সংস্কারক: আবুল হুসেন। ছবি সৌজন্য: বেনজীন খান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক জনসমক্ষে নাকে খত দিচ্ছেন। সবাই দেখছেন তা। কেউ ভাবছেন, বড্ড বাড় বেড়েছিল লোকটার। উচিত শিক্ষা হয়েছে।
শিক্ষকের নাম আবুল হুসেন। তাঁর অপরাধ, তিনি মুসলমান সমাজের ধর্মসংস্কারে, প্রচলিত আচারে–বিচারে আঘাত করছেন। পত্রপত্রিকায় লিখছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিছু দিন আগে এক সভায় তাঁর বক্তৃতা শুনে স্বয়ং মহম্মদ শহীদুল্লাহ সভা ত্যাগ করলেন। তীব্র প্রতিবাদও করে গেলেন রবীন্দ্রস্নেহধন্য এই ভাষাতাত্ত্বিক। পিছন–পিছন বেরিয়ে গেলেন আরও অনেকেই।
কী এমন বলেছিলেন আবুল হুসেন যে শিক্ষিত মুসলমানেরাও প্রতিবাদ করলেন! অনুষ্ঠানটি ছিল ঢাকায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য–সমিতির সাধারণ অধিবেশন। ২৯ নভেম্বর ১৯১৯। আবুল হুসেনের বক্তৃতার শিরোনাম ‘সুদ বা রেবা বা ধনজ’। শরিয়তে সুদ নেওয়া নিষেধ। অপরাধ। কিন্তু আধুনিক সময়ে এই বিধান মানলে মুসলিম সমাজকে পিছিয়ে পড়তে হবে। অর্থনীতির শিক্ষক আবুল হুসেন বুঝেছিলেন, সুদের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকায় মুষ্টিমেয় হিন্দু দাদন কারবারির একচেটিয়া ব্যবসার কবলে সর্বস্ব হারাচ্ছে দরিদ্র চাষীরা। তাই অবিলম্বে এই বিধান থেকে সরে আসুক মুসলমান সমাজ। তাঁর স্পষ্ট যুক্তি, সুদকে হারাম রাখা এখন আর সম্ভব নয়। ধর্মের বহু আইন সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এখন সময় পালটেছে, আইনও পালটাতে হবে। বলা আছে, ‘চুরির শাস্তি হাত কেটে নেওয়া’; কোন দেশে কোন মুসলমানের পক্ষে চোরের হাত কেটে নেওয়া সম্ভব? আইন এমন ভাবেই আইন পালটায়, পালটাতেই থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
এই ভাবে আবুল হুসেন নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। তার মুখপত্রটির নাম ‘শিখা’। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, আবদুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ শিক্ষিত বাঙালি যুবক যোগ দিলেন এই দলে। তাঁদের পরিচিতি হল ‘শিখা গোষ্ঠী’। এঁদের যুক্তিতে ভরা তীক্ষ্ণ ভাষণে ও লেখায় নড়েচড়ে উঠল বৃহত্তর মুসলিম সমাজ। ‘শিখা’ পত্রিকার শিরোনামে হুসেন সাহেব লিখলেন: ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ ১৯২৬-এ ঢাকায় চিন্তা ও কাজের এই বিস্ফোরণকে অনেকেই বলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’।
আবুল হুসেন আরও একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন— ‘তরুণ পত্র’। তার তিনটে সংখ্যা হাতে পেলেন প্রমথ চৌধুরী। তখন তাঁর ‘সবুজপত্র’–এরও রমরমা। সেখানে প্রমথ চৌধুরী ‘তরুণ পত্র’-এর নবীন কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে লিখলেন: ‘সবুজপত্র তাই তরুণপত্রকে ডেকে বলছে: ভাই, হাত মিলানা।’
পরদাপ্রথার বিরোধী আবুল হুসেন প্রতিষ্ঠা করলেন ‘অ্যান্টি পর্দা লীগ’। লিখলেন: ‘আজ বোরখা মুসলমান নারীর দুর্বলতার চরম নিদর্শন হয়ে উঠেছে।’ আর একটি প্রবন্ধে লিখলেন: ‘কবর আজ মুসলমানের সর্বশ্রেষ্ঠ দরগা হয়েছে— তার সর্ব কামনার আখড়া সেখানে। দরগাকে শ্রদ্ধা করতে গিয়ে সে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হয় কেমন করে তা ভুলে গেছে।’
রক্ষণশীল মানুষ এ সব কথা ভাল মনে নিলেন না। অচিরেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। আবুল হুসেন অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছেন, এই সিদ্ধান্তে যে রক্ষণশীল কর্তাব্যক্তিরা উপনীত হচ্ছেন, তারা ‘নীরব’ সমর্থন পেয়ে গেলেন মহম্মদ শহীদুল্লাহ বা গোলাম মোস্তাফাদের মতো শিক্ষিত, অগ্রসর মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। ফলে আবুল হুসেনের উপর নির্যাতন, নিগ্রহ শুরু হওয়া যেন শুধুই সময়ের অপেক্ষা ছিল। ঢাকার বলিয়াদির জমিদার খান বাহাদুর কাজেমউদ্দিনের উদ্যোগে বিচারসভা বসে ১৯২৮–এর ২০ অগস্ট। আবুল হুসেনকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হল। শাস্তি হিসেবে চল্লিশ হাত নাকখত দিতে হল এক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে!
তবু কলম থামল না আবুল হুসেনের। চাকরি ছেড়ে ওকালতি শুরু করলেন। গড়লেন ‘আল–মামুন ক্লাব’। লিখলেন ‘আদেশের নিগ্রহ’। ১৯২৯–এর ৮ ডিসেম্বর ওই প্রবন্ধ লেখার ‘অপরাধে’ নবাববাড়ি আহসান মঞ্জিলে আবার বিচারসভা বসল। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকির মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবুল হুসেন লিখতে বাধ্য হলেন: ‘আমি অপরাধী’। শিখা গোষ্ঠীর আবদুল ওদুদ থেকে শুরু করে কেউ এই নিগ্রহের বিরুদ্ধে একটা কথাও বললেন না। প্রতিবাদের ভাষাটাই যেন ভুলে গিয়েছিলেন তাঁরা।
অপমান, অভিমানে আবুল হুসেন চলে এলেন কলকাতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে এমএ পাশ করলেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্নাতকোত্তর। ওয়াকফ আইনের জনক এই মানুষটি আর কিছু দিন মাত্র বেঁচে ছিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র একচল্লিশ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy