে টুকরো কেটে নিয়ে যান সম্ভবত চিলি ফিশের আয়োজন করতে। পুরনো দিল্লিতে আবার এই বাঘা চেহারার মাছের বিপণন মার মার কাট কাট। মুরগির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই।

কর্মস্থল এবং বাড়ির দূরত্বের কারণে, দিল্লিতে ভোর থেকেই দিন শুরু হয়। তাই সন্ধ্যায় হ্যাজাক জ্বালিয়ে বসে মাছের দ্বিতীয় শিফ্ট। কলাপাতার সবুজের উপর ঝলমল করে পমফ্রেট, পাবদা, আড়, বোয়াল, ভোলা-ভেটকি। পাশে মজুত সাইকেল, কারণ সপ্তাহ শেষের দিকে গড়ালেই ফোনে সমানে অর্ডার আসতে থাকে আশপাশের গেট ও পাঁচিল ঘেরা ‘সোসাইটি’ থেকে। ছোট প্লাস্টিকের ভাঁড়ে চা আর বিড়ির ব্রেক-এর মধ্যে দাপিয়ে ব্যবসা করতে থাকে পুতুল, বিশ্বনাথ, আলতাফরা। ও-পার বাংলার প্রজন্মবাহিত স্মৃতি নিয়ে আসা প্রবীণ প্রবাসীরাদিশি কই-মাগুরের খোঁজ করেন, একমাত্র যেটি এখানে দুর্লভ। সে ক্ষেত্রে প্রখর গ্রীষ্মের অকাল ফুলকপি কিনে তাঁরা কলকাতা-ভেটকি নিয়েই ফিরে যান প্রায়শই।

প্রবাসে দৈবের বশে ঘাই মেরে ওঠে রসনার স্মৃতি, স্বপ্নের রান্নাঘর, মায়ের হাতের স্বাদ, দেশভাগের কথা, বৃষ্টির মহাভোজে কানে হেঁটে যাওয়ার কিংবদন্তি, মৌরিবাটার ঘ্রাণ, নরম ডিমের আশ্চর্য রং। নীল হ্যাজাকের মৃদু আলোয় প্রতি রাতে এ ভাবেই মৎস্যপুরাণ লেখা হয় শাহি দিল্লিতে।

*****

প্রবাসের বাঙালিয়ানা চরিত্রে বহুত্ববাদী। রাজধানীর বাঙালিয়ানাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে তার প্রকাশ ও চর্চার ভিন্নতা। চিত্তরঞ্জন পার্কের রবীন্দ্র-নজরুল বন্দনা, মোগলাই পরোটা আর চায়ের গুলতানি, কালীবাড়ি-কেন্দ্রিক বঙ্গসত্তা, মহার্ঘ মাছের বাজার আর কচু-ওল-থোড়-পুঁই-পালংয়ের বিপণি সাজানো বাঙালিয়ানার বাইরেও তৈরি হয়েছে আরও অনেকানেক বঙ্গসত্তা। পটপড়গঞ্জ অথবা লক্ষ্মীনগর (যেখানে বাংলা থেকে আসা স্বর্ণকারদের আদি ঠেক, যাঁরা বাংলা ভুলে হিন্দি শিখে নিয়েছেন টিকে থাকার লড়াইয়ে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য) বাঙালির সঙ্গে পরিচয়চিহ্নে অনেক দূর, গ্রেটার কৈলাস বা পশ্চিম বিহার বা মহাবীর এনক্লেভের বাঙালিয়ানা। তবে এই বহুত্বের মধ্যে যে ঐক্যের সুতোটি প্রতি আশ্বিন মাসের নীলে উজ্জ্বল হয়ে যায়, তা বারোয়ারি দুর্গাপুজোর। এত বিপুল শারদীয় সম্ভার বাংলার বাইরে বুঝি আর কোথাও নেই।

গোড়ায় বারাণসী থেকে জলপথে দিল্লি আসত দুর্গাপ্রতিমা। কিন্তু সে সোয়াশো বছর আগের কথা। আজ পুজো এলেই যে কাশ্মীরি গেটের আরতি দেখতে, তার অভিজাত বনেদি আবহের গন্ধ নিতে এবং পুজোর প্রতিদিন অপূর্ব স্বাদের বিরিয়ানির লাইনে দাঁড়াতে হাজার হাজার বাঙালি ধাবমান, তা প্রবাসে থাকার শূন্যতাকে হারিয়ে দেয় সপ্তমী থেকে বিসর্জন পর্যন্ত। একশো পনেরো বছরের এই পুজো যুদ্ধের সময় কয়েক জায়গা ঘুরে এক সময় পৌঁছেছিল ফতেহপুরি অঞ্চলে, লক্ষ্মীনারায়ণ ধর্মশালায়, তার পর কাশ্মীরি গেট পলিটেকনিকে এবং এখন আলিপুর রোডে। পাশাপাশি আরও একটি ঐতিহ্যে ভরপুর পুজো দিল্লির তিমারপুরের পুজো, যেখানে এক সময় ঠাকুর-ভাসান হত গরুর গাড়িতে বসিয়ে। সে অবশ্য কাশ্মীর গেটের ভাসানও ছিল এক দেখনসই অথচ মনছোঁয়া অভিজ্ঞতা। সে কথা দিল্লির প্রবীণ বাঙালিমাত্রই জানেন। গরুর গাড়িতে চলেছেন দুর্গাঠাকুর যমুনার দিকে, ফতেহপুর হয়ে চাঁদনি চকের ফোয়ারায় এক বার প্রদক্ষিণ করে। পথে চলেছেন অনেক মানুষ। বাঙালির সঙ্গে ছোট ছোট অবাঙালি দোকানদার ব্যবসায়ীও মিশে যেতেন সেই হরিষে বিধুর যাত্রায়। পুজোর পাশাপাশি বিবিধের মাঝে প্রবাসের বাঙালিয়ানা বেঁচে থাকে গানে-নাটকে-সংস্কৃতির শিকড় খুঁজে খুঁজে।

*****

এক সময় সরোজিনী নগরে গায়ে গায়ে ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল কয়েকশো বাঙালি পরিবারের বসতি। কালক্রমে তাদের মধ্যে দু’টি সাহিত্য দল। প্রাচীনপন্থী দলের নেতা বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘কল্লোল’ যুগের কবি হিসাবে তাঁর পরিচিতি। অন্য দল যেন একটু বাম-ঘেঁষা। পঁচিশে বৈশাখ তাই দু’টি সাহিত্য সভা। সেই রেষারেষির মধ্যেই দিল্লি ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি স্কুল-এর প্রিন্সিপাল ব্রজমাধব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ‘অনামিকা সাহিত্য সভা’ শুরু হল পঞ্চাশের গোড়ায়। প্রায় দশ বছরের এই সাহিত্য আড্ডার কোনও মুদ্রিত নথি নেই ঠিকই, কিন্তু এ কথা আজও রাজধানীর প্রবীণ বঙ্গবাজার একবাক্যে মেনে নেয়, পঞ্চাশের দশকে প্রবাসে বাংলা সাহিত্যসৃজনে অভিভাবকের কাজ করে গিয়েছে অনামিকা। বারোয়ারি বাংলা উপন্যাস নামে এক চমকপ্রদ ধারণার জন্ম দিয়েছিল অনামিকার আড্ডা। প্রত্যেক মাসের একটি নির্দিষ্ট রবিবার দুপুরে এই আড্ডা বসত, যেখানে যে কোনও এক জন, উপন্যাসের একটি পর্ব লিখতেন। পরের মাসে সেই পর্ব এগিয়ে নিয়ে যেতেন অন্য জন।

সভার সদস্যদের মুখ্য অংশ ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ অফিসারেরা, যাঁরা সাহিত্যপ্রেমীও। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ব্রজমাধববাবু ত্রিনিদাদ চলে যাওয়ায় আরও কয়েক বছর অনামিকার সভাপতিত্ব চালিয়েছিলেন মণি রায় (পেশায় চিকিৎসক)। মণিবাবু তাঁর এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, “অনামিকার আসরে যোগদান করেননি দিল্লিতে আগন্তুক এমন কোন কবি সাহিত্যিকের নাম করা কঠিন। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, প্রবোধ সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুজতবা আলী, সন্তোষকুমার ঘোষ আসতেন। ... প্রেমেন্দ্র মিত্র একদিন বলেছিলেন, আপনাদের সভাতে যেমন হয় তেমন কচুকাটা মন্তব্য সবার লেখা নিয়ে, যদি কলকাতাতে হত, একদিনেই সভা ভঙ্গ হয়ে যেত!” ১৯৬৪ সালে এই আড্ডা বন্ধ হয়ে যায় কোনও মুদ্রিত চেহারা না রেখেই।

অনামিকার মুদ্রিত চেহারা না থাকলেও তার কাছাকাছি সময়ে কিন্তু প্রথম জনপ্রিয় মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশিত হয় ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ নামে। খুলনার জাতক আদিত্য সেন ও-পার বাংলায় পড়াশোনা শেষ করে দিল্লি এসেছিলেন চাকরির তাগিদে। ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি। অর্থাভাবে ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ স্তব্ধ হয়ে গেলেও শিল্পপতি ও প্রযুক্তিবিদ দিল্লিবাসী বিকাশ বিশ্বাসের সঙ্গে শুরু করেন ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ নামে একটি পত্রিকা। যেটি এখনও চলছে।

মধ্যবর্তী শূন্যতাকে অতিক্রম করে আসুন নব্বইয়ের দশকে। আর্থিক উদারীকরণ যখন সবে তার খেল-তামাশা শুরু করেছে, বিশ্বায়ন ঘোমটা সরিয়ে রাজধানীকে দেখাচ্ছে তার দর্পিত নাকের নথ, এই সময়েই একটি কবিতা পত্রিকাকে ঘিরে আবার দলবদ্ধ হলেন এক ঝাঁক দিল্লির কবি।উত্তর-আধুনিকতার ধারণাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে যাঁরা খনি খুঁড়ে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করলেন তিন দশকের পুরনো হাংরি আন্দোলনকে। যাঁদের ডানার ঝাপট শুনতে পাওয়া গেল উত্তরবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, জামশেদপুর এবং খোদ কলকাতায়।কবি দীপঙ্কর দত্তের সম্পাদনা এবং উৎসাহে জন্ম নিল সর্বার্থেই অভিনব এক সাহিত্যপত্রিকা— ‘জ়িরো আওয়ার’।

‘শূন্য প্রহর’-এর সন্ধানীরা তাই আড্ডার জায়গা বদলালেন। দীপঙ্কর দত্ত, অরূপ চৌধুরীরা খুঁজে বার করলেন দিল্লি হাটে বসার একটি ঠেক। বিজলি গ্রিল স্টলের পাশে চারকোনা পাথরের টেবিল ঘিরে বাড়তে থাকে সভ্যসংখ্যা। পড়া হতে থাকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। কিন্তু কিছু স্পর্শকাতরতা, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার প্রশ্নে কোনও সঙ্গীর সৎ না থাকার অভিমানে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। আড্ডা কিন্তু বন্ধ হয় না। বরঞ্চ যোগ দিতে থাকেন নতুন নতুন সদস্য।

সব মিলিয়ে দিল্লিতে একটা সাহিত্য-আড্ডা গড়ে উঠেছে, অনলাইন, অফলাইন মিলেমিশে। দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। এই অ্যাসোসিয়েশনের সাহিত্য ও সংগঠন বিষয়ক শাখার দুই কর্ণধার শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায় এবং সৌরাংশু সিংহ গত দশ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে আয়োজন করে থাকেন সাহিত্য-আড্ডার। তাঁদের উদ্যোগ, পরিশ্রম এবং উৎসাহে কলকাতা থেকে এসে কবি সাহিত্যিক গায়ক বাচিকশিল্পীরা আসেন। দিল্লির বঙ্গসৃজনের সঙ্গে আদানপ্রদান ঘটে চিন্তার। বইমেলায় তো বটেই, তা ভিন্নও সাহিত্য-আসর গড়িয়ে যায় পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ হয়ে আরও রকমারি মঞ্চে। বর্ষা থেকে বসন্ত — কবিতা গল্প গান চলতেই থাকে রাজধানীর বিভিন্ন ঋতু জুড়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Culture Bengali Language Bengali Tradition new delhi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}