শোকাতুর: শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের তোলা আলোকচিত্র। সামনের সারিতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৬ অগস্ট ১৮৮৬
শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ-মিশনে কারও তিরোধান দিবস নিয়ে তেমন ব্যস্ততা নেই। বিশ্বসংসারের মৃত্যুহীন প্রাণেরা তো দেহাবসানের পরেই নতুন ভাবে বেঁচে ওঠেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রেও একই আইন, তবু কাশীপুর উদ্যানবাটীতে বহু যুগ আগে শ্রাবণের শেষ কয়েকটি দিনে ভক্তজনদের বিনিদ্র রজনীর বৃত্তান্ত জানবার জন্য নতুন যুগের মানুষদের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। ইদানীং সংবাদপত্রের ছোট্ট একটি খবরে সেই আগ্রহ আরও বেড়েছে। কলকাতা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তাঁদের শ্মশানঘাটের একটি ঐতিহাসিক রেজিস্টার থেকে রামকৃষ্ণ-দেহাবসানের নথিপত্রের ছবি বেলুড়ের সংগ্রহশালায় দান করতে চলেছেন।
১৯০২ সালে দেহাবসান হলেও স্বামী বিবেকানন্দের কোনও ডেথ সার্টিফিকেট নেই। এ বার অন্তত ঠাকুরের ইতিহাসটা আরও একটু জোরদার হল। যে দিনটি এত বছর পরে আবার মানুষের কৌতূহলে পূর্ণ হয়ে উঠতে চাইছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্তলোক-যাত্রার সেই তারিখটি কবে? ১৫ অগস্ট? না পরের দিন? পরবর্তী সময়ে দুটি কারণে ১৫ অগস্ট মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাতচল্লিশের মধ্যরাতে ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ এবং তারও বেশ কিছু দিন আগে আজকের থিয়েটার রোড বা শেক্সপিয়র সরণিতে শ্রীঅরবিন্দের আবির্ভাব দিবস (১৫ অগস্ট ১৮৭২)।
শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানও ১৫ অগস্ট মধ্যরাতে, এ কথা ইস্কুল থেকেই শুনতাম। যার থেকে ‘শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুরে’ এই কথাটা ভক্তদের মুখে মুখে ঘুরত। কিন্তু শ্মশানের খাতা তো ভুল করে না। সেখানে ৯৫০ নম্বর এন্ট্রিতে লেখা— ১৫ অগস্ট ১৮৮৬! এখন সবাই বোঝে, মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরোলেই তারিখ পাল্টে যায়। যদিও বাংলা হিসেবে সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত পুরনো তারিখটাই থেকে যায়। তাই জন্ম-মৃত্যুর হিসেবে প্রায়ই একটা দিনের পার্থক্য এসে যায়। এই গোলমাল কাশীপুরে সরকারি ভাবে সংরক্ষিত প্রয়াণ-নথিতে রয়ে গিয়েছে। সাবধানী লেখক স্বামী প্রভানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (প্রথম প্রকাশ আষাঢ় ১৩৯৪) সরকারি নথি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন:
রাম কিষ্টো প্রমোহংশ
৪৯ কাশিপুর রোড্, বয়স ৫২
মৃত্যু তারিখ- ১৫ আগস্ট ১৮৮৬
সেক্স-পুরুষ, গতি ব্রাহ্মণ
পেশা- ‘প্রিচার’
মৃত্যুর কারণ-গলায় আলসার
কে রিপোর্ট করেছেন-
জি সি ঘোষ, বন্ধু
সাম্প্রতিক সংবাদপত্রে সংক্ষেপিত ‘জি সি ঘোষ’ নামটি থাকায় বিভ্রান্তি কিছু বেড়েছে। অনেকে ধরে নিয়েছেন সংবাদদাতা ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’—যাঁকে সঙ্ঘের অনেকেই ‘জি সি’ বলে ডাকতেন।
এক সময় এই জি সি ঘোষের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। পূর্বনাম গোপালচন্দ্র ঘোষ (সুর), জন্ম ১৮২৮, যৌবনকালে চিনাবাজারে বিখ্যাত বেণীমাধব পালের দোকানে সামান্য চাকরি করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ১৮৭৫, বয়সে বড় বলে ঠাকুর এই ভক্তকে ‘বুড়োগোপাল’ বলে ডাকতেন। ইনিই নরেন্দ্রনাথ প্রমুখকে ১২খানি গেরুয়া ও রুদ্রাক্ষের মালা বিতরণ করেন— এর মধ্যে শেষ উপহারটি রাখা হয়েছিল গিরিশ ঘোষের জন্য। গোপাল পরবর্তী কালে বরাহনগরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, নাম হয় স্বামী অদ্বৈতানন্দ। মঠ মিশন ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম মিটিংয়ে তিনিই সভাপতিত্ব করেন (১৯০১) এবং পরবর্তী কালে দু’বার মঠের অস্থায়ী সভাপতি হন। বেলুড় মঠে তাঁর দেহাবসান ২৮ ডিসেম্বর ১৯০৯।
ঠাকুরের শেষ দিনগুলির কাশীপুর-বৃত্তান্ত দুই ভুবনবিদিত জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও স্বামী সারদানন্দ কেউই বিস্তারিত ভাবে লিখে যাননি। মহেন্দ্রনাথ শুধু লিখেছেন, ঠাকুর দশ মাস ধরে ভুগেছিলেন, গলায় ঘা হয়েছিল, ভক্তেরা সেবা করে পরিশ্রান্ত, ‘‘ডাক্তারের হাত ধরে কাঁদতেন, ভাল করে দাও বলে’’ এবং শেষকালে বলতেন, ‘‘মা আমার শরীর রাখবেন না।’’ কথামৃত-য় শেষ বিবরণ ২৪ এপ্রিল ১৮৮৬। লীলাপ্রসঙ্গ-রচয়িতা স্বামী সারদানন্দও কাশীপুরের শেষ অসুখের দিনগুলির বিবরণ লেখেননি। এ বিষয়ে স্বামী চেতনানন্দ খোঁজখবর করেও বিশেষ কোনও বিবরণ দেখেননি।
শ্রীম ও স্বামী সারদানন্দ যে ঠাকুরের দেহাবসানের পরে কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন, তার প্রমাণ বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স-এর ১৬ অগস্ট ১৮৮৬ তারিখের তোলা ছবিতে রয়েছে।
কথামৃত ও লীলাপ্রসঙ্গে অন্ত্যলীলা পর্বের খবর তেমন না থাকলেও প্রয়োজনীয় বিবরণের অভাব হয়নি। ছড়ানো-ছিটানো এই সব স্মৃতিকথা থেকে স্বামী প্রভানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ বইতে অনেক খবর পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। অন্য একটি বইয়ে বর্ণিত হয়েছে কথামৃত রচয়িতা শ্রীম-র জীবনের পরবর্তী কালের একটি ঘটনা। বহু বছর পরে (৩০ মার্চ ১৯২৪) তিনি একবার কাশীপুর উদ্যানবাটী দর্শনে গিয়েছিলেন। তখন এক আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ওই বাড়িতে বাস করতেন। ঘরের একটি অংশ দেখিয়ে শ্রীম বললেন, ‘‘এইখানে ঠাকুরের বিছানা
ছিল।...দক্ষিণ দেয়ালের দিকে ছিল ঠাকুরের শিয়র।’’
সে দিন ডা. বকশি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ঠাকুর কেন খাটে শুতেন না?’’ শ্রীম—‘‘মেঝেতে শোয়া সুবিধে ছিল। দুর্বল শরীর, মাদুরের ওপর শতরঞ্চি। তার ওপর বিছানা।’’
আমি নিজেও এক সময় এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, ‘শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুর উদ্যানে’। সেই প্রবন্ধে লিখেছিলাম, দক্ষিণেশ্বরে অনেক দিন শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। সুস্থ অবস্থায় তিনি আধসের থেকে দশ ছটাক চালের ভাত খেতেন। ব্যাধি বলতে আমাশয়। আর ছিল বায়ুবৃদ্ধি রোগ। কবিরাজদের পরামর্শ মতো ছিলিমের ভেতর ধানের চাল ও মৌরি দিয়ে তামাক খেতেন। তাঁর গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ অগস্ট ১৮৮৫। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’। প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে দেখেন ২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ এবং পরের মাসে (১২ অক্টোবর) নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁরই সিদ্ধান্ত, রোগটা ক্যানসার, কবিরাজি ভাষায় রোহিণী রোগ। বাড়িওয়ালার চাপে শ্যামপুকুর আশ্রম ছেড়ে ৯০ কাশীপুর রোডে মাসিক ৮০ টাকায়, ছ’মাসের জন্য চুক্তি। এখান থেকেই নরেন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের কাছে বিডন স্ট্রিটে পীরুর রেস্তোরাঁয় ফাউল কারির অর্ডার দিয়েছিলেন। সে রিপোর্ট ঠাকুরের কাছেও গিয়েছিল।
খরচাপাতির টানাটানি ও সেবকের সংখ্যা কমানোর বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনে বিরক্ত ঠাকুর প্রিয়জনদের বলেছিলেন, ‘‘তোরা আমাকে অন্যত্র নিয়ে চল... তোরা আমার জন্য ভিক্ষা করতে পারবি? তোরা আমাকে যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই যাব।’’
২৫ মার্চ ১৮৮৬ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে এম কোটস এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। শোনা যায়, ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায় ডাক্তার কোটসকে বত্রিশ টাকা দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ডা. কোটস ভিজ়িট নেননি।
বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন ৬ এপ্রিল ১৮৮৬। এঁকে ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় তাঁর পিলের চিকিৎসা হয়েছিল। কাশীপুরে মাঝে মাঝে রাঁধুনির অনুপস্থিতিতে রাঁধতেন ভক্ত তারক (পরবর্তী কালের স্বামী শিবানন্দ)। এক দিন খাবারের গন্ধ পেয়ে ঠাকুর বললেন, ‘‘আমার জন্য একটু চচ্চড়ি নিয়ে আয়।’’
‘শ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত’ বইতে ভক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, ‘‘আগস্ট মাসে ঠাকুর বললেন, ইচ্ছে হয় ইজের পরে ডিশবাটিতে খাই। সেই মতো ব্যবস্থা হওয়ায় প্রভু খুব আনন্দ করলেন।’’
এই সময়েই আসন্ন দেহত্যাগের আশঙ্কা বুঝতে পেরে ঠাকুর তাঁর সহধর্মিণীকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে। শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।... কারও কাছে একটি পয়সার জন্য চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাতকাপড়ের অভাব হবে না।’’
রবিবার ১৫ অগস্ট ১৮৮৬, কাশীপুরে শ্রাবণের শেষ দিনে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ‘বেশ ভাল’। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, ‘‘আজ ভাতের পায়স খাব’’ শুনে সকলে আশ্বস্ত। কিন্তু ওই দিনেই ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘‘ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।’’
শেষের সেই দিনে খিচুড়ি নিয়েও বিশেষ গোলযোগ। সেবকদের জন্য শ্রীমা যে খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নীচের অংশ ধরে গেল।
বিকেলের দিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় ভক্ত শশী (পরবর্তী কালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডা. নবীন পালকে ধরে নিয়ে এলেন। ঠাকুর বললেন, ‘‘আজ আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে।’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সারবে?’’ ডাক্তার নিরুত্তর।
এক সময় ঠাকুর ভক্তদের বললেন, ‘‘একেই নাভিশ্বাস বলে।’’ ভক্তরা বিশ্বাস করল না। তারা ভাতের মণ্ড নিয়ে এল।
তখন প্রায় রাত ন’টা। হঠাৎ ঠাকুরের সমাধি। নরেন সবাইকে ‘হরি ওঁ তৎসৎ’ কীর্তন করতে বললেন। সমাধি ভঙ্গ হল রাত প্রায় এগারোটায়। সেবক শশীর ইংরেজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, ‘পুরো এক গ্লাস পায়েস পান করেন।’ তার পর ঠাকুর নাকি বলেন, ‘আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নেই।’
স্বামী অভেদানন্দ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ঠাকুরের শেষ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ রেখে গিয়েছেন—‘‘একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাঁহার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হইতে থাকে। নরেন তাড়াতাড়ি তাঁহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। নাড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা সকলে ভাবিলাম, উহা সমাধি।’’
সেই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দেওয়া হল। রামলাল এসে বলল, ‘ব্রহ্মতালু গরম আছে, তোমরা একবার কাপ্তেন উপাধ্যায়কে খবর দাও।’ তিনি তাড়াতা়ড়ি এসে বললেন, মেরুদণ্ডে গব্যঘৃত মালিশ করলে চৈতন্যোদয় হবে। তিন ঘণ্টার বেশি মালিশ করেও কোনও ফল হল না।
১৬ অগস্ট সকালবেলায় ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের কাশীপুরে আবির্ভাব। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের রচনা অনুযায়ী, পরদিন প্রত্যুষে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সর্বপ্রথম উদ্যানে উপস্থিত হন। অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডা. সরকার ‘‘বেলা দশ ঘটিকায় এসে নাড়ি দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।’’ অনেক বিচার-বিবেচনার পর স্বামী প্রভানন্দের মতামত, ‘ডাক্তার সরকার কাশীপুর পৌঁছান বেলা একটায়।’
ডাক্তার সরকারের দিনলিপি, ‘‘খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eyes open, mouth partly open,...।’’
এর পরে লেখা, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল ছবি তোলার পরামর্শ দিলেন এবং নিজের চাঁদা হিসেবে দশ টাকা রেখে গেলেন।
বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের ছবি তোলা সম্বন্ধে অভেদানন্দের বর্ণনা: ‘রামবাবু নিজে খাটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে বলিলেন। আমরা সকলে নির্বাক হইয়া সিঁড়ির ওপরে দাঁড়াইলাম। বেঙ্গল ফটোগ্রাফার কোম্পানি দুইখানা গ্রুপ ফটো তুলিয়া লইলেন।’ কাশীপুর মহাশ্মশানের উদ্দেশে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেল ছ’টার পর।
১৬ অগস্ট ১৮৮৬ তারিখে তোলা বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের দুটি গ্রুপ ফটোগ্রাফের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। মঠ মিশনের কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক কারণেই এই ছবির প্রচারে কোনও দিন উৎসাহিত হননি। বৈকুণ্ঠনাথের মন্তব্য: ‘পরিতাপের বিষয়, অত্যধিক লম্বাবশত প্রাতঃকালের সে জ্যোতির্ময় ভাবটি তখন অস্তমিত হইয়াছিল।’
সহজলভ্য না হওয়ায় এক সময় গ্রুপ ছবিটি সাইক্লোস্টাইল অবস্থায় বিক্রি হত এবং এক সময়ে আমিও একটি কপি শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে সংগ্রহ করি। এক সময়ে চিরনিদ্রায় শায়িত রামকৃষ্ণের দেহ বাদ দিয়ে এই ছবি প্রচারিত হত। পরবর্তী সময়ে মার্কিন গবেষকরা এই ছবিটি নিয়ে নানা ভাবে গবেষণা করেছেন এবং সেইমতো বিস্তারিত ক্যাপশন লিখেছেন।
ঐতিহাসিক এই ছবিটির সব নায়ককে আজও শনাক্ত করা যায়নি। কারা সে দিন উপস্থিত ছিলেন আর কারা ছবিতে স্থান পাননি, তা বোঝা এত দিন পরে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় তৈরি বিবেকানন্দ অ্যালবামে তেত্রিশ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তা ছাড়াও আরও উনিশ জনকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। খুঁটিয়ে দেখলে কয়েকটি বালকের মুখও নজরে আসে। মার্কিন সম্পাদকরা ছবির বাঁ দিকে কিছু তোশক-বালিশের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের ধারণা, এগুলি ঠাকুরের ব্যবহৃত। যাঁদের শনাক্ত করা গিয়েছে, তাঁরা হলেন: (১) অতুলচন্দ্র ঘোষ, (২) অমৃত, (৩) বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল, (৪) ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, (৫) বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ), (৬) নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ), (৭) রামচন্দ্র দত্ত, (৮) গোপালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী অদ্বৈতানন্দ), (৯) শরৎ (স্বামী সারদানন্দ), (১০) বলরাম বসু, (১১) লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ), (১২) শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), (১৩) রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), (১৪) নিত্যগোপাল বসু, (১৫) যোগীন্দ্র (স্বামী যোগানন্দ), (১৬) দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, (১৭) তারক (স্বামী শিবানন্দ), (১৮) হুটকো গোপাল, (১৯) নিত্যনিরঞ্জন (স্বামী নিরঞ্জনানন্দ), (২০) নারায়ণ, (২১) মণিলাল মল্লিক, (২২) ফকির, (২৩) সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, (২৪) ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায়, (২৫) হরিশচন্দ্র মুস্তাফি, (২৬) গিরীন্দ্রনাথ মিত্র, (২৭) বিনোদবিহারী ঘোষ, (২৮) শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত), (২৯) কালী (স্বামী অভেদানন্দ), (৩০) নবগোপাল ঘোষ, (৩১) গঙ্গাধর (স্বামী অখণ্ডানন্দ), (৩২) মহিমাচরণ চক্রবর্তী, (৩৩) মনমোহন মিত্র।
বলা বাহুল্য, এই ছবিটি নিয়ে আরও খোঁজখবর করার প্রয়োজন এখনও রয়েছে। দুটি ছবিতে কিছু পার্থক্যও রয়েছে, সবাই এক জায়গায় নেই। বিবেকানন্দ-ভক্তরা লক্ষ করেছেন, একটি ছবিতে তিনি খালি গায়ে, আর একটিতে গায়ে ওড়না অথবা ধুতির খুঁট দেখা যাচ্ছে।
আরও নানা খবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ নাকি ঠাকুরের মহাসমাধির পরে একবার গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন—শোক সামলাতে পারছিলেন না। আরও অনেক কিছু ঘটেছিল সে দিন উদ্যানবাটীতে এবং মহাশ্মশানে। পরবর্তী কালে আরও স্পষ্ট, শিষ্যেরা দাহের পক্ষে ছিলেন না, তাঁরা চেয়েছিলেন সমাধি। বিবেকানন্দের এক চিঠি— ‘‘ভগবান রামকৃষ্ণের শরীরে নানা কারণে অগ্নি সমর্পণ করা হইয়াছিল। এই কার্য যে অতি গর্হিত তার আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে তাঁহার ভস্মাবশেষ অস্থি সঞ্চিত আছে। উহা গঙ্গাতীরে কোনও স্থানে সমাহিত করিয়া দিতে পারিলে উক্ত মহাপাপ হইতে কথঞ্চিৎ বোধ হয় মুক্ত হইব।’’
স্বামী অভেদানন্দ লিখছেন—‘‘নরেন্দ্রনাথ বলিল, ‘দ্যাখো, আমাদের শরীরই শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন্ত সমাধিস্থল। এসো, আমরা সকলে তাঁহার পবিত্র দেহের ভস্ম একটু করে খাই আর পবিত্র হই।’ নরেন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম কলসি হইতে সামান্য অস্থির গুঁড়া ও ভস্মগ্রহণ করিয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া
ভক্ষণ করিল।’’
১৬ অগস্টের বিকেলবেলার অনেক বিবরণ পরবর্তী কালে ধৈর্য সহকারে সংগৃহীত হয়েছে। সে দিন আকাশে ‘‘বর্ষা মেঘের হাল্কা আবরণ।... মহাসমাধিস্থ মহাপুরুষের শরীর বাহিরে আনয়নপূর্বক এক বিস্তীর্ণ শয্যায় শয়ন করাইয়া আর্দ্র বস্ত্রে অঙ্গ পরিষ্কার করিয়া দেওয়া হইল। অদ্য মনের সাধে জন্মের মত চন্দন পরা হইল।... প্রভু আমার যেন ফুলশয্যায় শয়ন করিয়াছেন।’’ আর এক জন রামকৃষ্ণ-অনুরাগী, ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিবরণ: ‘‘তাঁর মাথার নিচে একখানি আর পা-দুখানির মধ্যে আর একটা বালিশ... একখণ্ড মেঘ থেকে বড় বড় দানার বৃষ্টি ঝরে পড়ল। উপস্থিত সকলে বলতে থাকল এই হচ্ছে পুরাণকথিত স্বর্গ থেকে ঝরে পড়া পুষ্পবৃষ্টি। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলিকাতা হইতে একশত, দেড়শত লোক যাইয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন।’’
স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন, ‘‘এক ঘণ্টার মধ্যে চিতা স্বকার্য সাধন করিয়া লইল, যখন চিতানল পূর্ণপ্রভাবে জ্বলিতেছিল, সেই সময় ঠিক চিতার উপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হইয়াছিল।’’
ঠিক কখন মহাসমাধি লাভ হয়েছিল, তা নিয়ে সামান্য মতভেদের উল্লেখ করেছেন স্বামী প্রভানন্দ। ১৬ অগস্ট প্রাতঃ ১টা ২ মিনিট। অন্য মতে ১টা ৬ মিনিট। সরকারের কাছে রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়নি, বুড়োগোপাল এই রিপোর্ট দাখিল করেন তিন দিন পরে।
শ্মশানে আরও অনেক কিছু ঘটেছিল। বিশেষ ভক্ত ‘বসুমতী’ পত্রিকার সতীশ মুখোপাধ্যায়কে শ্মশানে সাপে কামড়েছিল। আরও শোনা যায়, কেউ কেউ শ্মশান থেকে অস্থি সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বুটে। সেগুলো নাকি এক সময় পুজো করা হত। নরেন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই হাবু দত্ত (অমৃতলাল) পরবর্তী কালে গলায় একটি হাড়ের মালা পরতেন, যা নাকি শ্রীরামকৃষ্ণের পূতাস্থিতে তৈরি। আরও নানা কাহিনি এত দিন পরেও লোকমুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কোনও ধৈর্যশীল গবেষক সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে এ কালের পাঠকদের উপহার দিলে মন্দ হয় না। সেই সঙ্গে আশঙ্কা হয়, ঠাকুরের কিছু অস্থি কোথাও কোথাও আজও লুকিয়ে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy