সঙ্ঘমাতা: শ্রীমা সারদা দেবী। তাঁর হাতের রান্নাও ছিল অতি উপাদেয়।
ভক্তদের কাছে শ্রীমা সারদা দেবীর জন্মতিথি একটি বিশেষ দিন। শ্রীমায়ের জীবদ্দশায় এই দিনটি খুব সাধারণ ভাবে পালন করা হয়েছে, কিন্তু মায়ের উপস্থিতিতে সেই সাধারণের মধ্যেও প্রকট হয়েছে অসাধারণত্ব।
জীবনযাপনের মতো তাঁর খাওয়া-দাওয়াও ছিল অতি সাধারণ। তিনি সকালের জলখাবারে মিছরির পানা খেতেন, সঙ্গে অল্প মুড়ি, কড়াইভাজা। বেশি বয়সে পেটের অসুখ ও বাতের জন্য সামান্য আফিম খেতে হত। তাই দুপুরে ও রাতে তাঁর জন্য আধসের করে দুধ রাখা হত। দুপুরে তিনি সেই দুধের অর্ধেক খেতেন এবং বাকিটা ভাতে মেখে ভক্তদের জন্য প্রসাদ হিসেবে রেখে দিতেন। এ ছাড়াও শ্রীমায়ের কাছে আরও এক অভিনব প্রসাদ পাওয়া যেত। শ্রীমা যখন দুপুরে খেতে বসতেন, তখন তিনি ভাতে একটু ডাল, একটু শুক্তো, সামান্য ঝোল, কখনও বড়ি কিংবা চচ্চড়ি অল্প অল্প করে মেখে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে নিতেন। সেই ঝালে-ঝোলে-অম্বলে প্রসাদ মায়ের ভক্তদের, বিশেষত স্বামী সারদানন্দের বিশেষ প্রিয় ছিল। সারদা দেবী সন্ধেবেলায় সামান্য মিষ্টি, জল খেয়ে একটা পান মুখে দিতেন। ভক্তদের বলতেন, “সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধের সময় হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে সামান্য জল খেলে শরীরটা বেশ স্নিগ্ধ হয়। তার পর জপ-তপ বা যে কোনও কাজে মনটি বেশ স্থির হয়ে বসে।” রাতে দু’-তিনখানা লুচি, সামান্য তরকারি এবং দেড় পোয়া দুধ খেতেন। যা-ই খেতেন, সবই আগে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিবেদন করতেন।
শ্রীমায়ের পিত্তের ধাত থাকায় শরীর জ্বালা করত, তাই পছন্দ করতেন স্নিগ্ধ খাদ্য। শ্রীমায়ের মন্ত্রশিষ্য স্বামী অরূপানন্দ জানিয়েছেন, ‘কলাইয়ের পাতলা ডাল ও পোস্তপোড়া তাঁহার খুব প্রিয় ছিল।’ শ্রীরামকৃষ্ণের আমলে দক্ষিণেশ্বরে ভোগ রান্না করতেন বাঁকুড়ার ঈশ্বর চট্টোপাধ্যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দিয়ে হিং দেওয়া কলাইয়ের ডাল, আরও নানা পদ রাঁধিয়ে শ্রীমাকে খাইয়েছিলেন।
ছোলাশাক, মুলোশাক, আমরুল শাক মায়ের প্রিয় ছিল। খেতেন গাঁদালের ঝোলও। ভালবাসতেন তেলেভাজা, ঝুরিভাজা। শীতের সময় সকালের নিত্যপুজোয় শ্রীমা ঠাকুরকে মুড়ি, ফুটকড়াইয়ের সঙ্গে বেগুনি, ফুলুরি, ঝালবড়া, আলুর চপ ভোগ হিসেবে নিবেদন করতেন। মিষ্টির মধ্যে পছন্দ করতেন মুগের নাড়ু, রাতাবি সন্দেশ আর রসে ডোবানো রাঙা আলুর পিঠে। ছোটবেলায় ছোলাপাটালি ভালবাসতেন।
তাঁর প্রিয় ফল ছিল পাকা পেঁপে। টক-মিষ্টি আম পছন্দ করতেন। পেয়ারাফুলি, ছোট ল্যাংড়া আম এবং মুম্বাইনিবাসী জনৈক ভক্তের পাঠানো আলফানসো আম তাঁর প্রিয় ছিল। এক বার এক ভক্ত অনেকগুলি আম মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। দেখা গেল, আমগুলো এত টক যে, মুখে দেওয়া যায় না। অথচ শ্রীমা সেই আম খেয়ে বেশ তৃপ্তির সুরে বলছেন, “না, এ বেশ টক-টক আম।”
শ্রীমা ভাল রাঁধতে জানতেন। তাঁর রান্নার বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি তরকারিতে নুন, ঝাল, মশলা একটু কম দিতেন। কালীবাড়ির মশলাদার ভোগ খেয়ে ঠাকুরের প্রায়ই আমাশয় হত। তাই দক্ষিণেশ্বরে শ্রীমা ঠাকুরের জন্য তেল-মশলা কম দিয়ে রান্না করতেন। শ্রীমায়ের হাতের শুক্তো, শিঙি মাছের ঝোল খেয়ে ঠাকুর বলতেন, “দেখো তো, তোমার রান্না খেয়ে আমার শরীর কেমন ভাল আছে।”
শ্রীমা জানতেন যে, নরেন্দ্রনাথের পছন্দ মোটা মোটা রুটি আর ঘন ছোলার ডাল। তাই নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে এসে রাত্রিবাস করলে শ্রীমা নরেন্দ্রের জন্য ছোলার ডাল চড়িয়ে ময়দা মাখতে বসে যেতেন।
শ্রীমা ভাল মাংস রাঁধতেন। প্রত্যক্ষদর্শী উপেন্দ্র রায় জানিয়েছেন, “নবমীর দিন পূজা করিয়া প্রসন্নমামা (শ্রীমায়ের জ্যেষ্ঠভ্রাতা প্রসন্নকুমার) একটি পাঁঠার মুড়া লইয়া আসিয়াছেন। মা স্বহস্তে রান্না করিলেন এবং খাইবার লোক অনেক থাকায় তাহাতে প্রচুর আলু ও জল দিলেন। কিন্তু সে মাংসের যে কী অপূর্ব স্বাদ হইয়াছিল, জীবনে এমনটি আর খাই নাই!” কেউ মাংস খেতে চাইলে, তিনি জয়রামবাটীতে থাকলে সিংহবাহিনীর উদ্দেশে নিবেদিত বলির মাংস এবং কলকাতায় থাকলে কালীঘাটের প্রসাদী মাংস আনিয়ে রান্না করতেন।
স্বামীজির শিষ্য স্বামী বিরজানন্দ জয়রামবাটীতে গিয়ে শ্রীমায়ের হাতের কলাইয়ের ডাল, পোস্ত চচ্চড়ি, মাছ চাটুই প্রভৃতি খেয়ে এত আনন্দ পেয়েছিলেন যে, বহুকাল পরেও তিনি মায়ের রান্নার প্রশংসা করে বলেছেন, “সে রান্না যে কী সুস্বাদু ছিল তা বলা যায় না। যেন স্বর্গীয় কিছু! এখনও যেন মুখে লেগে আছে!” জয়রামবাটীতে বেশি ভক্তের সমাগম হলে শ্রীমা বাড়ির রাঁধুনিকে সকলের পছন্দসই পদগুলি রাঁধতে বলতেন। নিজেও রান্না করতেন। সেখানে দুপুরের খাবারের তালিকায় থাকত ভাত, কলাইয়ের ডাল, পোস্ত, একটা ঝাল তরকারি, মাছের ঝোল, একটু টকের পদ; কখনও শাক, ডালনা, ভাজা। রাতে রুটি, তরকারি আর গুড়।
পরিবেশনের ব্যাপারে শ্রীমায়ের কিছু নিয়ম ছিল। যেমন, আসন, শালপাতা সব পরিষ্কার হওয়া চাই। শালপাতায় লেগে থাকা জল তিনি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে রাখতেন, যাতে রুটি পাতায় লেগে না যায়। খাবার বাড়ার পর কারও আসতে দেরি হলে তিনি আঁচল দিয়ে মাছি তাড়াতেন। ভক্তদের খাওয়ার সময় তিনি কাছে বসে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, “কেমন হয়েছে?” কার পাতে ভাত নেই, রুটি শেষ, তরকারি কম ইত্যাদি কোনও কিছুই নজর এড়াত না। যাঁর যেমন রুচি, তাঁকে সেই বুঝে খাওয়াতেন।
খাওয়ার পরে তিনি কাউকে উচ্ছিষ্ট তুলতে দিতেন না। কেউ খাওয়ার পরে এঁটো শালপাতা তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখলে শ্রীমা তাঁকে বাধা দিয়ে বলতেন, “থাক, লোক আছে।” দেখা যেত, সে লোক শ্রীমা স্বয়ং। তাঁকে সকল বর্ণের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে দেখে কেউ কেউ অনুযোগ করে বলতেন, “তুমি বামুনের মেয়ে— গুরু, ওরা তোমার শিষ্য; তুমি ওদের এঁটো নাও কেন?” শ্রীমা উত্তর দিতেন, “আমি যে মা গো, মায়ে ছেলের করবে না তো কে করবে?”
এক বার জয়রামবাটীতে শ্রীমায়ের ভাইঝি নলিনী এক মুসলমান মজুরকে খেতে দিচ্ছেন। পরিবেশনের সময় নলিনী উঠোন থেকে ছুড়ে ছুড়ে খাবার দিচ্ছেন দেখে শ্রীমা বলে উঠলেন, “ও কীরে! ওভাবে খেতে দেয় নাকি!” এই বলে শ্রীমা নলিনীর হাত থেকে থালা নিয়ে নিজেই পরিবেশন করলেন। শেষে যখন তিনি মজুরের উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে গেলেন, তখন নলিনী ভয়ে চিৎকার করলেন, “পিসিমা, তোমার জাত যাবে যে?” সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমা বললেন, “ছেলের এঁটো পরিষ্কার করলে জাত যায় নাকি!”
তথ্যসূত্র: শ্রীশ্রীসারদাদেবী:ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, শ্রীশ্রীমায়ের কথা (অখণ্ড), শ্রীমা সারদা দেবী— স্বামী গম্ভীরানন্দ, শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে (১-৪)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy