রঙিন: বসন্তে বাংলার পলাশ। ইউরোপের বহু দেশেও বসন্তের আগমনে হয় নানা উৎসব। ছবি: তথাগত সিকদার
ক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছে একগাদা লোক। সবাই অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে সামনের বরফে ঢাকা পার্কের জমির দিকে, যদি কোনও গর্ত থেকে উঁকি দেয় একটি লোমশ ছোটখাটো প্রাণী! যদি তার মুখটুকু দেখা যায়, আর গর্তের বাইরে এসে সে লাফালাফি করে, তবে স্বস্তি— শীত বিদায় নেবে শিগগিরই, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আর যদি বাছাধন গর্তের বাইরে বেরিয়ে নিজের ছায়া দেখে ভয় পেয়ে আবার গর্তে সেঁধিয়ে যায়, তা হলে আরও ছ’হপ্তা চলবে শীতের দাপট।
অবাক হচ্ছেন? আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় অনেক শহরে এমন করেই বসন্তের আগমনবার্তা পায় লোকে। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ এখানে পরিচিত ‘গ্রাউন্ডহগ ডে’ নামে। এই ‘গ্রাউন্ডহগ’ একটি ছোট লোমশ প্রাণী, আকারে একটু বড়সড় মেঠো ইঁদুরের মতো। গর্তবাসী অন্যান্য প্রাণীর মতোই গোটা শীতকালটা এরা গর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটায়। শীতঘুম শেষে এদের বাইরে বেরিয়ে আসা দেখে অনেক কাল আগে ইউরোপে চাষিরা শীত-বসন্তের ঋতুসন্ধিতে ফসলের বীজ রোপণের জন্য জমি তৈরির উপযুক্ত সময় স্থির করত। সাধারণত বছরের ৩৩তম দিনে প্রজননের প্রয়োজনে ওরা গর্তের বাইরে আসে সঙ্গীর খোঁজে। যদি সে দিন চনমনে রোদ ওঠে, গ্রাউন্ডহগ নিজের ছায়া দেখতে পায়, আবার গর্তের ভিতর ঢুকে পড়ে। সে ক্ষেত্রে আরও কয়েক সপ্তাহ শীতের প্রকোপ চলতে দেখা যায়। কিন্তু যদি দিনটা থাকে মেঘলা, ওরা বাইরে এসে খানিক ছুটোছুটি করে। দেখা যায়, এর কয়েকদিনের মধ্যেই শীতের দাপট কমে গিয়ে বসন্তের ফুল ফুটতে শুরু করে। সেই থেকে এই গ্রাউন্ডহগরা ‘আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বক্তা’ হিসেবে প্রাচীন ইউরোপীয় লোকগাথায় জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপ থেকে উদ্বাস্তু মানুষ আমেরিকায় এসে বসতি স্থাপন শুরু করল, সঙ্গে নিয়ে এল তাদের কেলটিক ধর্মবিশ্বাসের শিকড়ও। বিশেষ করে জার্মানি থেকে পেনসিলভানিয়ায় আগত জনগোষ্ঠী দেখল, তাদের দেশের মতো ‘ব্যাজার’ বা ‘হেজহগ’-এর মতো প্রাণী আমেরিকায় নেই, কিন্তু একই স্বভাব ও গোত্রের গর্তবাসী প্রাণী ‘গ্রাউন্ডহগ’রা সংখ্যায় প্রচুর। কৃষিজীবী মানুষের উদ্দেশ্য তো চাষের জমি তৈরির সঠিক সময়ের আন্দাজ পাওয়া, তা ব্যাজারই জানিয়ে দিক বা গ্রাউন্ডহগ, কী আসে যায়! তাই তারা চালু করল ‘গ্রাউন্ডহগ ডে’। আমেরিকাবাসীও সোৎসাহে আপন করে নিল নতুন এই উৎসবকে।
যে দেশে যে রূপেই আসুক না কেন, উৎসবের মর্মবাণী চিরন্তন। যা কিছু জীর্ণ, পুরনো, তাকে ত্যাগ করে সজীব ও নবীনকে বরণ করে নেওয়া। ‘বসন্ত উৎসব’ কেবল আমাদের দেশের একচেটিয়া নয়। বিশ্ব জুড়েই নানা রূপে আর রঙে উদ্যাপন করা হয় ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’। ‘সামার সলস্টাইস’ বা সূর্যের দক্ষিণায়ন থেকে ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ অর্থাৎ ‘বসন্ত বিষুব’— ঋতু পরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণই বসন্তকাল। বরফের চাদর সরিয়ে, নির্জীব শুষ্ক ডালে সবুজ কলি আর রঙিন ফুল ফুটিয়ে, সোনা রোদ ঝরিয়ে প্রকৃতি সর্বত্র বইয়ে দেয় প্রাণের হিল্লোল।
ইউরোপে বসন্ত উৎসবে দারুণ জাঁকজমক। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় বসন্ত-সমাগমে শুরু হয় ‘লাস ফাইয়াস’। মাতা মেরির স্বামী সেন্ট জোসেফের স্মরণে এই উৎসব। প্রতিটি এলাকায় বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই কাঠ, কাগজ, মোম প্রভৃতি দিয়ে বড় বড় পাপেট বা পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়। খানিকটা দশেরায় আমাদের রাবণ-বধ উৎসবের মতোই, এখানেও বাজি পোড়ানো হয়; বাজির আগুনে লাল আভায় জ্বলজ্বল করতে থাকে জিশুর জীবনের সঙ্গে জড়িত নানা চরিত্র অবলম্বনে তৈরি অতিকায় পুতুলগুলো। তাদের ঘিরে চলে নাচ, গান, শোভাযাত্রা। এই উৎসবে বাজি পোড়ানোয় বিস্তর টাকা খরচ হয়। স্পেনে এই সময় পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে। ১ মার্চ থেকে আরম্ভ হয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে এই উৎসব।
স্পেন ছাড়াও আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, রোমানিয়া প্রভৃতি দেশেও হইহই করে উদ্যাপিত হয় বসন্ত উৎসব। মেক্সিকোতে বসন্ত ঋতুকে বলা হয় ‘সান মার্কোস’। প্রতি বছর ২০-২১ মার্চ দলে দলে মানুষ ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ উদ্যাপন করতে সাদা পোশাক পরে শহর থেকে ৩০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল তুতিহুয়াসান পিরামিডে সূর্যোদয় দেখতে যায়। অনেকেই ৩৬০ সিঁড়ি চড়ে পিরামিডের মাথায় পৌঁছে যায়, সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে সারা বছরের জন্য প্রাণশক্তি শুষে নেওয়ার সংস্কারে দু’হাত তুলে রোদ পোহায়। এর পর শুরু হয়ে যায় মেলা। তিন সপ্তাহব্যাপী এই বসন্ত উৎসব মেক্সিকোর বৃহত্তম উৎসব। অগণিত পর্যটক আসেন মোরগ লড়াই, সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা ও নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান দেখতে। পোল্যান্ডে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয় খড়ের তৈরি অতিকায় পুতুল। শীত ঋতু, প্লেগ, মৃত্যুর দেবী মারজানা-র প্রতীক এই পুতুলকে না পুড়িয়ে এরা শেষে জলে ডুবিয়ে দেয়; শীতের ক্রোধ শান্ত করে বসন্তকে স্বাগত জানায়। বসনিয়ায় বসন্তের অভ্যর্থনা হয় নবজীবনের প্রতীক ডিম দিয়ে। উৎসবের নাম ‘সিমবুরিজাদা’, অর্থ: ‘ফেস্টিভ্যাল অব স্ক্র্যাম্বল্ড এগ’। বসনা নদীর ধারে সবাই একত্রিত হয়, বিনামূল্যে বিতরিত হয় ‘স্ক্র্যাম্বলড এগ’। মিলনমেলার অভিনব আয়োজন!
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিন ও জাপানে মহা ধুমধাম হয় বসন্ত-বরণে। চিন-এ প্রচলিত ছিল লোকগল্প— ‘নিয়োন’ নামের এক ক্ষুধার্ত অপদেবতা দীর্ঘ শীতঘুম শেষে গ্রামে এসে ধ্বংস করত শস্য, পটাপট খেয়ে ফেলত গরু-ছাগল, এমনকি ছোট ছেলেমেয়েদেরও। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাচীন চিনের মানুষ বাড়ির দরজায় রেখে দিত সুস্বাদু খাবারদাবার, যাতে সে সব খেয়ে তৃপ্ত হয়ে নিয়োন বিদায় নেয়। কিন্তু এক সময় গ্রামের মানুষ লক্ষ করল, লাল পোশাকের একটি শিশুকে দেখে নিয়োন ভয় পেয়ে পালাচ্ছে। এর পর থেকেই নিয়োনকে ঠেকাতে শীতের শেষে সকলে লাল বা জমকালো রঙের পোশাক পরতে শুরু করল, শুরু হল লাল রঙের লণ্ঠন দিয়ে ঘর সাজানোর রীতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আধুনিক হয়েছে, প্রাচীন সংস্কার ঝেড়ে ফেলেছে, কিন্তু ঋতুসন্ধিতে নিজেদের রঙিন করে সাজিয়ে নেওয়ার প্রথাটি রয়ে গিয়েছে।
জাপানে বসন্তকালে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় চেরি গাছ। চেরি ফুলকে জাপানিরা বলে ‘সাকুরা’। এই ফুল তাদের কাছে বড় পবিত্র, সৌভাগ্যেরও প্রতীক। ফুল ফোটার উৎসব ‘হানামি’ পালনের শেকড় সেই সপ্তম শতকে। কৃষ্ণচূড়া যেমন জানুয়ারির শেষ থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্তও ফোটে, তেমনই সাকুরা অঞ্চলবিশেষে জানুয়ারি থেকে ফুটতে আরম্ভ করলেও ‘হানামি’র আয়োজন শুরু হয় মার্চ থেকে। প্রকৃতি তখন সবচেয়ে মনোরম। ফুল-বিছানো বিরাট চেরি গাছের ছায়ায় নানা ঐতিহ্যবাহী জাপানি খাদ্যদ্রব্য সহযোগে চলে বনভোজন পর্ব।
ইরানি সমাজে ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ ‘নওরোজ’, মানে নতুন দিন হিসাবে উদযাপিত হয়। জরথ্রুস্টীয় লোকগাথা অনুসারে, তিন হাজার বছর আগে সব প্রাণীর ত্রাসের কারণ হয়ে ওঠা এক দুষ্ট অপদেবতাকে এই দিনে বধ করেছিলেন রাজা জামসিদ। ইরানের প্রাচীন ‘নওরোজ’ উৎসব আজ ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ২০১০ সালে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নওরোজ দিবস’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’-এ উজবেকিস্তানের মানুষ নববর্ষ বরণ করে অঙ্কুরিত গমের চারা সাজিয়ে; এই দিনে পরিবেশিত হয় অঙ্কুরিত শস্যের একটি বিশেষ খাবার—‘সুমালাক’। অন্ধকারকে পরাস্ত করে আলোর জয় বোঝাতে তুরস্কের বসন্তোৎসবে জ্বালানো হয় ‘বনফায়ার’; লোকে নতুন পোশাক পরে, নাচ-গানে মেতে ওঠে, শহর থেকে দূরে জঙ্গলে যায় নতুন মুকুলোদ্গম দেখতে, আর সৌভাগ্যের প্রতীক রূপে ভেঙে ফেলে চিনেমাটির তৈরি বাসন!
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তাইল্যান্ড বসন্তকে স্বাগত জানায় ‘সংক্রান’ উৎসবের মধ্যে দিয়ে। বাংলার ‘সংক্রান্তি’ এখানে ‘সংক্রান’। বেশ মজার এই উৎসব। আমরা যেমন দোলের দিন একে অন্যের গায়ে আবির ও রং মাখাই, সে দেশের মানুষ জলে নেমে পরস্পরকে জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, বিগত বছরের রাগ-অভিমান-হিংসা সব ধুয়ে ফেলে শুদ্ধ হয়ে ওঠা, নতুন করে সব শুরু করা। মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে আছে আরও আচার-নিয়ম।
মিশর ও ব্যাবিলনের পুরাণকথাতেও আছে বসন্তের আখ্যান। সমস্ত জীবকুলের মাতা দেবী ইশতার-এর প্রেমিক, ফসলের দেবতা তামুজ-এর মৃত্যু হয় প্রতি হেমন্তে। গোটা শীতকাল হিমেল হাওয়ার শনশন শব্দে কান পাতলে শোনা যায় তামুজের শোকে ইশতারের হাহাকার। বসন্তে তামুজ পুনর্জীবিত হয়ে ওঠেন, ইশতার সুখী হয়ে আবার পৃথিবীকে ভরিয়ে দেন ফসলে।
ভারতে দোল-উৎসবের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বৈষ্ণব মতে, এই দোলপূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও গোপিনীদের নিয়ে আবিরখেলায় মেতেছিলেন বৃন্দাবনে। ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে এর নাম ‘ফাগুয়া’ বা ফাগ-উৎসব, যা এসেছে ‘ফাল্গুন’ বা ‘ফাগুন’ থেকে। বসন্ত-বরণের সঙ্গেই মিশে গিয়েছে দোল উৎসব। ভারতীয় পুরাণে কামদেব বা মদন বসন্তেরও প্রতীক, তাঁর গায়ে বকুলের ঘ্রাণ, তূণীরে পঞ্চপুষ্পশর— অশোক, শ্বেতপদ্ম, নীলপদ্ম, মল্লিকা ও আমের মঞ্জরী। পুরাণকাহিনির রূপকের আড়ালে বসন্তের রূপ-গুণই দেবতার রূপে বিধৃত, বুঝতে অসুবিধা হয় না।
বাংলার পাড়ায় পাড়ায় দোলের আগের সন্ধ্যায় সমস্ত আবর্জনা জড়ো করে একটা মানুষের আকারে গড়ে পুড়িয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলা হয়—‘আজ আমাদের নেড়াপোড়া কাল আমাদের দোল/ পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল!’ ছেলেবেলায় দোলের দিন ভোরে ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরির গানে, ‘প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে, গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে!’ বুকের মধ্যে কেমন করে উঠত। রঙের উৎসবে, পূর্ণচন্দ্রের জোছনা-প্লাবনের মাঝেই আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের। বসন্ত কেবল ফসল আর রঙেরই উৎসব নয়। রিক্ততার বিদায়ে পূর্ণতার, ঘৃণার অবসানে প্রেমের, ক্ষুদ্র আমির অন্তে বিরাট আমির আবির্ভাবেরও উৎসব। তারই উদ্যাপনে সার্থক বসন্তের ফুল গাঁথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy