মানুষের প্রেমের ট্র্যাজেডি মৃত্যুতে নয়, বিরহে নয়, অবসাদে আর ক্ষুদ্রতার পরিচয়ে, আর উদাসীনতায়।’ লিখেছিলেন জগদীশ গুপ্ত। ১৯৪৪ সালে তিনি এলেন কলকাতায়, এখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করবেন। দীর্ঘ ছ’বছরের চেষ্টায় মাথা গোঁজার মতো একটি বাড়ি তৈরি করলেন যাদবপুর অঞ্চলের রামগড় কলোনিতে। মাটির তৈরি, বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট বাড়ি। ঘরে শুধু তক্তপোশ, আর কোনও আসবাব ছিল না। নির্জনতাপ্রিয় এক মানুষ। বেশি পাওয়ারের পুরু চশমার কাচের আড়ালে উজ্জ্বল চোখ, যদিও দৃষ্টিশক্তি তখন বেশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। লম্বা, রোগা, ছিপছিপে চেহারা, মাথার চুলে পাক ধরেছে, ঠোঁটের উপর কালো গোঁফজোড়া বেশ জমকালো। বাড়িতে লোকজন বেশি হলেই বেরিয়ে যেতেন, বা ঘরের এক কোণে বেহালা বা এস্রাজ বাজাতে বসতেন। বাঁশিও বাজাতেন প্রায়ই। ছবি অাঁকতেন। আর যখনই সময় পেতেন, লিখতেন।
‘কল্লোল যুগ’ বইতে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘জগদীশ গুপ্ত কোনোদিন কল্লোল–অফিসে আসেননি। মফস্বল শহরে থাকতেন, সেখানেই থেকেছেন স্বনিষ্ঠায়। লোক-কোলাহলের মধ্যে এসে সাফল্যের সার্টিফিকেট খোঁজেননি। সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে। প্রাণ দিয়ে সাহিত্যরচনা করেছেন। অনেকের কাছেই তিনি অদেখা, হয়তো বা অনুপস্থিত।’ আড্ডা বা সভাসমিতির প্রতি কোনও দিনই তাঁর আকর্ষণ ছিল না। কথায়, আচরণে পরিমিতিবোধ ও রুচিগত আভিজাত্যের ছাপ। পড়াশোনার ব্যাপ্তি ছিল বিস্ময়কর। শেক্সপিয়র, মলিয়ের থেকে মোপাসাঁ, ওয়াশিংটন আরভিং— বহু লেখকের উল্লেখ করেছেন। এক চিঠিতে রেমিজভের কিছু অনুবাদ পাঠানোর কথা বলেছেন। প্রতীকবাদী আলেক্সেই রেমিজভ ছিলেন রুশ গদ্যের নতুন ধারার পুরোধা, যার অন্যতম অনুরাগী ছিলেন জেমস জয়েস।
জগদীশ গুপ্তের জন্ম ১৮৮৬ সালে, তৎকালীন নদিয়া জেলার কুষ্টিয়ায়। কাছেই ছিল গড়াই নদী, তার জলে এক সময় রোজ স্নান করতেন। খুব ছোটবেলা থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস। ১৯০৬ সালে নদিয়া জেলার ওসমানপুরের চারুবালা সেনগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। চারুবালার স্মৃতি থেকে জানা যায়, ‘তিন-চার বছর পর্যন্ত তিনি পতিতাদের বাড়িতে খেলাধূলা করতেন। বাড়ির জানালা দিয়ে এই পতিতাপল্লী দেখা যেত।’ পেশা হিসাবে টাইপিংকেই বেছে নেন তিনি। কর্মসূত্রে ছিলেন সিউড়িতে, ওড়িশার সম্বলপুরে এবং পটনা হাইকোর্টে। পরের অধীনে চাকরি করতে গেলে বহু অন্যায় কাজও অনেক সময় মেনে নিতে হয়। জগদীশ গুপ্তের মতো প্রখর মর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। উপরওয়ালা ইংরেজের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয় একটি ইংরেজি শব্দ নিয়েই। সাধারণ এক টাইপিস্টের ‘ঔদ্ধত্য’ শ্বেতাঙ্গ কর্তার সহ্য হয়নি। জগদীশ যে শুধু পটনা হাইকোর্টের চাকরি ছাড়লেন তা-ই নয়, জীবনে আর কখনও চাকরি করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নিলেন। পটনায় বাড়ির কাছেই ছিল গঙ্গা, সেখানে নিয়মিত স্নান করতে যেতেন সেই সময়।
চাকরির বিকল্প হিসাবে তিনি বেছে নিলেন ব্যবসাকে। কুষ্টিয়াতে ফিরে প্রথমে একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন বলে ঠিক করলেন। সেই পত্রিকা প্রকাশিত হলেও তা থেকে আয় খুব বেশি হল না। এর পর যেটুকু পুঁজি অবশিষ্ট ছিল, তার সবটাই বিনিয়োগ করে শুরু করলেন ফাউন্টেন পেনের কালি তৈরির ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসা চালানোর জন্য যে বৈষয়িক বুদ্ধির দরকার হয়, তা তাঁর একেবারেই ছিল না। ১৯২৭ সালে এলেন বোলপুরে, অর্থের বিনিময়ে মক্কেলদের কোর্টের দরকারি কাগজপত্র টাইপ করে দিতেন। সেই সময় অনেকেই বলেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি তিনি। ১৯৩১ সালে ‘লঘু গুরু’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে এক কপি বই রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বইটির দীর্ঘ সমালোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ।
জগদীশ গুপ্তের অনেক রচনাই ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, গল্প তৈরি তাঁর উদ্দেশ্য নয়। লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি শুধুমাত্র নিজের বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় একশো পঁচিশ। মানুষের যেমন হওয়া উচিত, অথবা যেমন হলে তাকে আমাদের ভালো লাগে তা নয়, মানুষ প্রকৃতই যা, তার বিশ্বস্ত ছবি একেবারে নির্মোহ দৃষ্টিতে আঁকতে চেয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎচন্দ্রের মিলিত প্রয়াসে, মানুষের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে সাহিত্যরুচি গড়ে উঠেছিল, জগদীশ গুপ্ত তা থেকে সরে এলেন। ভাববাদী ধারার সত্য, মঙ্গল ও নৈতিকতার মতো বিষয়গুলো আসলে যে কতটা মিথ্যা আর বানানো, তা দেখালেন। প্রবেশ করলেন মানুষের অবচেতনায়, মনের গহনতম প্রদেশে; দেখালেন পাপবোধ ও কদর্যতা মেশানো তার প্রকৃত স্বরূপকে। আর এই সবই দেখালেন বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে। শার্ল বোদল্যের ফরাসি কাব্যে প্রথম যা করে দেখিয়েছিলেন, বাংলা গল্প-উপন্যাসে সেটাই করে দেখালেন জগদীশ গুপ্ত। জীবনের অশুভ দিকগুলোকে স্বীকৃতি দিলেন, দেখালেন বেআব্রু করে।
জীবনের সমস্ত মেকি আবরণ টেনে ছিঁড়ে আপসহীন ভাবে দেখিয়েছেন তার ভেতরের সত্যকে। সত্যের সাধনাতেই তিনি কাটিয়ে গেছেন গোটা জীবন। তাঁর লেখা তাই আমাদের স্বস্তি দেয় না। তিনি আমাদের আয়নার সামনে বসিয়ে দেন, আর নিজেদের দিকে তাকিয়ে, অবচেতনের স্বরলিপি পাঠ করে, জীবনের বিকৃতি ও অসঙ্গতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা শিউরে উঠি। আমাদের মুখোশ খসে পড়তে থাকে, মুছে যেতে থাকে সমস্ত প্রসাধন। লেখার জন্য জীবনে কখনও আপস করেননি তিনি। এক প্রকাশক তাঁর একটি উপন্যাসকে আরও খানিকটা বাড়াতে বলে একটা চিঠি লিখেছিলেন। অগ্রিম কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেই টাকা ফেরত পাঠিয়ে জানান, ‘যে উপন্যাস যেখানে যখন সমাপ্ত হওয়া প্রয়োজন এবং যে ঘটনা বিস্তারের যতটুকু ক্ষেত্র আছে, তার বেশি কোনো ফরমাসী লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
নিঃসন্তান জগদীশ গুপ্ত একটি মেয়েকে সন্তানস্নেহে পালন করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন সুকুমারী। নিয়মিত ও নিশ্চিত আয় না থাকায় শেষের দিনগুলিতে রীতিমতো অর্থাভাবে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। আর ছিল নানা রোগ–ব্যাধির নিয়ত উপদ্রব। যদিও এই মানুষটিই এক সময় নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন। সাঁতার ছিল তাঁর প্রিয় নেশা। স্ত্রী চারুবালা, পালিতা কন্যা সুকুমারীকে রেখে ১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথিকৃতের সম্মান যাঁর প্রাপ্য বলে মনে করেন অনেকে, তিনি মারা গেলেন অবহেলায়, কোনও স্বীকৃতি না পেয়ে, কঠোর দারিদ্রের মধ্যে। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মনে কোনও অনুযোগ ছিল না। এক চিঠিতে লিখেছেন এই কথাগুলো, ‘নরনারীর মনের গতির পরিচয় কিছু কিছু যদি এতদিন না দিয়া থাকি, তবে আমার লেখা বৃথা হইয়াছে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy