মধ্য কলকাতার রেস্তরাঁটি মাছের নানাবিধ পদের জন্য পরিচিত। সেই টানেই সেখানে গিয়েছিলাম। সেটির উপরের তলায় গানও হয়। খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করার সময় হঠাৎ দেখি, উপর থেকে নামতে নামতে রেস্তরাঁর এক কর্মীর সঙ্গে রেস্তরাঁয় আসা এক জনের তুমুল বচসা। প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। বাকিরা তাঁদের শান্ত করতে এই বিবাদের কারণ জানা গেল। ওই ভদ্রলোক খাওয়া শেষ করে বেরনোর আগে একটি গানের অনুরোধ করেছিলেন। সেই গান শেষ হওয়ার আগেই রেস্তরাঁর ওই কর্মী তাঁকে বিল ধরিয়ে দিয়েছেন। গানে ডুবে থাকা ভদ্রলোক এমন ব্যাঘাতে রেগে কাঁই!
যাঁর গাওয়া গানের জন্য এত কাণ্ড, তিনি প্রয়াত হলেন মঙ্গলবার রাতে। বাপ্পি লাহিড়ী। গানটাও সবার চেনা, ‘ডিস্কো ডান্সার’ ছবিতে বাপ্পিরই সুরে, ‘ইয়াদ আ রহা হ্যায়, তেরা প্যার।’ বাপ্পির সুর দেওয়া, গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গানগুলি সঙ্গীতের বিচারে কতটা উঁচু দরের, সে তর্ক ভিন্ন। তবে টানা তিন-চার দশক ধরে সেই সুরগুলির উপরে ভিত্তি করে যে একাধিক পেশা আবর্তিত হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
বড় শহরে এমন পেশাগুলির মধ্যে যেমন নানা হোটেল-রেস্তরাঁ-পানশালার গায়ক-গায়িকা রয়েছেন, শহরের বাইরে, গ্রামবাংলায় রয়েছেন বহু ‘কণ্ঠী’ শিল্পী। তাঁদের অনেকে তিন-চার দশকের গানের কেরিয়ারের মূল নির্ভরতা বাপ্পি লাহিড়ীর অসংখ্য হিট গান। তার মধ্যে যেমন রয়েছে, ১৯৭৫-এ মুক্তি পাওয়া ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’, তেমন রয়েছে ১৯৮২ সালের ‘জিমি জিমি আ জা আ জা’, ‘আই অ্যাম আ ডিস্কো ডান্সার’ বা ‘কোই ইঁহা আয়ে নাচে নাচে’। কেবল গায়করাই নন, চলতি কথায় ‘মাচা’ বলে পরিচিত এ সব জলসার উপরে বছরের পর বছর নির্ভর করেছেন অসংখ্য যন্ত্রশিল্পী। জনপ্রিয় সুরকে নির্ভর করে যে ছোট আকারে হলেও এক অসংগঠিত অর্থনীতি চলেছে, এখনও চলছে, সে কথা অনস্বীকার্য। বাংলায় খ্যাতনামা সুরকার অতীতে অনেক ছিলেন, আজও আছেন, ভবিষ্যতেও হবেন। কিন্তু নাক-উঁচু সংস্কৃতির বাইরে অপরেশ ও বাঁশরী লাহিড়ীর পুত্র একাই এক শিল্পবৃত্তের জন্মদাতা।
এই বৃত্তেরই মধ্যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে গান গেয়ে কাটিয়েছেন মালদহের বাসিন্দা মৃণাল চক্রবর্তী। ষাটোর্ধ্ব মৃণালবাবু বলছিলেন, তাঁরা আগামী বেশ কয়েক মাস কেবল বাপ্পি লাহিড়ীর গানই গাইবেন। যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে বসে গান বেছে রেওয়াজও করে নিয়েছেন তিনি। বাপ্পি লাহিড়ীর প্রয়াণের পরে শ্রোতারা আরও বেশি করে তাঁর গান শুনতে চাইবেন আন্দাজ করেই এমন প্রস্তুতি। তবে গানের চাহিদা তিন দশক ধরেই একই আছে বলে জানাচ্ছেন মৃণাল। তাঁর অভিজ্ঞতা, “যত দিন ধরে গান গাইছি দেখছি, ‘শরাবি’, ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘অমর সঙ্গী’র গানগুলো গাইতেই হবে।”
এখানেই অনন্য বাপ্পি লাহিড়ী! জনপ্রিয়তার কত পরতে যে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছেন তিনি! কয়েক বছর আগেও ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে ‘উ লা লা উ লা লা... তু হ্যায় মেরি ফ্যান্টাসি’ গানটার কথা মনে পড়তে পারে। একদা সেক্স বম্ব দক্ষিণী নায়িকা সিল্ক স্মিতার জীবনের আদলে তৈরি, বিদ্যা বালন ও নাসিরুদ্দিন শাহের সেই ছবির জনপ্রিয়তার অন্যতম স্তম্ভ তো ওই গানই। আবার উত্তমকুমারের শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র অন্যতম আকর্ষণ বাপ্পির সুর। বোতলে ঠুনঠুন আওয়াজ তুলে ‘এই তো জীবন’ কে ভুলতে পারে!
দক্ষিণী নায়িকার কথায় মনে পড়ে গেল, হিন্দি ছবিতে জয়া প্রদা এবং শ্রীদেবীর উত্থানের পিছনেও কিন্তু আছে এই বঙ্গসন্তানের অবদান। ‘মাওয়ালি’ বা ‘তোফা’ কিংবা ‘হিম্মতওয়ালা’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জিতেন্দ্র, তাঁর বিপরীতে ছিলেন শ্রীদেবী, জয়া প্রদা। সেই সব ছবির ‘তোফা তোফা লায়া লায়া’ কিংবা ‘লড়কি নেহি হ্যায় তু লকড়ি কা খাম্বা হ্যায়’ গানগুলি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত দিগ্বিজয়ের ঘোড়া ছুটিয়েছিল।
বাপ্পি বা তাঁর গান অবশ্যই এই মাচা-অর্থনীতির জন্ম দেয়নি। বাপ্পি না থাকলেও মাচার অনুষ্ঠানে অন্য শিল্পীর গান নিশ্চয়ই বাজত। তবে বাংলায়, বিশেষত গ্রামবাংলায় বাপ্পি লাহিড়ীর জনপ্রিয়তার শুরুর সঙ্গে বাংলায় রাজনৈতিক-সামাজিক পরিমণ্ডলের বদলের এক অদ্ভুত সমাপতন চোখে পড়ে। মুম্বইয়ে বাপ্পির জনপ্রিয়তার শুরু সত্তরের দশকের শেষ থেকে। ১৯৭৫-এ মুক্তি পাওয়া ‘জখমি’র ‘জ্বলতা হ্যায় জিয়া মেরা’, ১৯৭৬-এর ‘চলতে চলতে’ ছবির ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’, ১৯৭৭-এর ‘আপ কি খাতির’ এর ‘বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত’ বা ১৯৭৯-র ‘লহু কে দো রঙ্গ’-এর ‘চাহিয়ে থোড়া প্যার’— বাপ্পির সুরে একের পর এক গান ঝড় তুলেছিল। বিপ্লবের দশক শেষে ক্লান্ত, ধ্বস্ত বাংলার জনপরিসরে কি এ ভাবেই শুরু হয়েছিল নতুন এক সেলিব্রেশন?
বাংলায় সেই সময়েই বামফ্রন্ট শাসনের শুরু। রাজনীতির প্রচারের মুখ শহর থেকে গিয়েছে গ্রামে। নকশাল আন্দোলনের পরে সামাজিক পরিস্থিতিতে স্থিতাবস্থাও এসেছে। শহরের বাইরের বিপুল সংখ্যক মানুষ ভূমিসংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন। সেই স্থিতাবস্থা, গ্রামাঞ্চলের তুলনামূলক সমৃদ্ধির সময়েই এল আশির দশকের গোড়ায় বাপ্পি লাহিড়ীর গান-সুর ও মিঠুন চক্রবর্তীর নাচের যুগলবন্দিতে ‘ডিস্কো ডান্সার’। প্রাতিষ্ঠানিক বাম-রাজনীতির পরিশীলিত পরিভাষায় অব্যর্থ ভাবে ‘অপসংস্কৃতি’। তবু যে জনপ্রিয় ভোট বামফ্রন্টের ভিত্তি ছিল, সেই জনপ্রিয়তা, সেই সেলিব্রেশন যে বাপ্পি লাহিড়ীর পালে হাওয়া দিয়েছিল তা অনস্বীকার্য। বাংলা থেকে মুম্বই গিয়ে লড়াই করে পাওয়া মিঠুনের ব্যক্তিগত সাফল্যের কাহিনিও হয়তো জনমানসে সেই জনপ্রিয়তাকে আরও জোরদার করে তুলেছিল। জনপরিসরে গানের এক দিকে তখন বাপ্পির সুরে ‘ডিস্কো ডান্সার’, অন্য দিকে ঊষা উত্থুপকে প্রায় প্রতি জলসায় গাইতে হয় বাপ্পিরই সুরে ‘রাম্মা হো হো’। বামফ্রন্ট সরকারও যে এই জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারেনি, ‘হোপ ৮৬’-র মতো অনুষ্ঠান আয়োজন তারই ইঙ্গিত।
দীর্ঘ দিন ধরে গ্রামবাংলার জলসা তথা মাচার অনুষ্ঠানে গান করেন এমন অনেকেরই বলছেন, ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর পর থেকে ওই গানগুলির জনপ্রিয়তা যে শুরু হয়েছে তা এখনও অটুট। সেই সময়টা গ্রাম-মফস্সলে সিনেমা দেখার ভিসিআর যেমন ঢুকছে, তেমনই ক্লাবের মতো গণসংগঠন বাড়তে থাকায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের হিড়িকও। আর কী অদ্ভুত, ১৯৮৭-র ‘ডান্স ডান্স’ ছবিতে সেই পশ্চিমবঙ্গেরই অনুষঙ্গ। যে জলপাইগুড়িতে বাপ্পির জন্ম, সেই জলপাইগুড়ির অনুষ্ঠানই ছবির গুরুত্বপূ্র্ণ উপাদান।
উত্তর থেকে দক্ষিণ— বাংলার সর্বত্রই কয়েক দশক ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে বাপ্পির গানগুলি। কথা হচ্ছিল দুর্গাপুরের বাসিন্দা, গায়িকা ঋতুপর্ণা বক্সীর সঙ্গে। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এমন অনুষ্ঠানে গান করে যাচ্ছেন তিনি। ঋতুপর্ণার অকপট স্বীকারোক্তি, “আমরা যারা মাচায় গান করি তাঁদের অস্তিত্ব পুরোপুরি নির্ভর করে বিখ্যাত শিল্পীদের উপরেই। দর্শক আমাদের গলায় তাঁদের গানই শুনতে চান।”
‘রাত বাকি বাত বাকি’, ‘রাম্মা হো’, ‘কোই ইঁহা আয়ে নাচে নাচে’ থেকে শুরু করে ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’ সব রকম গানই গেয়ে থাকেন ঋতুপর্ণা। বাঙালি ভুলে যায়, মঙ্গলদীপের মতো প্রার্থনাসঙ্গীত বা একদা আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয় ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়’ গানের সুরস্রষ্টা এক জনই। বাপ্পি!
দুর্গাপুজো থেকে সরস্বতী পুজো হয়ে দোল পর্যন্ত মাচা ফাংশনের সিজ়নে, তাতে প্রতি দিন দেড় হাজার টাকা বা তারও বেশি আয় করেন গায়ক-গায়িকারা। কত দূরে অনুষ্ঠান, তা বিচার করে পারিশ্রমিকও বাড়ে। পাড়ার জলসা নয়, বহু বিয়েবাড়িতেও এমন অনুষ্ঠান হয়। অনেকে কোনও হোটেলে নিয়মিত গান করেন। তবে মঞ্চ যেখানেই হোক, এই জনপ্রিয় গানগুলি যে তার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে, তা জানাচ্ছেন সব শিল্পীই। ঋতুপর্ণা জানাচ্ছেন, “এই গানগুলোকে ভর করেই তো আমরা সংসার করেছি, ঘরবাড়ি করেছি, পরিবারকে দেখাশোনা করেছি।”
সদ্যপ্রয়াত বাপ্পির কৃতিত্বকে তাই তাঁর গা-ভরা গয়নায় বিচার করলে হবে না। উত্তমকুমারের যুগে ‘লোলা লুলু কেন তোমার বয়স হয় না ষোলো’তেই শেষ হয়নি বাপ্পির সঙ্গীত-মূর্ছনা। আশির দশকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘অমরসঙ্গী’ ছবির সেই গান ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’কে ভুলতে পারে! তাপস পাল-শতাব্দী রায়ের ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবিতে তাঁর সুরেই কখনও বেজেছে ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’, কখনও বা আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘ফুল কেন লাল হয়’। নদীর ধারে তাপসের সামনে নাচছেন শতাব্দী, গাড়িতে বসে রঞ্জিত মল্লিক।
এই যে উত্তম থেকে তাপস, প্রসেনজিৎ অবধি দীর্ঘ ধারাবাহিকতা, এখানেই তিনি একক ইন্ডাস্ট্রি।
এই ইন্ডাস্ট্রিকে কখনও বাংলা-হিন্দির গণ্ডিতে বাঁধা যায় না। ‘শরাবি’ ছবিতে তাঁর সুরে ‘দে দে পেয়ার দে’ গানে কখনও থাকতে পারে ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’-এর অনুষঙ্গ। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? শুধু ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ নয়, উত্তম থেকে প্রসেনজিৎ, তাপস অবধি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে আছে তাঁর গান। আর সেই জনপ্রিয় সুরের ডানাতেই এই ইন্ডাস্ট্রির উড়ান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy